#ঢেউয়ের_স্রোতে_নিবিড়
#ঊর্মি_আক্তার_ঊষা
#পর্ব-৬
নিস্তব্ধ রাত। আশেপাশের গাছগাছালি গুলো দমকা হাওয়ায় বারবার এলোমেলো হয়ে উঠছে। বিশাল আকাশে আজ চাঁদের দেখা নেই। কিছু কিছু জায়গায় কালো মেঘ দলা পাকিয়ে আছে৷ শহর থেকে সুদূর কোলাহল বিহীন বিশাল অট্টালিকার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে নিবিড় আর ঊর্মি। এখানেই একটা রুম ওদের জন্য বুক করে রেখেছেন নাজিয়া মাহমুদ। যাতে দুজন কিছুটা একাকীত্ব মুহুর্ত অতিবাহিত করতে পারে। সকালে নিবিড়ের দেওয়া টেবলেটটা খেয়ে ঊর্মির মাথা ব্যথা কিছুটা হলেও অবসান ঘটে। নিবিড়েরও আর ক্লাস না থাকায় ঊর্মির ছুটি নিয়ে বাসায় চলে আসে। বাসায় এসে সে গোসল করে নেয় যদি কিছুটা ফ্রেশ লাগে সেই ধারণায়৷ তবে তার ধারণাটা সত্যিই প্রমানিত হয়৷ গোসল করার পর শরীর আর মনটা যেন আগের চেয়ে বেশি ফুরফুরে হয়ে গেছে৷ দুপুরের খাবার খাওয়ার পরেই নাজিয়া মাহমুদ জানান যে ওদের না জিজ্ঞেস করেই তিনি নিবিড় আর ঊর্মির একরাতের জন্য শহরের কোলাহল থেকে কিছুটা দূরে একটা রিসোর্টে রুম বুক করেছেন। কথাটা শুনে নিবিড় কিছুটা অমত করে কারণ কালও ঊর্মিদের বাসায় যাবার কারণে ভার্সিটি মিস দিয়েছে। তবে মায়ের ইচ্ছে পূরণ করতে ঊর্মিকে নিয়ে সেখানে আসে। এখানের পরিবেশটা ঊর্মির বেশ ভালোই লাগে। পুরো রুম জুড়ে যেন শুভ্রতায় ঘেরা। রিসোর্টটায় মোট আটটা কি নয়টা রুম হবে হয়তো। একপাশে বাগান আছে আর একপাশে সুইমিং পুল। নিবিড় ঊর্মিকে পুলের ওখানটায় নিয়ে যায়। দুজনেই পাশাপাশি বসে কিছুক্ষণ পা ভেজায় ঠান্ডা পানিতে। মুহুর্তটা খুব করে অনুভব করছে ঊর্মি। বড্ড ভালো লাগে নিবিড়ের সাথে কাটানো প্রত্যেকটা মুহুর্ত। মাঝে মাঝে মনে হয় সময়টা যদি এখানেই থেমে যেতো! কিন্তু এ যে হবার নয়। সময় তো নিজ গতিতেই প্রবহমান। ঊর্মি ওদের থেকে কিছুটা সামনে তাকাতেই দেখে ওদেরই মতো এক জোড়া কপোত-কপোতী বসে আছে। মেয়েটি তার স্বামীর কাধে মাথা রেখে বসেছে আর তার স্বামী বাম হাতটা ধরে কিছু একটা বলছে। ঊর্মি সেদিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। এই মুহুর্তে তার খুব করে ইচ্ছে করছে নিবিড়ের হাতটা ধরে বসে থাকতে। নিবিড় তাকে চুপ করে বসে থাকতে দেখে বলে…
–তোমার কি এখানে এসে ভালো লাগছে না ঢেউ?
–ভালো লাগছে তো!
এরপর দুজনের মাঝে আবারও নিরবতা বিরাজ করছে। ঊর্মি কিছু বলতে গিয়েও বারংবার নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছে। কিছুতেই মনে সাজিয়ে রাখা কথা গুলোকে মুখে প্রকাশ করতে পারছে না৷ এটা দ্বিধা নাকি লজ্জা সে বুঝে উঠতে পারছে না। “হয়তো লজ্জায় এমনটা হচ্ছে। নয়তো স্বামীর কাছে আবার কিসের দ্বিধাবোধ!” মনে মনে এই কথা গুলোই যেন আওড়াচ্ছে সে। দৃষ্টি পুলের দিকে সংযত করে নিবিড় ঊর্মির কোমল হাতটা নিজের হাতের মাঝে আবদ্ধ করে ফেলে। কিঞ্চিৎ চমকে ঊর্মি নিবিড়ের দিকে তাকায় তবে মুখে কিছু বলে না। তার সারা শরীর যেন শীতল হয়ে ওঠে। বারবার গলা শুকিয়ে আসছে। কথাগুলো যেন কণ্ঠনালীতেই আটকে গেছে। পলকহীন ভাবে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে নিবিড়ের দিকে। শুভ্র রঙা শার্টটা বেশ মানিয়েছে তার শ্যাম পুরুষকে৷ গা থেকে যেন এক মাতাল করা সুবাস ভেসে আসছে। এরই মাঝে নিবিড়ের শীতল কন্ঠ তার কর্ণকুহরে এসে পৌঁছালো।
–ঢেউ! কখনো কাউকে চিরকুট দেওয়া হয়েছে?
কথাটা শ্রবণ করা মাত্রই চকিত নয়নে নিবিড়কে একবার পরখ করে সে। “হ্যাঁ! বহুবার আমার শ্যাম পুরুষকে আমি আমার অনুভূতি নিবেদন করেছি” মনে মনে এই কথা গুলো বলতে চাইলেও কাঁপা স্বরে বলে…
–ক..কই না তো!
ঊর্মির কথাগুলো যেন তার বিশ্বাস হয় না। সন্ধিহান দৃষ্টিতে দেখতে থাকে ঊর্মিকে।
–তোমার কথা গুলো কেমন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে! লুকোচুরি খেলছো না তো আমার সাথে।
–না স্যার!
–এখানে তুমি আমাকে স্যার কেন বলছো ঢেউ? কেউ যদি শুনতে পায় তাহলে ভাবতে পারছো কি হবে?
–স্যার কে স্যার বলবো না তো কি বলবো?
ঊর্মির বোকামোতে নিবিড় হাসবে নাকি কাঁদবে বুঝতে পারছে না। সে ঊর্মিকে নিজের আরও কিছুটা আছে এনে তার এলোমেলো হওয়া চুল গুলোকে কানের কাছে গুজে দিয়ে বলে…
–ঢেউ তুমি বড্ড বোকা। টিচার ছাড়াও আমার কিন্তু আরেকটা পরিচয় আছে। আর সেটা হলো আমি তোমার স্বামী। আমাকে নাম ধরেই ডেকো। কেমন!
নিবিড়ের মুখে স্বামী কথাটা শোনা মাত্রই ঊর্মির বুকের ভেতর কেমন একটা ধক করে উঠলো। সে আমতা-আমতা করে বলে….
–স্বামীকে নাম ধরে ডাকতে নেই।
–তাহলে অন্য কোনো নামে ডেকো বাট স্যার বলে ডেকো না। ওইটা শুধুমাত্র ক্লাসে।
–আচ্ছা।
নিবিড় ওদের দুজনের জন্য খাবার অর্ডার করে রুমে চলে আসে ঊর্মিকে নিয়ে। নিবিড় তার ছোট্ট ব্যাগ থেকে টাওজার আর কালো টি-শার্টটা নিয়ে ওয়াশরুমে চলে যায়। সারাদিনের ধকল কাটিয়ে উঠতে হলেও ঘুমের প্রয়োজন। ঊর্মি রুমটাকে খুটিয়ে খুটিয়ে দেখতে থাকে। বিছানার চাদর, দেয়াল, ফ্লোর এমনকি জানালার পর্দা গুলোও শুভ্র রঙা। এতোক্ষণ শাড়ি পড়ে থাকলেও এখন বেশ অস্বস্তি ফিল হচ্ছে তার। হালকা গরমও লাগছে। নীল রঙা জামদানী শাড়িটা তার শাশুড়ী নাজিয়া মাহমুদ নিজেই পড়িয়ে দিয়েছেন। ঊর্মি ব্যাগ থেকে নিজের জন্য জামা বের করতে গেলে, সে একটা লাল রঙের ঢিলাঢালা নাইট ড্রেস পায়৷ হাতে নিয়ে সে সেটাকে ভালো করে একবার পরখ করে। এইটা তো কালই সকালে রিধিমা তাকে গিফট করেছিলো। এইটা পড়ে নিবিড়ের সামনে কিভাবে যাবে সেটাই ভাবতে থাকে সে। বিয়ের আগে বাড়িতে প্লাজু আর টি-শার্ট পড়লেও নাইট ড্রেস পড়ে নিবিড়ের সামনে কিভাবে যাবে ভাবতেই ভীষণ লজ্জা করছে তার। নিবিড় ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে দেখে ঊর্মি বিছানার উপর বসে আছে। সে তার কাছে এসে জিজ্ঞেস করে…..
–বসে আছো কেন ঢেউ? যাও তুমি ফ্রেশ হয়ে এসো।
ঊর্মি আর কথা না বাড়িয়ে ওয়াশরুমে যায়। লম্বা শাওয়ার নিয়ে সে চুল মুছতে মুছতে ওয়াশরুম থেকে বের হয়। নিবিড় তখন বিছানায় বসে ফোনে কিছু একটা করছিলো। ঊর্মি তার হাতে থাকা টাওয়ালটা চেয়ারের সামনে রেখে দেয়। চুলগুলো এখনো পুরোপুরি শুকোয়নি। এখনো টুপটাপ পানি পিঠে বেয়ে পড়ছে। কোমড়ের কিছুটা জায়গা ভিজেও গেছে হালকা। ঊর্মি বিছানায় অন্যপাশটায় গিয়ে বসে। নিবিড় ফোন রেখে কয়েকপলক ঊর্মিকে দেখে। মায়ের পর এই নারীকে তার পৃথিবীর সবথেকে সুন্দরী নারী মনে হয়। এই মুখপানে তাকালেই তার সমস্ত ক্লান্তি নিমিষেই দূর হয়ে যায়। কতটা মুগ্ধতা বিরাজ করে এই মুখশ্রীতে৷ যেন একটা ঘোরের মাঝে চলে যাচ্ছে সে। বারবার মনে হচ্ছে সবকিছু যেন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। ঊর্মিকে নিয়ে তার অনুভূতি গুলো যে মিথ্যে নয়। প্রণয় নামক অনুভূতি গুলোকে অস্বীকার কথা তার পক্ষে অসম্ভব। এই মুহুর্তে ঊর্মির নিবিড়ের সামনে বসে থাকতে বেশ লজ্জা আর ঘুম পাচ্ছে। শুয়ে পড়লে হয়তো নিমিষেই চোখে ঘুম চলে আসবে আর লজ্জা থেকে অবসান ঘটবে। নিবিড়কে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে ঊর্মি কিছু না বলে লাইট অফ করে শুয়ে পড়তে নেয়। নিবিড় তৎক্ষনাৎ তার হাতটাকে আকড়ে ধরে। চকিত হয়ে ঊর্মি এই অন্ধকারে আচ্ছন্ন রুমটায়, বিছানার তার পাশেই বসে থাকা নিবিড়কে পরখ করে। সুইমিং পুল এরিয়া থেকে বেলকনিতে আবছা আলো প্রবেশ করছে। নিবিড় যে এখনো তাকেই দেখে যাচ্ছে তা আর বুঝতে বাকি নেই তার। ঊর্মির কিছুটা কাছাকাছি গিয়ে নিবিড় বলে…..
–এভাবে পাগল করো না আমায়। আমার জন্য অনুভুতি গুলোকে সামলে রাখা দায়।
–স..স্যার!
–হুস!
সময় গুলো এভাবেই অতিবাহিত হতে থাকুক। ভালোবাসা গুলো সময়ের সাথে সাথে গাঢ় হোক৷ ঊর্মির মনের মাঝে থাকা প্রণয় একপাক্ষিক হলেও তার আদৌ জানা নেই নিবিড় তাকে ভালোবাসে কি-না। কখনো মুখ ফুটে বলা হয়নি ভালোবাসার কথাটা। তবে তার প্রতি যত্ন, চিন্তা আর পজেসিভনেসই জানিয়ে দেয় নিবিড়ের মনে তার জন্য জমিয়ে রাখা অনুভূতি গুলো কতটা গাঢ়। একপাক্ষিক ভালোবাসা গুলো কখনো কখনো উভয় পাক্ষিক হয়ে যায়। ভালোবাসায় অপরপক্ষের সম্মতি মুখ্য নয়। এ তো মনের অজান্তেই হয়ে যায়। ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। ঊর্মি এক হাতে বালিশে হেলান দিয়ে নিবিড়কে গভীর ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। ঘুমোলে প্রত্যেকটা মানুষকেই নিস্পাপ মনে হয় তবে নিবিড়কে তুলনা একটু বেশিই নিস্পাপ আর স্নিগ্ধ মনে হচ্ছে ঊর্মির কাছে। আজ তার এক্সাম শেষ হবে। এক্সামের দিন গুলোতে নিবিড় নিজেই ঊর্মিকে পড়িয়েছে। রাত জাগলে তার মাথা ব্যথা করতে তাই নিবিড় তার জন্য ডেইলি আগে ঘুমিয়ে পড়ার নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। ঘুম থেকে জেগে নিবিড় ঊর্মিকে বলে….
–ঘুমের মাঝেও আমার মতো একটা নিস্পাপ লোককে তুমি চোখ দিয়ে গিলে খাচ্ছো ব্যাপারটা কেমন দেখায় না মিসেস নিবিড়?
নিবিড় যে তাকে এভাবে হাতেনাতে ধরে ফেলবে এটা সে ভাবতে পারেনি। আজ নিবিড়ের আগেই ঘুম ভেঙেছে তার। সবসময় নিবিড়ই তাকে জাগিয়ে তোলে। তবে আজ তাড়াতাড়ি উঠে পড়ায় ভাবলো কিছুক্ষণ নিবিড়কেই দেখা যাক। তারই তো স্বামী। কিন্তু তা আর হলো কই! নিবিড়ের কথার প্রত্যুত্তরে সে বলে…
–একদম মিথ্যে কথা বলবেন না স্যার। আমি মোটেও আপনাকে চোখ দিয়ে গিলে খাচ্ছি না। আমি শুধু আমার স্বামীকে দেখছিলাম।
উর্মির কথার পিঠ পিছে নিবিড় বিছানা শুয়ে থেকে আড়মোড়া ভেঙে বলে….
–আমাকেও তো জাগিয়ে দিতে পারতে! আমিও চোখ খোলা রেখে আমার পিচ্চি বউকে দেখতাম অনন্তকাল ধরে।
–অনন্তকাল ধরে দেখার সময় নেই। উঠুন নামাজ পড়ে আসুন৷ আযান পড়ে গেছে।
শোয়া ছেড়ে উঠতে উঠতে কথাটা বলে ঊর্মি। নিবিড় তার হাত ধরে টেনে নিজের বাহুডোরে আবদ্ধ করে ফেলে। ঊর্মি ছাড়া পাওয়ার জন্য ছটফট করতে থাকে। নিবিড় তাকে থামিয়ে দিয়ে বলে…..
–এখন আমার বেশ প্রেম প্রেম পাচ্ছে ঢেউ। কি করা যায় বলো তো?
–আমি কি জানি! দেখি ছাড়ুন।
–দেখছিই তো।
নিবিড়ের সাথেই সকালের নাস্তা করে বের হয় ঊর্মি। ভার্সিটি আসতেই দেখে রিয়া মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে আছে। শাওন আর রাহাতও পাশেই দাঁড়িয়ে। নির্ঝর হয়তো এখনো এসে পৌঁছায়নি। ঊর্মি নিবিড়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ওদের কাছে আসে। ইশারায় রাহাতের কাছে জানতে চায় রিয়ার কি হয়েছে। রাহাতও গড়গড় করে বলে দেয় “মেকআপ সুন্দরী কি আর সেটা আমাদের জানাবে নাকি!” ঊর্মি রিয়াকে সোজাসাপ্টা জিজ্ঞেস করে….
–কিরে মুখটাকে প্যাঁচার মতো করে রেখেছিস কেন?
রিয়া এতোক্ষণ ঊর্মির অপেক্ষাতেই ছিলো। তার কথা শোনা মাত্রই কাঁদোকাঁদো মুখ করে বলে….
–তোকে সেদিন বলেছিলাম না আমাকে দেখতে এসেছিলো?
–হুম!
–ওদের আমাকে পছন্দ হয়েছে। তিনদিন পর কাবিন করিয়ে রাখতে চাইছে।
রিয়ার কাবিন হবে শুনে রাহাত খুশি হয়ে বলে….
–যাক এতোদিনে একটা বিয়ে খেতে পারবো। ঊর্মি তো আমাদের না জানিয়ের বিয়ে করে নিলো।
–বিয়ে খাওয়ার কথায় পরে আসছি আগে বল, এতোক্ষণ যে আমরা এতো প্রশ্ন করলাম তখন তো আমাদের কিছুই বললি না!
শাওনের কথার প্রত্যুত্তরে রাহাত বলে….
–ও কি আর আমাদের বান্ধুবী মনে করে নাকি? দেখবি বিয়ের পর আমাদের ভুলেই যাবে।
–আরে ব’ল’দ! বান্ধুবী হতে যাবে কেন? আমরা তো ওদের বন্ধু।
রাহাত আর শাওনের এরূপ কথাবার্তা শুনে রিয়া আর ঊর্মি হাসতে শুরু করে। এরই মাঝে নির্ঝর এসে পৌঁছায়। রিয়া তাকে দেখে কিছু না বলে সেখান থেকে চলে যায়। ঊর্মিও তার পেছন পেছন চলে যায়। ওদের চলে যাওয়া দেখে নির্ঝর বলে….
–ওদের দুটোর আবার কি হলো?
চলবে?…….
–
–