#ঢেউয়ের_স্রোতে_নিবিড়
#ঊর্মি_আক্তার_ঊষা
#পর্ব-৫
নিবিড় বিছানায় শুয়ে আছে। ঊর্মি লাইট অফ করে পাশেই শুয়ে পড়ে। আজ আর ওদের মাঝে কোনো কোলবালিশ নেই। যখনই রিধিমা শুনেছিলো কাল রাতে ওদের বিছানার মাঝখান বরাবর কোলবালিশের স্থান হয়েছিলো তখনই সে ঊর্মির ঘর থেকে তার কোলবালিশ খানা ছি’ন’তাই করে নিয়ে যায়। উপায় না পেয়ে ওদের এভাবেই শুতে হয়েছে৷ এভাবে শুয়ে থাকতে ঊর্মির বেশ নার্ভাস ফিল হচ্ছে৷ কালকের মতো যদি আজও নিবিড়কে সে জাপ্টে ধরে! ভাবতেই তার কান গরম হয়ে যেতে থাকে৷ নিবিড়ের দিক থেকে অন্য পাশ ফিরে শুয়ে পড়ে সে৷ তবুও যেন সময়টা নিদ্রাহীন কেটে যাচ্ছে। হঠাৎ করে মাথায় হাতের স্পর্শ পায় সে। নিবিড় তার চুলে কোমল ভাবে হাত বুলিয়ে দিতে থাকে। ঊর্মি চোখ বন্ধ করে তা অনুভব করে। এভাবে কিছুক্ষণ চুলে হাত বুলিয়ে দিতেই ঊর্মি ঘুমিয়ে পড়ে নিবিড় তা স্পষ্ট বুঝতে পারে। সে কিছুটা এগিয়ে গিয়ে তার কপালে নিজের ওষ্টদ্বয় স্পর্শ করে। মুহুর্তে আবার কাছ থেকে সরে আসে।
পরের দিন সকালে ফজরের আজানের কিছুক্ষণ পরেই ঘুম ভেঙে যায় নিবিড়ের৷ সে উঠেই ঊর্মিকে ডেকে তোলে তারপর জাহিদ আহসান আর দিদারের সাথে মসজিদে চলে যায় নামাজের জন্য৷ অরুনা আহসান সকালে উঠেই ঘরদোর গুছিয়ে নাস্তা বানানোর প্রস্তুতি নেন। রিধিমা হাতে হাতে সাহায্য করতে থাকে। ফুলজান বিবির ভোরে ওঠার অভ্যেস আছে৷ তিনি বসার ঘরে সোফায় বসে তসবিহ গুনছেন। ঊর্মি গিয়ে ফুলজান বিবির পাশে বসে। তিনি নাতনিকে একা দেখে বলেন….
–কিরে তুই একলা ক্যান? নাতজামাই রে একলা ঘরে রাইখা আইছস ক্যান??
–উনি তো আব্বু আর ভাইয়ার সাথে নামাজ পড়তে গিয়েছিলেন।
ফুলজান বিবি ঊর্মিকে নিজের কাছে টেনে এনে বলেন…..
–আইচ্ছা অহন তুই আমার কথা শুন। শশুর বাড়ির মানুষ তরে ভালা পায় তো বইন?
উনার কথা শুনে ঊর্মি বেশ ভালোই বুঝতে পারে নাতনির জন্য উনি অনেক ভাবেন৷ সে এক গাল হেসে বলে….
–হ্যাঁ বুবু। ওই বাড়ির সবাই খুব ভালো। আমাকে খুব ভালোবাসে।
–সবার মন মতো চলিস। জামাই যা কইবো সব শুনবি।
–আচ্ছা শুনবো।
এরই মাঝে কলিং বেল বেজে ওঠে। ঊর্মি উঠে গিয়ে গেইট খুলে দেয় ওরা চলে এসেছে। ওদের দেরি করে আসায় সে মনে মনে ভাবে হয়তো কোথাও গিয়েছিলো একসঙ্গে। ওরা বাড়ির ভেতর প্রবেশ করে। সকালে নিবিড় আর ঊর্মি নাস্তা করে বেরিয়ে পড়ে। কাল এখানে আসার সময় একদিনের ছুটি নিয়েছিলো সে। ওদের বাড়িতে ফিরতে ফিরতে বারোটা বেজে যায়। ঊর্মি কিছুক্ষণ রেস্ট নিয়ে নাজিয়া মাহমুদকে দুপুরের রান্না করার জন্য সাহায্য করে৷ নিবিড় বাড়ি আসার পরেই গোসল করে আবার কোথায় যেন বের হয়। এখন প্রায় দুটো বাজতে চললো। পূর্ণ আর পুষ্প বসার ঘরে কার্টুন দেখছে। “সিনচ্যান” তাদের সবচেয়ে প্রিয় কার্টুন। যাই হয়ে যাক না কেন এটা দেখা তাদের মিস যায় না। স্কুল থেকে এসে গোসল করেই কার্টুন দেখতে বসে পড়বে। এটাই তাদের রোজকার রুটিন। এদিকে রান্না ঘরের কাজ শেষ হতেই ঊর্মি ঘরে এসে গোসল করে নেয়। চুল মুছতে মুছতে ওয়াশরুম থেকে বের হয় সে। ড্রেসিং টেবিলের উপর থেকে ফেয়ার এন্ড লাভলি ক্রিমটা নিয়ে মুখে মেখে নেয়৷ আয়নার সামনে থেকে চিরুনিটা নিতে যাবে ঠিক তখনই তার ফোনে রিয়ার কল আসে। হয়তো কোনো দরকারী কাজও থাকতে পারে সেই ভেবে সে চিরুনিটা না নিয়ে আগে কলটা রিসিভ করে। ওপাশ থেকে রিয়া অনর্গল বলতে শুরু করে….
–কিরে ক্রাশ বর পেয়ে বন্ধুমহল কে ভুলে গেলি? আজ ভার্সিটি আসলি না কেন? জানিস আমার কতটা বোরিং লেগেছে আজ একা একা।
–আরে সব প্রশ্ন কি এক সাথেই করবি? জিরিয়ে নে আগে। আমি তো উনার সাথে ওই বাড়ি গিয়েছিলাম।
–সেটা তুমি আগে বলবা না! যাই হোক! এখন বল তো স্যারের সাথে প্রেম কেমন চলছে?
–কিসের প্রেম?
–এমন ভাব করছিস যেন কিছুই বুঝিস না! আচ্ছা শোন না, তোকে একটা কথা জানানোর ছিলো।
কথাটা কিভাবে বলবে সেই নিয়ে উশখুশ করতে থাকে রিয়া। ঊর্মি তার অবস্থা বুঝতে পেরে বলে…
–আমতা আমতা না করে বলে ফেল।
–আই এম ইন লাভ।
–নির্ঝর?
–কিভাবে জানলি?
–আমি তোর বেস্ট ফ্রেন্ড। আমি অনেক আগেই বুঝতে পেরেছি তোর ফিলিংস গুলো। তবে নির্ঝর ছেলে হিসেবে কিন্তু যথেষ্ট ভালো। এতো কিছু না ভেবে মনের কথা জানিয়ে দে। বাকিটা আমরা বন্ধুমহল দেখে নেবো।
–আমি আমার মনের কথা ওকে কিভাবে জানাবো সেই ব্যাপারে তোর থেকে বুদ্ধি চাই। তুই তো তোর ক্রাশ বর পেয়ে মিঙ্গেল হয়ে গেলি। এখন আমারও ইচ্ছে করছে সিঙ্গেল থেকে মিঙ্গেল হওয়ার।
–কিসের ক্রাশ? উনাকে আমি মনেপ্রাণে ভালোবাসি। মিঙ্গেল হওয়ার জন্য তাহলে বিয়েই করে ফেল।
–ধ্যাৎ! এখন রাখছি এই নিয়ে পরে তোর সাথে কথা হবে।
কল কেটে দিয়ে পেছন তাকাতেই দেখে নিবিড় হাত দুটো বুকে মাঝে ভাজ করে দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ঊর্মি মোবাইলটা বিছানার উপরই রেখে দিয়ে চুল আঁচড়াতে থাকে। নিবিড় ঘরের ভেতরে আসতে আসতে বলে….
–আচ্ছা ঢেউ! তোমার কি ক্রাশও ছিলো?
অনেকদিন পর নিবিড়ের মুখে ঢেউ ডাকটা শুনে ঊর্মি চকিত নজরে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। এই দুই বছরে প্রায়শই নিবিড় তাকে ঢেউ বলে সম্বোধন করেছে। তবে এই দুদিন এই ডাকটা একবারের জন্যেও তার কর্ণকুহরে যায়নি। যায়নি বললে ভুল হবে নিবিড়’ই তাকে ডাকে নি। ঢেউ ডাকটা শুনে ঊর্মির ভেতরটা কেমন যেন ফুরফুরে হয়ে গেলো মুহুর্তেই। জিহ্বা দিয়ে ঠোঁটটাকে ভিজিয়ে বলে….
–ক্রাশ কি আমি জানি না তবে একজনকে খুব ভালোবাসি৷
তার সোজাসাপ্টা কথা শুনে নিবিড়ের কিছুটা ভ্রু কুচকে আসে৷ ঊর্মি বুঝতে পারে হয়তো নিবিড় ওর মুখে ক্রাশের কথা শুনে ফেলেছে। নিবিড় ধীর পায়ে তার দিকেই এগিয়ে আসে। সে চোখ ছোট ছোট করে নিবিড়ের দিকে তাকায়। হঠাৎ করে নিবিড় কাছে চলে আসায় খুব অস্বস্তি ফিল হচ্ছে তার সাথে খুব লজ্জাও লাগতে শুরু করেছে তার। বুকের ভেতর ধুকপুক করতে শুরু করে। নিবিড় কাছে থাকাকালীন মুহুর্তটাকে সে সবসময় অনুভব করে৷ সবসময় কেমন একটা ঘোরের মাঝে চলে যায় সে। পারিপার্শ্বিক অবস্থার কথা যেন মুহুর্তেই ভুলে যায় সে। নিবিড় তার দিকে পূর্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলে….
–স্বামীর সামনে অন্য একজনকে ভালোবাসার কথা বলছো ভয় করছে না?
–ভয় করবে কেন? কাউকে ভালোবাসা কি পাপ নাকি?
–অবশ্যই স্বামী ব্যাতিত অন্য পুরুষকে ভালোবাসা তো দূর মনের মাঝে ভাবনা আনাও পাপ।
ঊর্মি নিবিড়ের কথা প্রতুত্তরে কিছু বলতে পারে না৷ তাকে ভালোবাসার কথাটা বলতে খুব লজ্জা করছে তার৷ “আচ্ছা এভাবে কথা বলায় নিবিড় কি তাকে ভুল বুঝবে?” বারংবার এই কথাটাই তার মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকে৷ ঊর্মি কিছু বলতে নিবে তখনই তার শাশুড়ী দুপুরের খাবার খাওয়ার জন্য ডাক দেন৷ নিবিড় ঊর্মির থেকে সরে ওয়াশরুমে ফ্রেশ হতে চলে যায়। কিছুক্ষণ পর বের হয়ে দেখে ঊর্মি তার জন্যই অপেক্ষা করছে৷ এরপর সবাই একসাথে দুপুরের খাবারটা খেয়ে নেয়।
রাতে নিবিড় নিজে ঊর্মিকে পড়তে বসায়। সামনেই ওদের আবার এক্সাম শুরু হয়ে যাবে। পড়া গুলো আগে থেকে কমপ্লিট না হলে পরে বেশ চাপে পড়বে৷ ঊর্মিও মনোযোগ দিয়ে নিজের পড়ছে। এতো চঞ্চলতার মধ্যেও পড়ালেখায় কোনো গাফিলতি তার মাঝে নেই। রেজাল্ট সবসময় ভালোই আসে৷ অরুনা আহসান মাঝে মাঝে এই নিয়ে চিন্তায় থাকেন যে, মেয়েটা পড়তে বসে কখন আর ভালো রেজাল্ট করেই বা কিভাবে। তিনি কখনো জোরে শব্দ করে ঊর্মিকে পড়তে দেখেননি। ঊর্মির স্বভাবটা বরাবরই তার বড় মামার মতো। তিনিও ছাত্রজীবনে খুব চঞ্চল ছিলেন তবে পড়ালেখায় সবসময় টপার৷ উনি সবসময় নিরবে পড়া গুলো মুখস্থ করতেন। টানা দেড় ঘন্টা পড়িয়ে নিবিড় ঊর্মিকে ঘুমোনোর পারমিশন দেয়। লাইট অফ করে দুজন পাশাপাশিই শুয়ে পড়ে।
পরের দিনও নিবিড় ঊর্মিকে নিয়ে নিয়ে ভার্সিটি আসে। সে নিজের মতো করে রিয়ার সাথে ক্লাসে চলে আসে। প্রথম ক্লাস থেকেই ঊর্মির মাথা ব্যথা করতে শুরু হয়। কাল রাতে দেরি করে ঘুমোনোর ফলেই মাথা ব্যথা করছে তার৷ এর আগেও যখন সে রাত জেগে ফেসবুক বা বই থেকে উপন্যাস পড়তো তখন সকালে ঘুম না হবার জন্য মাথা ব্যথা করতো। গল্প পড়াটা যেন এক ধরনের নে’শা হয়ে যায়। সে আ’স’ক্তি কাটিয়ে ওঠা যায় না। সবকিছু ফাঁকা ফাঁকা মনে হতে থাকে। কিন্তু বিয়ের পর এখনো ঊর্মি গল্প উপন্যাসের ধারে কাছেও যায়নি। আগে নতুন পরিবেশে একটু খাপ খাওয়ানো দরকার। তৃতীয় ক্লাসটা না করেই বের হয়ে আসে সে। পেছন পেছন শাওন, রিয়া, নির্ঝর আর রাহাতও যায়। ওরা ক্যান্টিনে এসে বসেছে। এবার অন্তত ঊর্মির এক কাপ আদা যুক্ত চায়ের প্রয়োজন মাথা ব্যথা দূর করার জন্য। এমন সময় একজন দপ্তরি এসে ঊর্মিকে ডেকে নিয়ে যান উনার সাথে।
দপ্তরির সাথে সে একাউন্টিং ডিপার্টমেন্টের সামনে এসে দাঁড়ায়। নিবিড় তাকে কেন ডেকেছে সেটাই ভাবতে থাকে। এখানে তো আরও টিচাররা থাকবে আর নিবিড় তাকে কেন ডেকেছে সেটাও তার বোধগম্য নয়। সাত পাঁচ না ভেবেই সে দরজাতে নক করে। নিবিড় স্বাভাবিক ভাবেই তাকে ভেতরে আসতে বলে৷ ঊর্মিকে এখানে নিয়ে এসে দপ্তরি আগেই চলে গেছে৷ সে ভেতরে গিয়ে দেখে এখানে নিবিড় ছাড়া আর কেউ নেই। নিবিড় তাকে সামনেই একটা চেয়ারে বসতে বলে। সেও তার কথা মতো সেখানটায় বসে পড়ে। এরপর ঊর্মির সামনে টিফিন বক্সটা এগিয়ে দেয়। যেটা নাজিয়া মাহমুদ সকালে ওদের দুজনের জন্য নিজের হাতে তৈরি করে দিয়েছিলেন। কিছুক্ষণ পর এমনিতেই টিফিন টাইম তাই দুজনে একসাথে খাবারটা খেয়ে নেয়। এমনিতেই ঊর্মি বেশ খিদে পেয়েছিলো। সকালে সে শুধু একটা রুটি আর অমলেট খায়ে এসেছিলো। খাওয়া শেষ হতেই নিবিড় ঊর্মির সামনে একটা টেবলেট এগিয়ে দেয়। টেবলেট এর নামটা দেখে আর না চেনার উপায় নেই যে এটা মাথা ব্যথার ঔষধ। সে কিছুটা অবাক হয়ে নিবিড়ের দিকে তাকায়। সে জিজ্ঞেস করে….
–আপনি কি করে জানলেন আমার মাথা ব্যথা করছিলো?
–সেটা তোমার না জানলেও চলবে৷
সে আর কথা না বাড়িয়ে খেয়ে নেয়। বেশ কিছুক্ষণ সে এখানেই বসে থাকে। নিবিড় যখন ক্লাসের বাইরে দিয়ে যাচ্ছিলো তখন সে জানালার বাইরে থেকে দেখেছিলো ঊর্মি বারবার কপালে দু’হাত চেপে ধরছে। সে বুঝতে পারে হয়তো তার মাথা ব্যথা করছে তাই সে দপ্তরিকে দিয়ে ঔষধটা আনিয়ে নেয়।
চলবে?……..