তারকারাজি সিজন 1 পর্ব-১৪

0
260

তারকারাজি- (১৪)
লেখনীতে- অহনা নুযহাত চৌধুরী

এক সপ্তাহের মধ্যে আরও তিনটে মধ্যরাত কেটে গেল মিশমি আর তিহামের লুকিয়ে-চুরিয়ে দেখা করবার। কথা হলো ফোনে অনবরত। কিন্তু প্রথম দিনে করা তিহামের সেই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হয়নি মিশমির। উত্তর জানা থাকলে তো দিবে সে? মাঝে মাঝে খুব ভয় হয় মিশমির, তার মতো শান্ত-শিষ্ট, সহজ-সরল মেয়েটার সাথে অমন একটা চঞ্চল ছেলের বনবে না বোধহয়। আবার মনে হয়, এইযে মিশমির তিহামের ডাকে সাড়া দেওয়ার তীব্র বাসনা… এটা শুধুই কি নিজের ভদ্রতা কাউকে ফিরিয়ে না দেওয়ার? হাজার অমিলেও না-কি অলৌকিকতার মধ্য দিয়ে দুটো মানুষের মনস্তাত্ত্বিক মিলন সম্ভব হয়। আচ্ছা, এটাও কি তবে তার আর তিহামের জন্য অলৌকিক কিছু?

গত রাতে তিহামের সাথে দেখা করার পর আর ঘুমায়নি মিশমি। সারা রাত জেগে ফোনালাপ শেষ করতেই সূর্যের উপস্থিতি ঘটে গিয়েছিল। অল্প-বিস্তর ঘুম সেরে নিয়ে ভার্সিটিতে এসেছে সে। সকালে পানিটাও মুখে দেওয়া হয়েছিল কি-না তার তা মনে পড়ছে না। বাহ্যজগতে আজ সূর্যের তেজ ভীষণ! গা গুলিয়ে আসছে মিশমির। ঘুম না হওয়ায় মাথাতেও রাজ্যের ভার জমেছে। ঝিমঝিম করছে মাঝে মাঝেই। ঘামে মাখো-মাখো শরীরটা ঢুলছে বলে মনে হচ্ছে তার। মিশমি শ্রেণিকক্ষ থেকে বাইরে এসেছিল চোখেমুখে পানি দিতে। কিন্তু ওয়াশরুম অবধি পা দুটো যেন চলতে চাইছে না আর। চলতে চলতে হঠাৎই সে ঢলে পড়ে পাশের দেয়ালে। আঘাত না-পেতেও ওষ্ঠদ্বয়ে আঁটে ব্যথিত আর্তনাদ। মাথা ঘুরছে তার। আরেকটু হলেই বোধহয় শরীরটা মাটিতে নুইয়ে পড়বে। ঠিক তখনই দুটো দায়িত্বশীল হাত তরুণীর বাহু জোড়া আঁকড়ে ধরে দাঁড় করিয়ে দিল মুহূর্ত ব্যয়ে। ব্যস্ত পুরুষের চিন্তিত কণ্ঠ এলো,

“ মিশমি? তোমার শরীর খারাপ লাগছে না-কি? ”

চোখ জোড়ায় ঘন ধোঁয়াশা আবদ্ধ হওয়ায় মিশমি দেখতে পারছে না মানুষটিকে। মনে প্রশ্ন জাগে৷ নিশান বা রিশান কখনোই তুমি বলে সম্বোধন করবে না তাকে। তাহলে কি তিহাম এলো? না, এটা তিহামের কণ্ঠস্বর না। কিছুক্ষণ ধরে সামনের মানুষটিকে দেখার চেষ্টা চালালো সে। অতঃপর সফল হতেই দেখা মিলল অত্যন্ত অনাকাঙ্ক্ষিত যুবক সায়ানের। তার চোখে নিজেকে নিয়ে অস্থিরতা দেখতে পাচ্ছে মিশমি। ছেলেটা দাঁড়িয়ে আছে ঠিক তার থেকে দু’হাত দূরে। মিশমি চোখে মেপেই বলে দিতে পারে সেই দূরত্ব! সে ভাবে, সায়ানকে বলে নীলাশা বা পিহুকে ডেকে পাঠাবে। কিন্তু ওষ্ঠদ্বয় এসে এখানেই সহায় হলো না তার। পা দুটোও কেমন কাঁপতে লাগল। এই বুঝি পড়ে যাবে! মিশমি ইচ্ছাকৃতভাবেই দেয়ালে মাথা ঠেকায়। দাঁড়িয়ে থাকার মতো ভরসা খুঁজে পাচ্ছে না সে। তবুও সহসা সামনের দিকে হাত বাড়িয়ে, অত্যন্ত অসহায় তরুণীকে বিচার-বুদ্ধিহীনতায় বলতে শোনা গেল,

“ আপনি একটু শক্ত করে আমার হাতটা ধরবেন? ”

মিশমি দেখতে পায় না সামনের মানুষটির ভাবমূর্তি। বুঝতে পারে না তরুণের প্রতিক্রিয়া। মস্তিষ্ক অচল হয়ে আসতে থাকে তার। দুনিয়াকে পুরোপুরি ভুলতে হয়তো আর মাত্র কয়েক মুহূর্ত বাকি। ঠিক সেই সময় নিজের হাতটা কারো মুঠোয় অনুভব করতে পারে সে। অত্যন্ত যত্নে তার হাত ধরা মানবের কোনো কথা শুনতে পাওয়া যায় না। দুনিয়া আঁধারে তলিয়ে আসতেই শরীরটা লুটিয়ে পড়তে চায় মেঝেতে। কিন্তু সেই শক্ত করে ধরে রাখা মানব যেন পড়তে দিতে চায় না অচেতন মিশমিকে। ভীষণ শক্ত করে রমণীর দুই বাহু আঁকড়ে ধরে, দাঁড় করিয়ে রাখে সে। যেন নিখুঁত অঙ্গনার হাত দুটো ছেড়ে লুটিয়ে পড়তে দিলেই অঙ্গনার অসম্মান করা হবে, সেইটা মাটির বুকেই হোক কি নিজের বুকে। কে জানে, এই শক্ত করে আগলে রাখাটাই তরুণের অনিদ্রার কারণ হয় কি-না!

কাচতুল্য ঝকঝকে সোনা রোদ তখন রাস্তার বাঁকে লুটোপুটি খাচ্ছে। অথচ আকাশ যেন ঘন শীতের নিষ্প্রভতার ও পাণ্ডুবর্ণের এক বিশাল বিস্ময়! সানাম আকাশের দিকে তাকায়। হেঁটে চলে আনমনে। পাশ থেকে মিশমি আর নীলাশার গল্প-গুজব শোনা যায়। সব কিছুই চলছে তার নিজস্বতায়। শুধু সানাম-ই যেন তার নিজস্বতা হারিয়ে উদাসীনতায় ডুবে আছে। সামনে থেকে সহসা এক যুবকের ত্রস্তব্যস্ত, নাজেহাল অবস্থা পরিলক্ষিত হয়। সানাম ভ্রু কুঁচকায় তাকে দেখে। ছেলেটির চালচলন দেখে আন্দাজ করে নেয় যে, সে এদিকেই আসছে। সানাম বেশ ব্যগ্রতার সাথে বুঝতে চায় ব্যাপারটা। আর তখনই দেখা যায়, ছেলেটি কোনো কথাবার্তা না বলেই মিশমির দু’হাত নিজের মুঠোয় পুড়ে নেয়। অত্যন্ত অধীরতার সাথে বলতে থাকে,

“ ঠিক আছো এখন তুমি? কী হইছিল তোমার? ”

মিশমিকে খুব ভয়াতুর দেখায়। তিহাম যে এভাবে এসে হাত ধরে নিবে তা কস্মিনকালেও ভাবতে পারেনি মিশমি। শৈত্য শিহরণের স্পর্শ পাওয়ার মতোই কেঁপে ওঠে মিশমির দেহ। হাত সরিয়ে নেয় মুহূর্তেই। কিন্তু তিহাম থামে না। অবিচলে প্রশ্ন করতে থাকে সে। অত্যন্ত চটপটে ছেলেটিকে নিজের অসুস্থতা নিয়ে ব্যস্ত হতে দেখে মনে প্রশান্তির প্রাচীরপত্র ছেপে যায় মিশমির। সেই পত্রের উপর আঁচড় কাটা মোহ-মায়াগুলো যেন ভেদ করতে চায় মিশমির হৃদপিণ্ড। মিশমি লাজুক স্বভাবে হাসে। মাথা নত করে বলে,

“ কিছুই হয় নাই আমার। প্রচুর গরম তো আজকে আর তাই-ই মাথাটা ঘুরে গেছিল। ”

“ তাই বলে এতই গরম লাগল যে, মাথা ঘুরেই পড়ে গেলা? খেয়ে আসো নাই, তাই না? ”

চকিতেই চোখ তুলে তাকায় মিশমি। প্রশ্ন করে,

“ আপনাকে কে বলল? ”

তিহাম নির্বিকারে উত্তর দিল, যেন এইসব বোঝা তার বা’হাতের খেল, “ কমনসেন্স! ”

সেই মুহূর্তে নীলাশা সানামকে নিয়ে তাদের একাকী সময় কাটানোর সুযোগ করে দেয়। মিশমিদের ছাড়িয়ে দুজন হেঁটে আসে বেশ দূরে। হৈমন্তিক শীতলতায় স্বস্তি বোধ করে দুজন-ই। সানাম একবার পিছনে ফিরে মিশমিদের দেখে নেয় সেই সময়। অতঃপর নীলাশার উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুঁড়ে,

“ কবে থেকে এই ইটিস-পিটিস চলতাছে, নীলইলিশ? ”

নীলাশা খুঁজছিল আরাভকে। এই সময়টাতে পুরো ভার্সিটি ঘুরে বেড়ানোই যেন মহারাজ ও তার সাঙ্গপাঙ্গের একমাত্র জরুরি কাজ। সানামের প্রশ্নটা যখন কানে বাজে ঠিক তখনই চোখ দুটো গোল-গোল হয়ে যায় তার। সে সানামের দিকে তাকিয়ে, বিস্ময়ের চরম সীমানায় অবস্থিত নিজের মস্তিষ্কের প্রশ্ন ছুঁড়ে বলল,

“ কী বললে তুমি? নীলইলিশ? তুমি তো দেখি আমার নামটা পচানোর জন্য উঠেপড়ে লেগেছো। একটু পর তো বলবে নীলবালিশ, নীলমালিশ এমনকি নীলবিষ-ও বলতে ভাববে না! এটা কেমন বিচার? ”

সানাম তিক্ততার সাথে জবাব দিল, “ শালার বেটি তুই পিহুর সাথে থাকতে থাকতে ড্রামাকুইন হয়ে যাইতাছোস। ওইটারে তো ঘরে সামলাইতে পারি না, আর তুই এখন বাইরে জুটছোস! ”

“ তা তুই ঠিক বলছিস! ওই কিন্তু দারুণ ড্রামা করে। ওর একটা কমেডি বুক লিখে ফেলা উচিত। ”

“ আজগুবি কথা না-বলে উত্তর দে। এই মিশমি আবার সাদা চামড়ার প্রেমে পড়ল না-কি? কবে থেকে চলে এগুলা? ”

“ থ্রি-ফোর্থস অফ মান্থ! আচ্ছা সানাম, আমি যে তোকে তুই বলে ডাকছি তা কি তুই ধরতে পারিস নাই? ”

খুব আগ্রহ নিয়েই প্রশ্নটা করেছে নীলাশা। সানামের অনুভূতিটা উপলব্ধি করতে চায় সে। স্বীকার করা অনিবার্য যে, সেইদিন এক সাথে সময় কাটানোর পর সানামের প্রতি তার দূর্বলতাটা সে নিজেও অনুভব করতে পেরেছিল। মেয়েটার সম্পর্কে আগেও ভালো ধারণা ছিল। কিন্তু সানামের কথা বলার ধরণটাই তার একমাত্র বিরক্তির কারণ। মেয়েটার মুখে কিছুই আঁটকায় না! মেয়েরা চঞ্চল হবে। তাই বলে এমন মাত্রাতিরিক্ত চঞ্চল হতে হবে কেন? খাপছাড়া, বেপরোয়া ভাব কি মেয়েদের সাথে মানায়? সেদিক দিয়ে দেখতে গেলে সেই আগের ছন্নছাড়া সানাম এখন আর ‘সানাম’ নেই। মিশমির থেকেও শান্ত হয়ে গেছে যেন মেয়েটা! নীলাশা খেয়াল করল সানাম উত্তর দিতে খুব দেরি করছে। পরে অবশ্য নীলাশার অতি কাঙ্ক্ষিত ঘটনাটিই ঘটল। তবে উত্তরটা ছিল বেশ অনাকাঙ্ক্ষিত। সানাম নির্বিকারে বলল,

“ শুনছি কিন্তু ধরি নাই। কারণ পাগলদের কথা ধরতে হয় না। ”

নীলাশা স্থির হলো। নীরস দৃষ্টিতে দেখতে লাগল সানামের উদ্বেগহীনতা। সে এমন উত্তরের আশা করেনি। সানামের উদাসীনতায় নীলাশার-ও কেমন উদাসীন লাগছে সবকিছুকে। ওই যে পলকা মেঘের আড়ালে সূর্য লুকিয়ে ধূসর করছে পরিমণ্ডল! এতেও যেন নীলাশার মনে হাজার খানিক উদাসীনতা। এইযে ঝাঁকে ঝাঁকে সাদা পাখিগুলো উড়ে বেড়াচ্ছে! এতেও নীলাশার উদাসীনতার কমতি নেই। যেন মনে হচ্ছে প্রিয় কিছু সানাম নয় বরং সে নিজেই হারিয়ে বসেছে।
নীলাশা তার ব্যাগ হাতড়ে একটা চকোলেটের প্যাকেট বের করে নেয়। তা সানামের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে সৌহার্দ্যপূর্ণ হেসে বলে,

“ তোর জন্য। ”

সানাম ভ্রু কুঁচকে একবার আপাদমস্তক দেখে নেয় নীলাশাকে। ভাব-সাব মোটে ঠিক নেই তার! নিগূঢ়ভাবে উপলব্ধি করে নেয় নীলাশার উদ্দেশ্য। অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু ঘটে যাচ্ছে বলেই বোধহয় সানামের এভাবে প্রশ্ন করা,

“ আর ইউ সিরিয়াস? তুই আর আমি… লাইক টম এণ্ড জেরি? ”

উত্তরে নীলাশা খিলখিলিয়ে হাসে। প্যাকেটটা সানামের হাতে গুঁজে দিয়ে বলে,

“ উঁহু, তুই আর আমি না। আমরা! আমি, তুই, পিহু, নিশান, রিশান আর মিশা… টোটাল আমরা! ”

সানামকে নিষ্প্রভতায় হাসতে দেখা যায়। নীলাশার কথাটার অর্থ তার কাছে অন্যকিছুই হয়ে দাঁড়ায়। সে বলে,

“ আমাকে সান্ত্বনা দিতে হবে না তোদের। বাপ-মা মরে গেছে আমার। অথচ কিছুই হচ্ছে না আর তোরা আসছিস ওই চুনোপুঁটি সাইফকে নিয়ে সান্ত্বনা দিতে, হাহ্! ”

চকোলেটটা রাস্তার এক ধারে ছুঁড়ে ফেলে সানাম। এই দেখে নীলাশার বিস্ময় যেন বাঁধ মানে না আর। সানাম চলতে লাগে তার হলের দিকে। সেই যান্ত্রিক, ছন্নছাড়া মেয়েটিকে চলন্ত অবস্থায়-ই বলতে শোনা যায়,

“ তোর বাপের না খুব টাকা? কিনে নিয়ে অন্যদের সান্ত্বনা দিস। আমাকে এতো টাকার ফুটানি দেখাতে আসিস না। ”

সানাম চোখের অগোচরে হারিয়ে যেতেই নীলাশা প্যাকেটটা তুলে নেয়। সে বুঝতে পারেনি সানামের কাছে তার অনুভূতি কেবলমাত্র সান্ত্বনা হয়ে দাঁড়াবে। অহেতুক অপমানে বুকটা ভার হয়ে আসে তার। কিন্তু তার পর যা ঘটল তা ছিল মারাত্মকভাবে বিস্ময়ের বিষয়। সানামের একেকটা কাজকর্মই ছিল যেন নীলাশার ভাবনার বাহিরে… এমনকি সবার ভাবনার বাহিরে!

#চলবে ইন শা আল্লাহ!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here