তুমিময় আমি,পর্ব:২

0
779

” তুমিময় আমি। ”
“ মার্জিয়া খাঁন নিহা। ”
পর্ব : ২।

« এক মাস আগে। »

এইচএসসি পরীক্ষা শেষ হয়েছে গতকাল। ঝড় থামার পর প্রকৃতি যেমন নিশ্চিন্তে শীতল রূপ ধারণ করে, এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের মনের অবস্থা অনেকটা তেমন। হৃদয়ও তার ব্যতীক্রম নয়। পরীক্ষা শেষেই ব্যাগ প্যাক গুছিয়ে রাতের গাড়িতে বন্ধুদের সাথে চলে এসেছে কক্সবাজার। এবার লম্বা ট্রিপ। গোটা সপ্তাহখানেকের পরিকল্পনা। ঘুরাঘুরি, হই- হুল্লোড়।

হৃদয় সমুদ্র পাড়ের বালিতে পা মুড়ে বসে আছে । শেষ বিকেল। হালকা কুয়াশার ছোয়াঁ। তবে ঠিক কুয়াশা বলা চলে না। বরং মেঘেদের বাড়ি বললে খুব একটা ভুল হবে না। বালিতে অগণিত পথিকের পদচিহ্ন। খানিক দূরেই একজোড়া কপোতী বালির ঘর বানাচ্ছে। সূর্য ডুবুডুবু। কক্সবাজারের সবচেয়ে মনোরম দৃশ্য। হৃদয়ের বন্ধুরা সে দৃশ্য উপভোগ করতেই ব্যস্ত। কিন্তু তার সেদিকে মন নেই। প্রকৃতি তাকে তেমন টানে না। সে মন দিয়ে উচ্ছাস যুগলের প্রত্যাশার বাড়ি বানানো দেখছে। মুহুর্তেই ঢেউ এসে ভাসিয়ে নিয়ে গেল সে ঘর। বিরস মুখে মেয়েটি উঠে দাঁড়াল। ছেলেটি হালকা হেসে মেয়েটির হাত জড়িয়ে পানির ধার ঘেঁষে হাঁটায় মন দিল। খানিকটা অবচেতন মনেই হৃদয়ও তাদের পিছু পিছু হাঁটছে। মুগ্ধ করছে এই যুগলপ্রেমের খুঁনসুটি। সমুদ্রের তীরে খালি পায়ে আনমনেই হাঁটছে। মাঝে মাঝে সমুদ্রের অবাধ্য জল এসে সন্তপর্ণে একটু ছুঁয়ে দিয়ে পুনরায় নিজের গতিপথে ফিরে যাচ্ছে। হঠাৎই মিষ্টি একটা গানের সুর কানে ভেসে এলো।

” ভ্রুমর কই ও গিয়া,
শ্রী কৃষ্ণ বিচ্ছেদের অনলে
আমার অঙ্গ যায় জ্বলিয়ারে
ভ্রমর কইও গিয়া। ”

এই পরিবেশে এমন একটা গানেরই বোধহয় কমতি ছিলো। এবার ষোলকলা পূর্ণ হলো।
হৃদয় গানের শব্দটা অনুসরন করেই সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। অদ্ভূত টান অনুভব করছে। তার প্রিয় গান বলেই হয়তো।
একটু এগিয়ে গিয়েই দেখতে পেল কালো একটা গাড়ি দাঁড়ানো। একপাশের দরজা খুলে রেখে সিটে বসে আছে একজন। এক পা গাড়ির বাইরে, বাম হাত গাড়ির দরজায়। মানুষটা যে কোনো নারী তা অবয়ব স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে। কালো প্যান্ট এর সাথে সাদা শার্ট। পায়ে বেবি পিংক কালার সুজ। আজব কম্বিনেশন। কালো সাদার সাথে পিংক কে পড়ে! চুল গুলো ছাড়া। চুল গুলো গাড়ি ছাড়িয়ে নিচে পড়ে আছে, মাটি ছুঁই ছুঁই অবস্থা। কিন্তু মুখটা দেখা যাচ্ছে না ঠিকঠাক চুলের কারণে। চুলের ফাঁক দিয়েই ফুঁটে ওঠেছে ফর্সা তীর্যক নাক। সম্ভবত গানটা মেয়েটাই গাইছে। মুগ্ধতা কাজ করছে তার মাঝে।

” কইও কইও কইরে ভ্রুমর কৃষ্ণরে বুঝাইয়া
আমি রাধা মইরা যামো গো কৃষ্ণ হারা হইয়ারে,
ভ্রমুর কইও বুঝাইয়া। ”

হৃদয় গান শুনতেই ব্যস্ত। কখন সাব্বির এসে পাশে দাঁড়িয়েছে খেয়ালই করেনি।
” কিরে কি করছিস এখানে? ”

হৃদয় নিশ্চুপ। কথাটা আদৌ তার কানে পৌছেছে কি না সন্দেহ।

” কথা বলছিস না কেন? বোবায় পাইছে? ”
কাঁধে ধাক্কা দিয়ে।

” ধাক্কাধাক্কি করিস কেন শালা, আমায় মেয়ে মনে হয়? ”
হঠাৎ ধ্যান ভেঙে বিরক্তিমাখা গলায় হৃদয়ের জবাব।

” নাউজুবিল্লাহ, আমার এত খারাপ দিন আসে নাই। ”

” তাইতো বলি, সময় থাকতে চরিত্র ঠিক কর মামা, নাহয় পাবলিকের উত্তম- মধ্যম খেয়েই দিন যাবে। ”

” আমায় নিয়া পরে ভাবিস, তুই কার পাল্লায় পড়ছোস? জলপরী নাকি? ”

« দিঘল চুল, তীর্যক নাক
আমি কি মুগ্ধ!
কী বলে ডাকি তারে,
মন বলে,
‘ কেশবতী কিংবা মায়াবতী ডাক। »

আনমনেই হৃদয় কয়েকটা শব্দ আওড়ে নিলো। সাব্বির খানিকটা অবাক হয়ে বলল,

” কী কস? ”

হৃদয় চকিতে ফিরে তাকাল। পরক্ষণেই স্বাভাবিক স্বরে বলল,

” জলপরী না, তবে কেশবতী বলতে পারিস। সাথে মায়াবতীও। ”

” আমিতো আন্দাজে তীর মারলাম, নিশানায় পইড়া গেল ক্যামনে? দোস্ত, ভাবী দেখতে কেমন? ”
সাব্বিরের কন্ঠে উচ্ছ্বাস।

” ভাই আস্তে চল, দ্রুতগামী বাস বেশিক্ষণ রাস্তায় থাকে না জানিস না? উল্টে খাদে পড়ে যায়। ”

” ডায়লগ পরে দেও। আগে ভাবী দেও। ”

হৃদয় সরোষ দৃষ্টিতে তাকাল।

” মানে ভাবী দেখাও আরকি! ”
সাব্বির জোর করে হাসার চেষ্টা করল।

” আরে ভাবী টাবি না। ছোট খাটো মুগ্ধতা। ঐতো সামনের গাড়িতে। ”

হৃদয় সামনে তাকিয়ে দেখল, গাড়িটা চলে যাচ্ছে।

” তোর কর্কশ গলা শুনে মেয়ে পালাইছে দেখ। তুই সাথে থাকলে জীবনে আমার প্রেম হইব না। ”
সাব্বিরের পিঠে মেরে।

” দেখিস, শেষ পর্যন্ত এই সাব্বিররেই কাজে লাগব। ”

হৃদয় জবাব দিলো না। নির্বাক আকাশের দিয়ে তাকিয়ে রইল। বাতাসে কেমন মুগ্ধতার আভাস পাচ্ছে। এমন সময় তার ফোন বেজে উঠল। ফোন হাতে নিয়েই দেখে মায়ের কল।
” হ্যালো, মা। ”
,,,,,,,,,,,,৷ ,,,,,,,

” আমি আসছি না। তুমিতো জানো, সাপ্তাহখানেকের জন্য এসেছি। ”

,,,,,,,,,,,,৷,,,,,,,,,,,,,

” আচ্ছা এখনি রওনা করছি। ”
,,,,,,,, ,,,,,,,,,,,,,

” হুম, তাড়াতাড়ি আসব। ”

ফোন টা কেটে গেল। হৃদয় পুনরায় ফোনটাকে পকেটে পুড়ে সাব্বিরের উদ্দেশ্য বলল,

” হোটেলে ফিরে তৈরি হয়ে নে। ফিরে যেতে হবে।আম্মু গাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে। ”

” তুই যা, আমি বাকিদের নিয়ে আসছি। ”

হোটেলে ফিরেই গোছাগাছ করে হৃদয় বন্ধুদের সাথে নিয়ে বেড়িয়ে পড়ল চট্টগ্রামের নিজ বাসার উদ্দেশ্য। গন্তব্যে পৌছে সবাই যে যার বাসায় ফিরে গেল।
প্রায় গভীর রাত।
বাসায় ফিরেই হৃদয় সোজা নিজের রুমে চলে গেল। বিছানায় গা এলিয়ে দিল বিছানায়। ক্লান্ত শরীরটা মুহূর্তের মধ্যেই ঘুমের কোলে ঢলে পড়ল। গত রাত জাগার ফল। সকালে ঘুম ভাঙলো মায়ের ডাকে। ঘড়ির কাটা তখন আট টার ঘরে।

” হৃদয় ওঠ তাড়াতাড়ি। ”
” মা আরেকটু ঘুমোতে দেও না। ”
” আর ঘুমোলে দেরি হয়ে যাবে বাবা, ওঠ না। আমাদের বেড়োতে হবে। ”
” যেখানে যাওয়ার তোমরা চলে যাও, আমি যাবো না। ভালো লাগছে না। ”
” যাবি না তোর নানু বাড়ি? ”

নানু বাড়ি শুনেই হৃদয় তড়িঘড়ি করে ওঠে বসল।
” নানু বাড়ি? ”
” হুম। ”
” আগে বলবেতো। তুমি দুমিনিট অপেক্ষা কর, আমি সময় নিয়ে তৈরি হয়ে আসছি। ”
উৎফুল্ল কন্ঠে হৃদয়ের জবাব।
” তখন থেকে ডাকছি, ওঠার নাম নেই। এখন তাড়াতাড়ি ওঠে ফ্রেশ হয়ে নে। আমি প্যাকিং করে দিয়েছি। আর তোর কাপড় ওয়াশরুমে রাখা। ”

হৃদয় দাঁত বের করে হেসে দ্রুত ওয়াশরুমে চলে গেল। হৃদয়ের মা নূরজাহান আহমেদও হালকা হেসে ঘর ত্যাগ করলেন। কালো প্যান্ট, কালো শার্ট, কালো ব্ল্যাজার, কালো সানগ্লাস, কালো সুজ।চুলে হালকা আঙুল চালিয়ে হৃদয় বেরিয়ে এলো। হৃদয় অনেক খুশি। কোনো এক বিশেষ কারণে গত তিন বছর তার পরিবারের সবাই নানু বাড়ি গেলেও তার যাওয়া হয়নি। নানু বাড়ি থেকে কম বেশি অনেকে অবশ্য প্রায়ই তাদের বাসায় আসে কিন্তু তার যাওয়া নিষেধ। সে বিশেষ কারন রিদয়ের অজানা। আজ এতোদিন পর আবার সবাইকে একসাথে দেখতে পাবে ভেবেই তার ভালো লাগছে। নিচে নেমে ডাইনিং বসেই সে চেচিয়ে উঠল,

” মা, এসো না! আর কতক্ষণ? ”
” আসছি।
সিঁড়ি ভেঙে নামতে নামতে।
এতক্ষণ নিজে পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছিল,এখন আমাকে তাড়া দিচ্ছে। ”
” তোমার দুই ঢঙ্গি কই? ”

” একদম ঢঙ্গি বলবি না। ”
সোফায় বসে জুঁইয়ের জবাব। তুই কোথাকার রাজকুমার? ”

” প্রতিটা ছেলেই জন্মগত রাজকুমার আর মেয়েরা ঢঙ্গি। ”

” একদম বাজে বলবি না, ভাইয়া। আমি তোদের সবার চেয়ে কয়েক ফোঁটা বেশি কিউট। ”
জুঁইের পাশে বসে জুমার জবাব।

” তোকে তো আমি ব্রীজের নিচে থেকে কুড়িয়ে এনেছি। ”

” ভাইয়া, ভালো হচ্ছে না কিন্তু। ”
জুমা ফোসাচ্ছে।

” সত্যি বলছি তো তাই গায়ে ফোচকা পড়ছে। ”

” আম্মু তোমার ছেলেকে চুপ করতে বলো। ”
জুমা চেঁচিয়ে বলল।

হৃদয়ের বাবা বাশার আহমেদ দরজায় দাঁড়িয়ে বলে উঠলেন,
” কে বলেছে আমার মেয়েরা ঢঙ্গি। তারাতো আমার রাজকন্যা। আমার দুইটা মা। ”

হৃদয়কে ভেংচি কেটে জুঁই, জুৃমা বাবাকে জড়িয়ে ধরে। সেদিকে তাকিয়ে হৃদয় মুখ বাকায়।

” থাক বাবা, আর সান্তনা দিতে হবে না। ও তো একদিন না একদিন জানবেই যে আমরা ওকে কুড়িয়ে পেয়েছিলাম। ”

” হৃদয় এবার মার খাবি। ”
নূরজাহান আহমেদ এগিয়ে এলেন।

” সত্য কথা বললেই দোষ। ”

” তুই কতোটা সত্যবাদী তা আমার জানা আছে। ”
জুঁই বিদ্রুপের সুরে বলল।

” থাম, তোরা। এখন তোর দেরি হচ্ছে না। এতক্ষণ তো চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় করছিলি। চল তাড়াতাড়ি। ”
নূরজাহান আহমেদ সকলকে তাড়া দিলেন।

” তোমরা যাও, আমি একা আসছি। ”

” কেন? একা যাবি কেন? ”

” মা, আমি ছোট বাচ্চা নই। আমি একা আসছি এটাই ফাইনাল। বাই। ”
কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে হৃদয় বেরিয়ে গেল।

” এই ছেলেটা একটুও কথা শুনে না। সবসময় নিজের খেয়াল খুশি মত চলবে। ”

” এই বয়সে একটু এমনি হয়। চল, আমরা বেরিয়ে পড়ি। ”

এইটুকু বলেই বাশার আহমেদ মেয়েদের সাথে নিয়ে বেরিয়ে এলেন। নূরজাহান বেগমও ছোট একটা দীর্ঘশ্বাস টেনে বেরিয়ে এলো। তাকে বেশ খুশি লাগছে। চোখ, মুখ উপসে পড়ছে হাসি। প্রতিটা মেয়ের কাছে বাবার বাড়িটা বোধহয় এমনি। যুগ পেরিয়ে গেলেও অনুভূতি সেই প্রথম দিনের মত। সবাই গাড়িতে বসতেই গাড়ি চলতে আরম্ভ করল। গন্তব্য কুমিল্লা।

চলবে,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here