” তুমিময় আমি। ”
“ মার্জিয়া খাঁন নিহা। ”
পর্ব : ৫।
সময়টা সকালের হলেও ভ্যাপসা গরম। ক্লান্ত দুপুরের মতোই মনে হচ্ছে স্নিগ্ধ সকালটাকে।
হৃদয় বসার ঘরের সোফায় বসে ফোন চাপছে। নিলুফা বেগম টেবিলে নাস্তা সাজাচ্ছেন। রান্না ঘরে তার ননদ আর জা। মামারা ইতিমধ্যে বেরিয়ে গেছেন। নোমানও জুমাকে নিয়ে বেরিয়েছে। বাকিরা এখনো নিচে নামেনি।
হঠাৎ করেই উপর থেকে চিৎকারের আওয়াজ ভেসে এলো৷ নিলুফার বেগমের মনটা ধক করে উঠল। তার বুঝতে অসুবিধা হলো না এটা নিহান।তিনি খাবার ফেলে উপরে ছুটলেন। তার পেছন পেছন বাকিরা। হৃদয় একটু বাঁকা হেসে নিজেও উপরের দিকে পা বাড়াল। সবাই নিহানের ঘরে প্রবেশ করে দেখল ঘর সম্পূর্ণ খালি। নোবাইদ ততক্ষণে বাথরুমের দরজায় নক করছে।
সেখান থেকেই চেঁচামেচি শোনা যাচ্ছে। অস্থির কন্ঠে নোবাইদ বলল,
” বাবু তুই ভিতরে? ”
নিহানের চিৎকার ছাড়া অন্য কোনো শব্দ পাওয়া গেলো না।
” কী হয়েছে বাবু, দরজা খোল, প্লিজ দরজা খোল। ”
জান চেচিয়ে যাচ্ছে। ‘ ভাইয়া প্লিজ আমায় বাঁচাও। ‘ নোবাইদ অস্থির হাতে দরজার লক ঘুরাতেই দরজা খুলে গেল। ভেতরে প্রবেশ করেই নিহানকে ফ্লোরে আবিষ্ককার করল। কানে হাত দিয়ে, চোখ মুখে খিচে বন্ধ করে বসে আছে।নোবাইদ দ্রুত লাইট অন করল। নিহানের সামনে হাঁটু মুড়ে বসে তাকে জড়িয়ে ধরল। ভাইয়ের আবাশ পেয়েই নিহান ভাইয়ের বুকে সিটিয়ে গেল। ভয়ে রীতিমতো কাঁপছে সে। নোবাইদ পাশেই প্লাস্টিকের সাপ পড়ে থাকতে দেখল। বুঝতে অসুবিধা হলো না এটাই নিহানের ভয়ের কারণ। ছোটবেলা থেকেই সাপে প্রচন্ড ভয় তার। শত চেষ্টা করেও নোবাইদ সে ভয় কাটাতে পারেনি। নোবাইদ জানকে তুলে দাঁড় করাল। জানের মুখের দিকে তাকিয়ে রিমান্তি হেসে উঠল। সাথে রাইসাও। হৃদয় মুখ চেপে হাসছে। রাইসা উৎফুল্ল গলায় বলল,
” আপু তুমি মুখে ক্রিম না মেখে কালি মেখেছো কেন? তোমার কি কালো হওয়া শখ হয়েছে নাকি? ”
রাইসার সাথে হৃদয়ও যোগ দিলো।
” পেত্নীকে আসল রূপে কেমন লাগে সেটাই দেখছিলো বোধহয়। এমন মোমেন্টের একটা পিকচার তো হতেই পারে। ”
” স্টপ! এই অসভ্য মজাটা কে করেছে আমি জানতে চাই। ”
নোবাইদ চেঁচিয়ে উঠল। মুহুর্তেই পরিস্থিতি শান্ত হয়ে এলো। নোবাইদ শান্ত গভীর দৃষ্টিতে রাইসার দিকে তাকিয়ে। রাইসা তা বুঝতে পেরেই দ্রুত মাথা দুলালো।
” ভাইয়া, আই সয়ার। আমি করিনি। ”
নোবাইদ গভীর গলায় বলল,
” বাইরে থেকে কেউ এসে নিশ্চয়ই এ কাজ করেনি। নিজে থেকে স্বীকার করবে নাকি আমি বের করব? ”
” আহ! নোবাইদ থাম এখন। আগে নিহানকে ফ্রেশ করা। ”
চিন্তিত গলায় নিলুফা বেগম তাড়া দিলেন।
” তোমরা যাও, আমি ওকে নিয়ে আসছি। ”
একে একে সবাই বাইরে চলে গেল। নোবাইদ জানকে ফ্রেশ হতে বলে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে রইল। রিমান্তি একটু সামনে এগোতেই চুলে টান অনুভব করল। রিমান্তি জানে কাজটা কার। না ফিরেই বলল,
” ছাড়ো, লাগছে আমার। ”
হৃদয় আঙুলে চুল পেচিয়ে রিমান্তির সামনে এসে দাঁড়াল। হালকা আওয়াজে বলল,
” এই যে হাসি হাসি মুখ করে আছিস, এরূপেই শ্যামবতীকে মানায়। বিষণ্ণ, বিরস মুখে নয়। ”
রিমান্তি জবাব দিলো না। হৃদয়ের হাত থেকে চুল ছাড়িয়ে নিলো। কয়েক পা এগিয়ে রাগি স্বরে বলল,
” এভাবে যখন তখন চুল টেনে ধরবে না। আমার চুল কারো টানাটানি করার জিনিস নয়। ”
রিমান্তি নিজের গন্তব্য পা বাড়াল। হৃদয় হালকা হেসে নিচে চলে গেল।
নোমান দাঁড়িয়ে আছে ধর্মসাগর পাড়ে। একটু দূরেই জুমা ফুচকা খাচ্ছে। ভোরবেলা এক প্রকার জোর করে তাকে ঘুম থেকে তুলে এনেছে। নাস্তাও করতে দেয়নি তাকে। কী এক কাটা গলায় আটকে গেছে। না পারছে ফেলতে না গিলতে। জুমা ডাকছে তাকে। কিন্তু তার একটুও ইচ্ছে নেই এই মেয়েটার আশেপাশে থাকার। চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। এবার জুমা কোমড়ে হাত দিয়ে নাক ফুলিয়েছে। চেঁচিয়ে ডাকছে তাকে। আশেপাশের অনেকেই তাকিয়ে। বিরক্তিতে তেঁতো মুখ নিয়েই নোমান বাধ্য হয়ে এগিয়ে গেল। চাপা রাগী স্বরে বলল,
” কী সমস্যা? পাবলিক প্লেসে সিনক্রিয়েট করছো কেন? ”
” সিন আমি ক্রিয়েট করছি না আপনি করছেন? তখন থেকে ডাকছি আর আপনি ভাব নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। ”
” তুমি ডাকলেই আমায় আসতে হবে? ”
” হ্যাঁ, আপনি বাধ্য। ”
” ননসেন্স! ”
জুমা দাঁত কেলিয়ে হেসে বলল,
” তাও আপনার চেয়ে ভালো। এখন ফুচকার বিল দেন। ”
” আমি বিল দেব কেন? আমিতো খাইনি। ”
” তো কী হয়েছে? আমিতো খেয়েছি। ”
” তো তোমার বিল তুমি দেবে, আমি কেন দেব? ”
” ঐ যে বললাম বাধ্য। ”
হঠাৎ করেই নোবাইদের ফোন বেজে উঠল। ফোন কানে তুলেই সে অস্থির হাতে ফুচকাওয়ালা টাকা দিয়ে জুমাকে টেনে নিয়ে এলো। জুমা চেঁচামেচি করছে।
” আরে কী করছেন? আমার ঘুরাঘুরি শেষ হয়নি। এখনো আপনার পকেট খরচ করা বাকি। ছাড়ুন। ”
” একদম চুপ। আরেকটা কথা বললে৷ হাত পা বেঁধে এই জলাধারেই ফেলে দেব। ছ্যাচরামির একটা লিমিট থাকা উচিত। চুপচাপ গাড়িতে গিয়ে বস। ”
জুমা চুপসে গেল। হাত ছাড়িয়ে চুপচাপ গাড়িতে গিয়ে বসল৷ নোবাইদও দ্রুত গাড়িয়ে চড়ে গাড়ি স্টার্ট করল।
কিছুক্ষণের মধ্যেই নোবাইদ নিহানকে নিয়ে নিচে খাবার টেবিলে বসল। হৃদয় বসে আছে টেবিলের অপজিটে। নোবাইদ খায়িয়ে দিচ্ছে নিহানকে।
” ভাইয়া, কী করছিস মেরে ফেলবি নাকি? এতো খাওয়া যায়? ”
” না খেতে খেতে একদম শুকিয়ে গেছিস। হোস্টেলে তো ঠিকমতো খাওয়া দাওয়া করিস না। আবার রান্নারও সমস্যা। ”
চিন্তিত গলায় নিলুফা বেগমের জবাব।
” আমি হাতি হয়ে গেলেও তোমার চোখে মশা ই থাকবো। কোনো মাকে বলতে শুনেছো আমার সন্তান ঠিকঠাক খায়? তোমরা মায়েরা এমনি, সন্তানের বেলা অতিরিক্ত, নিজের বেলায় কৃপণ। হোক শাসন কিংবা আদর। এই যে তুমি সকাল থেকে এখনো না খেয়ে আছো। কই আমিতো কিছু বলছি না। ভাইয়া বল, আমি কিছু বলেছি? ”
নোবাইদ নিঃশব্দে হাসছে। নিলুফা বেগম মুখ ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। পাশ থেকেই নূরজাহান আহমেদ হেসে বললেন,
” ভাবি তুমি বরং খেতে বসে পড়। এসব আদুরে শাসন তোমার দ্বারা হবে না। তার আগেই তোমার মেয়ে তোমার শাসন করে দেবে। ”
নিলুফা বেগম হালকা হেসে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে মেয়ের পাশের চেয়ারে বসে পড়লেন। কিছুক্ষণের মাঝে খাওয়া দাওয়া শেষ করে সকলেই নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। হৃদয় খাওয়ার মাঝে দু এক বার নিহানের দিকে তাকাল কিন্তু নিহান নিজের মতোই ব্যস্ত। খাওয়া দাওয়া শেষ করে নিহান উপরে চলে গেল। হৃদয়ের ব্যাপারটা কেন যেন হজম হচ্ছে না। নিহান এতো শান্ত মেয়ে না। সামান্য তেলাপোকার ভয়ে যে চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় করে, সেখানে সকালের ঐ ঘটনার পর তো তৃতীয় বিশ্ব যুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়ার কথা। অথচ, সে একদম চুপ। হৃদয় কিছুক্ষণ নিজের ঘরে পায়চারি করে মুখে হাসি ফুটিয়ে নিহানের ঘরের দিকে গেল।
নিহান নিজের ঘরে আধশোয়া হয়ে বসে ফোন চাপছে। হৃদয় সোজা নিহানের ঘরে ঢুকে গেল। আলমারি, ওয়ারড্রবের সাথে রাখা টেডি উল্টে পাল্টে দেখছে। জিনিসপত্র এলোমেলো করছে। কিন্তু নিহানের কোনো ভাবান্তর হলো না।
” কাউকে মনে হয় জ্বীনে ধরছে? ”
কথাটা বলেই হৃদয় নিহানের দিকে তাকাল। কিন্তু আগের মতোই নির্বাক। হৃদয় ভ্রু কুচকে পুনরায় বলল,
” বোবা জ্বীন হয়তো। ”
নিহান আগের মতোই ফোনে ব্যস্ত। তার ঘরে যে একজন মানুষ আছে তাতে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। হৃদয়ের বিরক্তিতে ভ্রু কুচকে এলো। কাউকে বিরক্ত করতে এসে সে বিরক্ত না হলে, নিজেরই বেশি বিরক্ত লাগে। হৃদয় চলে যাওয়ার জন্য উদ্ধৃত হলো। তখনি পেছন থেকে রিনরিনে গলা ভেসে এলো,
” কারো দুর্বলতায় আঘাত করা কাপুরুষের কাজ। আর অনুমতি ব্যবহৃত ঘরে প্রবেশ করা, ব্যক্তিগত জিনিসে হাত দেওয়াকে অসভ্যতা বলে। ”
হৃদয় সরোষ দৃষ্টিতে নিহানের দিকে তাকিয়ে। নিহানের দৃষ্টি তখনো ফোনের স্কিনে। যেন সে কিছু বলেইনি। হৃদয় কিছু বলতে গিয়েও বলল না। গা ভর্তি রাগ নিয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলো।
জুঁই ঘরের দরজা হালকা খুলতেই দরজার সামনে নোবাইদকে দেখতে পেল। পুনরায় দরজা বন্ধ করতে উদ্ধৃত হলো। কিন্তু তার আগেই ভেসে এলো নোবাইদের শান্ত, শীতল কন্ঠ।
” আমায় ভয় পাচ্ছো? ”
জুঁই দরজা ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল। গলা পরিষ্কার করে তীক্ষ্ণ কন্ঠে বলল,
” আপনাকে ভয় পাব কেন? ”
” তাহলে আমার থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছ কেন? ”
জুঁই আমতা আমতা করে৷ বলল,
” পালিয়ে বেড়াব কেন? ”
” কারণটা তুমি ভালো জানো। ”
জুঁই কিছু না বলে ঘর ছেড়ে সামনে এগিয়ে গেল। পেছন থেকে ভেসে এলো নোবাইদের গভীর স্বর।
” বিয়ে করছো শুনলাম। ”
জুঁই চকিতে ফিরে তাকাল। মামা বাড়িতেতো সে এখনো জানায়নি।৷ তাহলে নোবাইদ জানল, কেমন করে!
” আমি কীভাবে জানলাম তা ভেবে মাথা নষ্ট করার প্রয়োজন নেই। ভালোবাসা থাকলে, তথ্য জিনিসটা আবশ্যকীয় হয়ে দাঁড়ায়। ”
জুঁই চুপ করে রইল। এই অস্তিত্বে পড়তে চায় না বলেই সে নোবাইদকে এড়িয়ে চলছিলো। নোবাইদ নিচে তো সে উপরে। কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না। নিরবতা কাটিয়ে নোবাইদ পুনরায় বলে উঠল,
” তুমি এই বিয়েতে খুশি? ”
” প্রচন্ড। ভালোবাসার মানুষকে নিজের করে পাওয়ার খুশি ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়।
জুঁইয়ের উৎফুল্ল কন্ঠ। নোবাইদ ভারি আওয়াজে বলল,
” আমার ভালোবাসায় কোথায় খাদ ছিলো জুঁই? আমি কেন তোমার ভালোবাসার মানুষ হলাম না? ”
জুঁই অস্থির নয়নে অন্যদিকে তাকিয়ে রইল। তার সাধ্যে থাকলে এই মানুষটাকে সে কখনো কষ্ট পেতে দিতো না। কিন্তু সবকিছু আমাদের হাতে থাকে না। জুঁই নিজেকে কিছুটা শান্ত করে বলল,
” হয়তো তোমার ভালোবাসা আমার ভাগ্যে নেই তাই। আমি কাউকে পছন্দ করিনি, ভালোবেসেছি। তাকে ছাড়া আমি নিঃস্ব। তাকে কীভাবে ছাড়ব আমি? ”
নোবাইদ সন্তপর্ণে দীর্ঘশ্বাস টেনে নিলো। আড়ষ্ট গলায় বলল,
” ভালো থেকো। ”
দ্রুত পা বাড়িয়ে সামনে এগিয়ে গেল সে। কিন্তু জুঁইয়ের গলা শুনে পুনরায় দাঁড়িয়ে পড়ল।
” আমি ইচ্ছে করে তোমায় কষ্ট দিতে চাইনি। ”
নোবাইদ ফিরে তাকাল। গম্ভীর স্বরে বলল,
” আমি জানি। পৃথিবীতে সবাই কখনো একসাথে খুশি হয় না। দু’পক্ষে সানাই বাজে তো তৃতীয় পক্ষে বিষাদের সুর। ”
নোবাইদ আর দাঁড়াল না। দ্রুত পায়ে স্থান ত্যাগ করল। পেছন থেকে জুঁইয়ের বুক চিড়ে বেরিয়ে এলো দীর্ঘশ্বাস।
চলবে,