#জীবন মানে তুমি
#লেখিকা:H.B.Rini (Irini Ori)
#পর্ব:২৩
(৮৪)
আবরার হসপিটাল থেকে এসে ল্যাবে কাজ করছে।দেখে মনে হচ্ছে কাজটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ তাই তিন-চারজন ছাড়া রুমে আর কাউকে এলাও করা হচ্ছেনা।
-“স্যার আসতে পারি?”
প্রথমে আবরার কন্ঠটা শুনে খুব চমকে যায়।কেননা এই কন্ঠের মানুষকে বর্তমানে ইংল্যান্ডে থাকার কথা।আবরার ঘুরে তাকিয়ে দেখে ছয় ফুট মতো লম্বা,মুখে হালকা চাপ দাঁড়ি,চুলগুলো ব্রাউন কালারের,মুখে হাঁসি নিয়ে একটা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে।ছেলেটা আর কেউ নয়,ওর সবচেয়ে কাছের বিশ্বস্ত অ্যাসিস্ট্যান্ট বিহান দাঁড়িয়ে আছে।যার উপর আবরার চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করতে পারে।তাই জন্য ইংল্যান্ডে এতবড় একটা কাজের দায়িত্ব দিয়েছিলো।আবরার গায়ের ল্যাবের স্যুটটা খুলে ছেলেটাকে জড়িয়ে ধরে বলে,
-“হুয়াট এ্যা সারপ্রাইজ?তোমার তো হিসাব মতে আরো পরে আসার কথা,তাহলে এখন?কাজটা কী কম্পিলিট করেছ?”
ছেলেটা হেসে বলে,
-“স্যার,আপনার হিসাব মতে কী আদেও দেরী করে আসার কথা?আমার তো মনে হয়না।”
-“তুমি খুব চালু হয়ে গেছো বিহান।”
-“সব আপনার থেকে শিখেছি।স্যার,ম্যাম কেমন আছে?ইনি কী সেই…”
-“হামম,যার কথা ভাবছো সেই মেয়ে।ইউ নো,মেয়েটার এক অদ্ভুত মায়া আছে।বাট্ সরি টু ছে্,কাজের জন্য তুমি এ্যাটেন্ড করতে পারলেনা।”
বিহান হেসে বলে,
-“কোনো ব্যাপার না স্যার,কাজটা খুব গুরুত্বপূর্ণ বলেই আপনি দায়িত্ব দিয়েছিলেন।কিন্তু স্যার আপনি এত তাড়াতাড়ি তো বিয়েটা করতে চেয়েছিলেন না,তাহলে?”
আবরার বিহানকে সাথে নিয়ে কেবিনে ঢুকে চেয়ারে বসতে বসতে বলে,
-“ইউ্ নো বিহান,তুমি জানো আমি সবকিছু চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকি।প্রথমত ছিলো ওর কিছু পার্সোনাল প্রবলেম আর দিত্বীয়টা তুমি জানো, আমাকে বলতে হবেনা।”
বিহান হালকা হেসে মাথা নাড়িয়ে বলে,
-“এটাই ভেবেছিলাম স্যার..”
-“আজ কোনো কাজ করতে হবেনা,বাসায় যেয়ে রেস্ট নাও।পরে তোমাকে ডেকে নিবো…”
-“ওকে স্যার,বাই..”
বিহান কেবিন থেকে বেরিয়ে যেতেই আবরার নিজের ফোন অন করে ইয়ারাবীর ছবি দেখে।ছবিটাতে ইয়ারাবী ঘুমান্ত অবস্থায় আছে,দেখতে খুব মায়াবি লাগছে মেয়েটাকে।আবরার ছবিটা দেখতে দেখতে অতীতে ফিরে যায়।
লন্ডনে শুধু ডাক্তার পেশার জন্য নয় আরো একটা পরিচয় আছে ওর।তবে সেটা বেশি কেউ জানেনা।মাসছয়েক আগে আবরার বাংলাদেশে ব্যাক করে একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজে।দেশে আসার পর ওর ওর প্রিয় বন্ধু ইরাক আর ইফাজের সাথে দেখা করতে ওদের বাসায় যায়।আবরার ওদের বাসায় পৌঁছাতে বাগানে ইফাজের সাথে দেখা হয়।জানতে পারে ইরাক ক্যাম্পে আছে,তাই মনটা একটু খারাপ হলেও ইফাজের সাথে কথা বলতে বলতে ওর রুমে যায়।হঠাৎ পাশের রুম থেকে কোনো মেয়ের কথার শব্দ শুনে খুব অবাক হয়।কেননা ইফাজের মা বাসায় নেই,তাছাড়া যে কাজের মেয়ে আছে সে এতো জোরে জোরে কথা বলবেনা।কৌতুহল দমিয়ে রাখতে না পেরে ইফাজকে প্রশ্ন করে,
-“তোদের বাসায় লাউড সাউন্ডে কে কথা বলছে?”
ইফাজ কফির মগটা ওর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,
-“আমার বোন,আর এটা ওর লাউড সাউন না বল নরমাল সাউন্ড।”
আবরার ওর বাম ভ্রুটা উচু করে কিছুটা সন্দেহের কন্ঠে বলে,
-“তোদের বোন আবার কোথার থেকে এলো?”
-“আরে আমার খালার মেয়ে,ওই যে যার কথা বলতাম ও।তবে আমাদের নিজের বোন মনে করি ওকে।”
-“ওহ্হ্,তবে ওর নামটা কোনোদিন বলিসনি,কী নাম ওর?”
ইফাজ কিছু বলতে যাবে তার আগেই আবরারের একটা গুরুত্বপূর্ণ কল আসে।মুহুর্তের মধ্যে ওকে ইফাজের বাসা থেকে বের হয়ে যেতে হয়।
তার এক সপ্তাহ পর ইফাজ ওকে জোর করে হাসপাতাল থেকে বাড়িতে নিয়ে যায়।সেদিন ও প্রথম ইয়ারাবীকে দেখে।একটা কালো ট্রাউজার, সাদা লং গেন্জি,আর গলায় সাদা স্কার্ফ প্যাঁচানো, চোখে চশমা আর চুলগুলো খোপা করা ডাইনিং এ দাঁড়িয়ে খুব জলদি জলদি বিকালের নাস্তা করছে।ইফাজ ওকে দেখে মাথায় চাটি মেরে বলে,
-“তোকে বলেছিনা বসে নাস্তা করবি,আর এখন কেন করছিস?এটা বিকালের না সন্ধ্যার বল?”
ইয়ারাবী মাথা ঢলতে ঢলতে ইফাজের দিকে ঘুরে তাকিয়ে বলে,
-“খেতে ইচ্ছা করছিলোনা তাই,কিন্তু খালামনি শুনলো না।এখন ধরে বেঁধে নাস্তা করতে বসিয়ে দিলো।আর খাওয়া শেষ তাই দাঁড়িয়ে আছি।”
-“পিরিচে তো সব রয়েই গেছে,সব শেষ করে তারপর রুমে যেয়ে পড়তে বসবি।চুপচাপ বসে খাবার খা।”
-“আমার হয়ে গেছে…”
-“মার খেতে না চাইলে বসে যা…”
ইয়ারাবী একরাশ বিরক্তি নিয়ে আবার বসে খাবার খেতে থাকে।ইফাজ ওর মাথায় হাত দিয়ে সরে আসতেই আবরার ওকে দেখে খুব অবাক হয়ে যায়।তবে নিজেকে সামলে ইফাজের সাথে ওর রুমে বসে কথা বলতে বলতে এক পর্যায়ে ওর ল্যাপটপ অন করতে ইয়ারাবীর অনেকগুলো ছবি আসে।আবরার ছবিগুলো দেখে একবার হেসে ইফাজের দিকে তাকিয়ে বলে,
-“তোর বোনের নামটা কী?”
-“ইয়ারাবী”
-“পুরো নাম বল…”
ইফাজ এবার আবরারের দিকে একটু অবাক হয়ে তাকায়।তারপরও নিজেকে সামলে বলে,
-“তুই কী করবি?”
-“তুই বলবি?”
-“ইয়ারাবী বরকতুল্লাহ ইস্মা।কেন কী হয়েছে?”
-“কোনোদিন চিটাগাং গেছে ও?”
-“কেন বলতো?হামম গেছিলো,বাট্ একটা দুর্ঘটনা ঘটে সেইবার।”
-“ওহ্,আচ্ছা চেন্জ কর।শোন তোর বোনের কোনো বয়ফ্রেন্ড আছে?”
-“নাউজুবিল্লা,এসব থেকে অনেক দূরে থাকে ও।প্রয়োজনে ছাড়া কোনো ছেলের সাথে কথা বলেনা।এখন বল এগুলো কেন শুনছিস?”
-“তুই জানিস,আমি সোজাসুজি কথা বলা লাইক করি।তোর বোনকে আমার ভালো লেগেছে।প্লীজ ব্রো,কীভাবে,কেন,কখন এসব জানতে চাস না।”
ইফাজ খানিকটা হেসে বলে,
-“এটা তোর মোহ,ও শ্যামলা হলেও ওর মুখে এক মায়া আছে।যার জন্য অনেকে ওর মোহে পরে।”
-“এটা আবেগের বয়স নয় সেটা তুই জানিস।”
-“আবরার,এই মাসের লাস্ট উইকে ওর আঠারো পরবে।তাছাড়া ও সেমন মেয়ে নয় যা তুই ভাবছিস।পিচ্চির লাইফে ফ্রিডম বলে কিছু নেই, তাই এবার লেখাপড়া করে নিজের পায়ে দাঁড়াতে চাই…”
-“দেখ মম এমনিতে আমার জন্য মেয়ে খুঁজছে, তাছাড়া আমার ফ্যামিলি কেমন তোরা জানিস।ও স্বপ্নের পথে কোনো বাঁধা থাকবেনা।আমরা ফ্যামিলি ব্যাকডেটেড নয়,ও পড়তে না চাইলেও জোর করে পড়াবে।”
ইফাজ আবরারের হাতটা ধরে কিছু বলতে যাবে তখনি ইয়ারাবী ওদের রুমে ঢুকে বলে,
-“ওহ্ সরি সরি ভাইয়া,আসলে নক করতে চেয়েছিলাম কিন্তু দু’হাতে নাস্তা আছে।এগুলো ধরো তাড়াতাড়ি…”
ইফাজ তাড়াতাড়ি ওর হাত থেকে ট্রেটা নিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে বলে,
-“সাথী কই?তুই আনলি কেন,সিড়ি থেকে পরে গিয়ে হাতে ব্যাথা পেয়েছিস না?”
ইয়ারাবী খানিকটা চমকে গিয়ে বলে,
-“তুমি জানলে কীভাবে?”
-“তুই না বললে জানবোনা ভেবেছিস,আম্মু ফোন করেছিলো তাই।”
-“সাথি আপু চলে গেছে আর খালামনি রাতের জন্য রান্না করছে।আচ্ছা গেলাম,নয়তো ইমন ভাইয়া পড়ার জন্য বকবে।”
-“যা,পড়তে বস।”
ইয়ারাবী চলে যেতেই আবরার ইফাজের দিকে তাকিয়ে বলে,
-“খুব ইন্টারেস্টিং যে তোর বোন!আমি এখানে বসে আছি একবারও আমার দিকে তাকালোনা।”
-“ও ওমনি,অন্তর্মুখী টাইপের মেয়ে।খুব প্রয়োজন ছাড়া অপরিচিত কারোর সাথে কথা বলেনা।আর তাছাড়া আমাদের ফ্রেন্ড বাসায় আসলে ও ভুলেও তাদের সামনে যায়না,আজ শুধু সাথি নেই বলে নাস্তা দিতে এলো।”
-“তুই ওর ব্যাপারে কিছু বলতে চেয়েছিলি।”
-“তুই খুব কাছের তাছাড়া ওর প্রতি আগ্রহ দেখালি বলে তোকে বলছি শুধু।ওর ফ্যামিলি ওকে কখনো সাপোর্ট করেনা,না কখনো কোনো ফ্রিডম দিয়েছে ওকে।বাকী বাচ্চাদের মতো ওর লাইফটা কখনো হয়নি,ঘরবন্দী মেয়ে ও।আর তুই বললিনা,ওর স্বপ্নের পথে কোনোদিন বাঁধা হবিনা।কিন্তু কী জানিস?ওর লাইফে স্বপ্ন নামের জিনিসটা কখনো আসেনি।ওর বাবা-মা নিজেদের হাতে ওর স্বপ্নগুলোকে খুন করেছে।তুই লন্ডনে থাকতে কিছু মাস আগে ফোন করেছিলি,তখন বলেছিলাম না আমার এক বোন সুইসাইড এটেম নিয়েছে?”
-“হ্যাঁ,বলেছিলি…”
-“জানিস ওই মেয়েটা ইয়ারাবী ছিলো।যে আত্মহত্যার মুখ থেকে যাদের মোটিভেশন দিয়ে বের করে আনে,সেই বদ্ধ হয়ে আজ নিজে পদক্ষেপ নিয়েছিলো।শুধুমাত্র পরিবারের করা অবহেলা।পরিবার থেকে প্রতিনিয়ত অবহেলা,নির্যাতন,মানসিক চাপ সব মিলিয়ে ডিপ্রেশনে চলে গেছে মেয়েটা।মনখুলে হাসতে ভুলে গেছে।ওর পরিবারের কাছে ওর জীবনটা একটা খেলার মাঠ।আমার দেখা সব থেকে অবাক চরিত্র হচ্ছে ইয়ারাবী।জানিস ওর জন্মের…”
হঠাৎ আবরার ফোনে একটা কল আসার কারনে ভাবনা থেকে বের হয়ে আসে।ফোনের দিকে তাকিয়ে দেখে হসপিটাল থেকে কল এসেছে।ও একটা হতাশার নিঃশ্বাস ফেলে প্রাপ্তকে ল্যাবের দায়িত্ব দিয়ে হাসপিটালের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পরে।
(৮৫)
আশপাশে নানান ধরনের মানুষ আছে। সবার মধ্যেই রয়েছে হিংসা, ভালোবাসা, প্রেম কিংবা রাগ-ক্ষোভ।তবে কিছু মানুষ রয়েছে যাদের সঙ্গে থাকলে বা দেখা হলে আপনার জীবন হয়ে উঠতে পারে বিষাক্ত।এদের মধ্যে একদল মানুষ আছে যাদেরকে ইংরেজিতে বলে ‘নারসিসিস্ট’। তাদের থেকে দূর থাকা উচিত।কেননে অতিরিক্ত এই আত্মপ্রেমীদের আশপাশে থাকা মানুষদের গুনতে চরম মূল্য।‘নারসিসিস্ট’দের প্রথমে বেশ মনোহর মনে হবে। তবে তারা হবে ধান্দাবাজ, একগুয়ে, সহজেই অন্যকে দোষ দেবে এবং নিজের পছন্দমতো কাজ না হলে দেবে শীতল মনোভাব।আর এদের মধ্যে শাওন ও পরে।ইয়ারাবী সব সময় এসব মানুষদের থেকে দূরে থাকতে চাই কিন্তু তারপরও মুখোমুখি হতে হয় এদের।
ভার্সিটি থেকে এসে সবার সাথে কথা বলে,হালকা নাস্তা করে চুপচাপ পড়তে বসেছে।যতই সামনে বই থাকুক না কেন মন পরে আছে শাওনের প্রতিটা বাক্যে।একটা মানুষ কতটা নিচু মনের হলে এমনটা বলতে পারে।এমন কথা বলতে অন্ততপক্ষে বিবেকে বাঁধে,কিন্তু শাওন পুরো ভার্সিটির সামনে এমন কথাগুলো বিনা সংকোচে বলে গেল।তবে ইয়ারাবীর ভয় হচ্ছে এই কথাগুলো যদি আবরার যেনে যায়,তখন কী হবে?ওর পরিবারের মতো কী ওকে ভুল বুঝবে?নানা ধরনের চিন্তা মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে।এমন সময় কেউ দরজায় নক করলো।সামনে তাকিয়ে দেখে ইকরা দাড়িয়ে আছে।ইয়ারাবী চেয়ার থেকে উঠে ওকে বলে,
-“আপু আপনি,দরকার হলে আমাকে ডাক দিতেন?”
ইকরা হাসিমুখে ওর রুমে ঢুকে বলে,
-“কেন,কোনো প্রয়োজন ছাড়া কী আসতে পারিনা?”
-“তেমন কিছু না আপু,বসেন আপনি?”
ইকরা বসতে বসতে বলে,
-“আজ এক্সাম কেমন হলো?”
-“আলহামদুলিল্লাহ,মোটামুটি ভালো হয়েছে।আজ আপনার আসতে লেট হলো যে?”
-“আর বলোনা,একটা টেস্ট ছিলো তার খাতা দেখতে দেখতে লেট হয়ে গেলো।তোমার মনে হয় পড়ার ডিস্টার্ব করলাম।”
-“না আপু,তাছাড়া কাল অফ ডে,এক্সাম নেই।”
ইকরা হেসে বলে,
-“তাহলে তো মেঘের খুব ভালো হলো।আচ্ছা তুমি খেয়েছো?”
-“জ্বি,আসার পর লান্চ করে নিয়েছি।”
-“একটা কথা বলি তোমাকে?”
-“বলুন আপু”
-“আমাকে আপনি নয় তুমি করে বলবে।জানো তোমার মতো এমন একটা মিষ্টি বোন ছিলো আমার,তবে তোমার থেকে বয়সে একটু বড় হতো।”
ইয়ারাবী ইকরার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,
-“ছিলো মানে?উনি এখন কোথায়?”
-“আমাদের সবাইকে ফাঁকি দিয়ে দূর আকাশের তারা হয়ে গেছে।সে অনেক কথা অন্য আরেকদিন বলবো।তবে আজ থেকে আমাকে তুমি করে বলবে কিন্তু।”
-“আচ্ছা আপু…”
-“তাহলে তুমি এখন পড়ো আমি পরে আসবো।”
ইকরা ইয়ারাবীর মাথায় হাত বুলিয়ে চলে যায়।ইয়ারাবী ওর কষ্টটা বুঝতে পারছে,কেননা যার যায় শুধু সেই উপলব্ধি করতে পারে আসল কষ্টটা।আর কষ্টটা তখন আর বেশি হয় যখন নিজের মানুষগুলো অবিশ্বাস করে।ঘড়ির কাঁটার উল্টোদিকে তাকাতে চাইনা ইয়ারাবীর।কেননা বর্তমান থেকে অতীত ওকে আরো বেশি কষ্ট দেয়।শারীরিক ও মানসিক ভাবে আঘাত করে,সেটা হতে পারে পুরানো কোনো ঘটনা বা কোনো ব্যাক্তিত্ব দ্বারা।
মরিচার পিছু অনেকে ছুটে,কিন্তু মরিচিকা যখন ফাঁসির দড়ি হয়ে গলায় আটকে যায়…তখন বুঝা যায় জীবনের আসল মানে।তবে ইয়ারাবীর একটাই আফসোস থাকলো ওর পরিবার আজও মরিচিকার পিছু দৌঁড়াচ্ছে।ও বুঝানোর হাজার চেষ্টা করলেও লাভ হয়নি।তত্ত্বগতভাবে, তত্ত্বীয় আর ব্যবহারিক দিকটা একই,কিন্তু ব্যবহারিক ক্ষেত্রে তারা এক নয়।এটা ওর পরিবার কখনো বুঝতে চাইনা।
নানা ভাবনা থেকে বেরিয়ে বইরের পাতায় চোখ রাখতে একটা নাম্বার থেকে ওর ফোনে কল আসে।নাম্বারটা দেখে ও কিছুটা চমকে যায়,কেননা এই নাম্বারের ব্যাক্তির সাথে এসএসসির পর আর কোনো কথা হয়নি।যখনি ও ফোন ঢুকানোর চেষ্টা করতো নাম্বারটা বন্ধ দেখাতো।ইয়ারাবী সাত-পাচঁ না ভেবে ফোনটা রিসিব করে একটা সালাম দিতেই অপর পাশের ছেলেটি কান্না মিশ্রিত কন্ঠে বলে উঠে,
-“ইস্মা,প্লীজ আমাকে সাহায্য কর।নয়তো আমার মা বাঁচবেনা।”
ইয়ারাবী এই প্রথম ছেলেটির কান্না শুনছে।কেননা হাজার ঝড়-তুফান ওর জীবনের উপর দিয়ে গেলেও ওকে কখনো কাঁদতে দেখিনি।ইয়ারাবী খানিকটা চিন্তিত কন্ঠে বলে,
-“কী হয়েছে,উমীদ?”
-“ইস্মা আমার মায়ের হার্টের অপারেশন করতে হবে আগামীকাল,প্রচুর টাকা লাগবে।আত্মীয়-স্বজনদের কাজ থেকে,আর বাড়িটা বন্ধুক রেখে ধার-দেনা করে কিছু টাকা জমিয়েছি।কিন্তু এখনো পঞ্চাশ হাজারের মতো টাকা লাগবে।অনেকের কাছে বলেছি কিন্তু কেউ এতো টাকা দিতে চাইছেনা।বিলাশ তোর কথা বলে,তুই বলে মানুষের সাহায্য করিস।তুই জানিস আমাদের অবস্থা,যার জন্য আর লেখাপড়া করতে পারিনি।”
ইয়ারাবী খানিকটা চিন্তায় পরে যায়।আগে একটা এনজিওতে কাজ করতো কিন্তু এখন ছেড়ে দিয়েছে।আর এখন নিজেরা মিলে অসহায় বাচ্চা আর মহিলাদের জন্য কাজ করে।ইয়ারাবী খানিকটা চুপ থেকে কিছু একটা ভেবে ওকে বলে,
-“আমিতো ওই এনজিওতে নেই।তাছাড়া এখন যে কাজ করি সেখান থেকে টাকা দেওয়া পসিবল নয়।”
-“শেষ ভরসা তুই,প্লীজ না করিস না।”
-“শোন তোকে রাতে জানালে হবে?”
উমীদ হতাশার গলায় ওর ওকে বলে,
-“পারবি দিতে..”
-“ইনসাল্লাহ সব ঠিক হয়ে যাবে,পঞ্চাশ দিতে না পারলেও কিছুটা ম্যানেজ করে দিবো।চিন্তা করিস না,আল্লাহ হাফেজ।”
ইয়ারাবী ফোনটা কেঁটে টেবিল থেকে উঠে কাবার্ডের দিকে যেয়ে লকারটা খোলে।এখানে ওর কাবিনের টাকাগুলো রাখা আছে।ওর প্রথমে মনে হয়েছিলো এখান থেকে টাকাগুলো উমীদকে দিবে,কিন্তু আবরারকে না জানিয়ে দেওয়াটা ঠিক হবেনা।ও কয়েকবার ওকে কল করে কিন্তু ফোনটা বন্ধ দেখায়।ও আবার যেয়ে টেবিলে বসে পড়তে থাকে।
(৮৬)
প্রতিবারের মতো এই কেসটাও য়ুহার জিতেছে, পাইয়ে দিয়েছে অপরাধীককে অপরাধের সাজা।সবার সাথে কথা বলে কোর্ট থেকে বের হচ্ছে এমন সময় ওর গাড়ির কাছে শৈলকে দেখতে পায়।মানুষটা খুব রাগী হলেও য়ুহারের কাছে সব পানি হয়ে যায়।য়ুহার জানে শৈল এখানে কেন এসেছে?কথাটা ভাবতেই একটা হতাশার দীর্ঘশ্বাস ওর ভিতর থেকে বের হয়।য়ুহার ধীর পায়ে গাড়ির কাছে যেয়ে শৈলকে বলে,
-“শৈল ভাই আপনি এখানে কেন?”
-“কেন সেটা তুমি খুব ভালো করে জানো য়ুহার।”
য়ুহার হাতের ফাইলগুলো গাড়ির ভিতর রেখে বলে,
-“জানেন শৈল ভাই,একজন মানুষ মারা যাওয়ার আগে সে বুঝতে পারে পৃথিবীতে তার সময় খুব স্বল্প।ঠিক আমিও বুঝতে পারছি আমার সময়ও খুব কম…তাই এই স্বল্প সময়ে কাউকে নতুন রঙে রাঙিয়ে স্বপ্ন দেখাতে চাইনা।”
-“কেন এমন করছো য়ুহার?সময় আছে,নতুন করে সব শুরুও করা যাবে তাহলে…”
য়ুহার শৈলের কথা শুনে মুচকি হেসে বলে,
-“শীতের কুয়াশার সে কোন অন্তিম পোচড়ের ফাঁকে-ফাঁকে বৃহস্পতি কালপুরুষ অভিজিৎ সিরিয়াস যেন লন্ঠন হাতে করে এখান থেকে সেখানে, সেখান থেকে এখানে কোন সুদূরযানের পথে চলেছে, কেমন একটা আশ্চর্য দূর পরলোকের নিক্কণ শোনা যায় যেন।”
-” জীবনানন্দ দাশ (মাল্যবান) থেকে,পড়েছি অনেকবার লাইনটা।তবে তুমি কবে থেকে সাহিত্য প্রেমি হয়ে গেলে।”
-“আমি সাহিত্য প্রেমি নই,তবে পড়তে আমার বরাবারই ভালো লাগে।আমার একটা বিবেক আছে শৈল ভাই।ধরুন আপনাকে বিবাহের দিন প্রতিশ্রুতি দিলাম যে সারাটা জিবন আপনার পাশে ছায়া হয়ে থাকবো।আপনার মা সংসারের দায়িত্ব আমার হাতে তুলে দিলেন,প্রানোও খুশি হলো তাদের বন্ধুকে কাছে পেয়ে, অনেকে অনেক আশা করে চেয়ে থাকলো আমার দিকে।কিন্তু কিছু সপ্তাহ,মাস কিংবা বছর শেষে তাদের সবাইকে নিরাশ করে হারিয়ে গেলাম।না চাইতেও অপরাধী হয়ে গেলাম সবার কাছে,ভাবতেই আমার বিবেক আমাকে থামিয়ে দেয় প্রতিবার।”
-“মানুষের বিবেক কখনই কন্সট্যান্ট নয় য়ুহার, এটা নির্ভর করে, টাইম টু টাইম,প্যালেস টু প্যালেস অনুযায়ী।আর তুমি এতটা স্বার্থপর কীভাবে হতে পারো য়ুহার,শুধু নিজের কথাটাই ভাবলে।”
য়ুহার শৈলের কথা শুনে হেসে বলে,
-“ঠিক বলেছেন শৈল ভাই,তবে এই স্বার্থপরতা আমি অর্কভের কাছ থেকে শিখেছি।যখন আমার ব্যাপারে জানলো, আমি ভেবেছিলাম ও আমাকে সাহস জাগাবে,বলবে “আমি তোমার সাথে আছি।”
কিন্তু স্বার্থপরের মতো নিজের হাতে স্বপ্নের সুঁতাগুলো ছিড়ে চলে গেলো।তাই ভাবলাম ও যদি স্বার্থপর হতে পারে তবে আমি কেন পারবোনা।ব্যাস হয়ে গেলাম স্বার্থপর।আজ স্বার্থপর বলে,রোজ বাসায় ফিরে মায়ের হাসি মাখা মুখটা দেখতে পারি…স্বার্থপর বলে,বাবার ছেলেমানুষি নানা গল্প শুনতে পারি।আর আজ স্বার্থপর বলে,ছোট ভাইয়ের সব আবদার মিটাতে পারি।আপনি বলেন শৈল ভাই,আজ যদি স্বার্থপর না হতাম তাহলে কী এদের হাসি-খুশি সময়টা উপভোগ করতে পারতাম।জানি উত্তরটা নেই আপনার কাছে।”
য়ুহারের কথা শুনে শৈল চুপ হয়ে যায়।আসলেই তার কাছে এর উত্তর নেই।য়ুহার ওর দিকে তাকিয়ে আবার বলে,
-“জানেন এই চারটা মানুষ বাদে আরো একজন আছে সে হলো আমার বাচ্চাটা,ইয়ারাবী।অনেক ইচ্ছা ছিলো কেউ একজন এসে ওকে আগলে রাখুক,আর আমার সেই চাওয়াটা পুরন হয়েছে।জানেন এদের হাসি মাখা মুখটা দেখলে মনে হয় আরো কিছুদিন যদি এদের সাথে কাঁটাতে পারতাম।যখন কোনো কেস জিতে বাড়ি ফিরি, তখন বাবা-মা আমাকে কী দোয়া করে জানেন,”দীর্ঘজীবী হও,আরো অন্যায়ের প্রতিবাদ করো।আমাদের বাকীটা বয়স যেনো তোমার লেগে যায়।”তখন খুব চিৎকার করে বলতে ইচ্ছা করে যে,”আম্মু আমিও চাই দীর্ঘজীবী হতে,তোমাদের সাথে বাকীটা জীবন কাঁটাতে”…কিন্তু বলতে পারিনা।জানেন একজন মায়ের কাছে সব চেয়ে কঠিন জিনিস হলো নিজে সুস্থ সবল হলেও সন্তানকে চোখের সামনে ধুকে ধুকে মরতে দেখা,একজন বাবার কাছে তো আরো কঠিন যখন তার লাশের খাটিয়াটা কাঁধে রাখে,আর ভাই-বোন। যদি ইস্মিতা মারা না যেতো তবে এতকিছু বুঝতে পারতাম না।আমাকে মাফ করবেন শৈল ভাই আর ধন্যবাদও,কেননা কথাটা গোপন রাখার জন্য।”
য়ুহার শৈল দিকে না তাকিয়ে গাড়ি নিয়ে বেড়িয়ে পরে।শৈল ওখানেই চুপচাপ দাঁড়িয়ে দেখতে থাকে য়ুহারের গাড়িকে।কিছু বলতে পারেনা য়ুহারকে,আর বলবে বা কী?ওর কাছে কোনো উত্তর নেই।সব কিছু জানার পরও শৈল ওর কাছে নিজের মন থেকে এসেছিলো কিন্তু য়ুহারের এটা মনে হয় যেনো শৈল ওকে করুনা করছে।
সাড়া রাস্তাধরে য়ুহার শুধু চোখের পানি ফেলে।এ ছাড়া ওর আর কিছু করার নেই কেননা জীবনের উপর কারো হাত নেই।যার আয়ু যতটুকু সে ততটুকু বাঁচবে।ঘন্টাখানিক পর য়ুহার নিজের বাসার সামনে পৌঁছিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করে বাসার মধ্যে ঢোকে।ওর মা অচলা ওকে দেখে বলে,
-“এইতো চলে এসেছে আমার আম্মুটা। ”
-“কী হয়েছে আম্মু?”
-“তুই কী ভুলে গেছিস,সামনের মাসে ইস্মিতার মৃত্যুবার্ষিকী…”
-“হ্যাঁ,জানি সবটাই।তবে বরাবরের মতো এবারো আমি ফুপিদের ওখানে যাবোনা।”
-“জানি তুই কেন যাবিনা,এটা আমিও জানি ইস্মার কোনো হাত নেই এর ভিতরে।তবুও মেয়েটাকে ভুল বোঝে ওরা।”
-“সেটাতো অনেক আগ থেকেই,প্রশ্ন অনেক কিন্তু উত্তর একটাও নেই।এখন বলতো এক মাস পরের খবর একমাস আগে কেনো বলছো?”
মিসেস অচলা একটু নড়েচড়ে বসে বলেন,
-“কেউ একজন কেসটা আবার রি-অপেন করেছে।তুই তো লয়ার তুই একটু খোঁজ নিয়ে দেখতো কাজটা কার।কেননা তোর ফুপা বা ফুপু এমনটা করবেনা।তাছাড়া আজ সকালে ওনাদের বাসায় গেলে আপা আমাকে সবটা বলে।”
-“হ্যাঁ,দেখছি। আমি তার আগে খাবার দাও তো পেটে ছুচা,ইঁদুর সব দৌঁড়াচ্ছে।”
-“হ্যাঁ,আম্মু তোমার মেয়ে কোর্টে ঝগড়া করে এসেছে তো তাই ক্লান্ত হয়ে পরেছে।”
য়ুহার ঘুরে তাকিয়ে দেকে নিলয় ফোনে গেম খেলতে খেলতে সোফায় বসছে।য়ুহার ওর মাথায় একটা চাটি মেরে বলে,
-“আম্মু এই বাদরের হাত থেকে ফোন নিয়ে নিবা,পড়ালেখা তো সব গোল্লায় যাচ্ছে দিনদিন।”
-“আম্মু তোমার মেয়েকে নিষেধ করো আমার পিছু লাগতে।”
-“তুই ভুলে যাসনা আমি তোর বড়।সারাদিন তো দুই বাদর টোটো করে চরকার মতো ঘুরে বেড়াবি।বলছি লেখাপড়া কিছু কর,নয়তা পরীক্ষায় ফেল করলে আব্বু আর চাচুকে নিষেধ করে দিবো যাতে কোনো সুপারিশ না করে।”
-“মনে হচ্ছে আমরা ফেল করি,কই বুড়ো টাকলা তো আমাদের নম্বর কম দিলো।”
-“শিক্ষককে সম্মান দিবি,কই আমার নামে তো কোনোদিন নোটিশ আসেনি।”
-“কারন তোমদের নোটিশ দিয়ে কী টিচাররা মরবে।তোমরা হলে ভয়ংকর মহিলা,যারা কোমরে কাপড় বেঁধে মাঠে ঝগড়া করতে নামে।”
-“কী বলবি তুই….”
য়ুহার কথাগুলো বলে নিলয়ের পিঠে ইচ্ছা মতো কিল মারতে শুরু করে আর এদিকে নিলয় বোনের চুল ধরে টানতে শুরু করে।এগুলো দেখে মিসেস অচলা এবার রেগে যেয়ে বলেন,
-“ওই যে আবার শুরু হয়ে গেছে ওনাদের।এবার এই বিল্ডিং এর সব মানুষ বুঝতে পারবে আমার দুই গুনধর সন্তানরা এক হয়েছে।তোদের জ্বালায় আর পারিনা,আর একটা সাউন্ড যেনো না শুনি, নয়তো আমার থেকে খারাপ কেউ হবেনা।দু’টো ফ্রেস হয়ে টেবিলে বসবি।আমি খাবার দিচ্ছি…”
দুই জন ওদের মায়ের অগ্নিরুপ দেখে চুপচাপ ভদ্র মানুষের মতো সোফায় বসে পরে।মিসেস অচলা একবার তাকিয়ে রান্নাঘরের দিকে যেতেই দুই ভাই-বোন মায়ের রাগ দেখে হাসিতে ফেটে পরে।কেননা ওদের মাকে ওরা না রাগাতে পারলে দিনটা ভালো যায়।মিসেস অচলা লেখাপড়া কম করলেও সন্তানদের প্রতি খুব স্নেহশীল।ওনার আচারনে বা কাজে কেউ কখনো বুঝতে পারেনা উনি কম শিক্ষিত।
(৮৭)
সন্ধ্যা সাতটা বাজে,হালকা বাতাসের সাথে চারপাশটা অন্ধকার।কনকনে শীত পরছে আজ।আর সেই শীতের মধ্যে গুটিগুটি হয়ে বিড়াল ছানার মতো বেডে ঘুমিয়ে আছে ইয়ারাবী।আবরার ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে হালকা বাঁকা হেসে ওর গায়ে ব্লাঙ্কেটটা ঠিক করে টেনে দিয়ে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে ডাকতে থাকে।এমন শীতের মধ্যে মাথায় গরমের উষ্ণতা পেয়ে আধোআধো করে চোখ খুলে তাকিয়ে দেখে পাশে আবরার বসে আছে।আবরার ওর জাগতে দেখে হেসে বলে,
-“আমি তোমাকে এক্সাম দিয়ে এসে রেস্ট নিতে বলেছিলাম।কিন্তু তুমি সারাদিন পরে বিকালে ঘুমাচ্ছো?”
ইয়ারাবী তাড়াতাড়ি করে উঠে বসে গলার ওড়নাটা ঠিক করে বলে,
-“আ আসলে আমি পড়ছিলাম কিন্তু ঘুম কখন এলো বুঝতে পারিনি।আর বেডে..”
আবরার বিছানা থেকে উঠতে উঠতে বলে,
-“আমি এনেছি।ইউ্ নো,আমি এসে দেখি তুমি টেবিলে ঘুমিয়ে আছো।তাছাড়া কাল অনেক রাত পর্যন্ত পরেছিলে তাই আর ডিস্টার্ব করিনি।”
ইয়ারাবী আবরারের দিকে ভালো করে তাকিয়ে দেখে ওর একটা কালো ট্রাউজার আর ব্লাক কালারের গেন্জি পরে আছে।ইয়ারাবী বুঝতে পারছেনা এতো ঠান্ডার মধ্যে কীভাবে এমন পোশাক পরে আছে।যদিও রুমে হিটার অন করা আছে তাও ইয়ারাবীর প্রচুর ঠান্ডা লাগছে।ইয়ারাবী কিছুক্ষণ ওর দিকে তাকিয়ে থেকে বলে,
-“আচ্ছা,আপনার কী শীত লাগছেনা?”
-“রুমের টেম্পারেচার মিডিয়ামে আছে,তোমার হালকা জ্বর এসেছে তাই তোমার শীত লাগছে।”
ইয়ারাবী নিজের কপালে,মুখে হাত রেখে দেখে সত্যিই ওর জ্বর এসেছে।আজকাল রোগগুলো ওকে জেগে বসেছে,সুযোগ পেলেই হানা দেয়।আবরার সোফায় ল্যাপটপে অন করতে করতে বলে,
-“ফ্রেস হয়ে এসো, ভালো লাগবে।”
ইয়ারাবী কথাটা শুনে বেড থেকে নেমে সব গুছিয়ে রেখে ওর দিকে তাকিয়ে বলে,
-“আজ তাড়াতাড়ি যে ফিরলেন?না মানে আপনিতো রাত করে ফিরেন তাই আর কী?”
-“আজ বেশি কাজ ছিলোনা তাই,”
ইয়ারাবী ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়াতেই হঠাৎ ওর কিছু মনে পড়তেই ওর পাশে এসে দাঁড়িয়ে দু’হাত মুচড়া-মুচড়ি করে।আবরার ল্যাপটপ থেকে ওর দিকে তাকিয়ে বলে,
-“যেটা বলতে চাও বলে ফেলো।এত দ্বিধাদ্বন্দ্ব করার দরকার নেয়।”
-“ন্ না মানে আসলে দুপুরে আপনাকে ফোন করেছিলাম কিন্তু ফোন বন্ধ ছিলো।”
-“একটা সিরিয়াস পেসেন্ট দেখছিলাম,আর জানোই তো সাইক্রেটিসদের পেসেন্টরা কেমন হয়।কোনো দরকার ছিলো নাকী?ম্যাসেজ করে দিতে…”
-“আসলে একটা কথা বলার ছিলো…”
আবরার ওর হাত ধরে সোফায় বসিয়ে দিয়ে বলে,
-“এবার বলো কী কথা?”
-“আ আমার এক ফ্রেন্ডের আম্মু খুব অসুস্থ।কাল অপারেশন করাতে হবে হার্টের।এখন ওর পঞ্চাশ হাজার টাকায় শর্ট পরে যাচ্ছে,তাই ফোন করেছিল।এজন্য আপনাকে ফোন করেছিলাম যে টাকা দিবো কী দিবোনা?”
-“কোন হাসপাতাল?আর নাম কী তোমার ফ্রেন্ডের?”
-“গ্রীন লাইফ,আর ওর নাম উমীদ।যদি ভাইয়া থাকতো তাহলে সমস্যা হতোনা,কিন্তু উনিতো চ্ চিটাগাং গেছে।”
আবরার কিছু একটা ভেবে ওকে বলে,
-“হামম,ফোন করে বলো আমার এক লোক টাকাটা নিয়ে যাচ্ছে।”
-“আপনি টাকা দিবেন…”
আবরার ইয়ারাবীর চুলগুলো নাড়িয়ে বলে,
-“আমি জানি তুমি কাবিনের টাকা থেকে ওকে দিতে,যেহেতু আমি আছি তাই ওখান থেকে দিতে হবেনা।তাছাড়া আমার তোমার বলে কিছু নেই।আমার যা আছে সবটা তোমার বুঝেছো।এখন ওকে ফোন দাও…”
ইয়ারাবী তাড়াতাড়ি ফোনটা নিয়ে উমীদকে কল করে সবটা জানিয়ে দেয়।ঘন্টাখানিকের মধ্যে আবরার বিহানকে দিয়ে টাকা পৌঁছে দেয়।ইয়ারাবীর ভয় ছিলো যে ছেলে বন্ধুর কথা শুনলে ওর আবার কোনো রিয়্যাক্ট না করে।ও আর সাতপাঁচ না ভেবে ওয়াশরুম থেকে ফ্রেস হয়ে এসে আবরারের জন্য এক কাপ কফি নিয়ে আসে।আবরার কফিটা নিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে বলে,
-“তোমারটা কই?”
-“খেতে ইচ্ছা করতে না…”
-“জ্বর কী বেশি এসেছে?”
-“না ঠিক আছি”
-“তাহলে পড়তে বসো,আমি স্ট্যাডি রুমে আছি।ডিনার টাইমে ডাক দিও”
আবরার যেতেই আবার ফিরে এসে ওর সামনে দাঁড়িয়ে বলে,
-“আজ ভার্সিটিতে কিছু হয়েছিলো নাকী?”
-“ক্ কী হবে?”
আবরার হালকা হেসে কিছু না বলে রুম থেকে বের হয়ে যায়।ও চলে যেতেই ইয়ারাবী যেনো প্রাণ ফিরে পেলো।দেখতে দেখতে ডিনারের সময় হয়ে এলো।ইয়ারাবী রুম থেকে বেড়িয়ে আবরারকে ডাকতে ওর স্ট্যাডি রুমে যায়।যেহেতু দরজা খোলা ও নক না করেই রুমে ঢুকে পরলে আবরার ওকে দেখার সাথে সাথে কিছু পেপার তাড়াতাড়ি সরিয়ে ফেলে ওর দিকে তাকিয়ে কিছুটা রাগী কন্ঠে বলে,
-“তুমি,কিছু বলবে?”
-“স্ সরি,আমার নক করে আসা উচিত ছিলো।আম্মু ডিনারের জন্য ডাকছে।”
আবরার চোখেমুখে একটা ভয় কাজ করছিলো ইয়ারাবীকে দেখে।ও ওর স্ট্যাডি রুমে কাউকে ঢুকতে দেয়না।ও টেবিল থেকে পানির গ্লাস উঠিয়ে পান করে ইয়ারাবীর দিকে তাকিয়ে বলে,
-“ইটস্ ওকে,পরবর্তীতে খেয়াল রাখবে।চলো ডিনার করে আসি।”
ইয়ারাবীও আর বেশি মাথা ঘামায়না।হতে পারে আবরারের পার্সোনাল কিছু আছে,তাই এমন করে।ও কারোর একান্ত জিনিসে নিজের নাক না গলাতে বেশি পছন্দ করে।
রাতে ডিনার করে এসে এক সাথে এশার নামায আদায় করে,ইয়ারাবী বাকী পড়াগুলো কম্পিলিট করে এসে বিছানায় শুয়ে পরে।আবরার ওর পাশে বসে ল্যাপটপে কাজ করছে।ইয়ারাবী একবার ওর দিকে তাকিয়ে বলে,
-“একটা বাজতে চললো,আপনি ঘুমাবেন না।”
-“তুমি ঘুমিয়ে পরো আমার লেট হবে।আচ্ছা,আজ সব কমন পেয়েছিলে?”
-“মোটামুটি,মনে হয়না বাকী পরীক্ষাগুলো ভালো হবে।”
আবরার ওর কথা শুনে ল্যাপটপ থেকে চোখ সরিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে বলে,
-“একথা কেন বলছো?”
-“যা পড়ি সব ভুলে যায়,বুঝছিনা এমন কেন হচ্ছে?”
-“চিন্তা করবেনা,সব ঠিক হয়ে যাবে।এখন ঘুমিয়ে পরো,জ্বর এসেছে তো।”
আবরারের কথাটা শুনে ইয়ারাবী দিত্বীয় আর কোনো কথা না বলে ঘুমিয়ে পরে।ও নিজের কাছে নিজেকে খুব অদ্ভুত লাগে,বিগত চার বছর ধরে ও দু’চোখের পাতা শান্তিতে এক করতে পারিনি।কিন্তু বিয়ের পর কোনো ঘুমের ঔষধ ছাড়ায় ওকে ঘুম পেয়ে বসেছে।
জীবন নামক ঘড়িটা যে সময়ের সাথে জুড়ে আছে সেটা খুবই অদ্ভুত।কখন কীভাবে কেটে যায় কিছু বুঝা যায়না,দেখতে দেখতে পরীক্ষাগুলো শেষ হয়ে গেলো।এই এক্সামের মধ্যে আবরার ইয়ারাবী প্রচুর কেয়ার করেছে সাথে ওর পরিবারের মানুষগুলো।ইয়ারাবী ভেবে পায়না এমন শ্বশুড়বাড়ি কারো আদেও আছে যারা পরের বাড়ির মেয়েকে এতো ভালোবাসতে পারে।সব কিছু ঠিক ঠাক চলছিলো,বিয়ের চারমাস পেরিয়ে যায়।হঠাৎ একদিন,
#চলবে______