তাজ ইলোর প্রণয়ালাপন পর্ব:০৭

0
394

#তাজ-ইলোর প্রণয়ালাপন
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি
পর্ব:০৭

বিকাল চারটা পঁয়তাল্লিশ।‌ ড্রয়িংরুমে বসে টিভি দেখছি। খুব সুন্দর একটা হিন্দি সিরিয়াল হচ্ছে। আমার সম্পূর্ণ মনোযোগ এখন টিভির দিকে। টিভি যখন অন করেছিলাম তখন সুন্দরভাবে বসে ছিলাম। আর এখন সোফায় উবু হয়ে শুয়ে আছি। খুব আকর্ষণীয় একটা সিন হচ্ছে। নায়ক নায়িকাকে প্রপোজ করতে যাচ্ছে। যখনই নায়কটা নায়িকার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছে ঠিক তখনই টিভিটা বন্ধ হয়ে গেল। আমি হন্তদন্ত হয়ে উঠে বসলাম। ভাবলাম টিভির লাইনে কোনো সমস্যা হয়েছে। কিন্তু পাশে তাজ ভাইকে রিমোট হাতে আমার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আমার বুঝতে বাকি রইল না যে শয়তানটা টিভি বন্ধ করে দিয়েছে। আমি তার সামনে দাঁড়িয়ে ফুঁসে উঠে বললাম,“টিভি বন্ধ করলেন কেন আপনি? রিমোট দিন।”

উনি আমার মাথায় চাটি মেরে বিদ্রুপ করে বললেন,“এসব হিন্দি সিরিয়াল দেখে দেখে মোটা মাথাটাকে আরও মোটা বানাচ্ছিস? এবার বুঝতে পারছি তোর ঝগড়াটে হওয়ার আসল রহস্য। সব এই টিভির কেরামতি।”

আমি বিরক্তর সুরে বললাম,“রিমোটটা দিন তাড়াতাড়ি। আপনার আজাইরা বকবক পরে শুনব।”

উনি ভ্রু বাঁকিয়ে বললেন,“কেন? রোমান্টিক সিন দেখার জন্য এমন তাড়া দেখাচ্ছিস? ওয়েট কর, মামুকে বলব তার মেয়ের বিয়ের শখ জাগছে।”

“ফালতু কথা বলছেন কেন? আমি বলেছি আপনাকে বিয়ের কথা?”

“লজ্জায় মুখে বলতে পারছিস না বলেই তো ইঙ্গিতে বুঝানোর চেষ্টা চালাচ্ছিস। এইটুকুন একটা পিচ্চি, এত বেশি পেকে গেছিস!”

আমার এখন ওনার সাথে ঝগড়া করে সময় নষ্ট করার মতোও সময় নেই। সিরিয়ালটা শেষ হয়ে যাবে এখনই। আমি হাত বাড়িয়ে ওনার হাত থেকে রিমোট নেওয়ার চেষ্টা করে বললাম,“দিন তো।”

কিন্তু ওনার হাত পর্যন্ত আর পৌঁছানো হলো না। উনি ওনার হাতটা উঁচুতে তুলে ফেললেন। বার কয়েক চেষ্টা করার পরও ওনার হাত নাগাল পেলাম না। হাঁপাতে হাঁপাতে করুণ কন্ঠে বললাম,“দিন না ভাইয়া, থুক্কু ভাই।”

উনি আমার দিকে সরু চোখে তাকিয়ে রিমোটটা অপরপাশের সোফায় ছুঁড়ে মারলেন। রিমোটটা গিয়ে পড়ল অপরপাশের সোফায় ঘুমন্ত জেমির পায়ের কাছে। ও লাফ দিয়ে উঠে বসে পড়ল। আমি সেদিকে পা বাড়াতেই তাজ ভাই আমার হাত ধরে টানতে টানতে সিঁড়ির দিকে নিয়ে গেলেন। আমি থামার চেষ্টা করে অবাক কন্ঠে বললাম,“আরে আরে থামুন, হাতে ব্যথা পাচ্ছি তো। কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন?”

উনি সিঁড়ি ভেঙে উঠতে উঠতেই উত্তর দিলেন,“ছাদে।”

দোতলায় পা রেখেই আমি হাত ঝাড়া দিয়ে ওনার থেকে ছাড়িয়ে নিলাম। তারপর বাঁ হাত দিয়ে ডান হাতের কব্জি ঘষতে ঘষতে বললাম,“আপনি যাবেন তো আমাকে নিয়ে টানাহেঁচড়া করছেন কেন? আমি কি বলেছি ছাদে যাব?”

উনি এবার আমার বাঁ হাতের কব্জি ধরে আবার ছাদের দিকে টানতে টানতে নিয়ে গেলেন। আমি এত ছোটাছুটি করলাম, তাও রাক্ষসটা ছাড়ল না। ছাদে উঠে উনি আমার হাত ছেড়ে দিলেন। ছাদে পা রেখেই আমি বেশ অবাক হলাম। ছাদের এক কোণে ছোটো একটা টি-টেবিল আর দুটো বেতের চেয়ার রাখা আছে। আমি মাঝেমধ্যে এখানে এসে বসে বসে আকাশ দেখি। কিন্তু আমি অবাক হলাম টেবিলের ওপর সাজানো খাবার দেখে। সেদিকে কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে দেখলাম চা, বিস্কুট, নুডলস্ আর কয়েক রকমের ফল সাজানো আছে। তাজ ভাই এগিয়ে এসে একটা চেয়ারে আরাম করে বসে পড়লেন। আমি অবাক কন্ঠে প্রশ্ন করলাম,“এসব কে করেছে?”

উনি ভাব নিয়ে বললেন,“আগেই বলেছি আমি তোর মতো অকর্মা নই। এ বাড়িতে তুই আর আমি ছাড়া দ্বিতীয় কোনো ব্যাক্তি নেই এসব করার। কথা না বাড়িয়ে বসে পড়।”

আমি ত্যাড়াভাবে বললাম,“আমার এখন ইচ্ছে নেই এসব খাওয়ার। আপনি করেছেন আপনিই খান।”

উনি ভ্রুকুটি করে বললেন,“তোকে খেতে বলেছে কে? আমি তো শুধু বসতে বললাম। ভুলে যাস না তুই আমার এ্যাসিস্ট্যান্ট।”

আমি হঠাৎ প্রশ্ন করে বসলাম,“ঐ চিঠি আর পিকটা কী করেছেন আপনি?”

“আমার হেফাজতে রেখেছি। ওসব নিয়ে তোকে ভাবতে হবে না।”

ওনার খাপছাড়া কথায় আমি বেশ বিরক্ত হয়ে বললাম,“আমি তো আপনাকে সব কথা বলে দিয়েছি। তবুও ওগুলো ফেরত দিচ্ছেন না কেন?”

“সময় মতো পেয়ে যাবি।”

“সময়টা কত বছর পর হবে?”

“জানি না।”

“মানে কী?”

উনি বিরক্ত কন্ঠে বললেন,“মানে তোর মুন্ডু। এইটুকু একটা মাথায় এত চিন্তা কেন তোর? রিল্যাক্সে বোস এখানে।”

আমি ধপ করে সামনের চেয়ারটায় বসে বিড়বিড় করে বললাম,“আস্ত শয়তান সামনে থাকতে আবার রিল্যাক্স!”

উনি ফ্লাক্স থেকে কাপে চা ঢালতে ঢালতে বললেন,“যা বলার জোরেই বল। কষ্ট করে বিড়বিড় করার দরকার নেই।”

আমি কোনো উত্তর দিলাম না। আকাশের দিকে তাকিয়ে মনটা বেশ ভালো হয়ে গেল। আকাশটা আজ একটু বেশিই সুন্দর। যেন আমার মন ভালো করতেই আকাশ আজ নিজেকে নিখুঁতভাবে সাজিয়েছে। ফুরফুরে হাওয়া এসে গায়ে লাগছে। আমি মনোযোগ দিয়ে প্রকৃতি দেখতে ব্যস্ত। তাজ ভাইয়ের ডাকে ধ্যান ভাঙল। উনি আমার দিকে একটা চায়ের কাপ এগিয়ে দিলেন। আমি চুপচাপ হাত বাড়িয়ে কাপটা নিলাম। উনি চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বললেন,“আলুর নেহালের খবর কী?”

এত সুন্দর একটা পরিবেশে নেহালের কথা ওঠায় আমার মনটা কিছুটা খারাপ হয়ে গেল। তবু নিজেকে স্বাভাবিক রেখেই শান্ত স্বরে বললাম,“এখন এসব কথা না উঠালেও পারতেন। ওর খবর আমি জানব কীভাবে?”

তাজ ভাইয়া শুধু মাথা ঝাঁকালেন। তারপর দুজনেই চুপচাপ চা শেষ করলাম। উনি নিজের চা শেষ করে আমার দিকে এক বাটি নুডলস্ বাড়িয়ে দিলেন। কিন্তু ওনার বাটির দিকে তাকিয়ে দেখলাম ওটাতে অল্প একটু নুডলস্। আমি ভ্রুকুটি করে প্রশ্ন করলাম,“আপনি ওইটুকু নিয়েছেন কেন?”

উনি হেসে বললেন,“নডলস্ খুব একটা পছন্দ করি না আমি।”

আমি বেশ অবাক হয়ে বললাম,“পছন্দ না করলে বানিয়েছেন কেন?”

ওনার উত্তর,“ইচ্ছে হলো তাই।”

লোকটা অদ্ভুত! কখন কী করে বুঝি না। কিন্তু মনে মনে আমি একটু বেশিই অবাক হয়েছি। আমি সবসময় ভাবি বিকেলের সময়টা যদি কারও সাথে ছাদে বসে কাটাতে পারতাম তাহলে ব্যাপারটা বেশ জমে যেত। সঙ্গে চা আর নুডলস্ থাকলে তো কোনো কথাই নেই। কারণ নুডলস্ আমার খুব প্রিয়। এই একটা খাবারের প্রতি কখনও আমার রুচি যায় না। কিন্তু তাজ ভাই আমার ভাবনাটা সত্য করল কীভাবে? উনি কি তাহলে সত্যিই মাইন্ড রিড করতে পারেন? না কি সবটাই কাকতালীয় ব্যাপার? কী জানি! এই লোকটাকে বুঝার সাধ্য আমার নেই। তার থেকে ভালো নুডলস্ খাওয়ায় মনোযোগ দেই। মহারাজের বানানো নুডলস্ আবার খেতে কেমন লাগবে কে জানে? এক চামচ নুডলস্ মুখে দিয়ে মনে মনে ভাবলাম, বাহ্, খুব টেস্টি তো! শয়তানটার গুণের প্রশংসা করতে হয় বটে! কিন্তু মুখে তা প্রকাশ করলাম না। প্রশংসা করলেই মাথায় চড়ে বসবে। তাই চুপচাপ খেতে লাগলাম। উনি কয়েক চামচ নুডলস্ খেয়ে এখন ফল খাচ্ছেন। নুডলস্ শেষ করে আমি উঠে দাঁড়ালাম। ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে ছাদের রেলিং ধরে দাঁড়ালাম। নিচের দিকে উঁকি দিয়ে দেখলাম বাড়ির পেছনের দিকের ফাঁকা জায়গাটায় চৌদ্দ-পনেরো বছরের কয়েকজন ছেলে ক্রিকেট খেলছে। যদিও আমি এই খেলার আগামাথা কিছুই বুঝি না তবুও মনোযোগ দিয়ে ওদের খেলা দেখতে লাগলাম। হঠাৎ আমার খোপা খুলে চুলগুলো কাঁধে-পিঠে ছড়িয়ে গেল। আমি ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে দেখলাম তাজ ভাইয়ের হাতে আমার চুলের কাঠি।‌ বুঝলাম উনিই ইচ্ছে করে চুল খুলে ফেলেছেন। তবু কেন জানি এই মুহূর্তে আমার রাগ হলো না। আমি স্বাভাবিকভাবেই বললাম,“চুল খুললেন কেন? গরম লাগবে। কাঠি দিন।”

উনি আমার পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে নিচে উঁকি দিয়ে ঐ ছেলেগুলোর দিকে তাকিয়ে বললেন,“হাওয়া আছে, খোলা থাক।”

আমি আর কথা বাড়ালাম না। কেন জানি ওনাকে এই মুহূর্তে একটুও বিরক্ত লাগছে না। বরং সময়টার জন্য ভালোই লাগছে। মনে হচ্ছে আমার একাকীত্ব অনেকটা কমে গেছে। আমি সবসময় এমন একটা সময় মনেপ্রাণে চেয়েছিলাম। কিন্তু আমার জীবনে তো এসব ছোটোখাটো ইচ্ছে পূরণ করার মতো মানুষই নেই। সত্যিই কি নেই? যদি ভাবি আছে? সেটা কি ঠিক হবে? আমার বাঁ হাতের কব্জির দিকে তাকালাম। ফুপির অসাধারণ চুড়ি জোড়া চোখে পড়ল। এগুলো না-কি ওনার পুত্রবধূর জন্য। তাহলে তাজ ভাই এগুলো আমাকে কেন দিলেন? আমাকে কি উনি বিয়ে করতে চান? আজ সকালে ওমন অদ্ভুত আচরণ কেন করলেন? কেন বললেন উনি ছাড়া দ্বিতীয় কোনো ছেলে কোনোদিন আমার কাছে আসার সাহস দেখালে সেদিনই তার শেষ দিন হবে? উনি কি সত্যি সত্যিই আমাকে পছন্দ করেন? তাহলে মুখে কেন বলছেন না? ওনার হাবভাব দেখেও তো এমন কিছু বুঝার উপায় নেই। ধুর! এই লোকটা কী যে রহস্য তৈরি করছে আল্লাহ্ জানে। অকারণে তো আর আমাকে ফুপির পছন্দের চুড়ি পড়িয়ে দেননি। কিন্তু এসব প্রশ্নের উত্তর এখন আমি কোথায় পাব? ওনাকেও তো জিজ্ঞেস করা যাবে না। এমন যদি হয় উনি আমাকে পছন্দ করেন না তাহলে শুধু শুধু লজ্জা পাব। কী করা যায় এখন? আমি ভাবনায় ডুবে গেলাম। ওদিকে কেউ একজন যে গভীর দৃষ্টিতে আমার ভাবুক মুখটা দেখতে ব্যস্ত তা আর আমার জানা হলো না। হঠাৎ পাশ থেকে তাজ ভাই বললেন,“এই পিচ্চি, এইটুকুন একটা মাথায় এত এত ভাবনা আসে কোত্থেকে, হ্যাঁ? ভাবতে ভাবতে তো খুব শীঘ্রই পাগল হয়ে যাবি মনে হচ্ছে। কী এত ভাবনা তোর?”

আমি ওনার দিকে তাকালাম। উনি প্রশ্নভরা দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। আমি কিছু একটা বলতে গিয়েও মাথা নেড়ে বললাম,“কিছু না।”

ওনার থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে এসব ভাবনা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করলাম। কিন্তু আমার চেষ্টা বিফল হয়ে গেল তাজ ভাইয়ের মুখের একটা কথায়। উনি আমার কানের কাছে মুখ এনে ধীর কন্ঠে বললেন,“আমার মায়ের পছন্দের জিনিস যে হাত পাওনা ছিল, সেই হাতই পেয়েছে। আহনাফ তাজওয়ার বিশেষ কারণ ছাড়া কিছুই করে না।”

আমি ঘাড় ঘুরিয়ে ওনার দিকে তাকাতেই উনি আমার কাছ থেকে সরে দাঁড়ালেন। ওনার বলা কথাটা ভালোভাবে বুঝার চেষ্টা করলাম। উনি কি বুঝাতে চাইছেন? ফুপির পছন্দের জিনিস আমার পাওনা ছিল? কিন্তু কেন? আর উনি কোন বিশেষ কারণের কথা বলছেন? স্পষ্ট করে না বললে আমি বুঝব কীভাবে? আমি হঠাৎ প্রশ্ন করে বসলাম,“আপনি কোনো কথা স্পষ্টভাবে বলতে পারেন না?”

উনি মৃদু হাসলেন। ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি লেগে আছে। কিন্তু উনি আমার প্রশ্নের কোনো উত্তর দিলেন না। আমি জানি এই প্রশ্ন দ্বিতীয় বার করা বোকামি হবে। কারণ একবার যখন উনি উত্তর দেননি তো একশো বার জিজ্ঞেস করলেও দেবেন না। দুজনে নীরবতায় অনেকটা সময় কাটালাম। পাশাপাশি দাঁড়িয়ে সূর্যাস্ত দেখলাম। আমি তো আকাশ-পাতাল কতকিছুই ভেবেছি এতক্ষণে। আমার পাশে দাঁড়িয়ে মহারাজ কী ভেবেছেন কে জানে? ওনার মতো আমিও যদি মাইন্ড রিড করতে পারতাম তাহলে এত চিন্তা করে করে মাথা খারাপ হত না আমার। একসময় নীরবতা ভেঙে তাজ ভাই বললেন,“রুমে যা। সন্ধ্যা হয়ে আসছে।”

আমার এখন মোটেও রুমে যাওয়ার ইচ্ছে নেই। তবু মাথা দুলিয়ে চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়িয়েও থেমে গেলাম। টেবিলের দিকে এগিয়ে গিয়ে বাটি, ফ্লাক্স, চায়ের কাপ আর প্লেট ট্রেতে উঠিয়ে হাতে নিলাম। তাজ ভাই একবার আমার দিকে তাকিয়ে আবার চোখ ফিরিয়ে নিলেন। আমি ট্রেটা হাতে নিয়ে ধীর পায়ে ছাদ থেকে নেমে গেলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই মাগরিবের আজান শোনা গেল। আমি অজু করে নামাজ আদায় করলাম। নামাজ শেষ করে কিছুক্ষণ জেমিকে নিয়ে খেলা করলাম। তাজ ভাই একা একা কী করছেন কে জানে? নামাজ পড়ে মসজিদ থেকে ফিরেছেন কি না তাও জানি না। এতক্ষণে নিশ্চয়ই ফিরে এসেছেন। যাকগে, ওনাকে নিয়ে ভেবে ভেবে সময় নষ্ট করে আমার লাভ নেই। তবুও যে কেন বারবার না চাইতেও ওনার কথাই মনে পড়ে তা মনই ভালো জানে। আমার ভাবনার মাঝেই তাজ ভাই রুমে ঢুকলেন। ওনার হাতে ওনার ল্যাপটপটা। এটা নিয়ে আমার রুমে আসার কারণ খুঁজে পেলাম না। আমি প্রশ্নভরা দৃষ্টিতে ওনার দিকে তাকালাম। উনি ল্যাপটপ নিয়ে আমার বিছানায় পা ভাঁজ করে বসে পড়লেন। ল্যাপটপ খুলতে খুলতে আমার দিকে না তাকিয়েই বললেন,“পড়তে বোস।”

আমি বললাম,“একটু পরে বসব।”

উনি চোখ পাকিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,“সামনে না তোর এক্সাম? আগামী এক সপ্তাহ গ্রামে কাটিয়ে তো পড়াশোনা চান্দে উঠিয়ে রাখবি। যা তাড়াতাড়ি পড়তে বোস।”

ওনার সাথে আবার ঝগড়া বাঁধার উপক্রম দেখে গাল ফুলিয়ে চুপচাপ বিছানা থেকে নেমে পড়ার টেবিলে গিয়ে বসে পড়লাম। বই বের করে পড়তে শুরু করলাম। মাঝে মাঝে আড়চোখে মহাশয়ের দিকে তাকালাম। ওনার সম্পূর্ণ মনোযোগ ল্যাপটপের দিকে। কী এত দেখছেন উনিই জানেন। এশার আজান শোনার সঙ্গে সঙ্গে উনি উঠে পড়লেন। ল্যাপটপ নিয়ে রুম থেকে বেরোতে বেরোতে বললেন,“নামাজ পড়ে তারপর আবার পড়তে বোস।”

আমার মনে একটা প্রশ্ন জাগলো। লোকটা কি সুইডেন থাকাকালীনও এমন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তেন? দেশে ফেরার পর তো কখনও দেখিনি মসজিদে যেতে। আজই প্রথম দেখলাম পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তে। আমি বই বন্ধ করে অজু করে নামাজে দাঁড়ালাম। নামাজ শেষ করে আবার পড়তে বসলাম। একটানা পড়তে পড়তে রাত নয়টা আটান্নর দিকে হঠাৎ মনে পড়ল আজ রাতের খাবার তো আমার রান্না করার কথা‌ ছিল। হায় হায়! আমার তো মনেই ছিল না। এখন? যদিও আমার তেমন ক্ষুধা পায়নি। রাতে না খেলেও চলবে। কিন্তু তাজ ভাই? ওই রাক্ষসটা তো আমাকে তুলে আছাড় মারবে। উনি তো রান্নার কথা কিছু বললেনও না। মনে হয় আমার মতো উনিও ভুলে বসে আছেন। এখনই তো খাবার টেবিলে বসে ডাকাডাকি শুরু করে দিবেন। উফ্! ভাল্লাগে না। কী করব এখন? আমার ভাবাভাবির মাঝেই তাজ ভাইয়ের ডাক পড়ল। আমি বই বন্ধ করে এক লাফে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম। কিন্তু ওনার সামনে যেতে ইচ্ছে করছে না। গেলেই রান্না না করার কারণে একগাদা কথা শুনাবেন। কিন্তু উনি তো ডেকেই চলেছেন। উপায় না পেয়ে রুম থেকে বেরিয়ে এলাম। খাবার টেবিলের সামনে আসতেই খুশি হয়ে গেলাম। তাজ ভাই প্যাকেট থেকে বার্গার আর চিকেন ফ্রাই বের করছে। যাক ভালোই হয়েছে। এমনিতেও এখন ভাত খাওয়ার ইচ্ছে ছিল না। তাও তো আবার রান্না করিনি। আমাকে দেখে উনি ওনার পাশের চেয়ারের দিকে ইশারা করে বললেন,“বোস।”

আমি ওনার অপরপাশের একটা চেয়ার টেনে বসে পড়লাম। উনি আমার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললেন,“ওখানে বসতে বলেছি?”

আমি বললাম,“এক জায়গায় বসলেই হয়।”

উনি আবার বললেন,“চুপচাপ এখানে এসে বোস। বসের কথা মানতে শিখ।”

বস না ছাই! শয়তান একটা। মনে মনে ওনাকে বকতে বকতে উঠে গিয়ে ওনার পাশের চেয়ারে বসলাম। উনি একটা প্লেট আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন,“তোর মতো অকর্মা মেয়ে দিয়ে যে কোনো কাজই ঠিকমতো হবে না তা আমার ভালো করেই জানা আছে। রান্নার কথা ভুলে বসে আছিস কীভাবে?”

আমি গোমড়া মুখে বললাম,“কখনও তো রান্না করি না। তাই মনেও ছিল না।”

উনি বিদ্রুপ করে বললেন,“তা মনে থাকবে কেন? গেলার কথা মনে থাকে শুধু। সাধেই কি বলি আমার ভোলাভালা মামুর অন্ন ধ্বংস হচ্ছে?”

আমি বিরক্ত হয়ে ওনার দিকে তাকাতেই উনি বললেন,“চুপচাপ পুরোটা খেয়ে শেষ করে তারপর উঠবি।”

তারপর উনি খাওয়া শুরু করলেন। আমিও গাল ফুলিয়ে খেতে লাগলাম। খাওয়া শেষ করে প্লেটগুলো পরিষ্কার করে ড্রয়িংরুমের দিকে পা বাড়ালাম। ভাবলাম কিছুক্ষণ টিভি দেখে তারপর ঘুমাব। কিন্তু ড্রয়িংরুমে পা রেখেই দেখলাম মহারাজ আরামসে সোফায় শুয়ে শুয়ে টিভির চ্যানেল পাল্টাচ্ছেন। উনি আমাকে দেখেই হুকুম জারি করলেন,“এখন এখানে কী? ঘুমাতে যা।”

আমি বিরক্ত হয়ে জেমির জন্য খাবার নিয়ে রুমে চলে এলাম। জেমিকে খেতে দিতেই মনে পড়ল কাল সকাল নয়টায় গ্রামে রওনা দেবো। অথচ আমি এখনও প্যাকিংই করিনি। তাড়াতাড়ি প্যাকিং করতে লেগে পড়লাম। খুব বেশি সময় লাগল না কাজটা করতে। তারপর দরজাটা ভেজিয়ে শুয়ে পড়লাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমের রাজ্যে পাড়ি জমালাম। পরদিন ভোরবেলা আবার তাজ ভাইয়ের ডাকে ঘুম ভাঙল। আমি জেগে উঠতেই উনি মসজিদে চলে গেলেন। আমি নামাজ আদায় করে কুরআন তেলাওয়াত করলাম। তারপর ভাবলাম তাড়াতাড়ি সকালের নাস্তা তৈরি করতে হবে। রান্না ঘরে ঢুকেই বিরক্তি এসে গেল। আজ আবার রুটি বানানোর মতো বিখ্যাত ঝামেলা পোহাতে হবে। ধুর! ময়দা নামাতেই তাজ ভাই এসে রান্নাঘরে উপস্থিত। ওনাকে দেখেই আমার গতকালের ঘটনা মনে পড়ে গেল। আমি একটা শুকনো ঢোক গিলে বললাম,“আমি একাই পারব।”

উনি আমার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে এগিয়ে এসে ময়দা আর পানির পরিমাণ দেখিয়ে দিলেন। তারপর রান্নাঘর থেকে বেরোতে বেরোতে বললেন,“চা পাইনি আজ।”

আমি ময়দা মাখিয়ে চা করলাম। এক কাপ চা নিয়ে তাজ ভাইয়ের রুমে গেলাম। উনি বোধ হয় ওয়াশরুমে আছেন। তাই বেড সাইড টেবিলে চায়ের কাপটা রেখে উঁচু গলায় বললাম,“চা রেখে গেছি।” তারপর ওনার রুম থেকে বেরিয়ে রান্নাঘরে গিয়ে রুটি বানানো শুরু করলাম। আজও গতকালের মতোই আঁকাবাঁকা রুটি হয়েছে। যাকগে, কিছু করার নেই। রুটি আর ডিম ভেজে টেবিলে নিয়ে এলাম। তাজ ভাইকে ডাকার আগে উনি নিজেই চলে এলেন। দুজনে তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ করলাম। রান্নাঘরটা ভালোভাবে পরিষ্কার করে আমি রেডি হতে লেগে পড়লাম। ভাগ্যিস গতকাল রাতে প্যাকিংয়ের কথা মনে পড়েছিল। নইলে এখন রেডি হওয়ার বদলে প্যাকিং করতে হত। তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে লাগেজ নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে এলাম। তাজ ভাই আমার রুমের বাইরেই দাঁড়িয়ে ছিলেন। হয়তো আমাকে ডাকতেই এসেছিলেন। ওনার হাতে তো লাগেজ দেখছি না। বোধ হয় গাড়িতে রেখে এসেছেন। লোকটা আজ লেমন কালারের পাঞ্জাবি পরেছেন। হাতে ঘড়ি, চোখে সানগ্লাস। মনে তো হচ্ছে স্বয়ং হিরো দাঁড়িয়ে আছে আমার সামনে। কিন্তু না, আমার ক্রাশ খাওয়া চলবে না। এই বিপজ্জনক লোকের থেকে দূরত্ব বজায় রাখাই শ্রেয়। আজ আবার আরেকটা ব্যাপারে খটকা লাগল আমার। উনি কি কোনোভাবে আমার মাইন্ড রিড করে জানতে পেরেছেন যে আমি পাঞ্জাবি পছন্দ করি? সেজন্যই পাঞ্জাবি পরা শুরু করেছেন, না কি এটাও কাকতালীয় ব্যাপার? কী যে হচ্ছে, সব মাথার ওপর দিয়ে চলে যাচ্ছে! তাজ ভাই আমার হাত থেকে লাগেজটা নিয়ে দরজার দিকে পা বাড়ালেন। আমি জেমিকে কোলে তুলে নিয়ে ওনার পিছু পিছু বেরিয়ে এসে দরজা লক করলাম। তারপর গিয়ে দুজনে গাড়িতে উঠে বসলাম। উনি দারোয়ান কাকাকে বলে গাড়ি স্টার্ট করলেন। আমার মনটা বেশ ফুরফুরে লাগছে। কারণ গ্রামে কাটানো দিনগুলো আমার কাছে খুব আনন্দদায়ক হয়। তাছাড়া গ্রামে পৌঁছেই আমি বাবাকে দেখতে পারব।

চলবে………………..?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here