” তুমিময় আমি। ”
“ মার্জিয়া খাঁন নিহা। ”
পর্ব : ১২।
সময়ের কাটা নিজের গতিপথ পরিবর্তন করছে। সেকেন্ড থেকে মিনিট, মিনিট থেকে ঘন্টা, ঘন্টা থেকে প্রহর। দীর্ঘশ্বাসের এক রজনি শেষে দেখা মিলেছে নতুন দিবসের। সময়ের কাটার গতিপথ একই থাকে, মানুষ নিজের কর্ম, ভাগ্যরেখার উপর নির্ভর করে সময়ের নাম রাখে ভালো কিংবা খারাপ। পাথরের ওপারে স্বচ্ছ জল, জলের উপর ধোঁয়াটে কুয়াশা। কুয়াশার চাদর ভেদ করে রাবার গাছের উপর দিয়ে উঁকি দিচ্ছে দিনমণি।
মেডিক্যাল ব্যানার ঝুলানো একটা বাস এসে থামল চিত্রানদ থেকে খানিকটা দূরে। ব্যানারে বড় বড় অক্ষরে লিখা, ‘ মিডল্যান্ড হাসপাতাল প্রাঃ লিঃ ‘। সবাই এক এক করে নেমে গেল। নদের থেকে খানিকটা দূরে বিস্তর মাঠ জুড়ে মেডিক্যাল ক্যাম্পের আয়োজন করা হয়েছে। মিডল্যান্ড হাসপাতালের কিছু মেধাবী শিক্ষার্থী এবং বিদেশ থেকে আগত কয়েকজনকে নিয়ে আয়োজিত হয়েছে এই ক্যাম্প। পাশে তাবুতে হয়েছে থাকার আয়োজন। সকলে নেমে দাঁড়াতেই মেডিক্যালের সিনিয়র প্রফেসর আশরাফ চৌধুরী সকলের নাম উল্লেখ করে চেক করছেন সবাই উপস্থিত কি না! হঠাৎই উনি ‘ নিহাতুল ‘ বলে ডেকে উঠলেন। কিন্তু কেউ সাড়া দিলেন না। উনি দ্বিতীয় বার ‘ নিহাতুল ‘ বলে ডেকে ওঠলেন। সাথে সাথে প্রতিউত্তরে ভেসে এলো এক সুমিষ্ট কন্ঠস্বর,
” এক্সিস্ত স্যার। ”
সকলেই একনজর ফিরে তাকাল। কালো সোয়েটার টপসের সাথে জিন্স, পায়ে সাদা জুতো, সোয়েটারের উপর সাদা এপ্রোন। খোলা চুলের এক হাস্যোজ্জ্বল তরুণি দাড়ানো সবার পেছনে। আশরাফ চৌধুরীর ডাকে সবাই আবার কাজে মনোযোগ দিলো। সবাইকে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে আরাম করতে বলে তিনি নিজের তাবুতে চলে গেলেন। এক এক করে সবাই চলে গেল তাদের জন্য নির্ধারিত তাবুতে। নিহাতুল নিজের তাবুতে নিজের জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখছিলো, এমন সময় তাবুতে প্রবেশ করে ডাঃ আবির।
” অবশেষে তুমি এসেছো! আমিতো চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম। কোথায় ছিলে তুমি? ”
” আমি মুক্ত পাখি
যেখানে সেখানে থাকি
ডানা ঝাপটানোর ভয় নেই। ”
” ডঃ নিহাতুল বি সিরিয়াস। আপনিতো এমন নন। আজকে অলমোস্ট আপনি দেরি করে ফেলেছিলেন৷ আর আপনারতো আমাদের সাথে বাসে আসার কথা ছিলো। ”
” কথা থাকলেই কথা রাখতে হবে এমনতো নয়। তাছাড়া ব্যাখ্যা জিনিসটা আমার খুব একটা পছন্দের নয়।
আমি কীভাবে এসেছি সেটা নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে, এসেছি কি না তা দেখুন। ”
” আমি জানতে চাইছিলাম। চিন্তা হচ্ছিল। ”
” আপনার জানা শেষ হলে আপনি আসতে পারেন ডঃ আবির। ”
ডঃ আবির কিছু বলতে চেয়েও বললেন না। নিঃশব্দে বেরিয়ে এলেন। কথা শুরু করার পূর্বেই মেয়েটা সমাপ্তি টেনে নেয়। আর কথার বান তীরের মতোই এসে বিঁধে। মাঝে মাঝে তার মনে হয় মেয়েটা কোনোদিন কোনো মিষ্টির সংস্পর্শে আসেনি। তথাপি মুখ এত তিক্ত। বমির করার পর মুখের স্বাদ যেমন বিদঘুটে তেমনি মেয়েটার কথার ধাচ। কিন্তু অকারণে এই তিক্ত কথাগুলো তার হজম করতে ভালো লাগে। বার বার চলে আসে মেয়েটার বিরক্তিমাখা মুখ আর কথার টানে। সামান্য ঠোঁট প্রসারিত করে তিনি নিজের তাবুতে ফিরে গেলেন।
—————————
হৃদয় ঘড়িটা বুকে আগলেই চুপচাপ শুয়ে আছে তাবুর ভেতরে। হৃদয়কে বাইরে দেখতে না পেয়ে সাব্বির ডাকতে এলো।
” এখনো শুয়ে আছিস? ফ্রেশ হয়ে আয়। সবাই নাস্তা করছে৷ ”
” তুই যা আমার ভালো লাগছে না। ”
হৃদয়ের শান্ত কন্ঠস্বর।
সাব্বির তেতে উঠে বলল,
” শালা, তোর ভালো কবে লাগে? ”
” আমার ভালোথাকা তার সাথেই হারিয়েছে। ওর আমার জীবনে আসা আমার কাছে নতুন ভোরের মত ছিলো। কাল রাত অতিক্রম করে পাওয়া সেই সোনালি সকাল। ওর হারিয়ে যাওয়া আমার অস্তিতের খুন। এখন আমি বেঁচে তো আছি কিন্তু আমার আমিটা নেই। নিঃশ্বাস তো চলে কিন্তু হৃদযন্ত্র নয়। ”
” তুই দেবদাস হয়েই বসে থাক। এটাই তোকে সুট করে। ”
” ভুল বললি। আমি দেবদাস নই। দেবদাস জানতো তার পারু বিবাহিত। দূরে গিয়েও তার আছে। কিন্তু আমি? আমি কিছুই জানি না। ”
” তারপরেও কীসের আশায় অপেক্ষা তোর? ”
” জানি না। শুধু জানি এই অপেক্ষাই আমায় বাঁচিয়ে রাখছে। আমি নিজেকে বাঁচিয়ে রাখছি ওর জন্য। ও যদি কখনো এসে বলে, ‘ আমার মানুষটাকে আমায় দিয়ে দাও। ‘ তখন যদি আমি দিতে না পারি? সে ভয়ে আমি বাঁচি। ”
সাব্বির কিছু বলার মত খুঁজে পেল না। দীর্ঘশ্বাসের ঠোঁট প্রসারিত করে বলল,
” আচ্ছা ঠিক আছে। চল এখন বাইরে যাই। সবাই বাইরে আড্ডা দিচ্ছে। ”
” তুই যা আমি আসছি। ”
” তাড়াতাড়ি আয়। ”
সাব্বির বেরিয়ে গেল। হৃদয়ও হালকা হেসে ফ্রেশ হয়ে বাইরে বেরিয়ে এলো। সাথে গিটার। তাবুর বাইরে সবাই গোল হয়ে বসে আছে। চারদিকে ঘন কুয়াশা। মিটিমিটি রোদ। মাঝখানে কাঠ জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। সবাই আড্ডা দিচ্ছে মজা করছে। সাতজনের একটা দল। স্কুল, কলেজের গন্ডি একসাথেই পাড়ি দিয়েছে সবাই। বন্ধুত্বটা বেশ পুরনো বলেই হয়তো কেউ কারো কথা উপেক্ষা করতে পারে না। হৃদয় বাইরে এসে বসতেই, অভি চেঁচিয়ে বলল,
” হৃদয় গান ধর। পরিবেশ কেমন গুমোট হয়ে আছে। ”
শুভ হালকা থাপ্পড় মেরে বলল,
” এই রোমাঞ্চকর পরিবেশ তোর গুমোট কেন মনে হচ্ছে? প্রেমিকার অভাবে? ”
সাফিন জিভ কেটে বলল,
” ভালো কথা মনে করেছিস। আমার আনিসাকে শুভ সকাল জানানো হয়নি। রেগে গেছে নিশ্চয়ই। তোরা থাক আমি আসি। ”
শান্ত রেগে বলল,
” ঘুরতে এসেও তোর প্রেমিকার প্যানপ্যানানি বন্ধ হয় না। ঘুরতে এসেছিস, নিজের মত থাকবি। তা না করে এখানেও প্রেমিকা টেনে নিয়ে আসছে। ”
সাফিন আর গেল না। ফোঁড়ন কেটে বলল,
” বাদ দে। হৃদয় তুই গান ধর। ”
হৃদয় হালকা হেসে গিটারে টুংটাং শব্দ তোলায় মন দিলো। গম্ভীর আওয়াজে গাইতে লাগল,
“”ওআল্লাহ আমার কত করেছি যে আরজি
বুঝিনা তোমার কি যে মর্জি
দ্বিন ভালোবাসা ওগো দাওনা ফিরিয়ে
বলো তাকে ছাড়া বাঁচবো কি নিয়ে
ঘরে ফিরবেই একদিন যদি
প্রেম বুঝলে সে খোঁজবে দরদী
দাওনা তাকে ফিরিয়ে একটিবার
জানি আকাশ পায় না ছুঁতে মাটি
তবু মনতো মানে না তাই হাঁটি
যদি পথের ধারে পেয়ে যাই দেখা তার।
ও আল্লাহ আমার কত করেছি যে আরজি
বুঝিনা তোমার কি যে মর্জি
দিন ভালোবাসা ওগো দাওনা ফিরিয়ে
বল তাকে ছাড়া বাঁচবো কি নিয়ে।
মেঘলা দিনে আকাশ জুড়ে দাওবি
মনরে সামলে তাকাস পুড়ে যাবি
না পুড়লে কিসের ভালোবাসা
ভাঙে মন তবু ভাঙে না যে আশা
সে ছাড়া আর কেউ নেই যে আমার
জানি আকাশ পায়না ছুঁতে মাটি
তবু মনতো মানে না তাই হাঁটি
যদি পথের ধারে পেয়ে যাই দেখা তার
ও আল্লাহ আমার কত করেছি যে আরজি
বুঝিনা তোমার কি যে মর্জি
দিন ভালোবাসা ওগো দাওনা ফিরিয়ে
বল তাকে ছাড়া বাঁচবো কি নিয়ে।”
হৃদয় নিচের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে। সবাই ধম মেরে বসে আছে। সবাইর এখন খারাপ লাগছে। হৃদয়কে গান গাইতে বলা হয়তো তাদের উচিত হয়নি। পরিবেশ ঠিক করতে সাফিন বলল,
” এবার সায়ান গাইবে। ”
সায়ান আড়মোড়া ভেঙে উঠে দাঁড়াল। সাফিন অবাক হয়ে প্রশ্ন করল,
” কোথায় যাচ্ছিস? ”
” পালিয়ে যাচ্ছি শালা।
পরক্ষণেই শান্তস্বরে বলল,
গিটার নিয়ে আসি। ”
” হৃদয়ের হাতে তো গিটার আছে ঐ টা নে। ”
শুভের কথা শুনে সবাই ভ্রু কুচকে তার দিকে তাকালো।
” কী হলো সবাই আমার দিকে এইভাবে তাকিয়ে আছিস কেন মনে হচ্ছে আমি কোন ভিন গ্রহের এলিয়েন। ”
” তুই এলিয়েনের চেয়ে কম কী! ”
” তোরা সব কয়টা মনে হয় ধোঁয়া তুলসি পাতা।
যাইহোক হৃদয় গিটারটা দে তো? ”
হৃদয় চমকে উঠে বলল,
” সরি এই গিটারটা দেওয়া যাবে না। ”
” কেন?দে তো। ”
শুভ জোর করে গিটারটা ধরতে যাচ্ছিল রিদয় গিটারটাকে আড়াল করে রাখল।
“বললাম তো দেওয়া যাবে না। ”
ক্ষানিকটা রেগে।
” গিটার নিয়ে এমন করছিস কেন? মনে হচ্ছে তোর বউ চাইছি। ”
” বউই চাইছিস। কারণ এটা ভাবীর গিফট করা। ”
শুভ থেমে গেল। এইটা সে জানতো না। জানলে অবশ্যই চাইতো না। হৃদয় ততক্ষণে উঠে দাঁড়িয়েছে। আড্ডা ছেড়ে বেশ কিছুটা দূরে তার অবস্থান। সাময়িক প্রেক্ষিতে মন্তব্য করা সহজ। কিন্তু যার উপর মন্তব্য করা হচ্ছে সে জানে, এইসব মন্তব্য হজম করতে তাকে কত ক্যালরি শক্তি খরচ করতে হয়। পরিস্থিতি বুঝানো বোধহয় পৃথিবীর নিষ্ঠুর কাজের অন্যতম।
চলবে,