জীবন মানে তুমি পর্ব-২২

0
4370

#জীবন মানে তুমি
#লেখিকা:H.B.Rini (Irini Ori)
#পর্ব:২২

(৮০)

ইয়ারাবী হাত না দিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে আর তখনি আবরার ওর দিকে চোখ টিপ মেরে বাম হাতটা টান দেয়।ইয়ারাবীর আবরারের হাতের মুঠো থেকে হাত বের করার চেষ্টা করছে,কিন্তু কোনো লাভ হচ্ছেনা।

-“কোন লাভ হবেনা,শুধু নিজের শক্তি অপচয় করছো?”

-“দ্ দেখুন আবরার এটা দেওয়ারর কোনো প্রয়োজন নেই,আমি একদম ঠিক আছি।”

-“রেইলি,একটু আগে পেইনটা কার হচ্ছিলো?”

ইয়ারাবী তবুও শেষ চেষ্টা করতে থাকে।আবরার ওর দিকে মুচকি হেসে বলে,

-“লুক,আমার দিকে তাকাও।কিছু হবেনা।”

-“মরে গেলেও নিবো,আগেরটা পায়নি মানে এই নই যে এটাতে পাবোনা।”

-“তুমি বড্ডো জ্বালাতন করো।”

আবরার ও হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে ইনজেকশটা পুশ করেে দেয়।তবে আজ ও একটু বেশিই ব্যাথা পায়।ব্যাথায় একপর্যায়ে কান্না করে দেয়।আবরারের খুব খারাপ লাগে কিন্তু ওর কিছু করার নেই।কেননা ও ইয়ারাবীকে সুস্থ একটা জীবন দেওয়ার জন্য এমনটা করছে।আবরার ওর মুখে হাত দিতে গেলে ইয়ারাবী ধাক্কা দিয়ে বলে,

-“আমি আপনার সাথে কোনোদিন কথা বলবোনা।”

আবরার মুচকি হেসে বলে,

-“ঠিক আছে।”

-“আপনি খুব খারাপ,প্রথমদিন ব্যাথা দেননি আর আজ ব্যাথা দিলেন।”

আবরার সিরিন্জটা রেখে ওর দিকে তাকিয়ে বলে,

-“দেখো,একটা ইনজেকশন অনেকভাবে দেওয়া যায়।সেগুলো হলো পেশী,শিরা বা চামড়ার নিচে।মাঝে মাঝে নিডলের জন্যও ব্যাথা লাগে।তাই এখানে আমার কোনো দোষ নেই।”

-“আপনার কাছে ডাক্তারি শিখতে চাচ্ছিনা।”

-“কিন্তু ডাক্তার হওয়া তো তোমার স্বপ্ন ছিলো।”

ইয়ারাবীর কথাটা শোনার সাথে সাথে মুখটা কালো হয়ে যায়।ও কথাটা ঘুরানোর জন্য বলে,

-“অনেক রাত হয়েছে ঘুমাবেন না।”

কথাটা বলেই ও ব্লাঙ্কেটটা গায়ে টেনে নিয়ে শুয়ে পরে।আবরার ইয়ারাবীর দিকে কিছুটা ঝুঁকে বলে,

-“লিসেন্,ইয়ার ক্লিয়ার কথা বলাটা আমি খুব পছন্দ করি।তাই কথা ঘুরানোর ট্রাই করবেনা।”

-“আ আপনি এভাবে কাছে কেন আস্ আসছেন?”

আবরার ওর বামহাতটা দিয়ে ইয়ারাবীর সামনের চুলগুলো নিয়ে খেলা করতে করতে বলে,

-“কীভাবে আসছি?”

-“দ্ দেখুন আপনি বলেছিলেন আপনি ট্ টাইম দিবেন।”

-“আই ওয়ান্ট….”

আবরারের কথাটা শুনে ইয়ারাবী ভয় পেয়ে যায়।যদিও আবরারের পুরো অধিকার আছে তবুও ওকে সময় দিতে চেয়েছিলো।কিন্তু হঠাৎ করে আবরারের কী হলো?তবে কী ও এতোদিন নাটক করছিলো?কথাটাগুলো ভাবতেই ইয়ারাবীর গায়ে কাঁটা দেয়,প্রায় কেঁদে দেবো।এমন সময় আবরার ওর ভীতু চেহারা দেখে হেসে দিয়ে ওর নাকটা টিপে দিয়ে বলে,

-“রিল্যাক্স,আই সে্,আই ওয়ান্ট টু হেয়া দ্যা স্টোরি।”

ইয়ারাবী যেনো হাফ ছেড়ে বাঁচলো।মনে হচ্ছিলো এতোক্ষনে কেউ যেনো ওর বুকের উপর পাথর চাপা দিয়ে রেখেছিলো।ও নিজেকে সামলে বলে,

-“কোন স্টোরি?”

-“ওই যে গোল্ডেন চান্স পেয়েও নিজের স্বপ্ন পুরন করতে পারলেনা।”

-“ক্ কে বললো আপনাকে?এমন কিছুনা,আমার ঘুমপাচ্ছে।”

ইয়ারাবী কথাটা বলে উল্টোদিকে ঘুরতে গেলেই আবরার ওকে আটকে দিয়ে বলেন,

-“বারবার কেনো তোমাকে মনে করিয়ে দিতে হয় আই এম ইউর হাজবেন্ড,একজন গুড ফ্রেন্ডও।তোমার পাস্ট,প্রেজেন্ট, ফিউচার সবকিছু জানার রাইট আমার আছে। নাও টেলমি…”

আবরারের কথাশুনে ইয়ারাবী উঠে বসে।জানালার দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,

-“রাইট,ইউ আর মাই হাজবেন্ড…আর এটাও ঠিক বলেছেন আমার সবকিছু জানার অধিকার আপনার আছে।”

-“সরি,বুঝিনি যে তোমার এতো খারাপ লাগবে।”

-“একদিন না একদিন আপনি জানতেন।বাট্ আমি এটা জানিনা আপনাকে এসব কে বলেছে?”

আবরার হেসে বিছানায় হেলান দিয়ে বলে,

-“তোমার চোখ….তোমার এই চোখ আমাকে সব বলেছে।ইউ নো আমাদের সেকেন্ড মিটিং তোমার মনে আছে?সেদিন তোমার সম্পূর্ন মনোযোগ আমার এপ্রোনের উপর ছিলো এন্ড তোমার ওই চোখে ছিলো কোনো হারিয়ে যাওয়া স্বপ্নের আর্তনাদ।আর…”

-“কী বলবেন আমি জানি…জানেন পাঁচজন মানুষের কাছে আমি কথা লুকাতে পারতামনা।তারা আমার কিছু না বলার আগেই বুঝে ফেলে আমার না বলা কথা।সেই মানুষগুলো কারা জানেন?খালামনি,ভাইয়া,য়ুহার আপু,মনি,অনু আর তাদের সাথে আপনিও যুক্ত হলেন।”

-“তোমার না বলা কথাগুলো তুমি তোমার চোখের ভাষায় বলো,যা সহজে কেউ বুঝতে পারেনা।”

-“কেউ বোঝায় চেষ্টা করেনা তাই। যখন একটা ঘুড়ি উড়াতে গিয়ে যদি বারবার আপনার সুঁতা ছিড়ে যায় তাহলে কী করবেন আপনি?”

-“চেষ্টা করবো যতক্ষণ পর্যন্ত না হয়।”

-“যদি সেই চেষ্টা প্রতিবার আপনি না করতে পারেন,তাহলে একটা সময় মনে হবে সেই ছিড়া সুঁতায় আপনার ভাগ্য।আমারও ঠিক তাই।”

-“ইয়ারাবী,মেডিসিন দেওয়া হয়েছে।বসে থাকলে খারাপ লাগবে শুয়ে কথা বলো।”

-“না আমি ঠিক আছি, অসুস্থতা নিয়ে কত নির্ঘুম হাজারো রাত কাটিয়েছি।”

আবরার ইয়ারাবীর মাথায় হাত রেখে বলে,

-“রাতে চুল খুলে রাখো কেন?ঘুমের মধ্যে তোমার অসুবিধা হয়…”

-“বাঁধতে ইচ্ছা করেনা।”

-“এমন বললে হবেনা,এরপর থেকে বেঁধে ঘুমাবে।এখন বলো,চান্স থাকলেও পড়োনি কেন?”

-“আপনি জানেন ছোট থেকে আমার ইচ্ছা ছিলো,আমি আর্মিতে জব করবো।ক্লাস টেন পর্যন্ত ড্রিমটা থাকলেও আমার পরিবার এমনভাবে ডাক্তারের পেশাকে রোজ প্রেজেন্ট করতো যে না চাইতেও ডাক্তারের প্রতি একটা গভীর টান চলে এলো।নিজের মনের মধ্যে এক একটা সুঁতা দিয়ে স্বপ্ন সাজিয়ে ছিলাম।দিন-রাত এক করে পড়াশোনা করতাম।তৃষার্ত কাকের মতো নিজে স্বপ্ন পূরনের পিছু ছুটতাম।কিন্তু বাঁধ সাধলো এসএসসি এক্সামের ছয় মাস আগে।”

-“কী হয়েছিলো?”

-“যেটা মেয়েদের হয় “পিরিয়ড” বাট্ সেইবার কী হলো জানিনা…একভাবে চলতে থাকলো।টানা দু’মাস ধরে চললে আম্মুনিকে কথাটা বলি।কিন্তু সে কিছু মেডিসিন দেয় বাট্ এগুলো নিয়ে আরো সিক হয়ে পরি।আম্মুনি ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে চাইলে বড় খালা কোন একটা ডাক্তারের ঠিকানা দেয় কিন্তু তার মেডিসিন কাজে আসেনা।আম্মুনিকে কথা বললে সে বলে এগুলো নিতে।”

আবরার ওর হাতের ব্রাসলেটটা হাত দিয়ে নাড়তে নাড়তে বলে,

-“তোমার খালামনি জানতো বিকজ্ সে তোমাকে মেয়ের মতো কেয়ার করে?”

-“খালামনি কোনো একটা সেমিনারে ইন্ডিয়া গিয়েছিলো।তাছাড়া আম্মুনির কড়া নিষেধ ছিলো খালামনি যেনো না জানে।তবে টেনে উঠার পর ইমু ভাইয়ার কাছে ইংরেজি পড়তাম।ভাইয়া রোজ জিজ্ঞেস করতো কী হয়েছে বাট্ আমি কথাটা কাটিয়ে দিতাম।এটা কোনো লজ্জার ব্যাপার না কিন্তু তারপরও বলতে পারতাম না।তবে একদিন সহ্য করতে না পেরে ভাইয়াকে সব বলে দিলাম।তার একদিন আগে খালামনি ব্যাক করেছিলো।ভাইয়াকে বললে খালামনি কথাটা জেনে যায়।এসে সবাইকে বকাবকি করে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায়।আর তখন ইফাজ ভাইয়াও ডাক্তার ছিলো তাই বেশি প্রবলেম হয়না।কিছু মেডিসিন দিয়েছিলো আর রক্তশূন্যতার জন্য চার ব্যাগ ব্লাড নিতে হয়েছিলো।পরীক্ষা পর্যন্ত খালামনি আমাদের বাসাতেই ছিলো।সেবার মাত্র আর পাঁচের জন্য প্লাস পেয়েছিলাম না।তবে আব্বু কিছু না বললেও আম্মুনি বকেছিলো আর..”

ইয়ারাবী এতটুকু বলে থেমে যায়।আবরার ওর বামহাতটা নিজের মুঠো রেখেই ওর দিকে তাকিয়ে বলে,

-“আর..কী বলতে চেয়েছিলে?আচ্ছা না বলতে চাইলে জোর করবোনা তবে এর পরের কাহিনি বলো।”

ইয়ারাবী ওর দিকে তাকিয়ে বলে,

-“একটু পানি দিবেন..”

আবরার ওকে এক গ্লাস পানি দিলে ওর অর্ধেক পানি খেয়ে আবার বলে,

-“কলেজে সাইন্সে ভর্তি হলাম,সারাদিন পড়ার মধ্যে থাকতাম।আদার এক্টিভিটি থেকে কিছুটা দূরে সরে আসলেও মাঝে মাঝে করতাম।তবে জুন থেকে প্রবলেম ক্রিয়েট হতে থাকে।আমার কোনো বেস্ট ফ্রেন্ড ছিলোনা,আর যারা ছিলো শুধু নিজের স্বার্থের জন্য।কাজ হয়ে গেলে টিস্যুর মতো ছুড়ে দিতো।তবে আস্তে আস্তে সবকিছু বোরিং হতে শুরু করে।নিজের কাছেই নিজেকে হেয়ো মনে হয়,কারো কাছে আমার কোনো মূল্য ছিলোনা।রাতে ভয় পেতে থাকি,একটা সময় ইনসমনিয়া হয়ে যায়।বার বার মনে হতো কেউ আমাকে অবজারভ করে,রাতে একা থাকলে কারো অসস্ত্বি টের পেতাম।আম্মুনি-আব্বুকে বললে তারা হেসে উড়িয়ে দিতো।পড়াশোনাতে মন বসতো না,প্রথম এক্সামে একটা সাবজেক্টে ফেল করেছিলাম…ভয়ে কথাটা বাসায় বলতে পারিনি।সেকেন্ড এক্সাম রিজাল্ট খারাপ হয়,যেহেতু সেকেন্ড ইয়ারে উঠতে হবে তাই আব্বু সাথে এসেছিলো।”

-“বকেছিলো?”

ইয়ারাবী কান্না করে দিয়ে বলে,

-“মেরেছিলো…”

আবরার অবাক হয়ে তাকাই ওর দিকে।এবার বুঝতে পারে য়ুহার আর ইরাকদের কথার মানে।ইয়ারাবী চোখের পানি মুছে বলে,

-“আমার ফ্যামিলি শুধু ভালো মার্কস্ আর রেজাল্টের উপর ডিপেন্ড করে বাট্ আমার বোনের ক্ষেত্রে সেটা একদমই উল্টো।ওর ক্ষেত্রে মেধা আর ট্যালেন্ট বিবেচনা করে,কত হলো সেটা ওর সময় কোনো মেটার করেনা।যাইহোক,বোর্ড এক্সামের আগে আরো অনেক কিছু হয়..সেগুলো আর নাই বা বল্লাম।তবে বোর্ড এক্সামের ঠিক এক সপ্তাহ আগে আমার এক কোচিং ফ্রেন্ড সমুদ্র কিছু নোটের জন্য ফোন করে।ও ছেলেটাই এমন যে ওর সাথে কথা বলে না হেসে থাকতে পারা যেতো না।সেদিন বড় আর সেজো খালা আমাদের বাসায় এসেছিলো।সমুদ্রের সাথে হেসে কথা বলছিলাম মেজো খালা আসল ব্যাপারটা না যেনো আম্মুনিকে বলে আমি বয়ফ্রেন্ডের সাথে কথা বলছি সাথে তো আরো অনেক কিছু।”

আবরার অবাক চোখে ওর দিকে তাকিয়ে বলে,

-“তুমি কিছু বলোনি?”

ইয়ারাবী হেসে ওর দিকে তাকিয়ে বলে,

-“আপনি একদিন জিজ্ঞেস করেছিলেন,আমার ফোনে পাস নেই কেনো?”

-“হ্যাঁ,করেছিলাম বাট্ এর সাথে সম্পর্ক কী?”

ইয়ারাবী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,

-“আমার লাইফ বলতে আমার কিছু নেই,আমার মায়ের ধারনা আমি কাঠপুতুল…যেভাবে চাবি দিবে সেভাবে কাজ করতে হবে।”

-“মানে?”

-“ওইদিন আমি ফোনটা কাটতে কেউ আমার গালে খুব জোরে একটা চড় মারে।সামনে তাকিয়ে দেখি আম্মুনি।

খুব রেগে আছে দেখলেই বুঝা যাচ্ছে।পিছনে তার দুই বোনও দাড়িয়ে আছে।মিসেস জামান আপেল খেতে খেতে বলেন,

-“আরে এক চড়ে কাজ হবেনা,আরো দু’টা চড় দে।”

ইয়ারাবী ওর মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে,

-“আম্মুনি কী হয়েছে?”

মিসেস ইশানি চুলের মুঠি ধরে বলে,

-“লজ্জা করেনা কথাটা বলতে,বেহায়া মেয়ে।তোকে এতো মারি তারপরও লজ্জা হয়না।”

-“চুল ছাড়ো,কী করেছি আমি?”

-“এখন বুঝতে পারছি তোর ফোনে কেনো সিকিউরিটি দিয়ে রাখিস।আরে না রাখলেতো নাগরের সাথে প্রেম করতে পারবিনা,ধরা পরে যাবি।”

-“কী বলছো, কীসের প্রেম?সবার একটা প্রাইভেসি থাকে…”

ইয়ারাবী কথাটা বলার সাথে সাথে ওর মা ওকে ধাক্কা দিয়ে পেটে একটা লাথি মেরে বলে,

-“এতটুকু মেয়ের কীসের ফ্রিডম কীসের প্রাইভেসি?কিছু বুঝিনা মনে করেছিস অপয়া মেরে।তোকে এতো মারি,এত কথা বলি তোর গায়ে লাগেনা।আরে মরতে তো পারিস,তুই মরলে শান্তি পাই।”

-“আমি মরলে তোমরা শান্তি পাও।”

-“হ্যাঁ,পাই।বল কার সাথে প্রেম করছিলি।”

ইয়ারাবীর টেবিলের উপর একটা স্টিলের স্কেল ছিলো।মিসেস ইশানি ওটা হাতে নিয়ে ওকে মারতে মারতে বলে,

-“বল কার সাথে প্রেম করছিলি?”

-“আহ্ কে বললো তোমার?”

-“তোর সেজো খালা সব শুনেছে?”

-“আহ্ আহ্ আম্মুনি লাগছে…”

-“বল কে ছিলো?”

-“স্ সমুদ্র,নোটের জন্য ফোন দিয়েছিলো।খালার কোথাও ভুল হয়েছে?”

মিসেস রায়ীনা বাঘের মতো গর্জন করে বলে,

-“হারামজাদি মেয়ে,আমাকে তোর মা ভেবেছিস।কেউ বন্ধুদের সাথে ওভাবে হেসে কথা বলেনা।আমাকে শেখাতে আসবিনা,আমার চোখ খুব অভিজ্ঞ।আমারও তো মেয়ে আছে,কই সে তোর মতো বেশ্যাপনা করেনা।”

-“খালা মুখ সামলে কথা বলবেন,অনেক সহ্য করেছি আর না।”

-“দেখেছিস ইশা তোর মেয়ে যদি এসব না করে তাহলে এতো তেজ দেখাবে ক্যান।মিথ্যাবাদীরা নিজেদের ভালো সাজানোর জন্য এমনি করে।”

মিসেস ইশানি এমনি রেগে ছিলেন তার উপর নিজের বোনের কথা শুনে আরো রেগে যেয়ে মেয়েকে প্রচন্ড পরিমানে মারধোর করেন।সাথে ফোনটাও ভেঙে দিয়ে দরজা বন্ধ করে চলে যান।ইয়ারাবী শরীরের বিভিন্ন জায়গা কেটে গেছে।পরিবারের কাছে অবহেলা পায়,কিন্তু মিসেস রায়ীনার কথাটা ওর প্রচন্ড পরিমানে গায়ে লাগে।

ঘন্টা খানিকের মধ্যে মি.ফুয়াদ অফিস থেকে আসলে মিসেস ইশানি কিছু বলার আগেই ওনার বোনেরা কানে বিভিন্ন কথা বলে।যার জন্য রেগে যেয়ে মি.ফুয়াদও মেয়েকে হাতের কাছে যা পায় সেটা দিয়ে মারতে থাকে।অবস্থা খারাপ দেখে মিসেস ইশানি স্বামীকে আটকে দিয়ে বাইরে নিয়ে আসেন।মিসেস জামান এটা দেখে বলতে থাকে,

-“আরে ফুয়াদকে আটকালি কেনো,ওমন মেয়েকে মেরে ফেলায় ঠিক।তুই তো কিছুই বললিনা আর ওর বাপকেও আটকালি।”

ইয়ারাবীর কপালসহ শরীরের বিভিন্ন জায়গা থেকে রক্ত পরছে। ওদের কথা শুনে আস্তে করে ফ্লোর থেকে উঠে দরজায় কাছে যেয়ে বলে,

-“নামমাত্র প্রমাণে সত্য নির্ণয় নির্বোধের কাজ।আর তোমরা সেটাই করলে।বাট্ ডোন্ট ওরি,এটা নিয়ে না কোনো অভিযোগ করবো আর না ভবিষ্যতে তোমাদের বিরক্তির কারন হবো।”

কথাটা বলে রুমের দরজা বন্ধ করে দিয়ে ড্রয়ার থেকে একটা ছুরি বের করে হাতের উপর তিনটা টান দেয়।ইয়ারাবী আত্মহত্যা করার কোনো পক্ষপাতী নয়,কিন্তু আজকের কথাগুলো শোনার পর ওর বাঁচার ইচ্ছা একেবারে মারা গেছে।

ডিনারের সময় সবাই খেতে বসলেও মিসেস ইশানির গলা দিয়ে কোনো খাবার নামছেনা।ওনার মনে বারবার কু ডাকছে।ইয়ারাবীর কথাগুলো মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে।এর মধ্যে ইয়ামিলা ছাদ থেকে দৌঁড়ে এসে বলে,

-“আম্মু আপু কোনো কথা বলছেনা,বাম হাত থেকে খুব রক্ত পরছে।”

-“তুই কোথার থেকে দেখলি?”

-“আমি রেবিকে নিয়ে ছাদে ছিলাম কিন্তু এ আপুর ঘরের সিড়ির দিকে বারবার যাচ্ছিলো,তাই আমি ওকে আপুর রুমে নিয়ে যেয়ে দেখি…”

মি.ফুয়াদ ইয়ামিলাকে কিছু বলতে না দিয়ে ছাদের দিয়ে ওর রুমে যেয়ে দেখে ও বেহুশ হয়ে আছে।কিছু সময়ের জন্য ওনাদের মাথা কাজ করা বন্ধ করে দেয়।সাদা গেন্জিটা পুরো রক্তে ভিজে গেছে।তবে ওর খালার একদিক থেকে ওর জন্য না হলেও নিজের জন্য ভয় পাচ্ছে।”

ইয়ারাবী কাঁদতে কাঁদতে কথাগুলো বলে।আবরার ইয়ারাবীর চোখ মুছে দিয়ে বলে,

-“থাক কিছু বলতে হবেনা আজ,ঘুমিয়ে পরো নয়তো মাথা ব্যাথা করবে।”

-“না,আজ যদি না বলতে পারি তাহলে পরেও বলতে পারবোনা।”

-“ঠিক আছে বলো”

-“ভেবেছিলাম মারা যাবো,কেননা পরিস্থিতি এমন ছিলো,নিঃশ্বাস বন্ধে হয়ে এসেছিলো,কাটা জায়গাটা অসম্ভব যন্ত্রনা করছিলো,চোখে সবকিছু ঝাপসা হয়ে গেছিলো।কিন্তু কথায় আছে না,রাখে আল্লাহ মারে কে?

“আল্লাহর অনুমতি ছাড়া কারো মৃত্যু হবেনা।কেননা মৃত্যুর মেয়াদ অবধারিত।(সূরা আল-ইমরান:১৪৫)”

যখন আমার জ্ঞান ফেরে আমি হাসপাতালে নিজেকে পেয়েছিলাম।সারা শরীর পুরো ব্যাথা হয়ে ছিলো।উঠে বসার চেষ্টা করছিলাম তখন কেউ আমাকে চড় মারে।প্রথমে ভেবেছিলাম আম্মুনি কিন্তু পরে দেখি খালামনি।আর তারপাশে ইফাজ ভাইয়া রক্তচক্ষু নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।পুরো একদিন পরে আমার জ্ঞান ফিরেছিলো।তখন থেকে পরিবারের সাথে তেমন একটা কথা হয়না।পরীক্ষাগুলো খালামনির বাসায় থেকে দিয়েছিলাম।ওইদিনের ঘটনার খালামনিরা কেউ ঠিকভাবে কথা না বললেও কড়া শাসনে রাখতো।এই এক্সামের রেজাল্ট খারাপ হয়।মেডিকেলে এপ্লাই করতে পারছিলাম না।তাই রাশিয়ায় এপ্লাই করেছিলাম তার সাথে অক্সফোর্ড আর হার্ভার্ডেও।আশ্চর্য হলেও দু’টাতে টিকে গিয়েছিলাম।খালু আমার সব কাগজ,ভিসা কম্পিলিট করে দিয়েছিলো তবে আমার বাকী খালারা আম্মুনির কান ভারী করে দেয়।যার জন্য শেষ পর্যন্তু দু’টার একটাতেও যেতে পারিনা।”

-“কী বলেছিলো ওনারা?”

-“আমি বাইরে গেলে খারাপ হয়ে যাবো সাথে আরো অনেক কিছু।সেইগুলো আর নাই বা বললাম।শেষ পর্যন্ত আমার বিদেশে যাওয়ার ডকুমেন্টগুলো ছিড়ে ফেলে।রাগ করে ওইদিন বাসা থেকে বের হয়ে খালামনির বাসাতে থাকতাম।যেদিন আপনারা দেখতে এসেছিলেন তার আগের দিন খালামনির সাথে বাসায় গিয়েছিলাম।”

আবরার বিয়ের আগে মাঝে তিন-চারবার ইফাজের বাসায় গিয়েছিলো।তবে যেয়ে প্রথম দিন কোনো মেয়ের কথার আওয়াজ পেয়েছিলো,আর তার পরের বার ইয়ারাবীকে দেখলেও ইয়ারাবী আবরারকে খেয়াল করেনি।আবরার ওদিকে তাকিয়ে বলে,

-“অনেক রাত হয়ে গেলে,এখন ঘুমাতে হবে।”

ইয়ারাবীর ওর কথা শুনে শুয়ে পরলে আবরার শেডো লাইট জ্বালিয়ে ওর পাশে শুয়ে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকে।ইয়ারাবী ওর দিকে তাকিয়ে বলে,

-“আপনার কখনো বোরিং লাগেনা?সব সময় একটা বাচ্চার মতো আমাকে কেয়ার করেন।বিয়ের পর থেকেই আমি সিক হয়ে আছি,আর আপনি একটা রোবটের মতো সব সহ্য করছেন।স্বামীর হকটাও আদায় করতে পারেননি।”

-“আজকাল বড্ডো বেশি বুঝছো দেখছি।আর কেয়ারের কথা,জানো যখন কোনো নারী স্ত্রী হয় তখন তার স্বামীর কাছে সে আমানত।আর হক কে বললো আদায় করছিনা,আমারটা আমি ঠিকই আদায় করছি পিচ্চি বৌ..”

-“আমি মোটেও পিচ্চি না।”

-“জানো তোমার আমার এজ ডিফারেন্স কতো?”

-“হ্যাঁ,জানিতো সাত বছরের…”

-“অারে বাহ্ এটাও জানো দেখছি,এখন আর কোনো কথা নয়।শুভ রাত্রি…”

ইয়ারাবী ঘন্টাখানিকের মধ্যে ঘুমিয়ে পরে।তবে আবরারের চোখে ঘুম নেই।ও মনে মনে একটা হিসাব কষতে থাকে,তবে সেই হিসাবের উত্তরটা এখনো মিলাতে পারেনি।আজ আর ঘুম আসবেনা এই জন্য ও ইয়ারাবীর পাশ থেকে আস্তে করে উঠে তাহাজ্জতের নামায পড়ার সিদ্ধান্ত নেই।

(৮১)

“মনটা দিলাম মনের আশায় তুইতো বুঝলিনা
চইলা গেলি আমার ছাইড়া মানতে পারিনা
জীবন খাতায় তোর নামটা লিখলাম পুরোটাই
তোর মনে তো অন্যের নাম আমার নাম কোথায়||

নাইরে নাইরে নাই…ভালোবাসা নাই
নিষ্ঠুর এই পৃথিবীতে ভালোবাসা নাই||”

-“কাকে আবার মন দিলে জারিকা?”

জারিকা সকালে ঘুম থেকে উঠে ফোনটা হাতে দিয়ে একমনে স্ক্রীনের দিকে তাকিয়ে গান গায়ছিলো।হঠাৎ সমীরের আওয়াজ শুনে চমকে উঠে নিজেকে সামলে বলে,

-“কাকে আবার দিবো তুমি ছাড়া?সব কিছুতো সেই কবেই তোমাকে দিয়েছি।”

-“জানো মাঝে মাঝে খুব ইচ্ছা করে তোমার কথাগুলো বিশ্বাস করি কিন্তু করতে পারিনা।আর কেন পারিনা তা তুমি ভালো করেই জানো।নীরা কোথায়?”

-“ওর দাদুর কাছে গেলো।”

-“হাসালে তুমি জারিকা,বাবা যদি নীরার দাদু হয় তাহলে উনি তোমারও বাবা।কিন্তু কখনো আমি দেখিনি তুমি ওনাদের সাথে ভালো করে কথা বলেছো।”

জারিকা কথাটা শুনে তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠে বলে,

-“দেখো আমি আগেই বলেছি সমীর আমি সিপারেট হতে চাই।তোমার বাবা-মার দেখা শুনার জন্য আরো অনেকে আছে।মা বলেছিলো ধানমন্ডির ওইদিকে একটা ফ্লাট খুব সস্তায় আছে,তুমি দেখছোনা কেন?আমাদের সংসারটা ঠিক করে সাজাতে পারবো।”

-“যাতে তোমরা মা মেয়ে আরো চুনকালি মাখাতে পারো।আল্লাহকে ভয় করো জারিকা,তোমার একটা মেয়েও আছে…ভবিষ্যতের জন্য ভাবো।ক্ষণিকের মোহ-মায়ায় পরে নিজেকে শেষ করে দিওনা।হয়তো এমন একটা সময় আসবে যখন বাঁচার রাস্তাটাই হারিয়ে ফেলবে,কেননা দু’নৌকায় পা দিয়ে চলতে গেলে মাঝ সমুদ্রে ডুবে যেতে হয়।সংসারে শান্তি তখনি আসবে যখন তুমি তোমার মায়ের পরামর্শ নেওয়া বন্ধ করবে।”

সমীর কথা বলে রুম থেকে বের হয়ে যায়।জারিকা কিছুক্ষণ সমীরের দিকে তাকিয়ে থেকে আবার ফোনে মনোযোগ দেয়।জারিকা এমন এক মেয়ে যার উপর কোনো কিছুর প্রভাব পরে না।ও নিজের মনের স্বাদ মিটানোর জন্য হালাল-হারাম বিবেচনা না করে নিজের পিপাসা মেটায়।কিন্তু এই একটু একটু করে ও একদিন এমন এক মায়াজালে আটকে যাবে যার থেকে উদ্ধার কেউ করতে পারবেনা…কিন্তু ওকে বোঝাবে কে।

জারিকা ফোনের দিকে তাকিয়ে থেকে হঠাৎ করে ওর মুখে হাসি ফুটে উঠে।কেননা ও হুয়াটস্অ্যাপে কারো সাথে কথা বলার জন্য এতোক্ষণ ধরে প্রয়াস করছিলো,আর মনে হচ্ছে তার প্রয়াস সফলও হয়েছে।ও কোনো আননোন পার্সনকে হাই পাঠায়। কিন্তু ওপাশ থেকে কোনো জবাব আসেনা।ও ম্যাসেজ দিতেই থাকে।হঠাৎ সেই আননোন পার্সন বিরক্ত হয়ে রিপ্লাই করে,

-“হু আর ইউ?”

জারিকা মুখে হাসি এনে লেখে,

-“এত তাড়াতাড়ি ভুলে গেলে,গেজ করো কে আমি?”

-“দেখুন সকাল সকাল মুড খারাপ করবেন না।”

-“আরে ডাক্তার বাবু এতো রেগে গেলে হয়,বুঝিনা ইয়ারাবী কীভাবে আপনার সাথে সংসার করে।বিয়ে করেছো তো বাচ্চা মেয়েকে।”

আননোন পার্সনটা এমন কথা শুনে কথা শুনে কিছুটা অবাক হয়।কেননা অজানা লোকটা আর কেউ নয় আবরার।রোজ সকালে জগিং এ গেলেও আজ যাওয়ার কোনো মন ছিলোনা,তাই ছয়টায় দিকে ছাদে কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করে এসে বেডে আধশোয়া হয়ে অনলাইনে ঢোকে।আবরার এমন ম্যাসেজ পেয়ে পাশে ইয়ারাবীর দিকে তাকিয়ে দেখে ওকে কোলবালিশের মতো জাপটে ধরে শুয়ে আছে,ঘুমের মধ্যে ও গড়াতে গড়াতে আবরারের কাছে চলে আসে।তবে ও উঠার আগে আবরার ওকে ঠিক করে শুয়ে দেয়।আবরার ওর মাথায় হাত বলিয়ে দিয়ে ম্যাসেজ দিয়ে বলে,

-“আমার স্ত্রী কী করে সেটা তোমার না ভাবলে ভালো হবে জারিকা।কেননা ওর জন্য আমি আছি,আর আমার রাগকে টোলারেট করার ক্ষমতা তোমার বোনের আছে।”

জারিকা খানিকটা চমকে যায় ম্যাসেজটা পেয়ে।কেননা এই নাম্বারটা জারিকার একদম নতুন এমন কী সমীরও এটার ব্যাপারে কিছু জানেনা।ওর কাছে সত্যিই আবরারকে রহস্যময় পার্সন মনে হয়।ও নিজেকে সামলে বলে,

-“তুমি কীভাবে বুঝলে এটা আমি?”

-“এসব ছেড়ে এটা বলো,তুমি আমাকে ডিস্টার্ব করছো কেনো?”

-“একটু কথা বলতে ইচ্ছা করলো তাই।একটু ভিডিও কলে এসে কথা বলবে,প্লীজ।”

-“সম্ভব না,ইয়ারাবী ঘুমাচ্ছে।”

-“ওর কাছে থেকে সরে এসে কথা বলো।”

-“ইম্পসিবল,উঠে গেলো ওর ঘুম ভেঙে যাবে।”

-“তার মনে তোমাদের মধ্যে সব কিছু হয়ে গেছে।ইউ ইজ্ দিস পসিবল?”

-“হুয়াই নট?”

-“না মানে ওতো পুরো বাচ্চা আর এত তাড়াতাড়ি কিছু করবে বলে মনে হয়না।”

-“আসলে যাদের মন নোংরা তারা কোনোদিন পজিটিভ কিছু ভাবতে পারেনা।”

-“রেগে যাচ্ছো কেনো?আই জাস্ট কিডিং।”

-“ফারদার এমন কিডিং আমার সাথে করলে ভালো হবেনা।”

-“আবরার প্লীজ একটু ভালো করে কথা বললে কী হয়?আমি তোমাকে দেখেই বুঝেছি তুমি প্লে-বয়।সো আমার সাথে এমন করতে এসোনা।”

-“আই লাইক ইউ এটিটিউড।”

-“আমি জানতাম তুমি এভয়েড করবেনা আমাকে।”

-“কিছু কাজ আছে রাখি।”

আবরার অনলাইন থেকে বেরিয়ে হাসতে থাকে।এদিকে জারিকা তো খুশিতে গদগদ হয়ে আছে।ওর জালে আবরার পা দিয়েছে সেটা ভেবেই ও স্বপ্নের পৃথিবীতে হেঁটে বেড়াচ্ছে।তবে কার ভাগ্যে কী আছে সেটা কেউ জানেনা,সঠিক সময় এলেই বুঝা যায়।

(৮২)

ভোরের হালকা কুয়াশার চাদরে পরিবেশটা পুরোপুরি মুড়িয়ে আছে।অন্যদিনের মাত্রায় আজ শীতটা অনেকটা জেকে বসেছে নিজের রুপে।টুপটুপ করে শিশির পরছে ঘাসের উপর।তবুও বাড়ির লোকেরা উঠে পরেছে।সার্ভেন্টদের সাথে হাতে হাত রেখে সমান তালে ব্রেকফাস্ট বানাচ্ছে।ইয়ারাবী ফ্রেস হয়ে গ্রে কালারের একটা গাউন পরে তার উপর জিন্সের জ্যাকেট পরে মাথায় ওড়না দিয়ে দিয়ে নিচে নেমে কিচেনে চলে যায়।ইকরা ওকে দেখে বলে,

-“এত সকালে কেন উঠেছো?অসুস্থ তুমি নিজের খেয়াল তো রাখবে।”

-“তেমন কিছুনা আপু,আমার মতে তো একটু বেশি ঘুমিয়েছি…আচ্ছা আম্মু কোথায়?”

-“এখানে ছিলো কিছুক্ষণ আগে বাবা ডাকেছে আবার।”

-“ওহ্,আপু বলছিলাম আজকের চা-কফিটা আমি করি…”

-“বোন দেখ তোর চুলার কাছে আসতে দেওয়া নিষেধ আছে।প্লীজ এসব আমার কাছে বলিস না।”

ইয়ারাবী ইকরার কথা শুনে খানিকটা হকচকিয়ে যায়।ও অবাক দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে বলে,

-“কেনো আপু?আমি রান্না করতে পারিনা ঠিকই কিন্তু চা-কফি এসব বানাতে পারি।”

-“আরে পাগলি,আর এক সপ্তাহ আছে এক্সামের।তাছাড়া আমরা জানি তুমি আগুন জ্বালাতে ভয় পাও,তাই বলেছি।তার থেকে তুমি সার্ভেন্টদের সাথে এগুলো হাতে হাতে রাখো টেবিলে।”

-“আচ্ছা…”

ইয়ারাবী নাস্তার প্লেটগুলো টেবিলে রাখতে রাখতে সবাই চলে আসে।আবরারের পরিবারের লোকেরা ব্রেকফাস্টে বয়েল ফুড খাই।যা ইয়ারাবীর একদম পছন্দ নয়,বলতে গেলে এক প্রকারের শত্রু এগুলো।ও শুধু নাড়াচাড়া করছে,আবরার ওর দিকে এক নজর তাকিয়ে বলে,

-“নাড়াচাড়া না করে খেতে শুরু করো,তাছাড়া আজ থেকে এসব খেতে হবে।”

-“খ্ খাচ্ছিতো।”

মিসেস রায়হান আবরারের দিকে তাকিয়ে বলে

-“বকছিস কেনো ওকে,মা তুই যা খাবি আমাকে বল।এগুলো খেতে হবেনা।”

-“না আম্মু দেখেছো ওর হেল্থের অবস্থা, খাওয়া-দাওয়া কিছু করেনা।তাই এখন থেকে এসব খেতে হবে।”

-“তুই বেশি বেশি করিস সব সময়।ডাক্তার হয়েছিস নিজের হাসপাতালে,বাড়িতে করবিনা।”

জারবা হাই তুলতুলতে বলে,

-“সেটা বুঝাও তোমার এই দুই ছেলেকে।এদের জন্য তো আমি আর মেঘ ভাইয়া একটুও শান্তিতে থাকতে পারিনা।”

মি.রায়হান মেঘের দিকে তাকিয়ে দেখে মেঘ অনেকটা চুপচাপ হয়ে বসে আছে।মেঘের দিকে তাকিয়ে বলে,

-“কী হয়েছে আব্বু, এতো চুপ করে আছিস কেনো?”

-“কিছুনা বড় আব্বু।”

-“মন খারাপ করিস না,ভাগ্যে যা লেখা থাকে তাই হয়।জানি আমরা কোনোদিন তোর বাবা-মার প্রকৃত ভালোবাসা দিতে পারিনি কিন্তু তাই বলে মন খারাপ করবি।”

মিসেস রায়হান মেঘের দিকে তাকিয়ে বলে,

-“মেঘ আব্বু দেখ,মানুষ সারা জীবন বেঁচে থাকেনা।যার যেভাবে যেখানে মৃত্যু লিখা থাকে সেভাবে হয়।তুই ও বুঝিস,তাই কান্না কাটি না করে ওনাদের জন্য দোয়া করবি।আর আজ আমাদের সাথে এতিম খানায় যাবি।”

-“আমি কাঁদছিনা বড় আম্মু।তাছাড়া তোমরা আমার জন্য যা করো সেটাই বা কম কীসে?”

-“এই না হলে আমার ভাই।”

আবীর মেঘের পিঠ চাপড়ে কথাটা বলে।মেঘ একদৃষ্টিতে সবার দিকে তাকায় আর ভাবে,কখনো নিজের পরিবারের কথা মনে হতে দেয়নি এরা।বাবা মায়ের মতো সব সময় ভালোবেসে গেছে।

মেঘ মি.রায়হানের ছোট ভাই মরহুম রবিনের ছেলে।মেঘের সাত বছর বয়সে ওনারা হাসবেন্ড-ওয়াইফ কিছু ডাকাতের হাতে খুন হয় কিন্তু ভাগ্যক্রমে মেঘ ওইদিন বেঁচে যায়।তখন থেকে মি. এন্ড মিসেস রায়হান ওকে নিজের ছেলের মতো বড় করে।আর পরিবারের সবাই ও ঠিক ততটাই ভালোবাসে।

(৮৩)

দেখতে দেখতে পরীক্ষার সময় চলে আসে,যেহেতু এটা ফার্স্ট টার্ম তারপরও ইয়ারাবীর চিন্তার শেষ নেই।কেননা এবার বিয়ে, অসুস্থতা এমনভাবে ঘিরে ধরেছিলো ঠিকভাবে সব কম্পিলিট করতে পারেনি। তবুও দিন-রাত এক করে পড়েছে।মাঝে মাঝে আবরারও খুব হেল্প করেছে পড়তে।

সকাল থেকে ইয়ারাবী বই নিয়ে রুমের চারিদিক দিয়ে হেঁটে বেড়াচ্ছে আর পড়ছে।আবরার রেডি হয়ে এসে দেখে এই অবস্থা।

-“আমি তোমাকে বইটা রেখে রিল্যাক্স হতে বললাম না,এমন করলে বিপি হাই হয়ে যাবে।”

-“যদি কমন না আসে,রিজাল্ট যদি ভালো না হয়?”

-“এটাতো ফার্স্ট টার্ম তাইনা,তুমি এতো হাইপার কেনো হচ্ছো বলতো।তোমার দেবরকে দেখো,একটু আগে মম ঠেলেঠেলে মহারাজকে ঘুম থেকে উঠালো।”

-“তো,মেঘ খুব ভালো স্টুডেন্ট।তাই ওর কোনো চিন্তা নেই।”

আবরার ইয়ারাবীর হাত থেকে বইটা নিয়ে টেবিলে রেখে ওকে বিছানায় বসিয়ে বলে,

-“দেখো এই এক্সামটা কোনো মেটার করেনা, তাহলে চিন্তা করছো কেন?”

-“বকবেন নাতো…”

আবরার বেশ বুঝতে পারছে ইয়ারাবী পরীক্ষা নিয়ে কোনো চিন্তা করছে না,চিন্তা করছে পরীক্ষা খারাপ হলে আবরারও ওকে বকবে তাই।আবরার হেসে বলে,

-“একদম না,তুমি রেডি হয়ে নাও…”

ইয়ারাবী নেবি-ব্লু কালারের বোরখা পরে নিয়ে,ফাইলে সবকিছু ঘুছিয়ে নিয়ে নিচে নেমে আসে।মেঘ হাই তুলতে তুলতে সিড়ি দিয়ে নামতে নামতে ইয়ারাবীর দিকে তাকিয়ে বলে,

-“ওই পেত্নী,এখন তো ভাবী হয়ে গেছিস।তাই পরীক্ষার সময় হেল্প করা তোর জন্য ফরজ হয়ে গেছে….”

-“তুই পড়িসনি মনে হচ্ছে…”

-“পড়ছি তো মনে হয়,তবে মনে নেই কিছু।”

মিসেস রায়হান দু’জনকে দোয়া করে দেন।তারপর ওরা তিনজনে বেরিয়ে যায় ভার্সিটিতে।পরীক্ষার হলে ঢুকার আগে আবরার দু’জনকে কিছু মূল্যবান উপদেশ দেয়,কিন্তু তার শতভাগ মেঘ এক কান দিয়ে ঢুকিয়ে আরেকটা দিয়ে বের করে।আশি পার্সেন্ট কমন এসেছে ইয়ারাবীর।পরীক্ষার পর হল থেকে অনু,মেঘের সাথে কথা বলতে বলতে বের হচ্ছে তখনি কারো সাথে ধাক্কা লাগে।আজ আর নেকাব বাঁধেনি ও, তাই স্বাভাবিকভাবে সবাই চিনতে পারছে ইয়ারাবীকে।ও ছেলেটাকে সরি বলতে গেলে হঠাৎ থেমে যায়।কেননা ছেলেটা আর কেউ নয় শাওন।শাওন ওর দিকে তাকিয়ে বলে,

-“আরে এদেখি ইয়ারাবী,কতদিন পরে এই চাঁদখানা মুখ দেখা হলো।”

-“আপনি এখানে?”

-“কাজে এসেছিলাম,তা এখানে তুমি।শুনলাম বিয়ে হয়েছে…তা হাসবেন্ড বুঝি পড়তে দিচ্ছে।”

-“না দিলে এখন তো দেখতে পেতেন না।”

শাওন কিছুটা হেসে বলে,

-“কিছু মনে করেনা,মনে হয় তোমার স্বামী বোকা ছাড়া আর কিছুই নই।তোমাকে পড়তে দিয়েছে ঠিকই বাট্ তুমি অন্য ছেলেদের সাথে কথা বলে বেড়াচ্ছো।এগুলো কিছুই বেচারা বুঝতে পারছেনা,অবশ্য তোমাকে দেখে বুঝা যায়না।”

মেঘ কথাটা শুনে শাওনকে মারতে গেলে ইয়ারাবী আটকে দেয়।তারপর ইয়ারাবী ওর দিকে তাকিয়ে বলে,

-“খুব ভালো লাগলো আপনার চিন্তা-ধারা দেখে।”

কথাটা বলে ও চলে আসতে গেলে শাওন ওর হাত টেনে ধরে বলে,

-“তোমার কয়জন লাগে বলবে একটু?না মানে স্বামী কে দিয়ে হয়নি আবার এই ছেলেকে নিয়ে, যদি প্রয়োজন হয় তাহলে কল করো।আসলে আমার একটু বুঝতে ভুল হয়েছিলো তুমি কেমন টাইপের মেয়ে।”

ইয়ারাবী কথাটা শুনার সাথে সাথে ওকে একটা চড় মেরে দেয়।আরো মারতে গেলে মেঘ ওকে আটকে দিয়ে বলে,

-“আমি থাকতে তুই কেনো কষ্ট করবি,ভাইয়ার আসতে লেট হবে।ততোক্ষণে যেয়ে ফুসকা খেয়ে আয় আর এটাকে আমি দেখছি।অনু এটাকে নিয়ে যা আর একে একটু আপ্যায়ন করি।”

অনু ইয়ারাবীকে টানতে টানতে নিয়ে দোকানে যেতেই ইয়ারাবী বলে,

-“তুই এমন কেন করলো?আমি ব্যাপারটা হ্যান্ডেল করতাম..”

-“মেঘ যা করছে করতে দে”

-“দেখ অনু আমি চাইনা কথাটা আবরারের কান পর্যন্ত যাক,মেঘ ভার্সিটিতে মারামারি করলে বাসার সবাই জেনে যাবে।”

-“চুপ করবি,নে ফুসকা খা আর চিল কর।”

-“তুই চিল করতে বলছিস আমার ভয়ে যান যায় যায় অবস্থা হচ্ছে।”

-“এই ছ্যামড়ি তোর বিয়ে করতে কে বলেছিলো রে?”

-“জানিসনা কে বললো?”

চোখ গরম করে অনুর দিকে তাকিয়ে কথাটা বলে।অনুও বুঝতে পেরে চুপ হয়ে যায়,কেননা এই বিয়েটার জন্য অনুও কম চাপ দেয়নি।এর মধ্যে মেঘ এসে ওদের প্লেট থেকে ফুসকা নিয়ে খেতে খেতে বলে,

-“ভাইয়া একটু বিজি,আমাদের চলে যেতে বললো।ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে আসবে।”

-“শাওন কোথায়?”

-“আজকের ফুসকা সেই হয়েছে মামা।”

-“মেঘ আমি কিছু প্রশ্ন করেছি?”

-“চিল করনা,ও বেঁচে আছে মারা যায়নি।”

-“তুই জানিস বাসায় জানলে কী হবে,আর তোর ভাইয়া…”

-“কেউ জানবেনা,আমার বাচ্চাগুলো সামলে নিয়েছে।”

-“দেখ উনি বলেছিলো যে…”

-“বললাম তো কিছু হবেনা,আমি আছিতো।এমনিতে যা বলেছে তাতে মারটা ওর খাওয়া উচিত।”

মেঘ কথাটা বলে খাওয়ায় মনোযোগ দিলো,অনুও নিজের মতো খেতে আছে কিন্তু ওর গলা দিয়ে খাবার নামছেনা।এক অজানা ভয় ওকে ঘিরে ধরেছে।মনে হচ্ছে দোষটা ওর,এক্সামের সময় একটু খারাপ লাগছিলো বলে নেকাবটা খুলেছিলো কিন্তু পরে আর মনে নেই।নেকাবটা বাঁধা থাকলে হয়তো এত কিছু হতোনা।আজ শীত একটু বেশি পড়লেও ওর বারবার ঘেমে যাচ্ছে।

#চলবে_______

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here