” তুমিময় আমি। ”
“ মার্জিয়া খাঁন নিহা। ”
পর্ব : ১৬।
সূর্যের তীব্র তেজের ঝলকানির প্রতিফলিত আলো নিহানের উপর তার অঊিপত্য বিস্তার করতেই ঘুমরাজ পালানোর তোড়জোড় করছে।ঘুমরাজ কে বিদায় জানিয়ে অলস্য ভঙ্গিতে সে উঠে বসল। পাশের দেয়াল ঘড়িতে নজর পড়তেই চমকে উঠলো। এগারোটা পাঁচ! এত বেলা অবধি সে তার গোটা তেইশ বছর জীবনে ঘুমিয়েছে কি না সন্দেহ! তবে অবুঝবেলাটা ভিন্ন বিষয়। ফ্রেশ হওয়ার কথা মাথায় আসতেই সে আশেপাশে চোখ বুলায়। আশেপাশে কোথাও হৃদয়ের দেখা নেই। পাশেই তার লাগেজে চোখ পড়তেই আনমনে হাসে। ‘ যাক গাঁধাটা একটাতো ভালো কাজ করেছে। ‘ ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে আসতেই হৃদয়কে দেখতে পায়। খাবার হাতে বিছানায় বসে। নিহানকে দেখে এগিয়ে এসে হাত ধরে তাকে বিছানায় বসায়। খাবার মাখিয়ে খায়িয়ে দিচ্ছে। এতবেলা করে উঠার জন্য মিষ্টি ভাষায় বকছে। অবলীলায় কত সহজ ব্যবহার করছে যেন কিছুই হয়নি। নিহান চুপচাপ খাওয়া শেষ করে। নিহানের কাছ থেকে কোনো প্রকার সাড়া না পাওয়ায় হৃদয় শ্বাস টেনে নিজেকে শান্ত রাখে। বিছানায় পা গুটিয়ে বসে বলতে শুরু করে,
” জান, আমি জানি তুমি রেগে আছো। রাগ স্বাভাবিক। হয়তো আমার ভুলগুলো ক্ষমার অযোগ্য। কিন্তু আমি তাও চাই তুমি সব ভুলে আমার সাথে থাকো।
তোমায় ছাড়া আমি থাকতে পারব না। ”
” হঠাৎ এত ভালোবাসা কেন? ”
নিহানের স্বাভাবিক গলা।
” ভালোবাসা হুট করে আসে। তখন কীভাবে কার প্রতি আসে তার উপর কোনো পরিকল্পনা চলে না। বছরের পর বছর থেকেও কারো প্রতি ভালোবাসা জন্মায় না। আবার কেউ একপলকে গোটা দুনিয়া হয়ে যায়। তোমার প্রতি আমার ভালোবাসা হয়তো প্রথম থেকেই ছিলো। কিন্তু আমি বুঝতে পারিনি। ছোট থেকেই তোমার থেকে বেশি সময় আমি রিমান্তির সাথে কাটিয়েছি। তুমি আমার কাছে অপরিচিতদের মত ছিলে। অপরিচিত কারো জ্ঞান নিতে চায় না মানুষ, সেখানে খবরদারি কে মানে বলো? হুট করে তোমার আমার জীবনে চলে আসা আমি মানতে পারিনি। তথাপি তোমার রাগী রূপ আমায় ভাবতে বাধ্য করে। আমি কখনোই চাইনি তোমার জন্য আমার কেরিয়ারে কোনো দাগ আসুক। তাই তোমার সাথে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছিলাম। তোমার অশ্রু আমায় তোমার মায়ায় ফেলেছিলো। কিন্তু হুট করে আবার রিমান্তির সাথে নিজেকে জড়িয়ে ফেলা, সারাক্ষণ তার সংস্পর্শে থাকা, আমায় বিভ্রান্তিতে ফেলেছিল। আমার বার বার মনে হচ্ছিল, কোনো একজনের সাথে আমি অন্যায় করছি। তোমার প্রতি অনুভূতিকে সহানুভূতির নাম দিলাম। সবকিছুর জন্য তোমায় দায়ী মনে করলাম। তারপর তোমায় ঐ অবস্থায় দেখা। আমার মাথা ঠিক ছিলো না।
কিন্তু তোমার দূরত্ব আমায় প্রতি মুহুর্তে বুঝিয়েছে তুমি আমার কতোটা জুড়ে। আমি আমগ্ন তোমার মাঝে ডুবে থাকতে চাই। ”
নিহান শান্ত ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়ায়। লাগেজ খুলে বেশ কয়েকটা ফটো হৃদয়ের সামনে রাখে। হৃদয় ছবিগুলোতে চোখ বুলিয়ে চমকে উঠে। প্রতিটা ছবি রিমান্তি আর তার। চট্টগ্রামের তাদের একসাথের প্রতিটা মুহুর্ত ক্যামেরা বন্দি হয়েছে।
” এই ছবিগুলো আমায় কেউ দেয়নি। আমি নিজহাতে যত্ন করে তুলেছি। এক হাস্যোজ্জ্বল দম্পতির স্মৃতি সাজিয়ে রাখা থেকে নিজেকে আটকাতে পারিনি। রিমান্তিকে নিয়ে আমাদের বিয়ের রাতেই আমার সন্দেহ হয়। কিন্তু আমি গুরুত্ব দেইনি। অতঃপর আমার হাতে আসে কারো ভালোবাসা বন্ধি দিনপঞ্জি।
‘ নিজেকে তখন কতোটা অসহায় লাগে,
নিজের ছোটবোনের ভালোবাসা যখন নিজের স্বামী হয়ে থাকে? ‘
তবু এক বুক আশা নিয়ে মানিয়ে নিতে চেয়েছি। নিজেকে ভুলে আপনার পছন্দে নিজেকে রাঙাতে চেয়েছি।
‘ কিন্তু ঐ হাত পুনরায় কী ছোঁয়া যায়?
আমি থাকা শর্তেও আঙুলের ভাজে যে অন্যকারো ছোঁয়া চায়? ‘ ”
” অস্তমিত সূর্য রক্তিম হয়ে যায়, ফুটে ওঠে হারানোর বেদনা।
তাই বলে কি নতুন দিবস আসে না? ”
” প্রিয়জনের দূরত্ব পোড়ায়, কিন্তু মাঝে মাঝে কিছু দূরত্ব বাঁচতে দেয়, প্রাণভরে নিঃশ্বাস নিতে দেয়। আলোর মশাল নিভিয়ে আমি ঘুটঘুটে অন্ধকারে হাঁটি। আলোতে আমার চোখ জ্বলে, অন্ধকারেই ভালো থাকি।
তাই আপনার আমার গল্পটা অব্যক্তই রয়ে যাবে
শব্দ, সংলাপের অভাবে, পরিস্থিতির স্বীকারে। ”
হৃদয় নিঃশব্দে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। পরিস্থিতি দুজনের মাঝেই এক অদৃশ্য দেয়াল তৈরি করেছে। ভেঙেও যেন ভাঙে না।
দুপুর গড়িয়ে বিকেলের অপেক্ষা। নিহান বারান্দায় দাঁড়িয়ে ব্যস্ত শহর দেখছে। আজ তাদের সংসারটা ভালোবাসায় পরিপূর্ণ থাকার কথা। তথাপি ভালোবাসা আছে, সংসার নেই। শব্দ করে ঘরে প্রবেশ করে হৃদয়। নিহানকে বারান্দায় দেখে সশব্দে বলে উঠে,
” সরি। আমি একটু কাজে বাইরে ছিলাম। তোমার দুপুরে খাওয়া হয়নি নিশ্চয়ই। ”
নিহান ধীরপায়ে ঘরে প্রবেশ করল। কৌতূহলী হয়ে প্রশ্ন করে,
” আমি বাড়ি কখন যাব? ”
” যাবে না। ”
নিহান সরোচ দৃষ্টিতে তাকায়। নিহানের চোখে চোখ পড়তেই হৃদয় চোখ নামিয়ে ফেলে। বা হাতের ঘড়িটা ডান দ্বারা খুলতে থাকে। নিঃশব্দে ঘড়িটা টেবিলের উপর রাখে।
” আমি তোমায় যেতে দিতে পারি না। হয়তো আমি আগের মত তোমায় পাব না, তাও তোমায় থাকতে হবে। অকারণে থাকবে হবে। কিংবা চোখের সামনে পুড়তে দেখার জন্য হলেও থাকতে হবে। কিন্তু দিনশেষে তুমি আছো, এটা ভেবেই আমি নিশ্চিন্ত থাকব। ”
” আপনার মনে হয় আপনি আমায় আটকে রাখতে পারবেন? বোকা! ”
নিহানের বিদ্রুপের স্বরে পুনরায় বলল,
” পরিস্থিতি আপনি বিগড়েছেন। কোনো ভাই তার বোনের অপহরণকারীর কাছে তার বোনকে তুলে দেবে না। আর আমিতো ভাইদের নষ্ট বোন। ”
” শব্দগুলো আমায় ঘুমোতে দেয় না জান। সেখানে মনে করানোর কষ্ট করছো কেন? ”
” আচ্ছা, ভাবুন। হুট করে কলিং বেল বেজে উঠলো। দরজা খুলেই দেখলেন ছোট ভাইয়া দাঁড়িয়ে। ”
” এটা কখনো হবে না। ”
হৃদয়ের কথার মাঝেই কলিং বেল বেজে উঠলো। হৃদয় অবাক হয়ে নিহানের দিকে তাকিয়ে। নিহান দুই ওষ্টে সিটির সুর তুলে তাকে দরজা খোলার ইশারা করছে। হৃদয় চরম বিস্ময় নিয়ে দরজা খুলে চমকে উঠলো। নোমান দাঁড়িয়ে। নোমান হৃদয়কে দেখতেই রেগে গেল। ধাক্কা দিয়ে ভেতরে ঢুকেই চেঁচিয়ে উঠল।
” আমার বোন কোথায়? ”
নোমানের পেছন পেছন নোবাইদ, ডাঃ আবিরসহ আরো বেশ কয়েকজন ভেতরে প্রবেশ করল। হৃদয় এখনো হতবিহ্বল। এই মুহুর্তে এসব তার কল্পনাতীত। নোমান আশেপাশে কাউকে দেখতে না পেয়ে হৃদয়ের কলার ধরে পুনরায় চেঁচিয়ে উঠল,
” গায়ে হাত তুলতে বাধ্য করবি না হৃদয়। আমার বোন কোথায়? ”
” ভাইয়া। ”
নিহানের আওয়াজ পেয়েই নোমান ফিরে তাকাল। হৃদয়কে ছেড়ে দ্রুত তাকে জড়িয়ে ধরল। তার অশান্ত মনটা নিমিষেই শান্ত রূপ ধারণ করল। পাগলের মতো খুঁজেছে। এ অস্থিরতা শব্দের প্রকাশে সে বুঝাতে পারবে না। ডাঃ আবির রেগে এসে হৃদয়কে মারতে চাইলেই নোমান হাত বাড়িয়ে থামিয়ে দিলো।
” আমি কাউকে কথা দিয়েছি, তাই হৃদয়ের গায়ে কেউ ফুলের টোকাও দেবে না। ”
ডাঃ আবির রাগে ফোসাতে ফোসাতেই হাত নামিয়ে নিলো। নোবাইদ নোমান নিহানকে নিয়েই বেরিয়ে যেতে চাইল। নিহান ‘ এক মিনিট ‘ বলেই হৃদয়ের কাছে এলো। হৃদয় তখনো অবাক হয়ে সবকিছু দেখছে। পরিস্থিতি অনুসারে তার ব্রেনের নিউরন ঠিকঠাক কাজ করছে না। নিহান তার কানে কানে বলল,
” আস্ক ইউর লিটল সিস্টার। ”
নিহান হাসিমুখে তার ভাইদের সাথে বেরিয়ে গেল। ডাঃ আবির রক্তিম চোখে তার দিকে তাকিয়ে। সেদিকে তার মন নেই। সে অসহায় দৃষ্টিতে নিহানদের গমন পথে তাকিয়ে। হাতের মুঠো রেখেও তার সব পুনরায় হারিয়ে যাচ্ছে।
‘ জানার আগ্রহে কৌতূলের সৃষ্টি
জেনে গেলে সমাধি,
কিছু আশা অপূর্ণ থাক
অসমাপ্ত চাওয়া আজ অবধি। ‘
চলবে,