তুমিময় আমি,পর্ব:৪

0
666

” তুমিময় আমি। ”
“ মার্জিয়া খাঁন৷ নিহা। ”
পর্ব : ৪।

সন্ধ্যার পর। চারদিকে অন্ধকার পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। হৃদয় বিরক্ত হয়েই নিচে নামল। কতক্ষণ একা একা থাকা যায়! নোমানেরও কোনো খবর নেই। এই বাড়িতে এলে তার বেশিরভাগ সময় নোমানের সাথেই কাটে। কিন্তু গতকাল থেকে একবারও নোমানের দেখা মেলেনি। হৃদয়কে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বড় মামি এগিয়ে এলেন।

” কিছু লাগবে তোর? সারাদিন এত ব্যস্ত ছিলাম যে তোর একটু খবরও নিতে পারিনি। ”

” কিছু লাগবে না। কিন্তু নোমান ভাইয়া কোথায়? দেখছি না যে! ”

” নোমানতো নিহানকে আনতে গেছে। নোবাইদও ওদের সাথেই ফিরবে। ”

” আচ্ছা। ”

হৃদয় উপরের দিকে পা বাড়াল। এখানে থাকার তার বিন্দু পরিমাণ ইচ্ছে নেই। নিহান নামটাতেই বিরক্তি। মেয়েটার গা ভর্তি বিরক্তি। অবশ্য মেয়ে বলছে কেন? মেয়েলি কোনো স্বভাব আছে নাকি তার মাঝে! কিন্তু তাও এই মেয়েটাকে বাড়ির সবাই মাথায় করে রাখে। কিন্তু হৃদয়ের ভালো লাগে না। অকারনেই ভালো লাগে না। জীবনে কিছু মানুষের প্রতি অকারণেই বিরক্তি জন্মে। নিহানও তার কাছে তেমনই। শরীর ভর্তি আহ্লাদ। অবশ্য তাকে দেখে না ৫/৬ বছরতো হবেই। এমনকি নানুমণির মৃত্যুর সময়ও তাকে দেখা যায়নি। আদৌ এসেছিলো কি না কে জানে!
হৃদয় মাঝ সিঁড়িতে থাকতেই কলিং বেল বেজে উঠল। গোটা বাড়িতে উৎসব লেগে গেল। হৃদয়কে পাশ কাটিয়ে রিমান্তি, রাইসা, জুমা নিচে নেমে গেল। হৃদয় বিরস মুখে নিজের ঘরে ফিরে গেল।
নিলুফা বেগম দরজা খুলেই নিহানকে দুহাতে জড়িয়ে ধরল। নিহান চেঁচিয়ে উঠল,
” আম্মু আমি ফ্রেশ হইনি। ”

নিলুফা বেগম হাসলেন। মেয়ের এই স্বভাব তার জানা। কিন্তু তবু প্রতিবার দরজায় দাঁড়িয়ে মেয়েকে জড়িয়ে ধরবেন। আর মেয়ে তৎক্ষনাৎ চেঁচিয়ে উঠবে। নিলুফা বেগম মেয়েকে ভেতরে নিয়ে গেলেন। আশেপাশে সবাই ঘিরে ধরতেই নিহান চেঁচিয়ে উঠল,

” ডোন্ট টাচ মি এনিওয়ান। আমি আগে ফ্রেশ হব। ”

সবাই হেসে ফেলল। নিহান আর কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে উপরে নিজের ঘরের দিকে চলে গেল।

” আমিও বোধহয় এসেছিলাম। ”
পেছন থেকে নোবাইদের আওয়াজ। লাগেজ হাতে সে এখনো দরজায় দাঁড়িয়ে।

নিলুফা বেগম ছেলেকে জড়িয়ে কপালে চুমো খেলেন।
” আয় ভেতরে আয়। ”

” আমায় দেখা যাচ্ছে? আমি ভাবলাম অদৃশ্য হয়ে গেছি বোধহয়! ”
নোবাইদের কন্ঠে রসিকতা।
উপস্থিত সকলেই হাসলো। সবার সাথে কথা বলে, নোমান, নোবাইদ দুজনেই নিজেদের ঘরে চলে গেল ফ্রেশ হতে।

হৃদয় নিজের ঘরে বসে আছে। এর মাঝে নোমান, নোবাইদ এসে কথা বলে গেলেও নিহানের সাথে তার দেখা হয়নি। সে নিজেও ইচ্ছে করে যায়নি। নিচ থেকে খাবারের জন্য ডাকছে। হৃদয় ফোন হাতে নিচে নেমে এলো। ডাইনিং এর দৃশ্য দেখেই তার মন বিষিয়ে উঠল। নিহান বসে আছে। যদি পেছন দিক দেখা যাচ্ছে কিন্তু ড্রেসআপে বলে দিচ্ছে এটা নিহান। থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট, গায়ে শার্ট। চুলগুলো ঘাড়ের উপর খোপা করা। তার দুপাশে নোমান, নোবাইদ, সামনে বড় মামা, বড় মামি। চারজনেই মহান কাজে ব্যস্ত। আর তাদের এখন মহান কাজ হলো নিহানকে খায়িয়ে দেওয়া। হৃদয় চোখ মুখ কুচকে ফেলল। এই মেয়েটাকে তার বিরক্ত লাগে। অথচ, ভুল করেও কখনো নিহানের সাথে তার কোনো ঝামেলা হয়নি। মেয়েটা আসতে না আসতেই তার গুরুত্ব কমে গেছে এখানে। হৃদয় বিরস মুখে ড্রাইনিং এ বসল। সবার সাথে টুকটাক কথা বলে খাওয়ায় মন দিলো। এর মাঝে একবারও সে নিহানের দিকে তাকায়নি। অথচ, নিহান বিস্ময়ে নিষ্পলক তার দিকে তাকিয়ে। দু’পাশের নোমান, নোবাইদ নিঃশব্দে হাসছে৷ খাওয়া শেষ করেই হৃদয় নিজের ঘরে ফিরে গেল।

জুমা ছাদে উঠে এলো। সারাটা দিন হই হই করে কাটিয়ে এখন অকারণেই কেমন খারাপ লাগছে। সবকিছুর মাঝেও কী যেন নেই৷ তাই ছাদে এসেছে। একটু রিফ্রেশমেন্ট প্রয়োজন। পাশের বিল্ডিং থেকে আসা হালকা আলো এসে পড়েছে ছাদে। ছাদের মাঝে দাঁড়াতেই অপরপাশে আবছা নজরে পড়ল। মুহুর্তেই ভয় ঝেঁকে বসল। এ সময় ছাদে কে? ভূত টুত নয়তো? পরক্ষণেই নিজেকে বোঝাল, এসব কিছু হয় না। কিন্তু মন মানতে নারাজ। ভয়ে ভয়েই সামনে এগিয়ে গেল। অবয়ব ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে উঠল। নোমান ছাদে দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুঁকছে। জুমা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। যাক ভূত নয়। পরক্ষণেই ভ্রু কুচকে প্রশ্ন করল,
” আপনি সিগারেট খান? ”

কারো গলার স্বর কানে আসতেই নোবাইদ দ্রুত নিজের হাতের সিগারেটটা ফেলে পা দিয়ে পিষে ফেলল। ফিরে জুমাকে দেখে, সাবধানে আশেপাশে নজর বুলালো। অন্য কাউকে দেখতে না পেয়ে কিছুটা স্বস্তি মিললো। কৌতূহলী কন্ঠে বলল,
” তুমি এতরাতে এখানে কী করছ? ”

” ভূতের সাথে সাক্ষাৎ করতে এসেছিলাম, কিন্তু পেত পেয়ে যাব ভাবিনি। ”

নোমানের ভ্রু কুঁচকে এলো। ডান হাতে দু আঙুল ডান ভ্রুতে ঘষে বলল,
” বাই এনি চান্স, তুমি কি আমাকে পেত বলতে চাইছো? ”

” আমি সরাসরি আপনাকে পেত বলে সম্বোধন করলাম। ”

” বাড়াবাড়ি করছ। বড়দের সম্মাদ দিয়ে কথা বলবে। ”
নোমান ধমকে উঠল। নিচে যাওয়ার জন্য পা বাড়াল। পেছন থেকে জুমা আধ খাওয়া সিগারেটটা হাতে তুলে বলল,

” আমি কি আপনার এত সুন্দর গুপ্ত ধরণের নিউজটা টেলিকাস্ট করব? আমি সিউর ব্রেকিং নিউজ হবে। ”

নোমান পেছনে তাকিয়ে জুমার হাতে আধ খাওয়া সিগারেট দেখে থমথম খেয়ে গেল।আমতা আমতা করে বলল,

” তুমি কি আমাকে ভয় দেখানোর চেষ্টা করছো? ”

” ছিঃ ছিঃ এত বড় দুঃসাহস আমার আছে নাকি? কিন্তু এত বড় সিক্রেট গোপন রাখার জন্য একটুতো খাটনি হবে। ”

নোমান সরোষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে। জুমা রসিয়ে বলল,

” এই যে এই সিক্রেটটা আমার পেটের ভেতর লাফালাফি করছে বাইরে আসার জন্য। তাকে ভেতরে চেপে রাখলে গুটুর গুটুর করবে। আমার কষ্ট হবে। বিনা লাভে আমি কষ্ট কেন করব বলুন? ”

নোমান শক্ত গলায় প্রশ্ন করল,

” কী চাই? ”

” বেশি কিছু না। আপনাকে শুধু আমার কথা শুনতে হবে। ”

নোমান রেগে জুমার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। আঙুল তুলে বলল,

” তোমার মতো দু আঙুলের মেয়ে কথা শুনব আমি? ”

জুমা নোমানের আঙুলটা ধরে নিচে নামিয়ে দিলো।
” এই দু আঙুলের মেয়ের তিন আঙুলের কন্ঠস্বরে আপনার রহস্যভান্ডার আটকে আছে মিস্টার। সো ইউ হ্যাভ নো অপশন। ”

নোমান তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল জুমার দিকে। জুমা সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে বলল,

” আপনাকে কী করতে হবে তা আমি আগামীকাল জানাব। এখন আমার মুড নেই। গুড নাইট। হ্যাভ সাম সুইট ড্রিম। ”

জুমা হেলতে দুলতে নিচে নেমে গেল। নোমানের শরীর জ্বলে যাচ্ছে। এইটুকু মেয়ে তাকে শুনিয়ে চলে গেল। শালা, কোন দুঃখে আজ সিগারেট খেতে ছাদে এসেছিলো কে জানে!

হৃদয় ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলো। এমন সময় দরজায় নক করল। হৃদয় দরজা খুলতেই সামনে রিমান্তি, রাইসার সাথে আরেকটা মেয়েকে দেখল। হৃদয়ের বুঝতে অসুবিধা হলো না এটাই নিহান। অবিকল নোবাইদ ভাইয়ার চেহারার গড়ন। দুজনের কেবল চুলগুলোর ব্যবধান। হৃদয় চোখ নামিয়ে নিলো। বিরক্তকর মানুষের দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাক যায় না, সে যতই সুন্দর মনোহারিণী হোক না কেন। কিন্তু মেয়েটা প্রশংসনীয় সুন্দর। হৃদয়কে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে, নিহান তাকে পাশ কাটিয়ে ঘরে প্রবেশ করল। হাসি হাসি মুখ করে বলল,

” কেমন আছেন? ”

” কারো ঘরে ঢুকতে অনুমতির প্রয়োজন পড়ে বোধহয়। ”
না চাইতেও হৃদয়ের মুখ থেকে কথাটা বেরিয়ে গেল। নিহান থমথম খেয়ে গেল। পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,
” আপনাকে এখানে পাব আমি ভাবতেই পারিনি। ”

” প্রতিবন্ধিদের মস্তিষ্ক ছোটই হয়। ”

নিহান বিস্ময় নিয়ে প্রশ্ন করল,
” মানে? ”

” নিহান তোমার পেছনে তেলাপোকা। ”

নিহান লাফিয়ে বিছানার উপর চড়ে গেল। সাথে কান ফাটা চিৎকার। হৃদয় স্বশব্দে হেসে উঠল। সাথে রিমান্তি, রাইসাও। নিহান তাজ্জব বনে গেল। হৃদয় রসিয়ে বলল,

” ওলে বাবালে, বাবুটা ভয় পেয়েছে। আগে বাবু বড় হও, তারপর না ভাবতে শিখবে। ”

নিহান নিঃশব্দে নিচে নেমে দাঁড়াল। তার বুঝতে অসুবিধা হয়নি হৃদয় কী বুঝাচ্ছে। নিহান ছোট করে ‘ সরি ‘ বলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। নিহানের পেছন পেছন রাইসাও চলে গেল। রিমান্তি চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই চুলে টান অনুভব করল। হৃদয় পেছন থেকে এক গোছা চুল নিজের ডান হাতের আঙুলে পেঁচিয়ে রেখেছে। হৃদয় চুলে হালকা টান দিতেই রিমান্তি ফিরে হৃদয়ের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। কিন্তু দৃষ্টি মেজের দিকে স্থির। হৃদয় বামহাতে রিমান্তির মুখটা উঁচু করে ধরল। কৌতূহলী গলায় বলল,

” কী হয়েছে? ”

রিমান্তি চুপ করে রইল। দৃষ্টি হৃদয়ের আদলে। হৃদয় অস্থির নয়নে তাকে পর্যবেক্ষণ করছে। চোখ থেকে নাক, ঠোঁট, চিবুক। তার দৃষ্টির ধারালোর বানেই ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে রিমান্তির হৃদয়। হৃদয় উত্তেজিত গলায় বলল,

” চঞ্চল মেয়েটার চোখে গভীর বেদনা ফুটে ওঠেছে। এই শ্যামবতীর মন খারাপ করার দুঃসাহস কে দেখাল? ”

রিমান্তি নির্বাক। সে নয়ন ভরে মানুষটাকে দেখছে। তৃষ্ণার্ত দৃষ্টি। এ দেখার শেষ নেই, তবু মাঝে কাচের দেয়াল। হৃদয় ক্রমাগত অস্থির হয়ে উঠল।

” কী হয়েছে বলবে তো! শরীর খারাপ করছে? মামি বকেছে? ”

রিমান্তি নিজের ডান হাত হৃদয়ের গালে রাখতেই হৃদয় থেমে গেল। চিবুকে হাত ছুঁয়িয়ে রিমান্তি বলল,

” এমনভাবে ধরা দিলে তুমি, না ঘর বানাতে পারি না পর। ”

পরক্ষণেই হাত নামিয়ে ছু্টে বেরিয়ে গেল। হৃদয় হতবিহ্বল হয়ে রিমান্তির যাওয়ার দিকে তাকিয়ে। কিছুই বুঝতে পারল না। চরম অস্থিরতা নিয়ে রাত বাড়তে লাগল। নিজেকে এই বলে শান্ত করল, ‘ সকালে জেনে নেবে সব। ‘ একসময় সকল অস্থিরতা, ভাবনাকে বিদায় জানিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল।

চলবে,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here