” তুমিময় আমি। ”
” মার্জিয়া খাঁন নিহা। ”
পর্ব : ১।
উৎসুবমুখর পরিবেশ। কৃত্রিম রঙিন আলোর সাথে যোগ দিয়েছে এক ফালি চিকন চাঁদ।একহাতে লেহেঙ্গা সামলিয়ে বেশ কষ্টে ছাদের দিকে যাচ্ছে জান। এই লেহেঙ্গা নামক বস্তা তার গায়ে জড়ানোর কোনো শখ ছিলো না। কিন্তু ফুফি দিয়েছে, তাই মুখের উপর বারণ করতে পারেনি। উপরের সিঁড়িতে আসতেই পথ আগলে দাঁড়াল হৃদয়। জান চোখ মুখ কুচকে বিরক্তমাখা গলায় বলে উঠল,
” কী সমস্যা? চোখের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন কেন? ”
” মানুষতো চোখের সামনেই দাঁড়ায়, পেছনে দাঁড়ায় বলেতো আমি জানি না। ”
” আপনাকে জানতে হবে না। যার খুশি তার চোখের সামনে গিয়ে দাঁড়ান, কিন্তু আমার চোখের সামনে কেন? ”
” কেন তোমার চোখের সামনে দাঁড়ানোর নিষেধাজ্ঞা আছে নাকি? ”
জান বিরক্তিতে চুপ করে গেল। হৃদয়কে পাশ কাটিয়ে ছাদের দিকে পা বাড়াল। কিন্তু তার আগেই হৃদয় জানের হাত টেনে নিজের সামনে দাঁড় করিয়ে দিল। গভীর মনোযোগ দিয়ে জানকে পর্যবেক্ষণ করে বলে উঠল,
” খোলা চুল, কোমড়ে বিছা, মাথায় টিকলি, ঠোঁটে লিপস্টিক, চোখে গাঢ় কাজল, মুখে ভারি মেকআপ। এত সাজ কার জন্য? আমার? ”
” আপনার জন্য সাজতে আমার বয়েই গেছে। ”
মুখ বাঁকিয়ে জানের জবাব।
হৃদয় তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে জানের দিকে তাকাল।
” তো কি অন্য ছেলেদের নিজের প্রতি আকর্ষণ করার জন্য? ”
জান বিরক্তিতে নাক কুচকে, চোখ বন্ধ করে লম্বা শ্বাস টেনে নিলো। জোর করে হৃদয়ের হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে বলল,
” আপনার সাথে কথা বলাই বেকার। ”
বড় বড় পা ফেলে জান ছাদে চলে গেল। জানের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে হৃদয় দুষ্টু হাসল। জানকে নকল করে নিজেও বলে উঠল,
” আপনার সাথে কথা বলাই বেকার। ”
ছাদে জুঁইয়ের পাশে বসে আছে জান। বসছে কম, ছটফট করছে বেশি। জুঁইয়ের গায়ের হলুদ আজ। বাসায় মেহমানে গিজগিজ করছে। ছাদে হলুদের আয়োজন করা হয়েছে। রঙিন বাতির আলোয় চারপাশও রঙিন হয়ে উঠেছে। ফুলের গন্ধে মৌ মৌ। আকাশে বেশ কয়েকটা রঙিন ফানুস। জান ছটফট করছে লেহেঙ্গা পাল্টে সাজ মুছে ফেলার জন্য। এসবে সে অভ্যস্ত নয়। জুঁই চোখ রাঙিয়ে পাশে বসিয়ে রেখেছে। আশেপাশে সবাই ব্যস্ত। জুঁইকে হলুদ দেওয়া শেষে বড়রা নিচে নেমে গেলো। ছোটরা নাচ, গান নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। হৃদয় একটু পর পরই জানকে খোঁচাচ্ছে। জান বিরক্ত হয়ে মুখ ফুলাচ্ছে আবার কখনো মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে।
প্রায় রাত ২টা। কিন্তু অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার নামই নিচ্ছে না। জান ঘুমে ঢুলছে। রাত জাগার অভ্যাস তার একদমই নেই। জান চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে নিলো। না, হৃদয়কে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। জান জুঁইয়ের একহাত জড়িয়ে কাঁধে মাথা রাখল।
” আপ্পি ঘুম পাচ্ছে। ”
” যা নিচে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়। ”
” কোথায় ঘুমোব? সব ঘরেই তো মেহমান। ”
জুঁই কিছুক্ষণ ভেবে জবাব দিলো,
” তুই বরং হৃদয়ে ঘরে চলে যা আজ। ও ঘরে একাই আছে মনে হয়। ”
” প্রয়োজন নেই। আমি বরং তোমার ঘরে তোমার সাথে শুয়ে পড়ব। ”
” আমি আজ আমার বান্ধবীদের সাথে থাকব। আর কবে দেখা হয়, না হয়। ”
” সে তোমরা এসে আমায় তুলে দিও। আমি এখন যাই। ”
” আমরা তো এখুনি যাব। অনুষ্ঠান চলুক। আমি অনেক ক্লান্ত। তোর জিজুর সাথে কথা বলেই আমি আসছি। ”
” তাহলে আমিও তোমাদের সাথে থাকব। ”
” জান, প্লিজ বুঝার চেষ্টা কর। আমরা বান্ধবীরা কত কথা বলব। তুই থাকলেতো আমার কথা বলতে খারাপ লাগবে। শত হলেও ছোট বোন। ”
” এটা ঠিক না, আপ্পি। আমায় পর করে দিচ্ছো। ”
” প্লিজ যা, শুয়ে পড়। চল, আমি তোকে পৌছে দিয়ে আসি। ”
বাধ্য হয়েই জান জুঁইয়ের সাথে নিচে গেল। তার এখন ঘুমানো প্রয়োজন, সেটা পাতালেই হোক না কেন। হৃদয়ের ঘরের সামনে এসে দাঁড়িয়ে আছে দুজনেই। দরজা হালকা ভেজানো। জান একবার জুঁইয়ের দিকে তাকিয়ে দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করল। জান ঘরে প্রবেশ করেই দেখলো সারা ঘর অন্ধকার। হৃদয় সচরাচর ঘর অন্ধকার করে ঘুমোয় না বলেই জান জানে। কিন্তু আজ হঠাৎ অন্ধকার কেন বুঝতে পারছে না। হয়তো বাইরে অনেক শোরগোল তাই। হিম আবহাওয়ায় গা ছমছমে ভাব। ভূতুড়ে ভূতুড়ে লাগছে সব। জানের কেমন অস্বস্তি হচ্ছে। তার উপর হৃদয় জানতে পারলে এটা নিয়ে আবার যাত্রা সাজিয়ে বসবে। এসব ভেবে আরো অস্থির লাগছে। কোনোরকম ফোনের ফ্লাশ টা অন করে সামনের দিকে এগিয়ে গেল। বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে টেবিল ল্যাম্পটা অন করল। বিছানার উপর নাকে মুখে কম্বল মুড়ে ঘুমোচ্ছে হৃদয়। জান একবার বিছানার দিকে তাকিয়ে সোফার দিকে তাকালো।সাবধানে গুটি গুটি পা ফেলে এগিয়ে গেলে সোফার দিকে। সোফা গিয়ে কোনোরকম শুয়ে পড়ল। সকালে হৃদয় জাগার আগে সে এ ঘর থেকে বিদায় নিতে পারলেই বাঁচে। কিন্তু কিছুতেই ঘুমোতে পারছে না। বিছানা জুড়ে ঘুমোনোর অভ্যাস তার। তাছাড়া গায়ে এখনো ভারি লেহেঙ্গা। এটা পড়ে কিছুতেই ঘুমানো যাবে না। রোদ উঠে বসে দরজার দিকে পা বাড়াল। ঘরে গিয়ে চেঞ্জ করতে হবে। কিন্তু দরজায় হাত দিতেই বুঝতে পারল, দরজা বাইরে থেকে বন্ধ। জান ফুস করে নিঃশ্বাস ছাড়ল। আজ তার কপালটাই খারাপ। কী মনে করে আলমারির সামনে গেল। আলমারি ঘেটে নিজের টি- টি-শার্ট আর প্লাজু আলমারির ভেতর পেয়ে ভ্রু কুচকে এলো। ঘুমের কারণে এসব পাত্তা দিলো না। ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে এসে চুপচাপ খাটে কম্বল মুড়ে শুয়ে পড়ল। হৃদয়ের ঘরে থাকার কথা বেমালুম ভুলে গেল।
কিছুক্ষণ পর হৃদয় অনুভব করল বিড়াল ছানার মতো তুলতুলে কিছু তার ওপর ওঠে তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছে। হৃদয় ঠাস করে তাকে বিছানায় ফেলে ওঠে বসল। জানও হুড়মুড় করে ওঠে বসল। হঠাৎ ঘুম ভাঙায় কিছুই তার বোধগম্য হচ্ছে না। সমস্ত শরীর ঝিম ধরে আছে। মাথার ভেতর কেমন ফাঁকা ফাঁকা। সে প্রশ্নবিদ্ধ নয়নে হৃদয়ের দিকে তাকিয়ে। আবছা আলোয় হৃদয়ের বুঝতে অসুবিধা হলো না এটা জান। সে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করল,
” তুমি আমার ঘরে কি করছো? ”
জান ঘুমের কারণে ঠিকঠাক চোখ খুলে রাখতে পারছে না। ঠুলে হৃদয়ের কাঁধে পড়ে গেল। হৃদয় জানকে ধরে পেছনে বালিশ দিয়ে বসিয়ে দিল।
” এখানে কী করছ? ”
ঘুম থেকে তুলে এভাবে বসিয়ে দেওয়ায় জান বেশ বিরক্ত। এই ছেলেটা রন্ধ্রে রন্ধ্রে বিরক্তি। আশেপাশে থাকলেই থাকে বিরক্ত করবে। এমনকি এই ছেলের নামটাও তাকে বিরক্ত করে।
জান চুপচাপ পেছনে মাথা এলিয়ে দিল। জানের কোনো সারাশব্দ না পেয়ে হৃদয় জানের দুই বাহু ধরে ঝাকিয়ে বলল,
” কিছু জিজ্ঞেস করছিতো তোমায়? ”
” আমি শুনতে পাইনি। ”
নির্লিপ্ত গলায় জানের উত্তর।
” আমার ঘরে কী করছ? ”
” ইচ্ছে করে আসিনি। ”
” তো কি আমি কোলে করে নিয়ে এসেছি? ”
” সে আপনি দুঃস্বপ্নেও আনবেন না আমি জানি। ঘুমোতে এসেছি। ”
” আমার ঘরে কেন? ”
” অন্যসব ঘরে মেহমান তাই। ”
” আমার ঘর কী কোনো হোটেল নাকি যে যখন খুশি চলে আসবে? ”
” আমার কাছে ঐরকমই। ”
” মানে কী! আমার অনুমতি ছাড়া তুমি আমার ঘরে থাকতে পারো না। ”
” জান কারো অনুমতির ধার ধারে না। আপনার তো একদমই না। ”
” তুমি কিন্তু বাড়াবাড়ি করছ। ”
” আমি জানি। জান মানেই বাড়াবাড়ি। আপনার বাকি প্রশ্নের জবাব আমি সকালে দিয়ে দেবো। এখন ঘুম পাচ্ছে। শুভ রাত্রি। ”
হৃদয়কে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে জান কম্বল মুড়ে শুয়ে পড়ল। হৃদয় সরোষ দৃষ্টিতে জানের দিকে তাকাল। পরক্ষণেই মুখ ফিরিয়ে বাঁকা হাসল। হাত বাড়িয়ে জানকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে শুয়ে পড়ল। জান বিরক্তিতে মুখ দিয়ে ‘ চ’ উচ্চারণ করল। হৃদয় সেদিকে পাত্তা না দিয়ে বলল,
” আমার ঘরে ঘুমাতো হলে এভাবেই ঘুমোতে হবে। ”
জানের কোনো সারাশব্দ না পেয়ে হৃদয় কম্বল হালকা সরিয়ে জানের দিকে তাকাল। জান ততক্ষণে ঘুমে বিভোর। প্রচন্ড ঘুম কাতুরে সে। হৃদয় নিঃশব্দে হাসল। জানকে জড়িয়ে সহস্র ভাবনার দাড় খুলে বসল।
হালকা আলো আর তীব্র শোরগোলের কারণে হৃদয়ে ঘুম হালকা হয়ে এলো। বিয়ে বাড়ির এই এক সমস্যা। শোরগোল, মানুষের উপস্থিতিই জানান দেয় বিয়ে বাড়ি অন্য সব বাড়ি থেকে কতোটা ভিন্ন। আলসেমি ঝেড়ে চোখ মেলে তাকাল সে। জান তখনো ঘুমে মগ্ন। এলোমেলো কেশের খাঁচায় একটুখানি মুখটা বন্দি পাখির মত লাগছে। সে পাখির যেন মুক্তির আশায় সুখ খুঁজচ্ছে তার বুকে। মুগ্ধ দৃষ্টিতে আটকে নিলো স্নিগ্ধ আদল। অতঃপর তার উপর জাহির করল নিজের অধিপত্য। এলোমেলো চুলের উপরেই কপালে ঠোঁট চেপে চুমো খেলো। জানের ভ্রু কুচকে এলো। হৃদয় হেসে ফেলল। ঘুমের মাঝেও মেয়েটা কেমন বিরক্ত হচ্ছে। এই বিরক্তমাখা চেহারাটা দেখে সে মজা পায়। তাইতো বার বার ইচ্ছে করে তাকে বিরক্ত করে। পরক্ষণেই গত রাতের কথা ভেবে মুখের হাসি সমুদ্রের ঢেউয়ের ন্যায় আরেকটু প্রসারিত হলো। গত রাতে জানকে এ ঘরে রাখা হৃদয় আর জুঁইয়ের পরিকল্পনা ছিলো। জান তা ঘুণাক্ষরেও টের পেলে তাদের খবর করে ছেড়ে দেবে।
জানালা গলে আসা প্রখর আলো ধীরে ধীরে জানের ঘুম হালকা করে দিলো। হৃদয় তা বুঝতে পেরে সাবধানে তাকে বালিশে রেখে, বিছানা ছেড়ে ওয়াশরুমে চলে গেল। জানকে সে কোনো বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলতে চায় না। ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে দেখতে পেলো জান সোফায় মাথা নিচু করে বসে আছে। হৃদয় মুখে শব্দ করে তার উপস্থিতির জানান দিলো। জান নিঃশব্দে হৃদয়ের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,
” গত রাতে আপনার ঘরে থাকার জন্য দুঃখিত। অনেকটা বাধ্য হয়েই এসেছিলাম। যদিও আমি চাইলে হয়তো না এসেও থাকতে পারতাম। ”
” এত জবাবদিহিতার কিছু হয়নি। তুমি চাইলে এ ঘরে থাকতেই পারো। বউ তুমি আমার। ”
” এতোদিন পর আজ হঠাৎ কেন মনে হলো আমি আপনার বউ? সে যাইহোক, অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু জান সজ্ঞানে মেনে নেয় না। ”
মুখের কঠিনত্ব বজায় রেখে বড় বড় পা ফেলে জান ঘর ত্যাগ করল। হৃদয় নির্লিপ্ত তাকিয়ে রইল সেদিকে। মেয়েটা বড্ড জেদি। নিজের মর্জির বাইরে কিছু করতে সে নারাজ। তবে তার এখানাকার এই জেদের পেছনে কোথাও না কোথাও সে নিজেই দায়ী। হৃদয় সোফায় গা এলিয়ে ডুব দিলো এক মাস আগের সময়টায়।
চলবে,