তুমিময় আমি,পর্ব:৬

0
595

” তুমিময় আমি। ”
“ মার্জিয়া খাঁন নিহা। ”
পর্ব : ৬।

বাড়ির সামনে গাড়ি থামিয়ে নোমান দ্রুত নেমে ভেতরে চলে গেল। জুমাও ধীর পায়ে গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়াল। সবকিছু কেমন ঝাপসা লাগছে তার। ভেতর গুলিয়ে আসছে। কোনোরকম ভারি শরীরটাকে টেনে নিয়ে ঘরে চলে গেল। নোমান ভেতরে ঢুকেই সোজা নিহানের ঘরে চলে গেল। নিহান তখন কাঁথা মুড়ে শুয়ে আছে। নোমান ভেতরে প্রবেশ করেই নিহানের পাশে বিছানায় বসল। কপালে হাত দিয়ে জ্বর চেক করে চিন্তিত সুরে বলল,

” বেশি খারাপ লাগছে বাচ্চাটা? ”

ছোট ভাইয়ার আওয়াজ পেয়েই নিহান উঠে বসল। ভাইয়ের কাঁধে মাথা রেখে বলল,

” আমি ঠিক আছি। ”

পরক্ষণেই সকালের সমস্ত ঘটনা খুলে বলল। সব শুনে নোমান রাগী কন্ঠে বলল,

” এটা যার কাজ, তাকে এর জন্য সাফার করতে হবে। ”

নিহান অসহায় দৃষ্টিতে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে। নোমান সে দৃষ্টিতে কী পড়ল কে জানে! বোনকে আগলে নিয়ে বলল,

” সব ঠিক হয়ে যাবে। ”

নিহানও ভাইয়ের ভরসায় মাথা এলিয়ে দিলো। কিছুক্ষণ পর নিহানকে আরাম করতে বলে নোমান বেরিয়ে এলো। জুমার সাথে কথা বলা প্রয়োজন। তখন একটু বেশি বাজে বিহেভ করে ফেলেছিলো। সে কী করত, ফোনে নোবাইদের ধমক, নিহান অসুস্থ শুনেই সে অস্থির হয়ে পড়েছিল। অথচ, জুমা উল্টো গো ধরে বসে রইল। তখন কার না রাগ হয়! নোমান দাদা-দাদির ঘরে দিকে পা বাড়াল। সেখানেই জুঁই,, জুমাকে থাকতে দেওয়া হয়েছে। ঘরে প্রবেশ করার আগেই দরজায় জুমার সাথে দেখা হলো। জুমা ক্রুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে। নোমান হালকা হেসে বলল,

” ভেতরে আসতে পারি? ”

জুমা দরজা ছেড়ে ভেতরে গিয়ে দাঁড়াল। নোমান ঘরে প্রবেশ করে কোনো ভনিতা ছাড়াই বলল,

” তখনকার জন্য সরি। আসলে মাথা ঠিক ছিলো না। ”

” ইট’স ওকে। ”

” অন্য কেউ হলে হয়তো এতোটা রিয়েক্ট করতাম না, কিন্তু জানের ব্যাপারে আমি একটু বেশিই সিরিয়াস। ”

” আমি জানি। আমারো তখন জেদ দেখানো উচিত হয়নি। ”

” তুমিতো জানতে না। যাইহোক, কিছু মনে কর না। আসছি। ”

” অনেক বেশি ভালোবাসেন না জান আপ্পিকে? ”

” আমার সাধ্য থাকলে একটা পিঁপড়েকেও আমি আমার বাচ্চাটাকে ছুঁতে না দেই। ”

” এতোটা ভালোবাসাও ঠিক না। তাছাড়া আপনার জীবনেও অন্যকেউ আসবে। সে কি এটা মেনে নেবে? ”

” যার আমার জীবনে আসা আমার বোন আর আমার মাঝে দূরত্ব সৃষ্টি করবে, তাকে কখনোই আমি আমার জীবনে আসতেই দেবো না। ”

জুমা কোনো জবাব দিলো না। নোমান ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল।

—————————

এক শব্দ তিনবার উচ্চারণেই সবকিছু কেমন পাল্টে গেল। একটা কবুল শব্দই ঘুরিয়ে দিল জীবনের মোড়। পরিচিত মানুষগুলোর সাথে মুহুর্তেই পাল্টে গেল সম্পর্কের নাম। হৃদয় হাত মুঠ করে শক্ত মুখে বসে আছে৷ মায়ের অনুরোধে একটু আগেই জীবনের সবচেয়ে অপছন্দের কাজটা সে করেছে। নিহানকে বিয়ে। প্রচন্ড রাগ হচ্ছে। রাগে তার সবকিছু দুমড়ে মুচড়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে। সেই রাগেরই ঝড় বয়ে গেছে একটু আগে। সারা ঘর এলোমেলো। ফ্লোরে গড়াগড়ি খাচ্ছে আধ ভাঙা কাচের ফুলদানি। একটু দূরেই জান শক্ত মুখে বসে আছে। হাত চুয়িয়ে রক্ত পড়ছে। কপালে রক্ত জমাট বেঁধে আছে। হঠাৎ করেই হৃদয় চেঁচিয়ে উঠল,

” সব তোমার পরিকল্পনা তাইনা? এতোটা নিচে কীভাবে নামতে পারলে? দিলেতো আমার জীবনটাকে জাহান্নাম বানিয়ে? ইচ্ছেতো করছে খুন করে ফেলি। ”

জান নিঃশব্দে ফুফিয়ে যাচ্ছে। হৃদয় নিজের মাথা চেপে পুনরায় বসে পড়ল। কিছুক্ষণ পর উঠে নিজের কাপড় গুছিয়ে বেরিয়ে গেল। জান একবারো চোখ তুলে সেদিকে তাকায়নি।

সপ্তাহ কেটে গেছে। চট্টগ্রামে ফিরে হৃদয় নিজেকে স্বাভাবিক করে নিয়েছে। এর মাঝে জান বা হৃদয় কেউ কারো সাথে যোগাযোগ করেনি৷ আজ সম্পূর্ণ এক সপ্তাহ পর ঘরে ফিরেছে হৃদয়। সেদিন নানু বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলেও সে বাসায় আসেনি। বাবা- মায়ের উপরেও অনেকটা রাগ জমেছিল।
কলিং বেল চাপতেই দরজা খুলে দিলো জান। গত সাত দিনের ঠান্ডা হওয়া রাগটা মুহুর্তে জ্বলে উঠল। জানের দিকে ক্রুর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে দ্রুত পায়ে ভেতরে চলে গেল।

ফ্রেশ হয়েই হৃদয় নিচে খাবার টেবিলে এলো। জান আগে থেকেই টেবিলে বসা। নূরজাহান আহমেদ তাকে খায়িয়ে দিচ্ছে। হৃদয় নিজের খাবারে মনোযোগী হলো। খাওয়া শেষ করে সে সরাসরি বলল,

” ও এখানে কী করছে? ”

নূরজাহান আহমেদ চমকে উঠলেন। পরক্ষণেই ছেলের রাগের কথা মাথায় রেখে শান্ত স্বরে বললেন,

” জুঁইয়ের বিয়েতে এসেছে। ”

” আপুর বিয়ের আরো সপ্তাহ খানেক বাকি। এত আগে আসার কী ছিলো? ”

হৃদয় আর কারো জবাবের অপেক্ষা করল না। দ্রুত পায়ে নিজের ঘরে চলে গেল।

জানের নিজেকে বড্ড ছোট মনে হচ্ছে। হৃদয়ের প্রতিটা কথাই বুঝিয়ে দিয়েছে হৃদয়ের কাছে জানের অবস্থানটা কোথায়! জান ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে গা এলিয়ে দিলো। হৃদয়ের পাশের ঘরটাতেই আপাতত সে থাকছে। সেদিন হৃদয়ের ঐভাবে বেরিয়ে যাওয়ার পর ফুফি পরিস্থিতি সামলাতেই তাকে সাথে নিয়ে এসেছিলো। জানও সবটা ভেবে আর অমত করেনি। জানের ক্ষত দেখে বার বার সবাই প্রশ্ন করলেও সযত্নে এড়িয়ে গেছে। হঠাৎ করে সবকিছু কেমন যেন হয়ে গেল। জানের এখানে খারাপ কাটেনি। সবার সাথে তার আলাদা সখ্যতা। আর জুমা তো জানকে পেলে আর ছাড়তেই চায় না।
ঐ দিন আর জান রুম থেকে বের হয়নি,খাবার খেতেও যায়নি। ফুফি বারবার এসে ডেকে গেলেও জান ভালো লাগছে না বলে কাটিয়ে দেয়। পরক্ষণেই নিজেকে খুব একা লাগতে শুরু করল। নিজের বাড়ি হলে, জানকে কখনোই কেউ না খেয়ে ঘুমোতে দিতো না। চোখের কোণা ভরে এলো। এসব চিন্তা- ভাবনার মাঝেই জান ঘুমিয়ে পড়ল।

সকালে জান ফ্রেশ হয়ে নিচে নামলো। নূরজাহান আহমেদ তখন রান্না ঘরে। বাড়ির সব কাজ কাজের লোক করলেও রান্না তাকেই করতে হয়।নাহয় তার স্বামি,সন্তান কেউই মুখে খাবার তোলেন না।

” রান্না করছো ফুফি? আমি সাহায্য করি? ”

” না, তোর সাহায্য করতে হবে না। ”

” করি না প্লিজ! ”

” আচ্ছা, তাহলে এই কফিটা হৃদয়কে দিয়ে আয়। ”

” আচ্ছা। ”

জান চরম অস্বস্তি নিয়ে হৃদয়ের ঘরের দিকে পা বাড়াল। এখন ফুফির মুখের উপর তো আর না করতে পারবে না। কিন্তু হৃদয়ের সামনে পড়ারও তার ইচ্ছে নেই। ঘরে প্রবেশ করেই দেখল হৃদয় ঘুমোচ্ছে। প্রচন্ড আদুরে লাগছে দেখতে। জান হালকা হেসে বিছানার দিকে এগিয়ে গেল। বিছানার পাশের টেবিলে কফি রাখার জন্য ঝুকতেই হৃদয় চোখ খুলে তাকাল।

চকিতে এতকিছু হয়ে যাবে জান ভাবতে পারেনি। হাত তার জ্বলে যাচ্ছে। পায়ের গোঁড়ালিতে চিনচিনে ব্যথা।
হৃদয় চোখ খুলে তাকে দেখতেই আচমকা ধাক্কা দিয়ে বসল। আর জান টাল সামলাতে না পেরেই নিচে পড়ে গেল, গরম কফি তার হাতে৷ হৃদয় স্থির হয়ে বসেই তিক্ত গলায় বলল,

” আমার ঘরে কী করছো তুমি? যখন তখন ছেলেদের ঘরে ঢুকে যাওয়ার বদঅভ্যাস আছে নাকি তোমার? ”

” কফি দিতে এসেছিলাম। ”
হালকা স্বরে জানের জবাব।

” তোমার কাছে কফি চেয়েছি আমি? নাকি ভাবছো এসব করে আমায় মন জয় করে নেবে? একটা কথা ভালোভাবে মাথায় ঢুকিয়ে নাও, তোমার মত মেয়ের দিকে হৃদয় চোখ তুলেও তাকায় না। ”

জান চোখ বন্ধ করে বসে রইল। পরক্ষণেই উঠে নিজের ঘরে চলে গেল। হৃদয় বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলে নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করছে। তখন ঐভাবে জানকে দেখে সে রীতিমত ভয় পেয়ে গিয়েছিল। মাথার ভেতর সব ফাঁকা ফাঁকা লাগছিল। বিছানা ছেড়ে চুপচাপ ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়াল।
জান ওয়াশরুমে হাত ভিজিয়ে বসে। মনে হচ্ছে কেউ চামড় তুলে নিচ্ছে। ভেতর ভেঙে কান্না দলা পাকিয়ে আসছে। একটু পর পরই চোখের কোণা ভরে উঠছে ব্যথায়। এমন সময় দরজায় নকের শব্দ।

” আপ্পি তুমিকি ভেতরে? ”
জুমার উদ্বিগ্ন কন্ঠ।

জান চোখ মুখে পানি ছিটিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করছে। নতুন করে কোনো নাটকীয়তা সে চায় না।

” আপ্পি! ”

” হুম,বলো। ”
জানের আড়ষ্ট গলা।

” আম্মু তোমায় খেতে ডাকছে। ”

” যাও, আসছি। ”

জুমা চলে গেল। জান চোখ মুখ মুছে স্বাভাবিকভাবে নিচের দিকে গেল। হাঁটতে সামান্য কষ্ট হলেও সে সামলে নিচ্ছে। হাতটা এখনো জ্বলছে। জান নিচে গিয়েই টেবিলে বসলো। হৃদয় তখন অপজিটে বসে নাস্তা করছিলো। ফুফি নুডলস এগিয়ে দিলো জানের দিকে।
জান ভাবছে কি করবে। হাতে খাওয়া সম্ভব না।হাতটা টেবিলের নিচে লুকিয়ে বসেছে যাতে কেউ না দেখে। আর তাছাড়া বাসায় থাকলে কখনো ও নিজের হাতে খায় না।

” কী হলো খাচ্ছিস না কেন? ”

” ফুফি, প্লিজ খায়িয়ে দেও না। ”

” আচ্ছা, দিচ্ছি। ”
নূরজাহান আহমেদ হালকা হেসে জানকে খায়িয়ে দিতে লাগলেন। হৃদয়ের চোখে মুখে বিরক্তির ছাপ। জান একবার সেদিকে তাকিয়ে নিজের খাওয়ায় মন দিলো। নাস্তা শেষে বাশার আহমেদ অফিসে চলে গেলেন। জুঁই ভার্সিটি, জুমা স্কুলে। জান নিজের ঘরে গিয়ে দরজা আটকে বসে আছে। ভালো লাগছে না কিছু। চলে যেতে পারলো হয়তো ভালো হতো। কিন্তু এ মুহুর্তে তা সম্ভব নয়। হৃদয়ও নিজের ঘরে বসে। নূরজাহান আহমেদ একটু আরাম করেই আবার দুপুরের রান্নায় ব্যস্ত।
সকাল গড়িয়ে দুপুর এলো। দুপুরে খাবার টেবিলে কেবল জান, হৃদয় আর ফুফি। তখনও নূরজাহান আহমেদ জানকে খায়িয়ে দিয়েছে। হৃদয় ভ্রু কুচকে বসে। হালকা শব্দ বলে উঠল,
” কত ন্যাকামু! ”
জান একপলক তাকিয়ে নজর ফিরিয়ে নিলো। হৃদয়ও আর কথা বাড়াল না।

চলবে,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here