#টুয়েন্টি_মিনিটস (চ্যাপ্টার-০১)
পর্ব-১১
লেখা: ShoheL Rana শামী
রাতে যখন সবাই ঘুমিয়ে পড়ে রিহান তার ব্যাগটা গুছিয়ে বের হয়ে পড়ে জাকারিয়া সাহেবের বাড়ি থেকে। নিজের পূর্বপুরুষ সম্পর্কে যথেষ্ট ধারণা হয়ে গেছে তার৷ কতটা নির্মম হলে এরা একজনের জায়গায় আরেকজনকে বলি দিতে দ্বিধাবোধ করে না! সে এমনিতেই একটা বিপদ থেকে বের হতে পারছে না, এখন যদি ব্রিটিশদের হাতে গিয়ে পড়ে, তবে আরেক বিপদ। সে ইতোমধ্যে বুঝেছে, কোনো দুর্ঘটনা হলেও তার সময়ে ফিরতে পারবে না। যদি ভাগ্য চায়, তবেই ফিরতে পারবে, যেভাবে ভাগ্য তাকে এখানে নিয়ে এসেছে।
নিস্তব্ধ রাস্তায় কোনো পরিবহন চলছিল না সেই সময়। গ্রাম এলাকার মানুষ একটু রাত হতেই ঘুমিয়ে পড়ে। বাধ্য হয়ে রিহান হেঁটেই জাফর মাস্টারদের বাড়িতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো। দুর্বল শরীর নিয়ে হাঁটতে তার কষ্ট হচ্ছে। অনেকটা হাঁটার পর সে হঠাৎ একটা গাড়ির শব্দ পেলো। একটা প্রাইভেট কার ছুটে আসছে। রিহান রাস্তায় দাঁড়িয়ে লিফট চাইলো। থামলো গাড়িটা।
‘কী চায়?’ ড্রাইভিং সিট থেকে একজন প্রশ্ন করলো।
‘একটু লিফট পাবো, স্যার? একটু চর-আলগীতে নামিয়ে দেবেন?’
‘চর-আলগী এটা কোথায়?’
‘ঐ তো সামনে, কয়েক কি.মি দূরে।’
‘দুঃখিত, লিফট দেয়া যাবে না।’
তখন পেছনের সিট থেকে একজন বললেন, ‘তুলে নাও ওকে, সামনে নামিয়ে দিয়ো।’
‘কিন্তু স্যার, লোকটাকে দেখুন, কেমন অদ্ভুত লাগছে। গাড়িতে তুললে কোনো বিপদ হবে না তো? তাছাড়া আমরা এভাবে বের হয়েছি কেউ জানে না।’
‘সমস্যা নেই, তুলে নাও। লোকটার চেহারা দেখে মনে হচ্ছে বিপদে পড়েছে। গাড়িতে তোলার আগে ব্যাগটা চেক করে নাও।’
‘ঠিক আছে স্যার।’
কথা-বার্তায় বোঝা গেল পেছনের লোকটা কোনো ভিআইপি। লোকজনের চোখ ফাঁকি দিয়ে গাড়ি নিয়ে বের হয়েছে বাইরে। হয়তো কোনো প্রয়োজনে বা কাজের ফাঁকে একটু স্বস্তির নিশ্বাস ফেলতে। লোকটার চেহারা দেখা গেল না। ধুলাবালি থেকে রক্ষার্থে মুখে মাস্ক পরে আছেন তিনি। রিহান ব্যাগটা এগিয়ে দিলো ড্রাইভারের দিকে। ড্রাইভার ব্যাগ চেক করতে করতে বললো, ‘স্যার, সন্দেহজনক কিছু নেই। কিছু কাপড়চোপড়, একটা ডায়েরি, আর কী একটা যন্ত্র আছে।’
‘কী যন্ত্র?’ প্রশ্ন করলেন পেছনের লোকটা।
‘মোবাইল স্যার, মোবাইল। এটা দিয়ে কথা বলা হয়।’ জানালো রিহান।
‘ঠিক আছে, ওর জিনিস ওর ব্যাগে রেখে দাও। ওকে গাড়িতে তুলে নাও।’ নির্দেশ দিলেন পেছনের লোকটা। মোবাইল জিনিসটা কী, এটা দিয়ে কীভাবে কথা বলা হয়, এসব ব্যাপারে আগ্রহ দেখালেন না। কোনো বিষয় নিয়ে চিন্তিত মনে হচ্ছে তাঁকে। রিহান ড্রাইভারের পাশে উঠে বসলে, গাড়ি ছেড়ে দেয়া হলো। নির্জন রাস্তা পেয়ে ছুটতে লাগলো গাড়ি। হঠাৎ পেছন থেকে বলে উঠলো, ‘গাড়ি থামাও। সামনের বাঁ পাশের চাকাটা থেকে বাতাস বের হচ্ছে। চাকাটা চেঞ্জ করো।’
আশ্চর্য হয়ে গেল রিহান। গাড়ি তো ঠিকই আছে। সুন্দর গতিতে ছুটছে। বাতাস বের হবে কেন? কোনো শব্দও তো হচ্ছে না।
গাড়ি থামালো ড্রাইভার। গাড়ি থেকে নেমে চেক করলো সে। তারপর বললো, ‘জি স্যার, চাকাটা থেকে বাতাস যাচ্ছে। এখনই চেঞ্জ করে দিচ্ছি।’
ড্রাইভারের কথা শুনে চমকে তাকালো রিহান পেছনের লোকটার দিকে। ‘স্যার, আপনি কী করে জানলেন একটা চাকা থেকে বাতাস বের হচ্ছে? আর ঐটা যে সামনের বাঁ পাশের চাকা, এটাই বা কী করে বুঝলেন?’
‘নাম কী তোমার?’ পেছনের লোকটা প্রশ্নের জবাব না দিয়ে নাম জিজ্ঞেস করলেন। রিহান নিজের নাম বললে উনি পুনরায় বললেন, ‘জীবনে চলতে গেলে চারপাশটা অবজারভেশনে রাখবা। বুঝলে তো যুবক?’
‘তা রাখবো। কিন্তু স্যার, কতটা অবজারভেশন করলে না দেখেই, না শুনেই বলে দেয়া যায় ঠিক ঐ চাকা থেকেই বাতাস বের হচ্ছে?’
‘শুনো রিহান, তুমি গাড়িতে উঠার পর সবকিছুর একটা নির্দিষ্ট ব্যালেন্স ছিল। তোমার আর আমার ড্রাইভারের একটা নির্দিষ্ট উচ্চতা ছিল। কিন্তু হঠাৎ করে তুমি এক ইঞ্চি বাঁ দিকে কাত হয়ে গেছো। আর আমি হালকা সামনে ঝুঁকে গেছি। পুনরায় আমরা আগের ব্যালেন্সে আসলে সব ঠিকই থাকতো, কিন্তু আগের ব্যালেন্সে ফিরিনি আমরা, তাই সহজেই বুঝলাম বাঁ পাশের চাকাটা থেকে বাতাস বের হচ্ছে।
‘কিন্তু, কীভাবে এতটা নিখুঁতভাবে বললেন স্যার? আমি বা আপনার ড্রাইভার কেউ তো টেরই পাইনি।’
‘ঐ যে বললাম, অবজারভেশন?’
রিহান এখনও বিশ্বাস করতে পারছে না। একটা লোক এতটা মেধাবী কী করে হতে পারে? রিহান তার পুরো জীবনে হয়তো এতটা মেধাবী লোক দেখেনি।
চাকা বদলিয়ে পুনরায় উঠে বসলো ড্রাইভার। গাড়ি স্টার্ট দিতে দিতে রিহানের উদ্দেশ্যে বললো, ‘পেছনে যিনি বসে আছেন, তাঁকে চিনছেন তো?’
‘না, কে উনি?’ অবাক হয়ে প্রশ্ন করে রিহান।
‘উনার সম্পর্কে আপনার ধারণা নেই, তাই এতটা অবাক হচ্ছেন। উনি খুবই দূরদর্শী এক লোক। উনার পরিচয়টা না হয় অজানাই থাকুক।’
রিহানের মনটা হঠাৎ খারাপ হয়ে গেল। এমন এক মেধাবী লোকের সাথে তার দেখা হলো অতীতে এসে, আর সে তাঁর পরিচয়টা জানবে না?’
‘কোথায় নামবে তুমি?’ পেছন থেকে প্রশ্ন এলো।
‘আরেকটু সামনে স্যার।’ জবাব দিলো রিহান।
‘নিজ বাড়ি নিশ্চয়ই এখানে নয়। তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে, একটু দ্বিধায় আছো।’
‘জি স্যার। আপনি তো মেধাবী লোক। আপনাকেই বলি আমার কথাটা। কেউ তো বিশ্বাস করে না আমাকে।’
‘বলো শুনি।’
‘আমি আপনাদের এই সময়ের কেউ না। ভবিষ্যত থেকে এসেছি।’
চমকে উঠে ব্রেক কষলো ড্রাইভার। কিন্তু, এতটাও চমকালেন না পেছনের লোকটা। তিনি ড্রাইভারকে ঠিকভাবে গাড়ি চালাতে বলে রিহানকে শান্ত কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন, ‘ভবিষ্যত থেকে এসেছো? কোন সাল থেকে?’
‘২০১৭ সাল স্যার।’
‘আচ্ছা, তুমি জানো বাংলার প্রধানমন্ত্রী কে এই সময়ে?’
‘মানে আপনাদের এই ১৯৪২ সালে?’
‘হ্যাঁ।
রিহান ইতিহাসের ছাত্র ছিল। তাই একটু কী যেন ভেবেই বললো, ‘বাংলার প্রধানমন্ত্রী এখন শের-এ বাংলা এ কে ফজলুল হক নিশ্চয়ই। আরও এক বছর তিনি বাংলার প্রধানমন্ত্রী থাকবেন।’
‘আর এক বছর পর কে হবেন বাংলার প্রধানমন্ত্রী?’
‘খাঁজা নাজিমুদ্দীন।’
রিহানের কথাগুলো লোকটা বিশ্বাস করলো কি-না বোঝা গেল না। হ্যাঁ বা না কিছুই বললেন না তিনি। একটু পর গাড়ি থেকে নেমে গেল রিহান। তাকে নামিয়ে দিয়ে গাড়ি যখন চলে যাচ্ছিল, তখন পেছনের লোকটা মুখ বের করে মাস্কটা নামিয়ে বললেন, ‘ভালো থেকো যুবক।’
চেহারাটা চিনতে পারলো রিহান। এই চেহারাটা অনেকবার বইয়ের পাতায় দেখেছে সে। যিনি ‘বাংলার বাঘ’ নামে পরিচিত। স্বয়ং শের-এ বাংলা এ কে ফজলুল হকের সাথে একই গাড়িতে চড়ে এসেছে রিহান! বিশ্বাস করতে পারছে না সে। উনার মেধার পরিচয় সে বইয়ে পড়েছে, আজ যেন স্বচক্ষে দেখলো।
‘স্যার স্যার’ বলে ডাক দিলো রিহান কয়েকবার। গাড়িটা ক্রমশ দূরে সরতে লাগলো।
জাফর মাস্টারের বাড়িতে গিয়ে দরজায় টোকা দিলে ঘুম-ঘুম ভাব নিয়ে দরজা খুললেন মাস্টার সাহেব। রিহানকে দেখে অবাক হয়ে প্রশ্ন করলেন, ‘এ কী! রিহান তুমি এত রাতে?’
রিহান সব খুলে বললো মাস্টার সাহেবকে। শুনে উনি বললেন, ‘ঠিক আছে, ভেতরে এসো। কিছু খেয়েছো?’
‘হ্যাঁ, খেয়েছি।’
‘এখন তবে ঘুমাও। সকালে কথা হবে।’
সকালে রিহানের ঘুম ভাঙলো পানির স্পর্শ পেয়ে। সুফিয়া এসে মুখের উপর পানির ছিটকা দিয়ে বললো, ‘এই যে, ওঠুন।’
চোখ খুলে রিহান আড়মোড়া ভাঙলো। রাতে সুফিয়ার সাথে দেখা হয়নি তার। তখন সে ঘুমিয়ে ছিল। এখন তাকে দেখে জিজ্ঞেস করলো, ‘কেমন আছেন?’
‘ভালো আছি। চোরের মতো আমাদের বাসায় কে প্রবেশ করতে বলেছে?’
‘চোরের মতো না তো। আংকেল দরজা খুলে দিয়েছিল।’
‘আমি তো দেখিনি। তাই চোরের মতোই ঢুকেছেন। যাইহোক, ওঠুন। খাবার খাবেন। ইশ! আপনার কপালটা তো অনেকটা কেটে গেছে।’
‘ঐ যে, ঐদিন বিমানের অংশ পড়েছিল…’
‘শুনেছি বাবার কাছে। এর বিচার পরে হবে। এখন ওঠুন তো…’
‘বিচার? কীসের বিচার?’
জবাব না দিয়ে বের হয়ে গেল সুফিয়া।
অবশ্য পরে এটা নিয়ে আর কথা বলেনি সুফিয়া। সুযোগই পাইনি সে। সারাদিন ব্যস্ত ছিল। পাত্রপক্ষ দেখতে এসেছিল তাকে সেদিন। সারা ঘরে মেহমানে ভরে গিয়েছিল। আশেপাশের বাড়িঘর থেকে কয়েকটা ভাবি এসে সুন্দর করে সাজিয়েছিল সুফিয়াকে। তখন তাকে এত বেশি সুন্দর লেগেছিল, পাত্রপক্ষ আর অপছন্দ করতে পারেনি। অবশ্য আগে থেকে ওরা পছন্দ করেই এসেছে। পাত্রের বাবা জাফর মাস্টারকে বাজারে পেয়ে সুফিয়াকে নিজের ছেলের বউ করার প্রস্তাব করে। এর আগেও অনেকবার একই প্রস্তাব করেছে। মাস্টার সাহেব অনেকবার প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলেও এবার আর না করেননি। বয়স তো কম হয়নি সুফিয়ার। বারো-তেরো বছর বয়সী মেয়েদের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে, সেখানে সুফিয়ার বয়স এখন আঠারো প্রায়। সুফিয়ার বিয়ে হয়ে গেলে জাফর মাস্টার একা হয়ে পড়বেন, তাই এতদিন বিয়ে দেননি। তবে এখন আর নিজের কথা ভাবেননি উনি। মেয়ের কথা ভেবেছেন। হঠাৎ উনার কিছু হয়ে গেলে সুফিয়ার কী হবে? তাই এবার বিয়ের প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেলেন।
পাত্রপক্ষ চলে যাওয়ার পর, বিকেলে একটু অবসর পায় সুফিয়া। তখন সে ক্লান্ত ছিল। কারও সাথে কথা না বলে নিজ কক্ষে গিয়ে শুয়ে পড়ে। জাফর মাস্টার একবার গিয়ে মেয়েকে প্রশ্ন করেন, ‘পাত্র পছন্দ হয়ছে মা, তোর?’
সুফিয়া শুধু উত্তর দেয়, ‘হ্যাঁ বাবা।’
জাফর মাস্টারের পাশেই ছিল তখন রিহান। সুফিয়ার মুখে ‘হ্যাঁ’ শব্দটা শুনে, কেমন যেন খুশি হতে পারলো না সে। বুকের ভেতর কেমন যেন চিনচিন ব্যথা অনুভব করলো। তবে কি সে ভালোবেসে ফেলেছে সুফিয়াকে? নাহ্, সেটা অসম্ভব। দুজন তারা ভিন্ন ভিন্ন সময়ের মানুষ।
সুফিয়ার সাথে রিহানের আবার কথা হয় পরদিন সকালে। হকার থেকে পত্রিকা নিয়ে এসে রিহান সুফিয়ার হাতে দেয়। সুফিয়া তা ফেরত দিয়ে বলে, ‘বাবাকে দিয়ে আসুন।’
‘আংকেল তো গাছে পানি দিচ্ছেন…’
‘এসে তারপর পড়বে। ওখানে রাখুন, টেবিলে।’
‘আপনার কি মন খারাপ?’
‘না, মন খারাপ হবে কেন?’ কৃত্রিম হাসলো সুফিয়া।
‘আমার বিচার করবেন না? কী যেন বিচারের কথা বলছিলেন সেই সময়’
‘থাক ঐ বিচার। আপনি একটু সাবধানে থাকবেন। ওভাবে খামখেয়ালি আর হবেন না। আমার বিয়ে হয়ে গেলে বাবাকে একটু দেখে রাখবেন। কী সৌভাগ্য তাই না? আমারও বিয়ে হবে, আপনিও এলেন। বাবা একজন সঙ্গী পাবে আমি না থাকলে।’ দূরে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো সুফিয়া।
[[চলবে….]]