” তুমিময় আমি। ”
“ মার্জিয়া খাঁন নিহা। ”
পর্ব : ১৩।
দক্ষিণা বাতাস বইছে। তীব্র শীতের মৌসুমে সাধারণ উত্তরে বাতাস বয়। কিন্তু আজ প্রকৃতি বিপরীত ব্যবহার করছে। এলোমেলো বাতাস। হৃদয় দু’হাত মেলে নদের তীরে দাঁড়িয়ে। চোখজোড়া বন্ধ। কানের ভেতর হু হু করে বাতাস প্রবেশ করছে। জ্যাকেট ভেদ করে বাতাস শরীর হীম করে দিচ্ছে। কিন্তু মুখে তার তৃপ্তির হাসি। সাব্বিররা একটু দূরেই পাথরের উপরে দাঁড়িয়ে। খানিকবাদেই সাফিন ছুটে এসে পাশে দাঁড়াল।
চোখে বিস্ময় ফুটিয়ে বলল,
” শীত লাগছে না তোর? ”
” না, ভালো লাগছে। এই বাতাস যখন এসে আমায় ছুঁয়ে যায়, আমি তাকে অনুভব করতে পারি। মনে হয়ে এ অবাধ্য বায়ু তার বার্তা নিয়ে এসেছে। ”
« তুমি আমার এলোমেলো
দক্ষিণা বাতাস
তুমি আমার বিশ্বাস
নীলচে আকাশ। »
হঠাৎ সাব্বিরের চিৎকার কানে আসতেই দুজনে চমকে উঠলো। দ্রুত পায়ে ওদের কাছে পৌছাল।
সাব্বির পাথরের ফাঁকে পড়ে ব্যথা পেয়েছে। বেশ ভালোই লেগেছে। তেমন গুরুতর কিছু না হলেও জরুরি চিকিৎসা প্রয়োজন। নাহয় ইনফেকশনের ভয় আছে। হৃদয় সবাইকে সব গুছিয়ে নিতে বলল। এখান থেকে ফিরে যাবে। যাওয়ার পথে সাব্বিরকে ডাক্তার দেখিয়ে নেবে। এখান থেকে হাসপাতাল বেশ দূরে। সাফিন বাঁধা দিয়ে বলল,
” এখান থেকে হাসপাতাল যাওয়া সময়ের ব্যাপার। তাছাড়া সবকিছু গুছিয়ে নিতেও বেশ সময়ের প্রয়োজন। পাশেই একটা মেডিক্যাল ক্যাম্প এসেছে শুনলাম। যেহেতু গুরুতর কিছু না, আপাতত সেখানেই নিয়ে যাই? ”
সাফিনের কথায় সবাই সম্মতি প্রদান করল। হৃদয় সবাইকে ব্যাগ- পত্র গুছাতে বলে সাব্বিরকে নিয়ে মেডিক্যাল ক্যাম্পের দিকে পা বাড়াল।
——————————-
সকাল থেকেই নিহান বেশ ব্যস্ত। এই ক্যাম্পের তত্ত্বাবধানে ছিলো নোবাইদ। সে আসতে পারেনি বলে সবটা তাকে একা সামলাতে হচ্ছে। নিহান সবকিছু ঠিকঠাক আছে কি না দেখছিলো। তখনি ডঃ আবির এসে দাঁড়ায়।
” ডঃ নিহাতুল আপনার আরাম করা প্রয়োজন। সকালে নাস্তাও করেননি। ”
” আপনাকে আমায় নিয়ে ভাবতে কে বলল? ”
” আপনাকে নিয়ে যে ভাবতেই হবে। আপনি সকলের ভাবনায় অকারণে বিচরণ করা মানুষ। ”
” পরেরবার থেকে আর ভাববেন না। অকারণে আমি কারো ভাবনায় থাকতেও পছন্দ করি না। ”
নিহান খেমটা মেড়ে চলে গেল। ডঃ আবির বুকে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে। পাশ থেকে একজন মেডিক্যাল স্টুডেন্ট দেখতে পেয়ে বলল,
” কোনো সমস্যা ডাঃ আবির? ”
” অনেক সমস্যা। তার চোখ, চুল, চিবুক, হাসি সব সমস্যা। তার চোখ আমায় ডুবিয়ে ফেলে, হাসি মুগ্ধতার মোহজালে বন্ধি করে রাখে, তার তিক্ত কথার বান প্রতিনিয়ত ক্ষত-বিক্ষত করে। কিন্তু সে কি আদৌ কখনো বুঝবে? ”
” কীসব বলছেন ডাঃ আবির? ”
ডাঃ আবির চকিতেই ফিরে তাকালেন। নিজেকে কিছুটা স্বাভাবিক করে বলল,
” কিছু না। আপনি আপনার কাজে যান। ”
তার যাওয়ার অপেক্ষা না করেও তিনি নিজেই দ্রুত পায়ে সামনে অগ্রসর হলেন।
তাবুর ভেতরে সাব্বিরকে বসিয়ে হৃদয় বাইরে দাঁড়িয়ে। তার অস্বস্তি হচ্ছে ভীষণ। মুক্ত বায়ু প্রয়োজন। নিঃশ্বাস যেন বুকে এসে আটকে ফিরে যাচ্ছে। কেমন চেনা চেনা গন্ধ পাচ্ছে চারিপাশে। কিন্তু এই গন্ধে তার অস্থিরতা বাড়ছে বৈ কমছে না।
সাব্বির চেয়ারে বসে। পায়ে চিনচিনে ব্যথা। ডাক্তারের অপেক্ষায় চারপাশে চোখ বুলাচ্ছে। ডাক্তারকে ভেতর প্রবেশ করতে দেখেই চমকে উঠলো। নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে। বার বার মনে হচ্ছে সেও হৃদয়ের মত পাগল হয়ে গেছে। তাই ভ্রম হচ্ছে। মানুষটাকে সে সামনাসামনি একবারই দেখেছিলো। কিন্তু তার কল্পনা জল্পনাকে মিথ্যে করে দিয়ে ডাক্তার নিজেই বলে উঠলো,
” কেমন আছেন সাব্বির ভাই? ”
সাব্বির বোকার মত তাকিয়ে। অস্পষ্ট স্বরে উচ্চারণ করল,
” ভাবী! ”
কিন্তু সেই অস্পষ্ট কথা ঠিকই কারো শ্রবণ ইন্দ্রিয় ভেদ করে মস্তিষ্কে পৌছে গেছে। ব্যক্তিটি হাসি মুখে বলল,
” ডাঃ নিহাতুল। চাইলে নিহানও ডাকতে পারেন। তবে তার বাইরে কিছু নয়। ”
সাব্বির অবাক। বুঝতে অসুবিধে হয়নি পুরনো ক্ষত এখনো তাজা। কিছু বলতে চেয়ে বলতে পারল না। বিপরীত পাশের ব্যক্তির গাম্ভীর্য, তার কন্ঠ রোধ করে দিয়েছে। সাব্বিরের পায়ে ব্যান্ডেজ করে, কিছু ঔষধ দিয়ে নিহান অন্য রোগীদের নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। সাব্বির তাড়াহুড়ো করে তাবুর বাইরে এলো। হাঁটতে তার অসুবিধা হচ্ছে। কিন্তু এ খুশির কাছে এ ব্যথা যেন তুচ্ছ। মনে হচ্ছে অনেক বড় কোনো বিজয় তার প্রাপ্তিতে যোগ হয়েছে। বন্ধুত্ব বোধহয় এমনি। কোনো রক্তের সম্পর্ক ছাড়া, আত্মার টানে একে অপরের দুঃখ সুখ সব অনুভব করে, ভাগাভাগি করে নিতে জানে।
হৃদয় তখনো দাঁড়িয়ে। সাব্বির এসে ডাকতেই, হৃদয় তাকে নিয়ে সামনে অগ্রসর হলো। এখানে তার ভালো লাগছে না। সবকিছুতে দমবন্ধকর অনুভূতি। হয়তো আবহাওয়াটাই এমন। কিন্তু সাব্বির বাঁধা দিলো।
” তুই তাবুর ভেতরে যা। ”
সাব্বিরের উৎফুল্ল কন্ঠ।
হৃদয় প্রথমে ঠিক বুঝতে পারল না। ভ্রু কুচকে সাব্বিরের দিকে তাকিয়ে। সাব্বির তাড়াহুড়ো করে বলল,
” তুই তাড়াতাড়ি তাবুর ভেতরে চল। ”
হৃদয় অবাক হয়ে প্রশ্ন করল,
” আমি তাবুর ভেতরে কেন যাব? ”
” ভাবী আছে ভেতরে, তুই চল। ”
হৃদয় কিছু বুঝতে পারল না। সাব্বির একপ্রকার জোর করেই তাকে ভেতরে নিয়ে গেল। ভেতরে প্রবেশ করেই তার হৃদযন্ত্র ঠক করে উঠলো। নিহান ফাইল দেখছিলো। কারো উপস্থিতি টের পেয়ে বলল,
” বলুন, কী সমস্যা? ”
চোখ তখনো ফাইলের উপর।
হৃদয় কিছু বলতে পারল না। সারা শরীর থরথর করে কাঁপছে। হাঁটুর নিচ থেকে পা অবধি অবশ মনে হচ্ছে। অনেক চেষ্টা করেও গলা দিয়ে কোনো শব্দ বের করতে পারলো না। মনে হচ্ছে গলায় কিছু আটকে। ধপ করে সে পাশের চেয়ারে বসে পড়ল। তার প্রচন্ড তেষ্টা পাচ্ছে। ঢুক গিলে গলা ভেজানোর ব্যর্থ প্রয়াস করল। কিছুর আওয়াজ পেয়ে নিহান চোখ তুলে তাকাল। পরক্ষণেই চোখ নামিয়ে নিজের কাজে মন দিলো। যেন অস্বাভাবিক কিছুই হয়নি। সবই তার অবগত। স্বাভাবিক কন্ঠে বলল,
” কিছু বলার না থাকলে আসতে পারেন। আমি ব্যস্ত। ”
হৃদয় কাতর নয়নে তাকিয়ে। নিজেকে প্রাণহীন মনে হচ্ছে। হাত বাড়িয়ে নিহানের হাত ধরতে গিয়েও ধরল না। যদি প্রতিবারের মত এবারো স্বপ্ন হয়। ছুঁয়ে দিলেই হারিয়ে যায়। গলার তৃষ্ণাটা বেড়েই চলেছে। কাঁপা কন্ঠে হালকা আওয়াজ তুলে বলল,
” একটু পানি পাওয়া যাবে? ”
নিহান ভ্রু কুচকে তাকিয়ে। পরক্ষণেই নিজের পানির বোতলটা এগিয়ে দিলো। হৃদয় ঢকঢক করে পানি পান করে কিছুটা স্থির হয়ে বসল। নিহান তাকে পর্যবেক্ষণ করে উঠে দাঁড়াল। হৃদয় চমকে উঠল। দ্রুত পায়ে নিহানের সামনে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরল। নিহান হতভম্ব।
” প্লিজ কোথাও যেন না। বিশ্বাস করো, তোমায় ছাড়া থাকতে আমার ভীষণ কষ্ট হয়। হাসফাস লাগে। দম বন্ধ হয়ে আসে। তুমিহীনা আমি নিজেকে খুঁজে পাই না। ”
নিহান নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো। শান্তস্বরে বলল,
” বিহেভ ইউর সেল্ফ মিঃ। একজন ক্রিকেটারকে কখনোই এমন অশোভন আচরণ মানায় না। ”
হৃদয় স্থির দৃষ্টিতে নিহানের দিকে তাকিয়ে। চেহারা স্বাভাবিক। তাকে দেখে মোটেও বিচলিত মনে হচ্ছে না। হৃদয় কন্ঠে আকুলতা ফুটিয়ে বলল,
” আমি তোমায় সবকিছু ব্যাখ্যা করছি। তুমি রাগ করে আছো তাই না? তুমি বসো, আমার কথা শুনো। ”
” আমি ব্যস্ত আছি। আপনার কিছু বলার হলে পরে আসবেন। ”
” নিহান আমার কথা শুনো প্লিজ। ”
হাত বাড়িয়ে নিহান তাকে থামিয়ে দিলো। শান্ত কন্ঠে বলল,
” চার পাঁজরের বেষ্টনীর গভীরে লুকিয়ে রাখা ভালোবাসা, বুকের বা পাশের চিনচিনে ব্যথা, চোখের অজস্র সংলাপ, ওষ্ঠের ব্যক্ত- অব্যক্ত অনুভূতি, রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রেমের গন্ধ। আদরের চাদরে মোড়ানো এক সত্তা। এত কিছুর পরেও আমি আপনার বা পাজরের হার হওয়ার অনুমতি পাইনি। এরপর আর শোনার কিছু থাকে? ”
হৃদয় ব্যাকুল কন্ঠে বলল,
” জান এক ভুল সবারই মাফ হয়। একবার সবটা শুনো। তোমায় সবটা বুঝিয়ে বলছি। ”
” বের হওয়ার দরজাটা ডানদিকে মিঃ। ”
হৃদয় হতাশ হলো। তাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে নিহান নিজেই বেরিয়ে গেল। সে নিজেও ধীর পায়ে বেরিয়ে এলো। সাব্বির বেরিয়ে এসেছিলো বহু পূর্বেই। হৃদয় বাইরে আসতেই তাকে জড়িয়ে ধরল।
” ভাই, তোর সব অপেক্ষার অবসান হয়েছে। তোর বিশ্বাস হারেনি। ”
” ও কিছুই ভুলেনি সাব্বির। ”
সাব্বির অবাক হলো। খানিকটা সে প্রথমেই আঁচ করতে পেরেছিলো। ভাবুক হয়ে প্রশ্ন করল,
” তো, এখন? ”
” আমার হয়তো তাকে আজীবন দূর থেকেই ভালোবাসতে হবে। তার কাছে যাওয়ার অধিকারটা সে কেড়ে নিয়েছে কিংবা আমি হারিয়ে ফেলেছি। ”
চলবে,