তাজ ইলোর প্রণয়ালাপন পর্ব:০৮

0
385

#তাজ-ইলোর প্রণয়ালাপন
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি
পর্ব:০৮

ঘুম ভাঙতেই দেখলাম আমি তাজ ভাইয়ের কাঁধে মাথা রেখে বসে আছি আর উনি চুপচাপ ড্রাইভিং করে চলেছেন। নিজেকে ওনার এত কাছে দেখে আমার ছোখ দুটো ছানাবড়া হয়ে গেল। আমি লাফিয়ে ওনার থেকে সরে বসলাম। উনি শুধু একবার আমার দিকে তাকালেন। তারপর আবার ড্রাইভিংয়ে মনোযোগ দিলেন। ফোনে সময় দেখে বুঝলাম আমি গত দেড় ঘন্টা যাবত ঘুমিয়েছি। তার মানে এই দেড় ঘন্টা আমি তাজ ভাইয়ের কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়েছি! আমিই ঢলে পড়েছিলাম না-কি উনি ইচ্ছে করেই এভাবে মাথা রেখেছিলেন। ধুর! উনি ইচ্ছে করে করবেন কেন? মনে হয় আমি নিজেই ঘুমের ঘোরে ওনার কাছে চলে গেছি। ছিঃ ছিঃ! এখন তো আমি লজ্জায় ওনার দিকে তাকাতেও পারব না। চুপচাপ বসে থাকতে থাকতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম খেয়ালই নেই আমার। কতক্ষণ ধরে ওভাবে ঘুমিয়েছিলাম কে জানে? উনি সরিয়ে দিলেন না কেন? আমি ইতস্তত করে আড়চোখে একবার ওনার দিকে তাকালাম। উনি রাস্তার দিকে দৃষ্টি রেখেই বললেন,“পৌঁছানোর সাথে সাথে আমার কাঁধ টিপে দিবি। গত দেড় ঘন্টায় কাঁধটার বারোটা বাজিয়ে দিয়েছিস।”

আমি সামনের দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে বললাম,“তো সরিয়ে দিলেই পারতেন।”

“সরিয়ে দিলে যে আবার ঢলে পড়তি না তার গ্যারান্টি কী?”

“সরিয়ে তো দেখতেন আগে।”

“তোকে ঠেলে কাঁধ থেকে সরিয়ে আমার এনার্জি লস করব কোন দুঃখে?”

ওনার এই কথা শুনে আমি আহাম্মক বনে গেলাম। দেড় ঘণ্টা যাবত ওনার কাঁধে আমি মাথা রেখে ঘুমালাম তাতে তার কিছুই যায় আসে না, অথচ সরিয়ে দিলে না-কি এনার্জি লস হত! অদ্ভুত লোকের অদ্ভুত কথা। ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনের সিটে তাকালাম। জেমি বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। তাজ ভাই বললেন,“এই বিলাই পালতে পালতে তুইও ওর মতো ঘুমাতে শিখেছিস।”

আমি ভ্রুকুটি করে বললাম,“বিলাই কী? ওর তো নাম আছে। জেমি বলতে পারেন না?”

“এটা তো নকল নাম। আসল নাম তো বিলাই।”

“তাও তো সুন্দরভাবে বলছেন না। বিড়ালকে বলছেন বিলাই।”

“এক হলেই হলো।”

তাজ ভাইয়ের ফোনটা স্বশব্দে বেজে উঠল। উনি ডান হাতে স্টেয়ারিং ধরে বাঁ হাত দিয়ে ফোন রিসিভ করে কানে ধরে বললেন,“বলো।”

ওপাশের ব্যাক্তি কিছু একটা বললেন। আর তাতে তাজ ভাইয়ের কপালে সূক্ষ্ম ভাঁজ পড়ল। উনি কিছু একটা ভেবে বললেন,“তোমাকে বলতে ভুলে গিয়েছিলাম আমি গ্রামে যাচ্ছি। তুমি তোমার কাজ চালিয়ে যাও, আমি ওদিকটা দেখছি।”

আবার কিছুক্ষণ মনোযোগ দিয়ে ওপাশের ব্যাক্তির কথা শুনলেন। তারপর বাঁকা হেসে বললেন,“পিপীলিকার পাখা গজায় মরিবার তরে। চোখ-কান খোলা রাখবে সবসময়। রাখছি।”

উনি ফোন রেখে দিলেন। আমি ওনার কথা শুনে হা করে তাকিয়ে আছি। কথার আগামাথা কিছুই বুঝতে পারলাম না। কিন্তু কোনো একটা ব্যাপার আছে তা বেশ বুঝতে পারছি। মুহুর্তে আমার মাথায় একগাদা প্রশ্ন এসে ভর করল। উনি কার সাথে কথা বললেন? কী কাজের কথা বললেন? কোন পিপীলিকার পাখা গজিয়েছে? কার মরার সময় হয়েছে? কী এমন কাজ যে চোখ-কান খোলা রেখে করতে হবে? তাছাড়া উনি তো কোনো কাজই করেন না তাহলে অন্যের সাথে কিসের কাজের কথা বললেন? ও হ্যাঁ, আবার তো বললেন উনি গ্রামে যাচ্ছেন, ওদিকটা উনি সামলাবেন। ওরে আল্লাহ্! শয়তানটা গ্রামে গিয়ে আবার কোন অঘটন ঘটানোর কথা ভাবছে? তাজ ভাইয়ের কথায় আমার ভাবনার সুতা ছিঁড়ল। উনি বললেন,“এই পিচ্চি মাথাটাকে এত ভাবনার চাপে ফেলিস না। শুধু শুধু মোটা মাথাটা ঘুরে যাবে, কাজের কাজ কিছুই হবে না।”

এ কথা শুনে আমার রাগ হওয়ার কথা। কিন্তু এখন আমার মাথায় ঘুরছে এক বস্তা প্রশ্ন। যার উত্তর না পাওয়া পর্যন্ত শান্তি পাব না। ওনার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলাম,“আপনি কার সাথে কথা বললেন?”

“মানুষের সাথে। জীবজন্তু তো কথা বলতে পারে না। পারলে না হয় ওদের সাথে বলতাম।”

“মানুষ তো বুঝলাম, কিন্তু সে কে? আর কী কাজের কথা বলছিলেন? আপনি তো কোনো কাজই করেন না। গ্রামে গিয়ে কী করবেন আপনি?”

উনি ধমকের সুরে বললেন,“ওই পিচ্চি, তোর এই প্রশ্নের বস্তার মুখটা আপাতত বন্ধ রাখ। নইলে এখানেই ফেলে রেখে চলে যাব। তারপর রাস্তায় হাত পা ছড়িয়ে ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কাঁদিস।”

আমি বিরক্ত হয়ে বললাম,“আপনার মুখে কি ভালো কথা রোচে না?”

“তুই এত ঝগড়াটে হয়েছিস কীভাবে রে? আমার মামু-মামি দুজনেই তো খুব ভালো মানুষ। তুই তাদের মেয়ে হয়ে এমন হয়েছিস কীভাবে? এসব তোর সাংঘাতিক মামুর ষড়যন্ত্র নয় তো?”

“আপনি সব কথায় আমার মামাকে টানেন কেন? আপনি জানেন না মামা কত ভালো মানুষ? আপনাকেও তো কত ভালোবাসে।”

উনি একটু ভাব নিয়ে বললেন,“আমার মতো ভালো ছেলেকে ভালো না বেসে উপায় আছে না-কি?”

আমি মুখ বাঁকিয়ে বললাম,“আপনি ভালো ছেলে হলে পৃথিবীর সব ভালো ছেলেরা তো রেলের নিচে মাথা দিয়ে মরবে।”

“বুঝি বুঝি, হিংসা হয় আমাকে দেখে। চিন্তা করিস না আমাকে দেখে দেখে তুই অনেক কিছু শিখতে পারবি।”

“আমাকে পাগলা কুকুর কামড়ায়নি যে আপনার থেকে শিখব। আপনার থেকে দ্বিগুণ ভালো আমি।”

উনি হো হো করে হেসে উঠলেন। আমি রাগত দৃষ্টিতে ওনার দিকে তাকালাম। উনি হেসেই চলেছেন। তখনই আবার ওনার ফোন বেজে উঠল। ভাবলাম এবার শুনে ছাড়ব কার সাথে কথা বলছে। কিন্তু উনি ফোন রিসিভ করে মামু বলতেই বুঝলাম বাবা ফোন করেছে। কতদূর এসেছি তা জানতেই ফোন করেছে বাবা। যদিও গাড়ির ভেতরে এসি চলছে, তবু কেমন যেন ভ্যাপসা গরমে আমার মাথা ঘুরছে। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। আমি মাথাটা সিটে এলিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করলাম। তাজ ভাই হঠাৎ গাড়ি থামালেন। আমি চোখ খুললাম না। উনি এগিয়ে এসে আমার পাশের জানালার কাঁচ নামিয়ে দিলেন। টের পেয়েও আমি চুপচাপ চোখ বন্ধ করে রইলাম। উনি দরজা খুলে গাড়ি থেকে বের হলেন। আমি এবার চোখ খুলে দেখলাম উনি রাস্তা পার হচ্ছেন। রাস্তার ওপারে যাচ্ছেন কেন বুঝলাম না। কিছুক্ষণের মধ্যেই উনি ফিরে এলেন। গাড়িতে উঠে উনি আমার দিকে কাগজে মুড়ানো কিছু একটা এগিয়ে ধরলেন। আমি ভ্রু কুঁচকে কাগজটার দিকে তাকাতেই উনি বললেন,“আমড়া মাখা।”

আমি এবার কাগজটা হাতে নিয়ে খুলে ফেললাম। এই মুহূর্তে এটা আমার প্রয়োজন ছিল। নিশ্চয়ই উনি মাইন্ড রিড করে জানতে পেরেছেন তাই নিয়ে এসেছেন। এসব দিকে শয়তানটার খেয়াল থাকে ভালো। উনি আবার গাড়ি স্টার্ট করলেন। আমি চুপচাপ আমড়া খেতে লাগলাম। জানালা দিয়ে মৃদুমন্দ বাতাস আসছে। এখন অনেকটা ভালো লাগছে। আমি আমড়ার কাগজটা ওনার দিকে বাড়িয়ে ধরলাম। উনি মাথা দুলিয়ে না করে দিলেন। আমি আমড়া খাওয়া শেষ করতে করতে জেমি জেগে উঠল। আমি ওকে পেছনের সিট থেকে আমার কোলে নিয়ে এলাম। উনি চুপচাপ গাড়ি চালাচ্ছেন। এত নীরবতা ভালো লাগছে না আমার। আমি নিজেই কথা বললাম,“দাদুমনি আপনাকে দেখলে খুশিতে কেঁদেই ফেলবে।”

উনি মৃদু হাসলেন। আমি প্রশ্ন করলাম,“আপনি সুইডেন থাকাকালীন দাদুমনি আর কাকাদের সাথে কথা হত না?”

উনি উত্তর দিলেন,“হুম, প্রায়ই হত।”

আমি হঠাৎ বলে বসলাম,“আমি রাজ ভাইয়া আর ভাবির সাথে কথা বলব।”

উনি একবার আমার দিকে তাকিয়ে তারপর আবার রাস্তার দিকে তাকিয়ে বললেন,“ওকে, গ্রামে পৌঁছে নেই আগে। ভাইয়া প্রায়ই তোর কথা জিজ্ঞেস করে মামুর কাছে।”

“ভাবি দেখতে কেমন?”

“কথা বললেই দেখতে পারবি।”

“ভাইয়া কি লাভ ম্যারেজ করেছে?”

“হুঁ।”

“কতদিনের রিলেশন ছিল?”

উনি আমার দিকে কপাল কুঁচকে তাকিয়ে বললেন,“এত বছর পর হঠাৎ এসব জানার ইচ্ছে জেগেছে তোর?”

আমি বললাম,“হ্যাঁ, আমি কারো সাথে কথা বলতাম না বলে এতদিন ইচ্ছেও জাগেনি। ”

“তাহলে এখন জাগার কারণ?”

“এমনি।”

তারপর আবার উনি চুপ মেরে গেলেন। আমি বিরক্ত হয়ে ব্যাগ থেকে ইয়ারফোন বের করে কানে গুঁজে গান শুনতে লাগলাম। ফোনের স্ক্রিনে দেখলাম বারোটা চার বাজে। পৌঁছতে হয়তো আর পনেরো/বিশ মিনিট লাগবে। আমি জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে প্রকৃতি দেখছি আর গান শুনছি। লোকটা চার ঘণ্টা ধরে গাড়ি চালাচ্ছে। অথচ ওনার মাঝে বিরক্ত বা ক্লান্তির রেশ মাত্র নেই। এভাবে অনেকটা সময় কেটে গেল। প্রায় বিশ মিনিটের মধ্যেই আমরা গ্রামে পৌঁছে গেলাম। গ্রামে পৌঁছেই আমার মনটা খুশিতে ভরে উঠল। বাড়ির গেট আগে থেকেই খোলা ছিল। হয়তো আমাদের জন্যই খুলে রেখেছে। তাজ ভাই গাড়ি নিয়ে বাড়ির উঠানে থামালেন। গাড়ি থামাতেই আমি সিট বেল্ট খুলে দরজা খুলে তাড়াতাড়ি গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ালাম। বাড়িটার দিকে তাকালাম। এবার অনেকদিন পর এসেছি গ্রামে। এই বাড়িটাতে আমার আম্মুর সংসার শুরু হয়েছিল। বাড়িটা একতলা হলেও বিশাল জায়গা নিয়ে করা। বাড়ির ভেতরে সবার জন্য আলাদা রুমের ব্যবস্থা আছে। দাদাভাই মূলত তার তিন ছেলের জন্যই বিশাল জায়গা জুড়ে বাড়িটা করেছিলেন। দাদাভাই আম্মুর মৃত্যুর দু’বছর আগেই মারা গিয়েছেন। আমার মেজো কাকা আর ছোটো কাকা তাদের স্ত্রী সন্তানদের নিয়ে একসাথে এই বাড়িতে থাকেন। দাদুমনিও তাদের সাথে থাকে। ছোটো কাকার ইচ্ছে ছিল শহরে গিয়ে থাকার। কিন্তু গ্রামে আমার দাদাভাইয়ের অনেক সম্পত্তি আছে। সেসব এখনও ভাগাভাগি হয়নি। তাই তারা গ্রামেই থেকে গেছেন। বাবা বছরে দু একবার আমাকে নিয়ে গ্রামে এসে ঘুরে যান। কাকারা আমার বাবাকে খুব মান্য করেন। পাশে তাকিয়ে দেখলাম তাজ ভাই বাড়িটার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। হয়তো ফুপির কথা ভাবছেন। অজান্তেই আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। বাড়ির ভেতর থেকে আমার ছোটো কাকা বেরিয়ে আসছেন। তার হাত ধরে এগিয়ে আসছে তার আট বছরের পিচ্চি মেয়েটা। আমাকে দেখেই ও কাকার হাত ছেড়ে এক দৌড়ে আমার কাছে এসে হাত ধরে উৎফুল্ল কন্ঠে বলল,“কেমন আছো ইলুপি?”

আমি হেসে নিচু হয়ে ওকে জড়িয়ে ধরে বললাম,“আমি অনেক ভালো আছি অলি বুড়ি। তুই কেমন আছিস?”

ও মিষ্টি হেসে বলল,“আমিও অন্নেক ভালো আছি।”

কাকা এগিয়ে আসতেই আমি আর তাজ ভাই হেসে ওনাকে সালাম দিলাম। উনি সালামের জবাব দিয়ে তাজ ভাইকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন,“এত বছর পর আমাদের মনে পড়ল তাহলে?”

তাজ ভাই কাকাকে ছেড়ে বললেন,“সবসময়ই মনে পড়ত মামু। তাই তো চলে এলাম।”

“ভেতরে চল। তোর নানুমনি তো সেই সকাল থেকে তোর পথ চেয়ে বসে আছে।” তাজ ভাই মাথা দুলিয়ে গাড়ি থেকে আমার আর ওনার লাগেজ নামালেন। অলি নিচু হয়ে জেমিকে কোলে তুলে নিয়ে আদর করতে লাগল। তাজ ভাই দুহাতে দুটো লাগেজ নিয়ে বাড়ির ভেতরে পা বাড়ালেন। কাকা ওনার থেকে একটা লাগেজ নিতে চাইলেন কিন্তু উনি দিলেন না। আমি অলির হাত ধরে তাজ ভাইয়ের সাথে বাড়িতে ঢুকলাম। বসার ঘরে পা রাখতেই দেখলাম বাড়ির প্রায় সব সদস্যরাই আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল। আমি দৌড়ে গিয়ে চেয়ারে বসা দাদুমনিকে জড়িয়ে ধরলাম। দাদুমনি হেসে বললেন,“আমার সতিনের আসার সময় হইল তাইলে?”

আমি ঠোঁট উল্টে বললাম,“তোমার ছেলেরই তো আসার সময় হয় না। আমার কী দোষ? আমি তো আসতেই চাই।”

দাদুমনি আমার কপালে চুমু দিলেন। আমার পেছনে দাঁড়িয়ে তাজ ভাই বললেন,“আমার জন্য কি একটু আদরও বাকি থাকবে?”

দাদুমনি আমাকে ছেড়ে দিয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। লাঠিতে ভর দিয়ে তাজ ভাইয়ের দিকে এগিয়ে গেলেন। আমি গিয়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরলাম। তাজ ভাই নিচু হয়ে দাদুমনিকে সালাম করলেন। দাদুমনি কাঁপা কাঁপা হাতে তাজ ভাইয়ের গালে হাত রেখে ধরা গলায় বললেন,“মাশা আল্লাহ্! আমার তাজওয়ার তো রাজপুত্তুর হইছে। ওগো মেজো বৌমা, ছোটো বৌমা দেহো আমার তাজওয়ার সাক্ষাৎ রাজপুত্তুরের মতো হইছে। আমি জানতাম তুই এমন রাজপুত্তুরের মতোই হবি। একদম আমার আলোর চেহারা পাইছোস ভাই। আমার আলো যদি আইজকা বাঁইচা থাকত তাইলে আটটা বছর পর তোরে দেখতে হইত না।”

বলতে বলতে দাদুমনি চোখের পানি ছেড়ে দিলেন। তাজ ভাই দাদুমনিকে জড়িয়ে ধরলেন। মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললেন,“কেঁদো না নানুমনি। এত বছর পর এসে তোমার কান্না দেখতে কি ভালো লাগে বলো?”

দাদুমনি আরও ফুঁপিয়ে উঠে বললেন,“আমার আলোরে বাঁচতে দিলো না ভাই। তোদের মা হারা করল। আমার রাজ ভাই আইবো না ভাই? ওর কি আমারে মনে পড়ে না?”

“পড়ে নানুমনি। ভাইয়া সবাইকে খুব মিস করে। ও বলছে এ বছরই একবার আসবে।”

“তুই আবার চইলা যাবি না-কি ভাই? থাকবি না দেশে?”

এই প্রশ্নের উত্তর আমিও জানতে চাই। ভালো হয়েছে দাদুমনি প্রশ্নটা করেছে। উনি দাদুমনিকে একটা চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে বললেন,“নিশ্চিত বলতে পারছি না নানুমনি। তবে এ বছরটা হয়তো থাকা হবে।”

আমি কিছুটা অবাক হলাম। উনি আবার চলে যাবেন? তার মানে আমার ধারণা ঠিক। উনি আমাকে পছন্দ করেন না। তাহলে চুড়ি কেন দিলেন? আপাতত এসব ভাবনা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেললাম। তাজ ভাইয়া এখন কাকিদের সাথে কথা বলছেন। এ বাড়িতে এলে অলিকে নিয়ে আমি আম্মুর রুমে থাকি। আমি তাজ ভাইয়ের পাশ থেকে লাগেজটা নিয়ে রুমের দিকে চলে গেলাম। পেছন থেকে মেজো কাকি বললেন,“ইলো, ঠান্ডা শরবত খেয়ে রুমে যাও।”

আমি যেতে যেতে বললাম,“এখন তাড়াতাড়ি গোসল করতে হবে কাকি। প্রচুর গরম লাগছে।”

রুমে ঢুকে দরজাটা আটকে দিলাম। লাগেজ খুলে জামাকাপড়গুলো বের করে আলমারিতে গুছিয়ে রাখলাম। তারপর সেখান থেকে একটা থ্রি-পিস নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকলাম। অনেকক্ষণ ধরে গোসল করে ওয়াশরুম থেকে বেরোতেই যোহরের আজান হলো। নামাজ পড়ে রুম থেকে বের হলাম। আশেপাশে তাজ ভাইকে চোখে পড়ল না। হয়তো রুমে আছেন। কোন রুমে আছেন তাও জানি না। জাহান্নামে থাক, আমার কী? মেজো কাকি আর ছোটো কাকি ডায়নিংয়ে খাবার সাজাচ্ছেন। মেজো কাকিকে প্রশ্ন করলাম,“কাকি, আফরা আপু ঘুম থেকে ওঠেনি এখনও?”

কাকি কাজ করতে করতে উত্তর দিলেন,“উঠেছে মনে হয়। রুমে গিয়ে দেখো। গিয়ে বলো খেতে ডাকছে।”

আমি মাথা দুলিয়ে আফরা আপুর রুমের দিকে গেলাম। মেজো কাকার এক ছেলে এক মেয়ে। আদিল ভাইয়া বড়ো আর আফরা আপু ছোটো। আদিল ভাইয়ার গতবছর সেনাবাহিনীতে চাকরি হয়েছে। আফরা আপু আমার থেকে তিন বছরের বড়ো। মেয়েটা দেখতে মাশা আল্লাহ্। আপু ঢাকাতেই পড়াশোনা করে। বাবা অনেকবার বলেছিল আমাদের বাসায় থাকতে কিন্তু সে হোস্টেল ছাড়তে রাজি হয়নি। আপু আমাদের বাসা চিনলেও কখনও যায় না। তাজ ভাই আসছেন শুনে আজ সকালেই বাড়ি ফিরেছেন। আমরা যখন এসেছি তখন সে ঘুমে ছিল। আপুর রুমের দরজা ভেজানো দেখে ভেতরে উঁকি দিয়ে আপুকে কয়েকবার ডাকলাম। কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে ভেতরে ঢুকলাম। ভেতরে আপুকে পেলাম না। তারপর সারা বাড়ি খুঁজতে লাগলাম। সব রুমে তল্লাশি চালিয়েও পেলাম না। হঠাৎ খেয়াল হলো কোনো রুমে তাজ ভাইকে দেখিনি। তাহলে কি ওনাকে আমার রুমের পাশের রুমে থাকতে দিয়েছে? একমাত্র ওই রুমটা খোঁজাই বাকি আছে। আল্লাহ্ বাঁচাও! আমার রুমের পাশেই শয়তানটাকে রুম দিলো। দৌড়ে গেলাম সেই রুমের সামনে। ঠিকই ধারণা করেছি। ভেতরে আফরা আপুর কথা শোনা যাচ্ছে। দরজা খোলা দেখে সোজা রুমে ঢুকে গেলাম। দেখলাম তাজ ভাই একপাশে দাঁড়িয়ে আছে আর আপু বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসে আছে। আমাকে দেখে আপু মিষ্টি হেসে বলল,“ইলো, কেমন আছিস?”

আমিও হেসে বললাম,“ভালো আছি আপু। তুমি?”

“আমিও ভালো আছি। এই রুমে এলি যে?”

“তোমাকে খুঁজছিলাম। তোমার রুমে না পেয়ে সারা বাড়ি খুঁজেছি। মেজো কাকি খেতে ডাকছে।”

“তুই যা, আমি তাজ ভাইয়ার সাথে আসছি।”

আমি তাজ ভাইয়ের দিকে তাকালাম। ওনার চোখে মুখে একরাশ বিরক্তি। হয়তো আফরা আপু জ্বালাচ্ছে। আরে বাহ্! এটা তো বেশ ভালো ব্যাপার। উনি আমাকে জ্বালায় আর আফরা আপু ওনাকে জ্বালায়। একদম ঠিক আছে। এবার শয়তানটা বুঝবে মজা। মনে মনে বেশ খুশি হয়ে মাথা দুলিয়ে চলে যাবার জন্য পা বাড়াতেই তাজ ভাই বলে উঠলেন,“আমার খুব ক্ষুধা পেয়েছে আফরা। আমি যাচ্ছি।”

কথাটা বলেই উনি আমাকে পাশ কাটিয়ে হনহন করে হেঁটে চলে গেলেন। আমি ঠোঁট টিপে হাসলাম। আফরা আপু হতাশ গলায় বললেন,“তাজ ভাইয়ার মতো এমন হ্যান্ডসাম, চার্মিং একটা ছেলে এতটা চুপচাপ স্বভাবের মানতে পারলাম না। উনি তো আগে এমন ছিল না।”

তাজ ভাই চুপচাপ স্বভাবের কথাটা শুনে আমি আহাম্মকের মতো তাকিয়ে রইলাম। শয়তানটা তাহলে ভদ্র সাজছে সবার সামনে। আমি তো জানি উনি ঠিক কতটা ভদ্র। আফরা আপুর দুঃখী দুঃখী মুখ দেখে আমি তাকে আরেকটু ফুঁসলিয়ে দেয়ার জন্য তার পাশে বসে বললাম,“কী ব্যাপার আপু? প্রেমে পড়লে না-কি?”

আপুর চোখ দুটো চকচক করে উঠল। সে মুচকি হেসে বলল,“হয়তো।”

আমি লাফিয়ে উঠে বললাম,“ওয়াও! এটা তো খুব ভালো কথা। চালিয়ে যাও আপু। অল দ্যা বেস্ট।”

আপু ঠোঁট উল্টে বলল,“কিন্তু তাজ ভাইয়া তো আমার সাথে ঠিকমতো কথাই বলছে না।”

আমি আপুর হাতের উপর হাত রেখে বললাম,“নো টেনশন। আমি আছি তো তোমার হেল্পিং হ্যান্ড হিসেবে।”

আপু খুশি হয়ে বলল,“সত্যি?”

আমি বললাম,“একদম। এখন চলো আগে খেয়ে নিই। তারপর এটা নিয়ে কথা বলব।”

আপু আমার হাত ধরে টেনে রুম থেকে বেরোতে বেরোতে বলল,“আচ্ছা, চল চল।”

চলবে…………………?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here