টুয়েন্টি মিনিটস (চ্যাপ্টার-০১) পর্ব ১০

0
250

#টুয়েন্টি_মিনিটস (চ্যাপ্টার-০১)
পর্ব-১০
লেখা: ShoheL Rana শামী

বাড়ির সামনে একজন পত্রিকার হকারকে থামিয়ে কথা বলছেন জাফর মাস্টার। হাতে তার বাজারভর্তি ব্যাগ। বাজার থেকে ফেরার মুহূর্তে হকারকে থামিয়ে তিনি দুটো পত্রিকা নিয়ে দাম দিলেন। তারপর হকারকে প্রশ্ন করলেন,

‘তুমি তো প্রতিদিন এই পথ দিয়ে যাও, তাই না?’

‘জি স্যার।’

‘বাসা কোথায়?’

‘মোড়ল-পাড়া।’

‘আচ্ছা শুনো, তুমি প্রতিদিন আমার বাড়িতে এই পত্রিকা দুটো দিয়ে যেয়ো, কেমন? এটাই আমার বাড়ি।’ বাড়িটা ইশারা করে দেখালেন জাফর মাস্টার।

‘জি স্যার।’ জবাব দিলো হকার।

‘মাস শেষে একেবারে হিসাব করে পয়সা নিয়ে নিয়ো।’

‘ঠিক আছে স্যার।’ বলেই বিনয়ের সাথে সাইকেল চালিয়ে চলে গেল হকার। সুফিয়া এগিয়ে এসে বাবার হাত থেকে বাজারের ব্যাগটা নিয়ে ভেতরে গেল। জাফর মাস্টার গায়ের কুর্তাটা খুলে সামনের কক্ষে বসে পত্রিকায় চোখ বুলাতে লাগলেন। খানিক পর মেয়ের উদ্দেশ্যে ডাক দিলেন, ‘সুফিয়া… সুফিয়া…’

‘হ্যাঁ বাবা, বলো।’ বাবার ডাকে রান্নাঘর থেকে এলো সুফিয়া। জাফর মাস্টার পত্রিকা থেকে চোখ না সরিয়েই বললেন, ‘ছেলেটার কথা তো সত্যি হয়ে গেল রে।

‘কোন ছেলে?

‘ঐ রিহান। সে বলেছিল না এই মাসেই ব্রিটিশ সরকারের হাতছাড়া হয়ে যাবে বার্মা। এই যে, বার্মা দখল করে ফেলেছে জাপানি সেনারা।’

‘কই? দেখি…’ পত্রিকার দিকে মুখ বাড়িয়ে সুফিয়া শিরোনামটা পড়ে নিলো। তারপর বললো, ‘বার্মা তাহলে ব্রিটিশরা নিজেদের দখলে রাখতে পারলো না? কিন্তু বাবা, তুমি কি বিশ্বাস করতে শুরু করেছো, রিহান সাহেব ভবিষ্যত থেকে এসেছেন?’

‘আরে না।’ হাসলেন জাফর মাস্টার। ‘এরকমটা হয় না-কি? এখন চলে ১৯৪২ সাল মাত্র। কেউ কয়েক যুগ পর থেকে কী করে আসবে? ছেলেটার আসলে মাথায় কোনো অসুখ হয়েছে। বাড়িঘর কোথায় সেটাও হয়তো সে জানে না। এখানে সে কার বাসায় না কার বাসায় থাকে। একটা ডাক্তার দেখাবো ভাবছিলাম তাকে, তাও হয়ে ওঠছে না। আচ্ছা, ছেলেটা তো অনেকদিন এদিকে আসে না, সেই যে গেল! কী হয়েছে বল তো?’

‘আমিও তো জানি না বাবা। তুমি একবার খোঁজ নিয়ে আসবে? ঐ যে, ওইদিন যে বাড়িটার সামনে উনাকে আমরা নামিয়ে দিয়েছিলাম ট্যাক্সি হতে, ঐ বাড়িতেই হয়তো থাকেন।’

‘ঠিক আছে। আমি একবার সময় করে দেখে আসবো ওকে।’

‘কিছু হয়ে যায়নি তো বাবা উনার? এমনিতেই কিছু চিনে না এদিকে। তার উপর মাথায়ও অসুখ, দেশের পরিস্থিতিও ভালো না। তুমি আজই একবার খোঁজ নিয় আসো না বাবা?’ সুফিয়ার মন যেন মানছে না।

‘আচ্ছা, বিকেলে যাবো।’

বিকেলে জাফর মাস্টার রিহানের খোঁজে জাকারিয়া সাহেবের বাড়িতে এলে, জাকারিয়া সাহেব মাস্টার সাহেবকে রিহানের কক্ষে নিয়ে এলেন। রিহান সে সময় শুয়ে ছিল বিছানায়। তাকে দেখিয়ে জাকারিয়া সাহেব বললেন, ‘এখনও পুরোপুরি সুস্থ হয়নি। বিমানের লেজের ভারি একটা অংশ তার গায়ে পড়েছিল। ভাগ্যিস গাছের শাখায় বাড়ি খেতে খেতে ওটা পড়েছিল, সরাসরি ওর উপর পড়লে ওখানেই মারা যেতো। আমরা চিকিৎসা করেছি। এখন অনেকটা সুস্থ ও।’

জাফর মাস্টার রিহানের পাশে গিয়ে বসলেন। মাথায় হাত বুলাতেই চোখ খুললো সে। মাস্টার সাহেবকে দেখে দুর্বল শরীরে উঠে বসতে চাইলে রিহানকে উনি পুনরায় শুয়ে দিলেন। তারপর একটু শাসনের সুরে বললেন, ‘তুমি কি ছোটো বাচ্চা? ঐ সময় যুদ্ধরত দুটো বিমান তোমার মাথার উপরে। তুমি ওখানে দাঁড়িয়ে থাকলে কেন?’

রিহান জবাব দিলো, ‘আমি আসলে দেখতে চেয়েছিলাম আংকেল, এরকম কিছু হওয়ার পর আমার সময়টা কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু কী হলো দেখেন, আমি এখনও আপনাদের সময়েই আটকে আছি। আমি আমার কথাগুলো কাউকে বিশ্বাসও করাতে পারি না। কেন যেন নিজেকে আপনাদের থেকে আলাদা মনে হয়।’

‘তুমি একদম এসব ভাববে না। তুমি শারীরিক এবং মানসিকভাবে সুস্থ হয়ে যাবে।’

‘আমি মানসিকভাবে অসুস্থ নয় আংকেল। আমি সত্যিই ভবিষ্যত থেকে এসেছি। এই মাসের শেষের দিকে বার্মা জাপানের দখলে চলে যাবে বলেছিলাম, আপনি পত্রিকায় এসব ব্যাপারে কোনো সংবাদ পেয়েছেন তো?’

‘হ্যাঁ, পেয়েছি। কিন্তু, জাপানদের শক্তি অনেক বেশি, এটা আগে থেকেই অনুমেয় ছিল যে ওরা বার্মা দখল করবে।’

জাকারিয়া সাহেব এতক্ষণ ওদের কথা কিছুই বুঝেননি। কী নিয়ে কথা বলছে এরা? হা করে চেয়েছিলেন এতক্ষণ। এবার বলে উঠলেন, ‘আমি তো কিছুই বুঝছি না। কী নিয়ে কথা হচ্ছে এখানে? কীসের এই সময়, সেই সময়? কীসের ভবিষ্যৎ?’

‘আমি বুঝাচ্ছি আপনাকে।’ জাফর মাস্টার বোঝাতে লাগলেন জাকারিয়া সাহেবকে। ‘এই যে রিহান, ও বলতে চাচ্ছে ও আমাদের সময়ের কেউ না। ওর জন্ম হবে ভবিষ্যতে। আর ও হবে আপনাদের উত্তরসূরী।’

‘ও তাহলে সেদিন এই মতলব নিয়ে আমার বাসায় ঢুকেছিলে, তাই না? আজ বুঝতে পেরেছি।’ জাকারিয়া সাহেবের কথায় ক্রোধ প্রকাশ পেল। জাফর মাস্টার তাঁকে বললেন, ‘ছেলেটা আসলে ভালো। আপনি ওকে ভুল বুঝছেন। আসলে ও একটু অসুস্থ। আমি ওকে ডাক্তার দেখাবো।’

‘না, না, এই ছেলেকে বিশ্বাস করে আমি ভুল করেছি। ওকে এখনই বের করবো আমার বাড়ি থেকে।’

খবরটা ইতোমধ্যে সারাবাড়ি হয়ে গেল। সবাই এখন এই বিষয়টা নিয়ে মাতামাতি শুরু করে দিলো৷ ইউনুস এসে জাকারিয়া সাহেবকে ডেকে নিয়ে কী যেন বুঝালো। তারপর পুনরায় ওরা ফিরে আসলে দেখা গেল জাকারিয়া সাহেবের মাঝে রাগটা আর নেই। ইউনুস এবার বলে উঠলো, ‘সব ঠিক হয়ে গেছে। বাবা রিহানকে এখানেই রাখবে। এখানেই থাকুক ও। আমরা মেনে নিলাম ও আমাদের উত্তরসূরি৷’

রিহান অবাক হয়ে গেল। ইউনুস লোকটা তো তাকে পছন্দ করতো না। হঠাৎ তার পক্ষ নিলো কেন? ওভাবে সে জাকারিয়া সাহেবকে ডেকে নিয়ে কী বুঝালো যে, উনার রাগটুকু জল হয়ে গেল?

পরিস্থিতি ঠান্ডা হয়ে এলে সবাই যার যার মতো আবার কাজে লেগে গেল। জাফর মাস্টারও উঠে দাঁড়ালেন। যাওয়ার আগে রিহানের মাথায় হাত বুলিয়ে হেসে বললেন, ‘দ্রুত সুস্থ হয়ে যাবে। সুস্থ হয়ে গেলে আমার ওদিকে যেয়ো, কেমন?’

‘যাবো আংকেল।’ রিহানও হাসলো।

জাকারিয়া সাহেবের সাথে বেরিয়ে গেলেন জাফর মাস্টার। রিহান একা শুয়ে রইলো কক্ষে। একটা বাচ্চা শিশুর কান্না শোনা গেল হঠাৎ। রিহান হাসলো। তার পিচ্চি দাদি কান্না করছে। অনবরত কেঁদেই চলেছে। আরেকটা কণ্ঠ ভেসে এলো ওই ঘর থেকে। পিচ্চি দাদির মায়ের কণ্ঠ। বাচ্চাকে সে শান্ত করার চেষ্টা করছে, ‘কাঁদিস না মা, কাঁদিস না আমার সাহারা মা উমমম উমমম উমমম।’

ওরা শেষ পর্যন্ত বাচ্চার নাম ‘সাহারা’ রেখেছে। রিহানের মুখ থেকে শুনে নামটা পছন্দ হয় খিজিরের। তারপর খিজির মেয়ের নাম ওটাই রাখে। তারমানে বলতেই হয়, দাদির এই ‘সাহারা’ নামটা হওয়ার পেছনে তারও অবদান আছে। আচ্ছা, পিচ্চি দাদি এভাবে কাঁদছে কেন? কখন থেকে কেঁদে চলেছে! কোনো সংকেত দিচ্ছে না তো কান্নার মাধ্যমে? ওই সময় ইউনুস কী বলেছিল জাকারিয়া সাহেবকে? পুনরায় মনে হতে ব্যাপারটা মাথা থেকে ফেলতে পারলো না রিহান। অনেকক্ষণ পর তার কক্ষে এলো ইউসুফ। ইউসুফ তাকে দেখে ব্যঙ্গ করে হাসলো। এখনও সে রিহানকে শত্রু মনে করে। ইউসুফকে হাসতে দেখে রিহান জিজ্ঞেস করলো, ‘কী দাদা, হাসছো কেন?’

‘চুপ।’ দুই কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়ালো ইউসুফ। ‘কে তোমার দাদা?’

‘তুমিই আমার দাদা।’ মৃদু হাসলো রিহান।

‘বলো, বলো, আরও দাদা বলো আমাকে। শীঘ্রই তুমি টের পাবা।

‘কী টের পাবো?’ ভ্রু কুঁচকালো রিহান।

ইউসুফ আরও কাছে এসে গলাটা নিচু করে বললো, ‘তোমাকে ব্রিটিশদের হাতে ধরিয়ে দেবে বলেছে। তারপর মজা বুঝবা। আমাকে সেদিন পয়সা দিয়ে ফেরত নিছো না? এবার খুব মজা হবে। হা হা হা।’

‘কে আমাকে ব্রিটিশদের হাতে ধরিয়ে দেবে?’ ব্যাপারটা সিরিয়াসলি নিলো রিহান।

‘আমার বাবা। বাবাকে বলতে শুনেছি এসব। আমার কমল চাচা আছে না? কমল চাচাকে ব্রিটিশরা খুঁজছে না? কমল চাচার বদলে তোমাকে ধরিয়ে দেবে। হুমম…’ ইউসুফ যেন খুব মজা পাচ্ছে কথাগুলো বলতে পেরে।

‘যাহ্, কমল চাচার বদলে আমাকে কী করে ধরায় দেবে? আমি আর ও এক না-কি?’

‘আরে, তোমার আর কমল চাচার শরীর তো দেখতে একই-রকম। শুধু চেহারাটায় মিল নাই। ব্রিটিশরা তো কমল চাচার চেহারা মনে রাখেনি।’

‘আচ্ছা, তুমি এখন যাও।’

‘হু হু, এখন মজা হবে। আমাকে পয়সা দিয়ে তুমি ফেরত নিছো।’ নেচে নেচে বের হয়ে গেল ইউসুফ। তার কথাগুলো বিশ্বাস করলো রিহান। তারমানে ঐ সময় জাকারিয়া সাহেবকে ডেকে নিয়ে এই কথাগুলো বলেছিল ইউনুস। ইউনুস হয়তো কমলকে বাঁচানোর জন্য আগে থেকেই এই পরিকল্পনা করেছে, যা জাকারিয়া সাহেব জানতেন না। তাই ঐ সময় জানার পর হঠাৎ কথার ধরন পালটে গিয়েছিল তাঁর। সবাই মিলে এরা রিহানকে ব্রিটিশদের হাতে ধরিয়ে দেয়ার পরিকল্পনা করছে। মনে মনে কৃতজ্ঞতা জানালো রিহান ইউসুফের প্রতি। ইউসুফ তাকে শত্রু ভেবে উপকারই করে গেল। মনে মনে রিহান বললো, ‘ধন্যবাদ দাদা, অতীতে এসে তোমাকে আমি মার খাইয়েছি, আর তুমি আমাকে অজ্ঞাত অবস্থায় বড়ো বিপদ থেকে বাঁচালে।’

পিচ্চি দাদিকেও ধন্যবাদ দিলো রিহান। ওর কান্না থেমে গেছে এখন। হয়তো কান্নার মাধ্যমে সেও একই সংকেত দিতে চেয়েছিল। নিজের দাদা-দাদি তাকে এভাবে বাঁচিয়ে দিলো! দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে হাসলো রিহান। তাকে আজই পালাতে হবে এখান থেকে। কিন্তু কীভাবে পালাবে? দুর্বল শরীর নিয়ে সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে সে পালাতে পারবে তো?

[[চলবে…]]

(আজ গল্প দেয়ার ইচ্ছে ছিল না। ক্লান্ত/দুর্বল শরীর নিয়ে তবুও লিখেছি। সবার সাড়া চাই।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here