তবু মনে রেখো পর্ব ৬

0
67

#তবু_মনে_রেখো
#নাজমুন_বৃষ্টি
#পর্ব_৬

সালেহা বেগম আজ ছেলের পছন্দমতো সব রান্না করেছে। ছেলে এতদিন কাছে ছিল তার মন শান্ত ছিল। আবার এতগুলো দিন বাইরে থাকবে!
মুহিব খেয়ে মায়ের আঁচলে হাত-মুখ মুছে উঠে দাঁড়ালো। তা দেখে সালেহা বেগম হাসলেন। ছেলেটার আর এই স্বভাবটা গেল না। এতো বকাঝকা করেন তাও ছেলে খেয়ে হাতমুখ মুছবে মায়ের আঁচলে।
‘বাসের টিকেট কয়টার নিছিস বাবা?’
‘এইতো এখনই রওনা দিবো। বাবা কই!’
‘রুমে আছে।’
মুহিব মায়ের কথা শুনে সিঁড়ি বেয়ে রুমের উদ্দেশ্যে রওনা দিল। আগে রুম থেকে সব ব্যাগপত্র নিয়ে আসা যাক। তারপর নাহয় বাবাকে বলবে।
মুহিব রুম থেকে বেরোবার সময় বইয়ের মাঝ থেকে চিঠিটা নিয়ে পকেটে গুঁজে নিল। হারুনও হাতে হাতে মুহিবের ব্যাগটা নিয়ে নেমে এলো।
সালেহা বেগম দুজনকে ধরে ব্যাগ নামাতে দেখে বললেন,
‘এতো কষ্ট করে বইগুলো শুধু শুধু আনতে গেলি। পড়া তো হয়নি।’
মুহিব ব্যাগের দিকে তাকালো। আসলেই এইবার তো ভুলেও বই খোলা হয়নি।
হারুন চাচীর দিকে তাকালো,
‘আহঃ চাচী। আন্নের পোলা বই আনছিল সেটার সামান্য বোঝাটা বহন করতাছে তাও আপনার সহ্য হচ্ছে না!’
মুহিব বাঁধ সাধলো,’মা তো মাই হয়। সন্তানের এইসব বোঝা তাদের জন্য অনেক কিছু।’
হারুন শুধালো ,’হ্যাঁ মা তো মাই হয়।’ তার অন্যমনস্কতা দেখে সালেহা বেগম এগিয়ে প্লেটে খাবার বাড়তে বাড়তে ডাকলেন,
‘এই আয় খেয়ে নিবি। সারাদিন শুধু বাইরে টো টো করিস।’
হারুন লোভনীয় খাবার দেখে তাড়াতাড়ি খেতে বসে গেল।
‘মা, আমি একটু আসছি।’ বলেই মুহিব ব্যাগপত্র রেখে বেরিয়ে গেল। সালেহা বেগম পিছু ডাকতে গিয়েও ডাকলো না। হয়ত কোনো বন্ধুকে বিদায় জানাতে যাচ্ছে।
——–
সন্ধ্যার রাতে ঘুম আসছে না। সে ছটপট করে উঠে বসলো। কী আশ্চর্য! আগে সে শোবার সাথে সাথেই ঘুমিয়ে পড়তো। ইদানিং একদম আসে না ঘুম। মুহিবের মতো তারও একই রোগ হলো নাকি! সন্ধ্যা হাসলো। না, এই রোগে শান্তি আছে, সুখ আছে। নিজেকে সুখী সুখী মনে হয়। সে হারিকেন নিভাতে গিয়ে মনে হলো তাদের ঘরের আশেপাশে কেউ হাঁটছে। সে পাত্তা দিল না। কিন্তু পরমুহূর্তে কী যেন ভেবে শোয়া থেকে উঠে পড়লো। হারিকেনের নিভু নিভু আলোতে জানালার ধারে এগিয়ে গেল। জানালা খুলতেই দমকা হাওয়া এসে গায়ে অদ্ভুত শিহরণ বয়ে গেল।
তার ভাবনায় সত্যি হলো। মুহিব এসেছে। সন্ধ্যা জানালা খুলতেই মুহিবের চড়া হাসি চোখে পড়লো। সন্ধ্যা সতর্ক চোখে মায়ের রুমের দিকে একবার পিছু ফিরে তাকালো। এরপর সাবধানী কণ্ঠে ফিসফিসিয়ে বলল,
‘আপনি!’
‘হ্যাঁ, আমি। ঘুমাওনি এখনো? আমার কথা ভাবছো বুঝি!’
সন্ধ্যা অপ্রস্তুত হওয়া কণ্ঠে জানালো,
‘আপনার কথা কেন ভাববো! আজেবাজে বকবেন না।’
‘জানি জানি।’
সন্ধ্যা বারবার পিছু ফিরে তাকাচ্ছে। সে মুহিবের দিকে তাকিয়ে শুধালো,’এতরাতে?’
‘আমি এখন চলে যাবো সন্ধ্যা। একেবারে দুমাস পরে আসব।’
সন্ধ্যার বুক ধড়ফড় করে উঠল। তার কান্না পেয়ে গেল। মুহিবকে সে আর দুমাস দেখবে না! কীভাবে!
মুহিব সন্ধ্যার চেহারা দেখে আঁচ করতে পারলো। সে জানাল,
‘এর মাঝে আমাদের আর কোনো যোগাযোগ হবে না। এসেছিলাম তোমার জানালায় চিঠি রাখতে কিন্তু ভাবিনি তুমি জেগে থাকবে। ভালোই হয়েছে। দেখার তৃষ্ণার অন্তত একটু হলেও পূর্ণ হয়েছে। ভালো থেকো সন্ধ্যা। আমি ফিরে আসবো খুব তাড়াতাড়ি।’
বলেই মুহিব চলে যেতে নিতে পিছু ফিরে তাকালো। এগিয়ে এসে হাতের চিঠিটা সন্ধ্যার কাছে এগিয়ে দিল।
‘কোনো প্রয়োজন পড়লে আমাকে ফিরতি চিঠি দিও। এখানে আমি আমার পোস্ট অফিসের ঠিকানা দিয়েছি। আর মাঝে মাঝে ডাকপিয়ন এলে এগিয়ে যেও। আমি মিস করলে পরীক্ষার মাঝে তোমাকে চিঠি দিবো।’

‘আপনি পরীক্ষা ভালোমতো দিয়েন।’
‘ঠিকাছে আমি যাচ্ছি। ভালোমতো থেকো। আমি ফিরে তোমাকে নিজের সাথে আগলে নিবো। আমি আছি তোমার সাথে।’
সন্ধ্যার চোখ টলমল করে উঠল। মনে হচ্ছে পলক ফেললেই জল গড়িয়ে পড়বে। মুহিব পিছু ফিরতেই সন্ধ্যা পলক ফেলতেই টুপ্ করে জল গড়িয়ে পড়লো। মুহিব এসে সযত্নে মুছে দিল।
‘আমি আছিতো। এভাবে বিদায় দিও না প্লিজ। আমি যে ভালো থাকতে পারবো না। হাসো।’
সন্ধ্যা হেসে হাত নাড়াতেই মুহিব পিছু ফিরে এগিয়ে গেল। অর্ধেক গিয়েও সন্ধ্যা বুঝতে পারলো মুহিব সন্ধ্যার দিকে তাকিয়েছে।
রাতের আধার মেখে প্রেমিক পুরুষের চলে যাওয়ার পথে তাকিয়ে থাকে সন্ধ্যা। বড্ড শীত করে উঠে তার হুট্ করে।ভিতরে কাঁপন শুরু হয়। উষ্ণতার অভাবে মন কুঁকড়ে উঠে যেন। এমন শীতকাল পেরিয়ে আবার দুমাস পরে বসন্ত আসবে নিশ্চই… তখনই হয়ত তার আবার সেই পুরুষের দেখা পাবে!
——–

বেশ কিছুক্ষন পরে মুহিব ফিরে এসে বাবার কক্ষে গেল। বাবা কিছু একটা লিখছেন। মুহিব ডাক দিল।
‘বাবা আসতে পারি।’
আজগর শেখ ফিরে তাকালেন।
‘হ্যাঁ, আসো।’
মুহিব বাবাকে বলে বিদায় জানিয়ে রুম থেকে বেরোবে তার আগেই আজগর শেখের ডাকে থেমে গেল।
‘দাড়াও একটু। আমি দিয়ে আসবো তোমাকে।’

মুহিবের মন মুহূর্তের মধ্যে খুশিতে ছেয়ে গেল। এতবার আসা যাওয়াতে এই প্রথম বোধহয় বাবা তাকে স্টেশনে দিতে যাবেন তাওবা নিজে থেকে! এটা তার বিশ্বাসযোগ্য হচ্ছে না। বাবা নামক মানুষটা সবসময় কাজের মধ্যেই ডুবে থাকেন। সেই নিয়ে মুহিবের কোনো খারাপ লাগা বা অভিযোগ ছিল না কিন্তু আজ নিজে থেকে বাবা তাকে স্টেশনে দিয়ে আসবেন সেটা সে ভাবতে পারছে না।

মুহিব মায়ের দিকে এগিয়ে গেল। সালেহা বেগম আঁচলে মুখ ঢাকলেন। তা দেখে মুহিব মাকে জড়িয়ে নিল,
‘আহ মা! আমি তো প্রথম যাচ্ছি না।’

‘আবার কবে আসবি!’

‘এইতো এই পরীক্ষাটা শেষ হতেই চলে আসবো।’ মুহিবের কথার মাঝে হারুন বাঁধ সাধলো,
‘আহঃ চাচী, কইতে হইবো না। এইবার মুহিব কওয়ার আগেই চইলা আসবো। আর আপনার সঙ্গী আনবো।’
সালেহা বেগম কিছু বুঝে উঠতে পারলেন না। তার আগেই মুহিব হারুনের পিঠে চাপর মেরে দিল। সে মাকে বিদায় জানিয়ে তড়িঘড়ি করে গাড়ির দিকে এগিয়ে গেল।
আজগর শেখ ছেলের মুখের দিকে তাকালেন। তিনি স্ত্রীকে বলে গাড়িতে উঠে গেলেন। স্বামী ছেলেকে বিদায় দিতে যাচ্ছে তা দেখে সালেহা বেগমের মন খুশি হলো। ছেলেটা তেমন ভাবে বাবার সান্নিধ্য কোনোদিন পায়নি।
আজ আর হারুন যাবে না। কেননা চাচা যাচ্ছে।
মুহিব গাড়িতে উঠেও হারুনকে শাসালো। যেন ওই ব্যাপারে কোনো ভুল কিছু না করে। হারুন আশস্ত দিলে মুহিব গাড়িতে উঠে পড়তেই আজগর শেখ গাড়ি ছেড়ে দিলেন। তিনি আজ নিজে ড্রাইভিং করবেন। বাপ্ ছেলের মাঝে কেউ ঢুকুক তা তিনি চাননা।
আজগর শেখ গাড়ি চালাচ্ছেন। শুনশান গ্রামের নীরব নিস্তব্ধতায় ঘেরা নির্জীব রাস্তা দিয়ে গাড়ি এগিয়ে যাচ্ছে। মুহিব বাইরে তাকিয়ে আছে। তার সন্ধ্যার কথা মনে পড়ছে। দুইটা মাস সে কীভাবে থাকবে মেয়েটাকে ছাড়া! সন্ধ্যাকে মনে পড়ছে ভীষণ। আরেকবার দেখে যেতে পারলে তার মন ভরতো কিন্তু তাতো সম্ভব না। মেয়েটিকে দেখার তৃষ্ণা তার সারাজীবনেও মিটবে না হয়ত। সর্বোপরি এইবারের পরীক্ষাটা কেমন হবে সেটাও সে ভাবতে পারছে না।
আজগর শেখ ছেলের দিকে তাকালেন। ছেলেকে বাইরে অন্যমনস্কভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে তিনি চোখ সরিয়ে নিলেন। তিনি নীরবতা কীভাবে ভাঙবে সেটা ভাবছেন। আশ্চর্য! এলাকার এতবড়ো নামধারী মানুষ হয়ে তিনি ছেলের সাথে কথা খুঁজে পাচ্ছেন না! এতটা দুরুত্ব হয়ে গেল তাদের বাপ্ ছেলের মাঝে!
বেশ কিছুক্ষন কথা বলতে চেয়েও তিনি কথা খুঁজে পেলেন না। তিনি খাখারি দিয়ে গলা পরিষ্কার করলেন।
এতে মুহিবের ধ্যান মগ্ন হলো। সে বাহির থেকে দৃষ্টি সরিয়ে বাবার দিকে তাকালো।
‘বাবা, আপনি কী কিছু বলবেন?’
‘হ্যাঁ, পরীক্ষা ভালোমতো দিও।’
মুহিব হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়তেই তিনি আবারো বলে উঠলেন,
‘এটা তোমার শেষ পরীক্ষা না?’
‘হ্যাঁ।’ মুহিব জানে বাবা কথা বলতে চাইছে তাই জানা কথাগুলো আবার আওড়াচ্ছে।
‘ভালোমতো দিও। এটার পরে তুমি তোমার যেটা ইচ্ছে সেটা করতে পারো। চাইলে বাবার ব্যবসাতে ঢুকতে পারো আর না চাইলে কোনো চাকরিতেও পারো। বাঁধা দিবো না। তবে চাকরিতে ঢুকলেও আমার ব্যবসাটা দেখাশোনা করতে হবে। অভিজ্ঞতা সবকিছুর নিতে পারো।’
‘জি।’
গাড়ি স্টেশনে পৌঁছে গিয়েছে। আজগর শেখ গাড়ি থামিয়ে নেমে পড়লেন। গাড়ির পেছনে তিনি নিজে গিয়ে ছেলের ব্যাগ নিয়ে এসে মুহিবকে দিলেন।
বাস এসে পড়েছে। এখনো বেশ কিছু সময় বাকী আছে। আজগর শেখ হাতঘড়ির দিকে তাকালেন।
মুহিব বাবাকে বলে বিদায় দিতে গেলে আজগর শেখ ডেকে উঠলেন।
‘পাঁচমিনিট দাঁড়াবে?’
মুহিবের পা থেমে গেল। সে আবার পিছু ফিরে বাবার কাছে এগিয়ে গেল।
আজগর শেখ ইতস্তত বোধ করছেন। কিন্তু ছেলেটাকে যে তিনি বড্ড ভালোবাসেন। এই ছেলেটার কষ্ট তিনি সহ্য করতে পারবেন না।
মুহিব বাবার ইতস্তত ধরতে পারলো না। সে শান্ত কণ্ঠে শুধালো,
‘বাবা? বলো? নির্দ্বিধায় বলো।’
আজগর শেখ ভরসা পেলেন। তিনি ছেলের দিকে তাকালেন,
‘কাউকে ভালোবাসো?’

মুহিব চমকে তাকালো বাবার দিকে। ছেলের চমকানো দেখে আজগর শেখ নিজেকে নরম করে হাসার চেষ্টা করলেন,
‘তখন হারুনের বলা কথার অর্থ আমি বুঝেছি। তাই বলছি, কাউকে ভালোবাসলে ইতস্তত করিও না। বাবাকে বলিও। এই বাবা সবসময় থাকবে। আমি নিজে প্রস্তাব নিয়ে যাবো।’
মুহিব যেন ভরসা খুঁজে পেল। সে বাবাকে জড়িয়ে ধরলো। আজগর শেখ আচমকা ছেলের জড়িয়ে ধরাতে ভড়কে গেলেও নিজেকে ধারস্ত করে নিজেও জড়িয়ে নিলেন। তার মনে হচ্ছে এতদিনের বাপ্ ছেলের দুরুত্ব গুচবে।
বাস ছেড়ে দিবে। আজগর শেখ মুহিবকে তুললেন,
‘তোমার থেকে পাঁচমিনিট সময় নিয়ে দশমিনিট কাটিয়ে দিয়েছি।’
মুহিব হাসলো। বলল,’এই দশমিনিট আমার কাছে অনেক কিছু।’
‘ঠিকাছে এইবার যাও। পরীক্ষাটা ভালোমতো দিয়ে ফিরে এসো।’
‘হ্যাঁ বাবা, আমি ফিরে এসেই আপনাকে বলবো।’
‘ঠিকাছে, ভরসা করো বাবাকে। আমি আছি সবসময় কিন্তু পরীক্ষাটা একদম নিশ্চিন্তে দিবে।’
মুহিব হেসে বাচ্চার মতো করে দুদিকে মাথা দুলাল। তার আর কিছু চাওয়ার নেই। সে বাসে উঠে গেল। জানালার পাশে বসতেই আজগর শেখ এগিয়ে হাত নেড়ে ছেলেকে বিদায় জানালেন। একমনে খুশি লাগলো যে ছেলেকে সে ভরসা দিতে পেরেছে। সে যে চাই না তার ছেলের পরিণতি তারই মতো কষ্টদায়ক হোক। যেটার রেশ তার এখনো রয়ে গেছে। এখনো গুমরে গুমরে খায়।

#চলবে ইন শা আল্লাহ।
(আসসালামু আলাইকুম। রিচেক দেওয়া হয়নি। অগোছালো হওয়ার জন্য দুঃখিত। একটা ছোট মন্তব্যের আশাবাদী। আর আমাকে পিছু করবেন না প্লিজ। আমি এই থিমটা অনেক আগেই এন্ডিংসহ ভেবে রেখেছি। ভুল ভ্রান্তি ক্ষমার নজরে দেখার অনুরোধ। )

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here