তুমিময় আমি,পর্ব:১৫

0
495

” তুমিময় আমি। ”
“ মার্জিয়া খাঁন নিহা। ”
পর্ব : ১৫।

হৃদয় দাঁড়িয়ে আছে রুমের সাথে লাগোয়া বারান্দায়। বারান্দায় থেকে ঘরের প্রতিটা কোণা দৃশ্যমান। বিছানার একপাশে কম্বল মুড়ে নিহান ঘুমিয়ে। নিহানের ভোরে জাগার অভ্যাস থাকলেও আজ সে গভীর ঘুমে। কুয়াশার বলয় ভেদ করে সূর্য্যিমামা এখনো উঁকি দেয়নি। বারান্দা থেকে নিচের শিশির সিক্ত পিচডালা রাস্তা দৃশ্যমান। তার পাশেই একতলা একটা বাড়ি। বাড়ির উঠোনে সদ্য বিবাহিত দম্পতি খুঁনসুটিতে ব্যস্ত। খোলা চোখে যেন স্বপ্ন সুখের সংসার। বুক গভীরের বদ্ধ কপাট ভেদ করে বেরিয়ে এলো দীর্ঘশ্বাস। ভাবাচ্ছে তাকে পাঁচ বছর পূর্বের বিষাক্ত দিনপঞ্জি।

«পাঁচ বছর আগে। »

এইচ এস সি পরীক্ষার ফলাফল ইতিমধ্যে প্রকাশ করেছে। নিহান তোড়জোড়ে নিজের ভর্তি প্রিপারেশন নিয়ে ব্যস্ত। এর মাঝেই রিমান্তির জেদ, ফুফি বাসায় যাবে। কিন্তু সামনেই তার পরীক্ষা। সকলে নারাজ। অবশেষে তার জেদের কাছে হার মেনে নোমান নিজে গিয়ে তাকে রেখে এসেছে। হৃদয়ও নিজের একাডেমি নিয়ে ব্যস্ত। রিমান্তি ফুফি বাড়ি এসেই খুব খুশি। জুমা, জুঁই, ফুফি সবার সাথেই স্বল্প সময়ের বেশ গভীর সক্ষতা গড়ে তুলেছে। হৃদয় একাডেমি ক্যাম্পিং এ সিলেটে ছিলো সপ্তাহ খানেকের জন্য। বাড়ি ফিরে রিমান্তিকে দেখে সেও বেশ খুশি। রিমান্তি তখন হৃদয়ের ঘরের বিছানায় বসে। হৃদয় উৎসাহিত কন্ঠে বলল,

” কী ব্যাপার শ্যামলতা আজ এখানে? ”

” রাঁধা তার কৃষ্ণকে বেশ স্মরণ করছিলো। তাই সাক্ষাৎ দিতে চলে এলো। ”

” গাড়ি ব্রেক আস্তে কষেন শ্যামলতা। আপনি যে বড্ড দেরি করে ফেলেছেন। কৃষ্ণ এখন অন্যকারো দখলে। ”

” তাতে ভালোবাসার কী! সে আপাতত বাহারওয়ালী, আমি ঘর ওয়ালী। ”

রিমান্তির কথা শুনে হৃদয় শব্দ করে হেসে উঠল। সাথে তাল মিলিয়ে খিলখিলিয়ে হাসছে রিমান্তি। দুজনের হাসির শব্দ দেয়ালের ধাক্কায় মুখরিত করে তুলছে পরিবেশ।

পরদিন রিমান্তি বায়না করল হৃদয়ের সাথে একাডেমি যাবে। হৃদয়ও বিনা বাক্য ব্যয়ে রাজি হয়ে গেল। দিন চলতে লাগল এভাবেই। কখনো তাদের পাওয়া যায় একাডেমির গ্রীন রুমে, কখনো বিস্তর মাঠের মাঝে, কখনো পাহাড়ের চুড়ায়। আবার কখনো মহামায়ার মাঝে ভাসতে দেখা যায়। মাঝরাতে জি এস সির মোড়ের টঙ দোকানে ধোঁয়া উঠানো চা হাতে বেশ গল্প জমে উঠে ওদের। শিশির সিক্ত পিচডালা রাস্তায় পূর্ণিমার আলোয় সুখি দম্পতি লাগে ওদের। দুজন দুজনের মাঝে হারিয়ে সময় চোখের পলকে যে কখন বিদায় নিয়েছে তা বুঝা দায়। সকলের নিষেধ উপেক্ষা করে রিমান্তি পনেরো দিন ছিলো চট্টগ্রামে। অবশেষে সকলের কথায় একপ্রকার বাধ্য হয়েই তাকে ফিরতে হয় কুমিল্লায় নিজ বাড়িতে। কিন্তু তার মাঝে বাড়ি ফেরার কোনো চাঞ্চল্যতা ছিলো না। কিন্তু বাড়ি ফিরেও হৃদয়ের সঙ্গ তাকে একা ছাড়েনি। সারাদিন স্কুল, কোচিং শেষে রাত কেটে যেতো ফোনালাপে। রাতের প্রহর কেটে কখন ভোরের সূর্য উঁকি দিতো বুঝাই যেত না।

সপ্তাহখানেক পর।
বিকেলবেলা। হৃদয় উদভ্রান্তের মতো নিজ ঘরে বসে। এলোমেলো চুল, কুচকানো শার্ট, দু হাতের শার্টের বোতাম খোলা। সবকিছু তাকে ভাবাচ্ছে। গত দিনগুলোতে একবারও সে নিহানের সাথে কথা বলেনি। রিমান্তির ভীড়ে নিহানের স্মৃতি উঁকিঝুঁকি মারতে চাইলেও সে পাত্তা দেয়নি। তার দিনগুলে রিমান্তিময় হয়ে কেটেছে। আর প্রচন্ড সুখেই কাটছে। কিন্তু গত রাত থেকেই নিহানের ভাবনা তাকে অস্থির করে তুলেছে। নিহান, রিমান্তির গোলকধাঁধায় আটকে নিজেকে প্রচন্ড অসহায় লাগছে তার। সে নিজেই বুঝতে পারছে না, তার অনুভূতিতে ঠিক কার নাম লেখা। সারা দিন পর এখন নিহানের উপর প্রচন্ড রাগ আসছে। বিয়েটা না হলে তাকে এতোটা বিভ্রান্তিতে পড়তে হতো না। সে নিশ্চিন্তে বাকিটা জীবনও রিমান্তির সাথে কাটিয়ে দিতে পারত। আর এই বিয়ের জন্য আজও সে নিহানকে দায়ী মানে। এভাবে বিভ্রান্ত হয়ে বাঁচা যায় না। সব ভেবে চিন্তে সে রিমান্তিকে কল করল। এতোদিন পর নিহানকে সরাসরি কল করার সাহস তার হচ্ছে না। রিমান্তিকে কল করতেই রিমান্তি ফোন তুলল,

” কী ব্যাপার, কৃষ্ণের আজ এ সময় রাধাকে মনে পড়ল কেন? ”

” শ্যামলতা তুমি ফোনটা একটু নিহানকে দিতে পারবে? ”

” আমিতো মাত্র কোচিং থেকে বের হলাম। আর আপুতো চট্টগ্রামে। ”

” নিহান চট্টগ্রামে! কখন থেকে? ”

” গত এক সপ্তাহ ধরেই আপু চট্টগ্রামে। ”

অবাক হয়ে হৃদয় কল কেটে দিলো। নিহান এতদিন ধরে চট্টগ্রামে অথচ সে জানেও না। হঠাৎই জুমা কল করল। তাকে কোচিং থেকে বাসায় আনার জন্য। গাড়ি খারাপ হয়ে যাওয়ায় নূরজাহান আহমেদের সাথে সে আটকে। হৃদয় আপাতত সব ছেড়ে ফ্রেশ হয়ে জুমাকে আনতে গেল।

—————————

হৃদয় স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে। তার থেকে সামান্য দূরে নিহান কারো বুকে জড়িয়ে। মাথার ভেতর দপাদপ করছে। কোচিং সেন্টার থেকে সামান্য দূরত্বে হৃদয় গাড়ি থামিয়ে ভেতরে যাচ্ছিল। পথিমধ্যে এমন কিছু দেখবে সে ভাবতেও পারেনি। সব এলোমেলো লাগছে। রক্তাক্ত নয়নজোড়া এ মুহুর্তে কাউকে খুনও করতে পারে। হৃদয় দ্রুত পায়ে তাদের কাছে পৌছে নিহানকে ছাড়িয়েই ছেলেটাকে মারতে লাগল। আকস্মিক ঘটনায় নিহান হতবাক। বোধ হতেই সে হৃদয়কে সরানোর ব্যর্থ প্রয়াসে মন দিলো। কিন্তু হৃদয়কে যত সরানোর চেষ্টা করছে সে তত বেশি হিংস্র হয়ে উঠছে। জোরাজুরির মাঝেই সে নিহানকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলো। নিহান হতবাক। হৃদয় তেঁতে উঠে বলল,

” এজন্য দু’ মাস ধরে তোর কোনো খবর নেই তাই না? বাইরে নাগর জুটিয়েছিস? লজ্জা করে না তোর? এসব করার হলে আমায় জোর করে বিয়ে কেন করেছিলি? আরে এতই আকাঙ্ক্ষা থাকলে বেশ্যা পল্লিতে যায় না। ”

নিহান ভেজা চোখে চারপাশে তাকাচ্ছে। ততক্ষণে রাস্তায় ভীড় জমে গেছে। নূরজাহান আহমেদও জুমাকে নিয়ে হৃদয়ের পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। নিহানের মা ও নোমান পাশেই ছিলো। ভীড় দেখে তারা এগিয়ে এসেই নিহানকে মাটিতে দেখে দ্রুত উঠিয়ে দাঁড় করাল। নিহানের মা তাকে জড়িয়ে দাঁড়িয়ে। হৃদয়ের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে নোমান প্রশ্ন করল,

” কী হয়েছে হৃদয়? ”

হৃদয় চেঁচিয়ে বলল,

” সেটা আপনার বেশ্যা বোনকে জিজ্ঞেস করুন। ”

নোমান এগিয়ে এসেই হৃদয়ের মুখ বরাবর ঘুষি বসিয়ে দিলো। অনবরত মারতে লাগল। নূরজাহান আহমেদ এগিয়ে এসেই তাদের ছাড়াতে চাইছে। অবশেষে নোমানকে থামাতে তার গালে চড় বসিয়ে দিলো। নিহান আঁতকে উঠল। নিহানের মা অবাক হয়ে সবকিছু দেখছে।

” লজ্জা করে না, এরকম একটা নষ্ট মেয়ের জন্য আমার গায়ে হাত তুলতে? অবশ্য করবে কেন! আপনারাই তো গড়েছেন। ”

” কী বলছো এসব হৃদয়? ”
অবাক কন্ঠে নিহানের মায়ের প্রশ্ন।

হৃদয় রাগে রীতিমত কাপছে। কী বলছে তার কোনো জ্ঞান, ধারণা নেই। নূরজাহান আহমেদও তেঁতে উঠে বলল,

” ঠিকই বলছে। ভাবি ছেলে মেয়েদের তুমি মানুষ করতো পারোনি। পারবে কীভাবে? তোমার নিজেরইতল শিক্ষার অভাব। ছোট ঘরের মেয়ে হলে যা হয় আরকি! ”

নোমান ‘ ফুফি ‘ বলে চেঁচিয়ে উঠল। তখনি নিহান চোখ বন্ধ করে ‘ ভাইয়া ‘ বলে শান্তস্বরে ডাকল। নোমান চকিতে ফিরে তাকালো। নোমানে তার কাছে যেতেই সে এখান থেকে চলে যাবার ইশারা করল। নোমান রাগারাগি করতেই নিহান জোর করেই তাকে নিয়ে সামনে পা বাড়াল। পেছন থেকে নূরজাহান আহমেদ বলে উঠলেন,

” যাও নিয়ে তোমার ভাইকে। আর তোমার কুকীর্তি শোনাও। ”

নিহান অস্পষ্ট স্বরে ‘ ধন্যবাদ ‘ উচ্চারণ করেই সামনে এগিয়ে গেল। তার সাথে তার মা ও ভাই। নূরজাহান আহমেদ বিরক্ত মুখে তাদের যাওয়ার পানে তাকিয়ে। সে নিজেও নিহানকে ছেলেটার সাথে দেখেছে। তাছাড়া রিমান্তি আসার পর থেকে তার নিহানের প্রতি এক ধরণের আক্রোশ সৃষ্টি হয়েছিল। মেয়েটা ঘরের কেউ না হয়েও তাকে সব কাজে হাতে হাতে সাহায্য করেছে কিন্তু নিহান ঘরের বউ হয়েও তার কোনো হেলদুলই ছিলো না। তার উপর নিজের ছেলের গায়ে হাত তুলতে দেখেই রাগটা যেন অনায়াসে আষ্কারা পেয়েছে।

নিহানের সাথে থাকা ছেলেটা উঠে দাঁড়াল। ক্ষীণ স্বরে বলল,

” আমি ভুল না হলে, আপনি হৃদয়। আপনাকে শাস্তি দেওয়া উচিত না আপনার প্রতি করুণা দেখানো উচিত আমি বুঝতে পারছি না। তবে আপনি আজকের জন্য জীবনভর আপসোস করবেন। ”

————————–

হৃদয় হকচকিয়ে চোখ খুলল। চোখের কার্ণিশ বেয়ে গড়িয়ে পড়ল তার আপসোস। সে আপসোস করছে, গত পাঁচটা বছর ধরে করছে। এ তার আজন্ম আপসোস।

চলবে,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here