তিনশত পয়ষট্টি পৃষ্ঠা শেষ পর্ব

1
439

#তিনশত_পয়ষট্টি_পৃষ্ঠা
#মুসফিরাত_জান্নাত
#অন্তিম_পর্ব(প্রথমাংশ)

তায়্যেবকে হন্তদন্ত করে বাসা থেকে বের হতে দেখে ভড়কে গেলো জামেলা বানু সহ সকলে।এত রাত্রী বেলা কোথায় যাচ্ছে ছেলেটা?তাকে পিছু ডেকেও কোনো সাড়া পেলো না কেও।জামেলা বানু কেবলই হৈ হৈ করলেন।কি হলো টা কি তায়্যেবের সাথে?একটু আগেই তো তাকে প্রিয়তার বইগুলো একটু গুছিয়ে দিতে বললেন।সেগুলো বেশ স্বাভাবিক ভাবেই গোছাচ্ছিলো সে।তারপর হটাৎ সেই বইগুলো ওভাবে রেখে কোথায় গেলো ছেলেটা?কারো কিছু হয়নি তো?দুশ্চিন্তা হতে লাগলো তার।যতই হোক মায়ের মন বলে কথা।

এদিকে একটু আগে মায়ের আদেশ মতো প্রিয়তার বইগুলো পাঠানোর জন্য গোছাতে ব্যাস্ত হয়েছিলো তায়্যেব।তখন স্টাডি টেবিলের বিভিন্ন তাকে সাজিয়ে রাখা প্রিয়তার বইগুলো এক এক করে নামাতে নিতে তায়্যেবের চোখ আটকে গেলো নীল রঙা এক মোটা ডায়েরির দিকে।সে জানে এটা তার না এবং সে এটাও জানে অন্যের ডায়েরির পাতায় লুকানো গল্প গুলো অনুমতি বিহীন পড়া অনুচিত কাজ।তবুও নিজের কৌতুহলকে দমাতে পারলো না সে।প্রিয়তার দীর্ঘদিন ধরে যত্নে লেখা অনুভুতিগুলো মেলে নিলো চোখের সামনে।যেগুলো নিজের করা এক বিরাট ভুলের সংশোধনী হয়ে ধরা দিলো তার নিকট।এই ডায়েরির প্রত্যেকটা পাতার ভাজে ভাজে লুকিয়ে আছে প্রিয়তার মনের মাঝে তার প্রতি ধীরে ধীরে গজিয়ে উঠা অনুভুতিগুলো।পৃষ্ঠাসংখ্যা যত এগুচ্ছে প্রিয়তার অনুভুতিগুলো তত গাঢ় হয়ে ধরা দিচ্ছে।আস্তে ধীরে প্রিয়তার তার প্রতি ভালোলাগা গুলো গাঢ় হয়ে ভালোবাসায় রুপ নেওয়ার চিত্রপট অঙ্কিত হয়েছে এতে।অপ্রত্যাশিত এক আকাঙ্খার নিভৃত পূরণের ব্যপারটি জানতেই শীতল হয়ে এলো হৃদয়। হাত পা অসার হয়ে এলো তার।দেহ জুরে সৃষ্টি হলো কম্পন।বুকের বা পাশ থরথর করে কাঁপতে লাগলো।চরম আগ্রহ ও উত্তেজনা নিয়ে প্রত্যেকটা শব্দ মস্তিষ্কে গেঁথে নিলো সে। অন্তরালে পড়ে থাকা কারো অতি যত্নে রচিত এক ভালোবাসাময় কাব্যগাঁধা নিমিষেই পড়তে লাগলো সে।এভাবে এক সময় প্রিয়তার লেখা গল্পের শেষ পৃষ্ঠাগুলোর উদয় হলো।যেটা কিনা তায়্যেবের আসার কয়েকদিন আগে থেকে লেখা।তায়্যেব আসার আনন্দঘন অপেক্ষার অনুভুতির প্রকাশ রয়েছে সেখানে।প্রিয়তা ঠিক শেষ পৃষ্ঠার আগের দিকের এক পৃষ্ঠায় লিখেছে,

মেঘরাজ, আপনি কি জানেন,
আপনার দূর দেশে গমনে পৃথিবীর কোথাও
এক চঞ্চল গাঙচিল বিষন্ন হয়ে তার ওড়ার গতি কমিয়ে দিয়েছিলো?আপনি কি জানেন,
ঝরে যেতে যেতে ব্যথিত হয়েছিলো কোনো এক
অরণ্যের প্রাণহীন পাতা?কোথাও যেনো কারো জীবনে বেশ কিছু কম পড়েছিলো আপনি নেই বলে।এসব কি আপনি জানেন?মাঝরাতে স্বপ্নে এসে কারো ঘুম ভাঙালেন বলে যে সে আর ঘুমিয়ে যাইনি,আপনার স্বপ্নকে মস্তিষ্কে গেঁথে রাখতে নির্ঘুম রাত্রি পাড়ি দিয়েছে,তা কি আপনি জানেন?
আপনি এসবের কিছুই জানেন না।আপনি জানেন না পথে হেঁটে যেতে যেতে সে কতবার দাঁড়িয়ে গিয়েছে খানিকক্ষণ, কোনো কাপলের যুগলবন্দী দেখে স্মৃতি স্মরণে আপনাকে জাগিয়েছে তার অবুঝ মন।আপনি এসবের কিছুই জানেন না।
তবে আপনি জানবেন এবার।স্বপ্নহীন এক অবুঝ বালিকার মেঘরাজকে নিয়ে ভালোবাসার প্রাসাদ সাজানোর গল্প জানবেন।আপনি কি একটু চমকাবেন তখন?

আর একদম শেষ পৃষ্ঠায় লেখা-

“মেঘরাজ,আজ আমি ঘুমাতে পারছি না।কেনো জানেন?কারণ আপনার আগমনের অপেক্ষার আনন্দ আমার ঘুম কেড়ে এক অজানা সিন্দুকে বন্দী করে রেখেছে।এক সুখের সাগরে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে আমাকে।আমি এক অন্যরকম অনুভুতির সাগরে সাঁতার কাঁটছি আর প্রহর গুনছি কখন কাল হবে।কিন্তু সময় আর কাটছে না।জানেন মেঘরাজ,আমি আগে জানতাম না ভালোবাসার মানুষের আগমনের অপেক্ষা এত মধুর হয়।ইশ আপনি দূরে না গেলে এই অনুভুতি আমার পাওয়া হতো না।কত বড় লস হয়ে যেতো তাই না বলেন?আচ্ছা আপনি কি এই অনুভুতিগুলো কেমন হয় জানেন?

মেঘরাজ,আপনি চেয়েছিলেন কেউ আপনাকে ভীষন ভালোবাসুক,যার দুনিয়াতে আপনি ছাড়া আর কেও না থাকুক।কেউ আপনার চোখে তাকিয়ে সব দুঃখ ভুলুক,আপনার কাধে মাথা রেখে তার ভরসার স্থান খুঁজুক।আপনি সবসময় চেয়েছিলেন ঠিক যেমন একজন,আপনি এবার এসে দেখবেন এখন আমি পুরোটাই আপনার সেই ইচ্ছে মতন।এটা দেখে কতটা চমকে যাবেন তখন আমি ঠিক জানিনা।তবে এটা জানি এক নিদারুন মুহুর্ত হবে সেটা।আমি সেই মুহুর্তের অপেক্ষায় মেঘরাজ।আপনার চমকানোর অপেক্ষায়,আপনার থমকানোর অপেক্ষায়।আপনি বৃষ্টি হয়ে দ্রুত ঝড়ে পড়ুন আমার নিকট।চলে আসুন এই মনের রাজ্যে।আমি অপেক্ষা করছি।

~02:45 AM

টানা সময় ধরে এই ডায়েরীর পাতা শেষ করতেই বুকের বা পাশে এক শীতল দহন শুরু হলো তায়্যেবের।প্রাপ্তির আনন্দ ও ভুলের যন্ত্রণা একাকার হয়ে খানিক থমকে রইলো সে।তার অন্তরালে প্রিয়তা তাকে ভালোবেসেছিলো,তাকে নিয়ে স্বপ্নের প্রাসাদ সাজিয়ে অপেক্ষায় ছিলো,সে আসবে বলে অধীর আগ্রহে রাত জেগে কাটালো।আর সে কিনা ফিরে এসে সবটা বৃথা করে দিলো?মুহুর্তেই ধুলিস্যাৎ করে দিলো মেয়েটির সকল অনুভুতিকে।তার অপেক্ষাদের এভাবে খান খান করে কীভাবে ভাঙতে পারলো সে?

সে যখন প্রিয়তাকে অসম্ভব ভালোবাসতো প্রিয়তা তখন তাকে পাত্তা দিতো না।আর প্রিয়তা যখন একটু একটু করে তার জন্য ভালোবাসার মহল সাজালো তখনই কিনা সে অন্যত্র ঘর সাজাতে ব্যস্ত হলো!তীব্র এক অনুশোচনাবোধ ঘিরে ধরলো তাকে।মনস্তাপে পুড়ে ছাই হয়ে যেতে লাগলো।এসব কি করতে চলেছিলো সে?

তার ভুলটা সম্পূর্ণ রুপে সংঘটিত হওয়ার আগেই তা চোখে পড়েছে।আর এই ভুলের সংশোধনপত্র নিয়েই সে ওইরকম ব্যস্ত হয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলো।উদ্দেশ্য তার অর্ধাঙ্গিনী প্রিয়তা।
_______
বিষাদময় অবসরের মরুভূমির বালুচরে একেকটা প্রহর গুনছে প্রিয়তা।রাতের ঘুমও যেনো চিরতরে বিদায় নিয়েছে।যেখানে পুরো জীবনেই অশান্তির বিচরণ সেখানে প্রশান্তির ঘুম তার চোখে নামবে কীভাবে?যতই সে দুঃখ ভুলতে চায় দুঃখ তাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে।এই দুঃখ গুলোকে খানিক সময়ের জন্য হলেও বিদায় দিতে একটু মুক্ত হাওয়ার মাঝে পদার্পণ করলো সে।একটু সাহস দেখিয়ে রাতের ঢাকার কৃত্রিম আলোকসজ্জিত চলন্ত গাড়িময় পথ দেখতে লাগলো ছাদে দাঁড়িয়ে।এসময়টায় কেও ছাদে আসে না বলে ছাদ এখন নির্জন।এই নির্জনতাকে ঠেলে সেখানে প্রবেশ করলো কেও।কারো আগমনের শব্দ পেয়ে আঁতকে উঠল প্রিয়তা। অজানা আশঙ্কায় শরীরে কাঁ’টা দিয়ে উঠলো তার।ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো সে।এই অসময়ে তার পিছনে তায়্যেবকে দেখে বিষ্মিত হতে বাধ্য হলো সে।তার এই চমকানো অনুভুতিকে আরও খানিকটা চমকে দিতে আচমকা এগিয়ে এসে তাকে জড়িয়ে ধরলো তায়্যেব।আকষ্মিক ঘটনায় কিংকর্তব্য বিমূঢ় হলো প্রিয়তা।সে নিজেকে ধাতস্থ করে নেওয়ার আগেই তায়্যেব কাঁপা গলায় বললো,

“যদি আগে একবার আমি জানতাম আমাকে ভালোবেসেছিলে তুমি,বিশ্বাস করো অন্য মেয়েকে জীবনে জড়ানো তো দূর তাদের দিকে তাকানোর স্পর্ধাও করতাম না আমি।”

কথাটা শুনে আশ্চর্যের উর্ধ্ব সীমায় পৌছে গেলো প্রিয়তা।তায়্যেবের হটাৎ এমন পরিবর্তনে মুখের খেই হারিয়ে রইলো কিছুক্ষণ।সব বুঝে উঠতে অক্ষম হলো প্রিয়তা।সে যে তায়্যেবকে ভালোবাসে তা লোকটা জানলো কি করে?পরিবেশের সাথে নিজেকে ধাতস্থ করে নিতেই সে স্পষ্ট দেখতে পায় তায়্যেবের হাতে তার লেখা সেই নীল ডায়েরিটা।এবার সব কিছু স্পষ্ট হয় তার নিকট।কিছুক্ষন প্রতিক্রিয়া শূন্য থেকে সে এবার তার থেকে ছাড়িয়ে নেয় নিজেকে।নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে দেখতে থাকে তায়্যেবকে।তাকে এভাবে নিশ্চুপ হয়ে তাকিয়ে থাকতে দেখে মাথা নুইয়ে ফেললো তায়্যেব। অনুতপ্ত গলায় আবারও বললো,

“নিজের অজান্তে ভুল করেছি আমি।তুমি থাকা কালীন অন্য কাওকে জীবনে জড়িয়েছি।এ ভুলের কি ক্ষমা হবে?”

প্রিয়তা এবার নিজেকে পুরোদমে ধাতস্থ করে নিলো।মাঝের কয়দিনে মনে জ্বলা আগুন আবারও দাউ দাউ করে জ্ব’ললো।সেই আ’গুন নেভাতে সে তাচ্ছিল্য ভরে হাসলো আনমনে।তারপর গম্ভীর কণ্ঠে বললো,

“এটা ভুল নয় এটা অ’ন্যায়।আর অ’ন্যায়ের কি কোনো ক্ষমা হয়?”

প্রিয়তার প্রশ্নে থমকে গেলো তায়্যেব।প্রশ্নটা তার শিকড় নাড়িয়ে দিলো।সত্যি সে অ’ন্যায় করেছে মেয়েটির সাথে।তার হক নষ্ট করেছে।এমন নিচু কাজের ক্ষমা কি এতো সহজেই প্রাপ্য তার?সে কিছুটা সময় নিয়ে ভারাক্রান্ত কণ্ঠে বললো,

“প্রায়শ্চিত্ত তো হয়!”

প্রিয়তা কাঠ কাঠ কণ্ঠে বললো,

“প্রায়শ্চিত্ত ও ভুলের প্রাপ্য।অন্যায়ের প্রাপ্য তো একমাত্র শাস্তি।”

“তবে তুমি শাস্তিই দাও।তোমার দেওয়া সব শাস্তি আমি মাথা পেতে নিবো।তোমাকে রেখে অন্য কাওকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেওয়াটা আমার জন্য যতটা কষ্টের ছিলো, তার চেয়ে তোমার বেধে দেওয়া অতি কঠোর শাস্তিও সহ্য করা সহজ লাগবে আমার।তুমি যা খুশি দণ্ড দাও আমায়।তোমাকে আরও একটিবার জীবনে পেতে সব দণ্ড সয়ে যাবো আমি।”

কোনো রুপ বিলম্ব না করে জবাব দিলো তায়্যেব।
অতপর কিছু সময় নিশ্চুপ থেকে সে মাথা নুইয়ে বললো,

“ভালোবাসি প্রিয়, ভীষণ ভালোবাসি তোমায়!”

প্রতিউত্তরে প্রিয়তা সরু চোখে তাকিয়ে বললো,

“আপনার ভালোবাসা বিষাক্ত! এমন ভালোবাসা চাইনা আমার।আপনার ভালোবাসা কেবল শরীর বোঝে, কিন্তু মন বোঝে না।কেবল মাত্র দৈ’হিক স’ম্পর্কের জন্য যে ভালোবাসা তার ব্যক্তিগত মানুষকে দূরে ঠেলে অন্য কাওকে নিজের জীবনে গ্রহন করে,যে ভালোবাসায় দৈ’হিক বিনিময় খোঁজে, সেটা কখনো স্বচ্ছ ভালোবাসা হতে পারে না।আর ছেড়ে দেন আমাকে আপনার জীবনে ফিরে পাওয়ার আশা।কোন ভরসায় আপনার কাছে ফিরবো আমি?যে তার বউয়ের অপূর্ণতায় নিজেকে সংযত রাখতে পারে না,শুধুমাত্র শা’রী’রিক স্পর্শের চা’হিদায় পরকীয়ায় জরায়,সে যে বিয়ের আগে নিজের চরিত্র হেফাজত রেখেছে, এটাই বা বিশ্বাস করবে কে?আর যে ব্যক্তির চরিত্র নিয়ে এত সংশয় তার সাথে আর যাই হোক, সুখে সংসার হয় না।”

নির্লিপ্ত গলায় বাক্যগুলো পূর্ণ করে নিজের ডায়েরি খানা তায়্যেবের হাত থেকে ছিনিয়ে নিলো সে।যার মাঝে বিগত এক বছর ধরে প্রতিদিন এক পৃষ্ঠা এক পৃষ্ঠা করে নিজের অনুভুতি ঠেসে দিয়েছিলো সে।সেগুলোর দিকে তাকিয়ে একটা তপ্ত শ্বাস ছাড়লো প্রিয়তা।তারপর বিবশ কণ্ঠে বললো,

“এসব আগের সৃষ্ট অনুভূতি।যার অস্তিত্ব আমার নিকট এখন মৃ’ত।আর মৃ’ত অনুভুতিকে স্মৃতি রুপে জিইয়ে রেখে লাভ নেই।”

কথাগুলো বলে আচমকা সে সব গুলো পৃষ্ঠা ছিঁ’ড়ে ফেললো।তারপর সেগুলো উড়িয়ে দিলো রাতের এই কালো বাতাসে।সেদিকে অসহায়ের মত ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো তায়্যেব।আবছা কালো অন্ধকারে প্রিয়তার লেখা সেই শুভ্র রঙা তিনশত পয়ষট্টি পৃষ্ঠা জুড়ে সাজানো ভালোবাসাময় অনুভুতিগুলো ঘুরপাক খেয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো চরম অবলীলায়।

#চলবে….

[ভাগনি এসেছে।ফোন এখন তার দখলে।সাজিয়ে গুছিয়ে লিখতেও পারছি না।শব্দগুলো মস্তিষ্কে ধরা দেওয়ার আগেই তার পুটুস পুটুস শব্দ কানে বাজছে।তাই সব খাপছাড়া হয়ে গিয়েছে।🙂]

1 COMMENT

Leave a Reply to Nuzaifa Binte Aayiraat Cancel reply

Please enter your comment!
Please enter your name here