” তুমিময় আমি। ”
“ মার্জিয়া খাঁন নিহা। ”
পর্ব : ১৪।
গাড়ি এগিয়ে চলছে গাড়ির চাকা, পিচঢালা রাস্তার ঘর্ষণে। পদার্থ বিজ্ঞানের ভাষায়, এই ঘর্ষণ বলের প্রভাবেই মানুষসহ সকল প্রাণীর চলাচল সম্ভাব্য করেছে। নিহান বাইরে তাকিয়ে। কুয়াশার তীব্রতায় সূর্যরশ্নি পৃথিবীতে পৌছানোর ঠিক সুযোগ পায়নি। সকালের প্রথম প্রহর। যতদূর চোখ যায় খোলা প্রান্তর, মাঝে কিছু সরিষারবাড়ি। নিহান ফিরে যাচ্ছে। নিহান সাব্বিরকে দেখেই বুঝেছিলো, আবার সে মানুষটার সম্মুখীন হতে চলেছিল। কিন্তু জানা আর মানার মধ্যে বিশাল ফারাক। বরং জানা জিনিসই আমরা সহজে মানতে পারি না। উপরে আজ ধূসর আকাশ। শূন্যে ভাসছে তার রঙিন বিষাদ স্মৃতি।
তখন অষ্টমের শিক্ষার্থী। স্কুল থেকে বনভোজনে চট্টগ্রাম গিয়েছিলো। সেখানেই প্রথম ভালো লাগা। কেউ জানতেও পারেনি, তার অজান্তেই তাকে নিয়ে কেউ নিজের পৃথিবী গড়েছিলো। বয়ঃসন্ধিকালের ভুল অনুভূতি তাকে কালো অধ্যায়ে ডুবিয়ে বাঁচিয়েছিলো তারপর তাকে দেখেছিলো দাদুর মৃত্যুর দিন। তার ভাইদের কাছে মুখ ফুটে চাওয়া একমাত্র খুশি ছিল ঐ মানুষটা। কিন্তু কে জানতো, তার চাওয়া খুশি তার পরিবারের খুশি কেড়ে নেবে! তথাপি আজ বিষণ্ণতার পাল্লাটাই ভারি। দীর্ঘশ্বাসই একমাত্র প্রাপ্তি।
গাড়ির তীব্র ঝাঁকুনিতে কাচের সাথে মাথায় সামান্য আঘাত পেলো। গাড়ির দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করল হৃদয়। ড্রাইভারের সাথে কথা বলে, নিহানের হাত ধরে তাকে বের করেই নিজের গাড়িতে নিয়ে গেল। নিহান হতবিহ্বল। ঘটনার প্রেক্ষিতে সময়ের কাটা অতি নগন্য। গাড়ি ততক্ষণে চলতে শুরু করেছে। হৃদয় তেতে উঠে বলল,
” আবার পালাতে চাইছিলে? আচ্ছা, আমি কতোটা পুড়লে আমার শাস্তি শেষ হবে? ”
” আপনি কে বলুনতো? ”
নিহানের শান্ত গলা।
হৃদয় ছলছল নয়নে তাকিয়ে। পরক্ষণেই দৃষ্টি নত করে বলল,
” আমি কেউ না। ”
” সেটাই। আপনি আমার কেউ না। যাকে তাকে নিয়ে ভেবে আমি আমার সময় নষ্ট করি না। শাস্তিতো অনেক দূরের ব্যাপার। ”
” নিহান আমায় একবার সবকিছু বুঝানোর সুযোগতো দেবে? ”
” বাহ! একরাতেই শুধরে গেছেন। জান থেকে নিহান! ”
” আমি ঐটা বুঝায়নি। ”
” গাড়ি থামাতে বলুন আমি নামব। ”
” আমার কথা শেষ হয়নি। ”
” আমি শুনতে ইচ্ছুক নই। ”
” জেদ করো না জান। নাহয় এরপর যা হবে তার জন্য দায়ী থাকবে তুমি। ”
নিহান হৃদয়ের কথায় কান না দিয়ে চলন্ত গাড়ি থেকে নামার প্রয়াস করল। হৃদয় নিজের পকেটে রাখা রুমালটা নিহানের মুখে চেপে ধরতেই নিহান তার উপর ঢলে পড়ল। সে আগেই জানতো, ‘ শুকনো কথায় চিড়ে ভিজবে না। ‘
——————————
নিহান পিটপিট করে চোখ খুলল। ঝাপসা চোখে চারপাশে নজর দিতেই অপরিচিত জায়গার আভাস পাচ্ছে। অপরিচিত হয়েও খুব পরিচিত। সে বিছানায় বসে আছে। বিছানামুখো পূর্বের দেয়াল জুড়ে তার অজস্র ছোট বড় ছবি। কয়েক মুহুর্তের জন্য ভাবুক হয়ে পড়লেও পরক্ষণে নিজেকে সামলে নিলো।
‘ অন্তরে গরম লোহা দ্বারাকৃত ক্ষত এত সহজে কী দাগ মিটে!
স্মৃতি সব ফেলে এসেছে, তবু রয়ে গেছে ছিঁটে। ‘
কপাট ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করল হৃদয়। হাতে খাবারের প্লেট। নিহানকে বার বার খেতে বলছে সে। কিন্তু নিহানের এক জেদ, সে বাড়ি যাবে। কোনো কথাই সে শুনতে চায় না।
হৃদয় সশব্দে খাবারের প্লেটটা টেবিলে রাখল। তেতে উঠে বলল,
” কীসের বাড়ি হ্যাঁ, আমি তোমাকে জঙ্গলে রেখেছি? ”
” আমি বাড়ি যাব। ”
হৃদয় রেগে টেবিল ল্যাম্পটা ছুড়ে মারল। রেগে নিহানের দিকে তাকিয়ে সশব্দে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল।
নিহান মিয়িয়ে আছে। আজকের ঘটনার পর হৃদয়কে কেন যেন ভয় করছে ওর। বাইরের দৃশ্যপট পাল্টেছে। কিন্তু ভেতরবাড়িকে কে বুঝাবে! নিহান চাইলেই হৃদয়কে বেশি কিছু করতে পারবে না। সবার সাথে সবকিছু করা যায় না। যার প্রতি গভীর ভালোবাসা আসে, ঘৃণা সেখানে স্থান পায় না। রাগ, ঘৃণা ছাড়া কাউকে আঘাত করা দুষ্কর। পাগলামিও সবার সাথে করা যায় না। পাগলামি করতেও অধিকার লাগে। সে অধিকার তার নেই।
সন্ধ্যা হয়ে গেছে। চারপাশের ঝাপসা অন্ধকার তারই জানান দিচ্ছে। হৃদয় ঘরে প্রবেশ করেই দেখল বিছানায় হাত পা গুটিয়ে নিহান ঘুমিয়ে। পাশ থেকেই তার উপর কম্বল টেনে দিয়ে হৃদয় সোফায় বসল। নিহানকে সে বনানীর নিজের ফ্ল্যাটে নিয়ে এসেছে। গত চারবছর যাবত এখানেই থাকছে সে। কয়েকজন ছাড়া তেমন কেউই তার এই ফ্ল্যাটের সন্ধান জানে না। ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে সে বিছানায় নিহানের পাশে কম্বল ভেতরে শুয়ে পড়ল। পাশে কারো উপস্থিতি টের পেয়েই নিহানের ঘুম ছুটে গেল। পাশে হৃদয়কে দেখতে পেয়েই সে উঠে বসল তাড়াহুড়োয়। হৃদয় ভ্রু কুচকে তাকিয়ে পুনরায় চোখ বন্ধ করে রইল। নিহান দ্বিধান্বিত মনে প্রশ্ন করল,
” আমার ফোন কোথায়? ”
” খেয়ে ফেলেছি। ”
” মানে? ”
” আমার অনেক খিদে পেয়েছিলোতো, তাই আমি পানিতে চুবিয়ে ফোনটাকে খেয়ে ফেলেছি। ”
নিহান সরোচ দৃষ্টিতে তাকিয়ে।
” আমি কোথায় এখন? ”
” তোমার বরের বাসায়। ”
” আমার বরের বাসাটা কোথায়? ”
” তোমার বাসায়। ”
নিহান বিরক্ত হয়ে মুখ ফিরিয়ে নিলো। নিজেকে শান্ত করে প্রশ্ন করল,
” আপনি নিজের বাসায় থাকেন না? ”
” তুমিহীনা ঐ বাড়ি কেবলই অট্টালিকা
তোমার পদচিহ্ন, ছুঁতে গেলেই বিভীষিকা। ”
——————————
ভোরের কোয়াশার রেশ কাটেনি। কাচের জানালায় দেখা মিলছে বিন্দু বিন্দু শিশির কণার। কাচের গায়ের বিচ্ছিরি অসুখ। অথচ, কী সুন্দর। জুমা গভীর দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে। সকালে নোমান কল করে তাকে ডেকেছে। সে এসেছে। না এলে মজা মিস।
তখনি কেভিনের দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করল নোমান। বরাদ্দকৃত চেয়ারে বসতেই জুমা ফিরে তাকাল। এলোমেলো চুল, নির্ঘুম চোখ, কুচকে যাওয়া পোশাক। জুমা বাঁকা হেসে প্রশ্ন ছুড়ল,
” আমায় ডাকার কারণ? ”
” কারণটা তোমার অজানা নয়। ”
” আমারতো কোনো কারণ মনে পড়ছে না। ”
” জুমা, নাটক করো না। আমার বোন কোথায়? ”
জুমা অবাক ভঙ্গিতে বলল,
” ও মা! আপনার বোন কোথায় আমি কীভাবে জানব? ”
নোমান দুহাতে নিজের মাথা চেপে ধরল। গতকাল সকাল থেকে নিহান নিরুদ্দেশ। পাগলের মত খুঁজে চলেছে সে। কিন্তু কোনো সন্ধান পায়নি। প্রতি সেকেন্ডে নিজের আত্মা হারাবার ভয় তাকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। আর ধৈর্য ধরে রাখতে পারল না সে। চেঁচিয়ে বলল,
” তুমি জানো, সব জানো। তোমার উশৃংখল ভাই ওকে কোথায় রেখেছে? ”
” মুখের জবানটা একটু ভেবে চিন্তে ব্যবহার করলে বোধহয় ভালো হতো মিঃ। ”
” তুমি আমাকে ব্যবহার শেখাচ্ছ? ”
” ইচ্ছে নেই। তবে আপনি চাইলে শেখাতেই পারি। ”
নোমান নেতিয়ে পড়ল। হতাশ নয়নে ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে। নিজের প্রেয়সী আর বোনের ভালোবাসার মাঝে আটকে তার দম বন্ধ হয়ে আসছে। যে পুতুলটাকে বুকে আগলে বড় করেছে তার কষ্ট কেমন লাগে কাউকে বুঝাতে পারছে না সে। জুমার খারাপ লাগছে। নিহান নোমানের কতোটা জুড়ে তা সে বুঝে। যে ছেলে নিজের বোনের জন্য ভালোবাসা পূর্ণ প্রেয়সীকে ছাড়তে পারে, সে ছেলের কাছে বোন আত্মার ন্যায়। আত্মা ছাড়া দেহ চলে না। কিন্তু সে নিজেও অসহায়। নোমান আকুতিপূর্ণ কন্ঠে বলে উঠল,
” জুমা প্লিজ বলোনা আমার বাচ্চাটা কোথায়? ও বেশিক্ষণ একা থাকতে পারে না। অন্ধকারে ওর ভীষণ ভয়। ”
” আপনার ভাষ্যমতে, গত পাঁচটা বছর একাই ছিলো বোধহয়। ”
” যা বুঝ না তা নিয়ে কথা বলো না। ”
” আমি বুঝতেও চাই না। ”
” বুঝতে হবে না। তুমি শুধু বলো, আমার বোনকে কোথায় রেখেছে? ”
” আমি জানি না। ”
” আমি বিশ্বাস করি না। ”
” আপনার এই বিশ্বাস নিয়ে আমি কী করি বলুনতো? ”
চলবে,