তবু মনে রেখো শেষ পর্ব

0
134

#তবু_মনে_রেখো
#নাজমুন_বৃষ্টি
#পর্ব_১৪(অন্তিম পর্ব)

আনিস মিয়া খোলা দরজার দিকে দৃষ্টি দিল। সে একবার খোলা দরজার দিকে তাকালো আরেকবার কুসুমের দিকে। তিনি অভিজ্ঞের মতো করে মৃদু আলো ঘরের চারদিকে দৃষ্টি ঘুরালো। না, সম্পূর্ণ ঘর নীরব। তাহলে কী তার ধারণায় সঠিক! এজন্যই কী জোহরা এই কয়দিন একদম চুপ ছিল! আনিস মিয়ার ঘুম ভেঙে যাওয়াতে প্রথমে রাগ হলেও এখন মনে হচ্ছে যা হয়েছে ভালোই হয়েছে।
আনিস মিয়া খোলা দরজার সামনে থেকে কুসুমকে সরতে ইশারা করলো। কিন্তু কুসুম যেন ভয়ে নড়াচড়া করতে ভুলে গিয়েছে।
আনিস মিয়া দ্বিতীয়বার জোরে ধমক দিয়ে সরতে বলতেই কুসুম ভয়ে কাচুমাছু ভঙ্গিতে দরজার পাশ থেকে সরে দাঁড়ালো। আজকের মতো বাবাকে তার আর ভয়ঙ্কর কোনসময় লাগেনি। অথচ বাবা এখনো কিছুই বলেনি তবুও তার কেন জানি ভয় ভয় লাগছে।

আনিস মিয়া কুসুমের পাশ কেটে বারান্দায় গেল। না, কেউ নেই। তাইলে তার ধারণায় সঠিক। সে হুড়মুড়িয়ে আঁধারের মাঝে দ্রুত গতিতে পা বাড়ালেন।
বাবার এমন তাড়াহুড়ো করে হাঁটা দেখে কুসুম বেরিয়ে এলো। তার চোখের সামনেই বাবা কয়েকসেকেন্ডের মাঝে পথের দিকে মিলিয়ে গেলেন।
কুসুম আঁধারের মাঝে চারদিকে তাকালো। অন্যসময় আপা সাথে থাকলেও ভয় লাগে অথচ আজ সে সম্পূর্ণ একা হয়েও ভয় লাগছে না। তার একটাই ভয়, বাবা যেন আপাকে ধরতে না পারে। বাস যেন ছেড়ে দেয়। সে তাড়াতাড়ি ঘরে ঢুকে দেয়ালে থাকা আধ পুরোনো ঘড়িটার দিকে দৃষ্টি দিল। মাত্র সাড়ে দশটা। বাস ছাড়তে এখনো আধঘন্টা বাকী! তবে কী আপাকে ধরে ফেলবে! কুসুমের ভয়ে হাত পা জমে এলো। সে মনে প্রাণে দোয়া করতে লাগলো।

জোহরা বাসের সিটে মেয়েকে বসিয়ে আস্বস্ত করলো। সে সন্ধ্যাকে বসিয়ে নেমে যেতে নিলে সন্ধ্যা জোহরার হাত ধরে ফেলল। তা দেখে জোহরা মেয়ের পাশের সিটে বসে ভরসা দিলেন। কিন্তু বেশিক্ষন পারলো না। পাশের সিটের মহিলাটা তাড়া দিল জোহরাকে সিট্ ছাড়তে। আর কিছুক্ষন পরে বাস ছেড়ে দিবে। জোহরা বাস থেকে নেমে বাইরে সন্ধ্যার সিটের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। সন্ধ্যা জানালার বাইরে থাকা বোরকা পরিহিত আগাগোড়া মুখ ঢাকা মায়ের হাত ধরে রইল।
আরেকটু পড়েই চিরচেনা এই জায়গা ছেড়ে যাবে। সে কী আদৌ পারবে! সন্ধ্যার ভয় ভয় অনুভূতি হতেই সে জানালার বাইরে থাকা মায়ের হাত আরো জোরে চেপে ধরলো। মা মেয়ের মুখে কোনো কথা নেই কিন্তু মনে মনে অনেক কথা হয়ে যাচ্ছে। জোহরাও ভয় পাচ্ছে কিন্তু মেয়েকে দেখাচ্ছে না।
বাস ছাড়বে। ঠিক সেসময় পেছনে থেকে কয়েকজন মানুষের শরগোল শোনা গেল। জোহরা পেছনে ফিরে তাকাতেই চমকে গেল। আনিস মিয়া হারুনকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হারুন সন্ধ্যার দিকে তাকিয়ে হাসি দিল। যে হাসিটা দিয়ে সে অনেক কিছু বুঝিয়ে ফেলছে। তা দেখেই সন্ধ্যা ভয়ে মায়ের হাত চেপে ধরলো তার কী তবে আর যাওয়া হলো না!

——–

সকাল নেমে এলো। সন্ধ্যা মেঝেতে হাটু মুড়ে বসে আছে। রাত থেকে সকাল ফুটে গেল অথচ তার চোখে ঘুম আর ধরা দেয়নি। ঘুম আসবেই বা কীভাবে! এইতো আসরের পড়েই তার কাবিন হয়ে যাবে। চোখের পলকে বাকী সময়টুকুও কেটে যাবে। সন্ধ্যা চোখ মুছে নিল। চোখের পানি যেন বাঁধ মানছে না। মা বোন কাউকে রাতের পর থেকে আর দেখেনি। দেখবেই বা কী করে! সে যে রুম বন্দী। সে জানে তাদেরকে বাবাই আটকে রেখেছে।
সন্ধ্যা তার কপালকে মেনে নিল। যা হওয়ার হবে।কপালের লিখন তো খন্ডানো যায় না। সন্ধ্যা নিজেকে মানাতে চেষ্টা করলো। হয়ত হারুনের সাথেই তার জীবন লেখা আছে। এখন আর কিছুই তো হাতে নেই। জীবনটা নাহয় অপছন্দের মানুষের সাথেই কাটিয়ে দিবে। হয়ত এটাই তার কপালে লেখা ছিল। নিজেকে হাজার মানানোর চেষ্টা করলেও তার ভয় ভয় অনুভূতি হচ্ছে। বারবার মুহিবের চেহারা ভেসে উঠছে। আচ্ছা, মুহিব কী চিঠিগুলো দেখবে না! তার আর মুহিবের সুন্দর মুহূর্তগুলো তবে কী কল্পনায় রয়ে গেল! মুহিবের কথা মনে পড়তেই তার চোখ গড়িয়ে জল নেমে এলো। এতসব সুন্দর মুহূর্ত ভুলে আদৌ কী সে হারুনের সাথে নিজেকে আবদ্ধ করতে পারবে! সন্ধ্যা নিজেকে শক্ত করলো। এটা ছাড়া আর উপায় নেই। পারতে তো তাকে হবেই। মা বোনের দিকে তাকিয়ে হলেও এসব মেনে নিতে হবে।
সন্ধ্যা রুমের বন্ধ দরজার দিকে অশ্রুমাখা চোখে তাকালো। সেই রাত থেকে সে রুম বন্দী। এখনো কেউ দরজা খুলল না। সন্ধ্যা চোখ মুছে নিল। জানালায় টক টক আওয়াজ হতেই এক মুহূর্তে সে খুশি হয়ে গেল। তার মনে হলো মুহিব বোধহয় এসে পড়েছে। তাহলে সে কী চিঠিগুলো পড়েছে! সব কী তবে ঠিক হয়ে যাবে! দ্বিতীয়বার আওয়াজ পেতেই সন্ধ্যা উৎফুল্ল হয়ে বসা থেকে উঠে দৌড়ে জানালার ধারে এগিয়ে গেল। খুশি খুশি রবে সে জানালা খুলতেই চমকে গেল। হারুন বি’শ্রী ভাবে হেসে তার দিকে তাকিয়ে আছে। সন্ধ্যার ভাবতেও ঘৃ’ণা লাগছে যে এই মানুষটার সাথেই তার বাকিটা জীবন কাটাতে হবে! সন্ধ্যা জানালা বন্ধ করে দিতে গেলে হারুন খপ করে গ্রিলের ভেতর দিয়ে জানালার কব্জা ধরে ফেলল। সে সরে যেতে নিতেই হারুন শিকল ভেদ করে তার হাত ধরে ফেলল। হারুন শক্ত করে সন্ধ্যার হাত চেপে ধরে আছে। সন্ধ্যার ব্যথায় চোখ ভরে উঠল। এই দক্ষিণ দিকটাতে কেউ আসে না। তাই হারুনের এই অস’ভ্য’তা’মি কারোর চোখে পড়বে না। সন্ধ্যা তাচ্ছিল্য হাসলো। চোখে পড়লেও বা কী! তার বিয়ে তো কিছুক্ষন বাদেই হবে।
হারুন সন্ধ্যার হাত আরো মুচ’ড়ে ধরতেই সন্ধ্যার চোখ গড়িয়ে পানি নেমে এলো। সে বুঝতে পারলো, হারুন এটা ইচ্ছে করেই করছে। ব্যথায় সন্ধ্যা হাত ছাড়ার চেষ্টা করলো তাতে হারুনের কোনো মাথা ব্যথা নেই। সে আবারো গা জ্বা’লা’নো হাসির সহিত বলে উঠল,
‘খুব বা’ড় বেড়ে গেছে না তোর? আমারে থা’প্প’ড় মারছিলি না?এই হারুনরে মা’র’ছিলি। এই হাত দিয়ে না?আজকে রাতেই তোর এসব মি’টি’য়ে দিমু।’ বলেই আবারো বলে উঠল,
‘তোরে মুই বিয়া করতাছি শুধুমাত্র তোরে শিক্ষা দিতে আর কিছুইনা। তোরে ভো’গ কইরাই ছা’ই’ড়া দিমু। তোর অ’হং’কার মুই মাটিতে পিই’ষা ছুঁ’ই’ড়া মার’মু।’

সন্ধ্যা হাত ছাড়ানোর বৃথা চেষ্টা করে অনুনয়ের সুরে বলে উঠল,
‘আমাকে ছেড়ে দিন দয়া করে। ব্য’থা পাচ্ছি।’
সন্ধ্যার কথা শুনে হারুন যেন ম’জা পেল। সে হেসে হাত আরো জোরে চেপে ধরে ক্ষো’ভে’র সহিত শা’সা’লো,
‘ছাইড়া তো দিমু, তোর এই হাতটা আমি শে’ষ কইরা দিমু। থা’প্প’ড় দেওয়ার শোধটা লইয়া লই। হারুনরে অবজ্ঞা করছিলি না? আর মাত্র কিছুক্ষন সময়। তারপরই তোর তো আমার কাছে যাইতেই হইবো। তোর লগে বহুত হিসাব-নিকাশ বাকী। এগুলা আগে কই’ষা লই,এরপরই ছুঁ’ই’ড়া মারমু আমার জীবন থেইকা।’ বলেই হারুন বি’শ্রী ভাবে হেসে চলে গেল। আর সন্ধ্যা লাল হয়ে যাওয়া হাতটা ধরে ওখানেই বসে গেল। এই কার সাথে তার জীবন সে আবদ্ধ করবে! হারুনের কর্মকান্ডে বুঝিয়ে দিয়েছে যে সে ভালোবেসে কিছুই করছে না। সে শুধুমাত্র ক্ষো’ভের ব’শে সব করছে। এমন অমা’নু’ষে’র সাথে সে যে পারবে না নিজের জীবন জড়াতে! আর না পারবে এভাবে বেঁচে থাকতে।
সন্ধ্যা চোখ মুছে উঠে দাঁড়ালো। মুহূর্তের মধ্যেই সে বড়ো একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল। সে শেষবারের মতো দরজার দিকে এগিয়ে গেল। আগের ন্যায় আবারো দরজা ধাক্কালো। না, দরজা খুলল না। সন্ধ্যা জানে, তার মা বোন দুজনেই অন্য রুমে বন্দী। সে রাতেই শুনেছিল ওদের আওয়াজ। সন্ধ্যা হাসলো। তার জন্য সবাইকে কতটা না বেগ পোহাতে হচ্ছে! সে মনে মনে আওড়ালো। আর কয়েকটা মিনিট মাত্র। তারপর সব ঠিক হয়ে যাবে আবারো। সে বন্ধ দরজার দিকে তাকিয়ে অশ্রুমাখা কণ্ঠে বিড়বিড় করে বলে উঠল,’ক্ষমা করে দিও আমায় মা। তোমার যোগ্য মেয়ে হতে পারলাম না। তোমার স্বপ্ন আমি পূরণ করতে পারলাম না। পড়াশোনা করে তোমার মনমতো তোমার অপূরণগুলো পূরণ করতে পারলাম না। কুসুমই নাহয় আমার অপূর্ণতা গুলো পূরণ করে দিবে। জানি, তুমি কষ্ট পাবে আমাকে হারিয়ে। বিশ্বাস করো, কয়দিন গেলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।’
সন্ধ্যা আলমারির দিকে এগিয়ে গেল। আলমারি খুলে তার সবচেয়ে পছন্দের জামার উড়নাটা হাতে নিল। উড়নাটার দিকে তাকিয়ে সে কান্নার মাঝে মলিন হাসলো। মা সেইবছর ঈদে কতই না কষ্ট করে জামাটা কিনে দিয়েছিল!
সন্ধ্যা চোখ মুছে ফেলল। তার নরম হলে চলবে না।
সন্ধ্যা উড়নাটা গিট দিয়ে রুমের চারপাশে তাকালো। কত স্মৃতি!শেষবারের মতো চোখের পাতায় সব ভেসে উঠল। চারদিকে সবুজ বিলের মাঝে দুহাত ছড়িয়ে উৎফুল্ল হয়ে ঘুরা। হাত বাড়িয়ে ছোট বোনটাকে আগলে নেওয়া। জানালা দিয়ে আঁধারের মাঝে অশ্রুমাখা চোখে প্ৰিয় পুরুষটিকে বিদায় দেওয়া! বাবা নামক মানুষটার কথা। পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর মাকে দুহাত বাড়িয়ে জড়িয়ে ধরা। রুম থেকে রিনরিনে কণ্ঠে বোনকে ডাকা। বোনটা এসে আপাকে পরম আদরে জড়িয়ে নেওয়া। সন্ধ্যা আর ভাবতে পারলো না। চোখ বুজে উড়নাটা পড়ে নিল। এরপর! পায়ের নিচের চেয়ার সরে খাট থেকে পড়ে গেল। তারপর! থেমে গেল সব।
বদ্ধ রুম থেকে কিছু একটার আওয়াজ হতেই আনিস মিয়া বার কয়েক ডাকলো কিন্তু সাড়া শব্দ না পেয়ে তিনি দৌড়ে দরজার তালা খুলল। আনিস মিয়ার দৌড়ানো দেখে জোহরা কুসুমও পিছু পিছু দৌড়ে এলো। তিনি দরজার তালা খুলে ওখানেই ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। তার পা দুটি যেন কিছু একটার সাথে আটকে গেছে। জোহরা আনিস মিয়াকে সরিয়ে নিজে পা বাড়ালো কিন্তু পা আর বাড়াতে পারলো না। সেও ওখানেই থেমে গেল। মুহূর্তেই স্তব্ধ হয়ে গেল সব।
ততক্ষনে থেমে গিয়েছে সব। নিস্প্রা’ন জু’ল’ন্ত দেহ চোখের সামনে ভেসে উঠল। দেহটির ছ’টপ’টা’নি থেমে গিয়েছে। খুঁটির সাথে জু’ল’ন্ত দেহটির পা দুইটি শেষবারের মতো নড়ে উঠল। পা দুইটির একটিতে পায়েল আছে। মনে হচ্ছে সেটা হাতছানি দিয়ে জোহরাকেই ডাকছে আর বলছে,’দেখো মা, শেষবারের মতোও তোমার কষ্টের অর্জিত পায়েলটি খুলিনি।’ সম্পূর্ণ নীরব রুমের একটি অসমাপ্ত প্রণ’য়ে’র নি’স্প্রা’ন দেহ জু’ল’ছে। যার খোলা চোখে এখনো পানির অস্তিত্ব চিকচিক করছে। চাঁদের মতো সুন্দর মুখটির গালদুটি শেষবারের মতো ভিজে আছে। সেই খোলা চোখের পানিগুলো যেন জানান দিচ্ছে সেও সুখী হতে পারতো তার মানুষটার সাথে!তার জীবনও আজ অন্যদিকে থাকার কথা ছিল। আফসোস! এসবকিছু কল্পনাতেই রয়ে গেল! আর কোনোদিন হবে না এই চঞ্চল বোকা মেয়েটার সাথে কথা। থেমে গেল সব।
আর কোনোদিন প্ৰিয়মানুষটির সাথে একসাথে সূর্যোদয় উপভোগ করা হবে না। আর কোনোদিন শীতের সকালে পাঠাঝরা শিশিরকনার ঘাসের উপর প্ৰিয়পুরুষের সাথে একসাথে পা মিলিয়ে চলা হবে না। সবকিছুর সমাপ্তি যে টেনে নিল প্রেমিকা নামক মেয়েটি। মুহিব কী আদৌ জানতে পারবে! তার মস্তিষ্কে ঘুরে বেড়ানো সেই মেয়েটির শেষ পরিণতি!
সেই চঞ্চল, সবার হৃদয় মাতিয়ে রাখা মেয়েটার সাথে তাদের সবার পথচলা এখানেই সমাপ্তি।

#সমাপ্ত
(আসসালামু আলাইকুম। অবশেষে শেষ হলো। অনেক ইনাক্টিভ হয়ে গিয়েছিলাম সেজন্য ক্ষমাপ্রার্থী। এমন এন্ডিংয়ের জন্য ক্ষমাপ্রার্থী। )

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here