#তবু_মনে_রেখো
#নাজমুন_বৃষ্টি
#পর্ব_১২
সন্ধ্যা নাগাদ আনিস মিয়া ঘরে ফিরলো। তবে খালি হাতে নয়। দুহাত ভরে বাজার নিয়ে। তিনি বারান্দায় ঢুকতেই হাসি হাসি রবে হাঁক ছাড়লেন,
‘কই রে সন্ধ্যা মা। এদিকে আয় তো।’
জোহরা চুলায় রান্না ছড়াচ্ছেন। পাতিল তুলতে গিয়ে তিনি বসা অবস্থায় মাথা উঁচিয়ে দেখলেন। রান্নাঘর বারান্দার সাথে হওয়াতে এখান থেকে বারান্দা একদম সরাসরি দেখা যায়। শুধু মাঝখানে একটা খড় দিয়ে আলাদা করে দেওয়া।
আনিস মিয়া সেই সকালবেলা ঘর থেকে বেরিয়েছে এর মধ্যে আর বাসায় আসেনি। যদিও স্বামীর থাপ্পড়ে তার অভিমান কাজ করেছে কিন্তু এখন সেগুলোর সময় নেই। তার আগে জানতে হবে আনিস মিয়া এই রাতে উৎফুল্লতার সহিত বাজার করার কারণ কী! আর সন্ধ্যাকেই বা এতো সুন্দর হাসি হাসি রবে ডাকার কারণটাই বা কী! উনি তো কোনসময় এভাবে ডাকে না। সন্ধ্যাকে তো ভুলেও নয়। এর পেছনে নিশ্চই কোনো কারণ বিদ্যমান!
চুলায় থাকা পাতিলটার সবজির ঘ্রান জানান দিচ্ছে এই মুহূর্তে সেটি নামানো দরকার। জোহরা পাতিলটা তাড়াতাড়ি নামিয়ে অন্য আরেকটা পাতিল চুলাতে বসিয়ে দিল। এরপর উঠে দাঁড়িয়ে দুহাত আঁচলে মুছে বারান্দার দিকে এগিয়ে গেল।
আনিস মিয়ার এমন উৎফুল্লতায় ভরা ডাক শুনে সন্ধ্যা রুম ছেড়ে বেরিয়ে এলো। মাত্রই সে মায়ের কাছ থেকে উঠে রুমে গিয়েছে। রান্না সে করতে চেয়েছিল কিন্তু আজকে মা কেন জানি করতে দেয়নি। তাই তো জোর করে চালটা বেছে -ধুয়ে দিয়ে এসেছে। মা ইদানিং কেন জানি তাকে চোখে হারাচ্ছে।
সন্ধ্যাকে তার বাবা এমন করে কখন ডেকেছে তা সে মনে করার চেষ্টা করলো কিন্তু ফলাফল শূন্য। না, তার মনে পড়ছে না। সে জানে না তার বাবা এভাবে ডাকার কারণ কিন্তু যেটাই হোক না কেন স্বভাবতই সে খুশিই হলো।
জোহরা ভরাটমুখে আনিস মিয়ার দিকে এগিয়ে এলো। সে এসেই তার কাছ থেকে বাজারের থলে দুটো এগিয়ে নিয়ে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়াতে বাড়াতে ভরাট কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
‘এই অসময়ে বাজার আনার কারণ?’
স্ত্রীর কথায় আনিস মিয়া খুশি খুশি রবে জবাব দিলেন,
‘ঘরোয়া ভাবেই হইবো। কয়েকজন আইয়া সন্ধ্যারে বিয়ে পড়াইয়া নিয়ে যাইবো।’
জোহরার পা থেমে গেল। সে থমকানো দৃষ্টিতে পিছু ফিরে স্বামীর পানে তাকালো। কী বলছে এসব! বিয়ে তাহলে আটকাইনি! শেষমেষ তার মেয়ের এমন জীবন হতে চললো!
আনিস মিয়া হাঁক ছেড়ে সন্ধ্যাকে আরেকবার ডাকলো। সন্ধ্যা এগিয়ে আসতেই মেয়েকে বললেন,
‘তোর পছন্দের মাছ আনছি মা। আজ ভালোমন্দ খাবি। চেয়ারম্যান সাহেবই তো জোর করে এসব বাজার কইরা দিল।’
সন্ধ্যা তার বাবা নামক মানুষটির দিকে তাকিয়ে রইল। হারিকেনের মৃদু আলোতে বাবাকে আজ ভীষণ সুন্দর লাগছে। সন্ধ্যার অবচেতন মন ভাবলো, এটা কী তার বাবার এমন ভালো ব্যবহারে! না কি আসলেই তার বাবা সুন্দর! কিন্তু এরূপ ব্যবহার করার মূলটা শুনতেই সন্ধ্যার মনে হলো পৃথিবীতে তার বাবার মতো কুৎসিত হয়ত আর কারোর বাবা না। সন্ধ্যা দৌড়ে রুমে চলে গেল।
জোহরা দৌড়ে এগিয়ে এসে তাড়াহুড়ো কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,
‘কী বলছো এসব? ঘরোয়া ভাবে হবে মানে? সন্ধ্যারে নিয়ে যাবে? এসব কী বলছো?’
আনিস মিয়া ফিরে তাকালেন।
‘হ্যাঁই তো। চেয়ারম্যান সাহেব তাড়া দিলো বইলা। কালকে আসরের বাদে আক্ড পড়াইয়া ওরা নিতে আসবো।’
জোহরা দাঁড়িয়ে রইল। এসব কী বলছে আনিস মিয়া! চেয়ারম্যান তাহলে তার কথা শুনে আরো বেশি তাড়া দিয়েছে! জোহরার আনিস মিয়াকে আর কিছু বলার প্রয়োজনবোধ মনে করলো না। সে বুঝে গিয়েছে আনিস মিয়াকে আর কিছু বলে লাভ হবে না।
আনিস মিয়া স্ত্রীর জবাবের আশা না করে আবারো পা বাড়াতে বাড়াতে বলে উঠল,
‘যাই, ইমাম সাহেব আর কয়েকজনরে বইলা আসি। যাতে আসরের পরে আর বিয়ে না নেয়। হাজার হোক চেয়ারম্যানের ভাইপোকে মাইয়া দিচ্ছি বইলা কথা।’
জোহরা ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। আনিস মিয়া চোখের দৃষ্টি থেকে আড়াল হতেই জোহরা ঘরে ঢুকে সন্ধ্যার রুমের দিকে পা বাড়ালো। কুসুম ঘরের এক কোণে বসে বসে পড়ছে। মাকে এভাবে হম্বিতমবি করে আপার রুমের দিকে যেতে দেখে সে ভাবনায় পড়ে গেল। প্রথমে আপা এখন আবার মা। সে পুরোপুরি বুঝতে না পারলেও কিছুটা হলেও বুঝে যে তাদের সংসার সেই সুখের সংসার আর নেই। আপাও বদলে যাচ্ছে। আগের মতো আর তাকে গল্প বলে বলে ঘুম পাড়িয়ে দেয় না। একরকম খিটখিটে মেজাজের হয়ে গেছে। তাই তো সে এখন সবসময় ভালো মেয়ে হয়ে থাকে। মা বা আপা কাউকে আগের মতো আর বিরক্ত করে না। মাগরিব হতেই পড়তে বসে যায়। কুসুম নিজের পড়ার দিকে ধ্যান দিল।
জোহরা সন্ধ্যার রুমে ঢুকেই দরজা বন্ধ করে দিল।
দরজা বন্ধ করার খট করে আওয়াজ পেতেই সন্ধ্যা মায়ের দিকে ফিরে তাকালো। জোহরা প্রথমে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করে উঁচু আওয়াজে শুধালো,
‘হ্যাঁ রে, ঘর আঁধার করে আছিস কেন? হারিকেন জ্বালাবি তো।’ বলেই তিনি হারিকেন জ্বালিয়ে দিল। এরপর জানালা বন্ধ করে খাটে বসা মেয়ের দিকে এগিয়ে এলেন।
‘আমি এই বিয়ে করবো না মা।’
জোহরা মেয়ের দিকে তাকালেন। মেয়ের এমন গভীর কণ্ঠস্বর শুনে তার খারাপ লাগলো। সে সন্ধ্যার দুগাল ধরে জড়িয়ে ধরে মেয়েকে ভরসা দিলেন।
সন্ধ্যা মায়ের কোমর চেপে জড়িয়ে ধরে অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছে। জোহরা নিজেও চায় না তার মেয়ের মতের বিরুদ্ধে কিছু করতে! তার উপর এমন একটা ছেলেকে তো ভুলেও না। সে মেয়ের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে আচমকা বলে উঠল,
‘আমি তোকে যা করতে বলবো করবি তো? ভয় পাবি না তো।’
মায়ের এমন কথায় সন্ধ্যা মাথা তুলে তাকালো। মেয়ের প্রশ্নবোধক চাহনী দেখে জোহরা হেসে আস্বস্ত করলো,
‘ভয় নেই। তোর ভালোর জন্যই করবো। আর তুই যেটা পারবি সেটাই করতে দিবো।’
সন্ধ্যা ফ্যালফ্যাল চোখে মায়ের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো,
‘কী করতে হবে মা ?’
জোহরা মেয়ের অশ্রুসিক্ত চোখের দিকে তাকালেন। তার নরম হলে চলবে না। তিনি নিজেকে যথাসম্ভব শক্ত করে বলে উঠলেন,
‘তুই পালিয়ে যাবি।’
সন্ধ্যা বি’স্পো’রিত চোখে মায়ের দিকে তাকালো।
‘কী বলছো মা এসব?’
জোহরা দুহাত দিয়ে মেয়ের মাথায় পরম আদরে হাত বুলিয়ে বলে উঠলেন,
‘আর কোনো কথা বা প্রশ্ন নয়। যা বলছি তাই করবি। তোর জীবন আমার মতো হতে দিবো না । আর ওই ব’দ’মাস ছেলের কাছে তো জীবনেও তোকে সপে দিবো না।’
সন্ধ্যা প্রশ্নবোধক চাহনীতে তাকালো,
‘তোমার মতো মানে?’
জোহরা কথা ঘুরানোর চেষ্টা করে বলে উঠল,
‘আর প্রশ্ন নয়। আমি যা বলছি তাই করবি। এছাড়া আর উপায় নেই। এখানে থেকে তোর জীবন আমি ধ্বং’স হতে দিবো না। অন্তত আমি বেঁচে থাকতে তো না।’
সন্ধ্যা কান্না করে দিল,
‘এমন বলো না মা। আমি তোমাদের ছাড়া থাকতে পারবো না।’
‘নিজেকে শক্ত কর। থাকতে তোকে হবেই।’এরপর একটু থেমে আবারো বলে উঠল,
‘তোকে ঢাকার এক আত্মীয়র ঠিকানা দিবো। আজ রাতেই বাস ধরে সোজা ওখানে চলে যাবি। আমি চিঠি লিখে দিবো। যতদিন না আমি চিঠি দিবো ততদিন আমার সাথে আর যোগাযোগের চেষ্টা আর করবি না মা। আমি জানি আমার মেয়ে পারবেই।’ বলেই আদুরে ভাবে গালে দুহাত রেখে মেয়ের কপালে চুমু দিলেন।
সন্ধ্যা অপলক দৃষ্টিতে তার মায়ের দিকে তাকিয়ে রইল। তার মা কী বলছে সেটা কী আধো উনার বোধগম্য হচ্ছে! সে তো কোনোদিন এই গ্রামের বাইরেই পা রাখেনি। সেখানে এমন একটা সিদ্ধান্ত!
#চলবে ইন শা আল্লাহ।
(আসসালামু আলাইকুম। খুব তাড়াতাড়ি গল্পটা শেষ হবে। ভুল ভ্রান্তি ক্ষমার নজরে দেখার অনুরোধ।)