চড়ুইপাখির বন্ধুত্ব পর্ব ১

0
1215

– ‘চোখে কি পট্টি লাগিয়ে হাটছিলি? দেখে চলতে পারিস না?’

অর্পনের কথা কর্ণপাত হতেই শরিরে রাগ রিনরিনিয়ে উঠলো অর্ষার। রুম থেকে বের হওয়ার জন্য অগ্রসর হচ্ছিলো সে। কানে তার হেডফোন লাগানো। আপন মনে সামনে এগুচ্ছে এমন সময় অর্পনের সাথে ধাক্কা লাগে তার। হাত থেকে মোবাইল মেঝে পরে যায়। অর্ষা তড়িঘড়ি করে মোবাইল হাতে নিয়ে দেখে স্কিনে বেশ কয়েকটা লম্বা ফাটার দাগ। রাগ তার তিরতির করে বেড়ে গেলো। একে তো মোবাইল ভাঙ্গলো। তার উপর অর্পন নিজে ধাক্কা দিয়ে আবার সেই নিজে গলাবাজি করছে? মানা যায় না। প্রতিবাদ করতেই হবে। তাই দাতে দাত পিষে বলে উঠলো, ‘তুই চোখে দেখিস না হাতি? ইচ্ছে করে ধাক্কা দিলি কেন? আমার মোবাইল বেচারা তোর হাতি মার্কা শরিরের ধাক্কা নিতে না পেরে ভেঙ্গে গেছে।’

– ‘আমার ঠ্যাকা পরে নাই তো তোরে ধাক্কা দেবার। কানে তো লতা ঢুকাই রাখছোস। শোনা তো দূর দেখবি কেমনে? আসলে কি বলতো সুন্দর পোলা দেখছোস তো। কি ভাবছোস আমি বুঝি না?’

অর্পনের কথায় ঠোঁট উল্টে ব্যঙ্গ করে হাসলো অর্ষা। বললো, ‘এহেহে নিজেরে কি ভাবছ রে? সালমান খান? নাকি হৃতিক রোশন? তোর তো তাদের চামচা হওয়ার যোগ্যতাও নাই। তোরে ধাক্কা দিয়া নিজের শরির নোংরা করবো কেন? ইয়াহ্, যা সর। তোর শরিরে গন্ধ। ইয়াক!’

অর্পন দাঁতে দাঁত চিবিয়ে বললো ‘ফর কাইন্ড ইউর ইনফরমেশন, আমি আমার ভার্সিটির সব চেয়ে হ্যান্ডসাম বয়। ওকে?’

অর্ষা মুখ দিয়ে আফসোসের সুর তুলে বললো, ‘আফসোস হচ্ছে। তাদের রুচি নাই তাই তোরে হ্যান্ডসাম ভাবে। আর তুই? তুইও তাদের কথায় আকাশে বাতাসে উড়ে বেড়াছ। ভাই এক বস্তা সমবেদনা তোর জন্য।’

উচ্চস্বরে হেসে ফেললো অর্পন। এ হাসি তাচ্ছিল্যের হাসি। অর্পন হাসতে হাসতে প্রতিত্তুর করল, ‘তুই হ্যান্ডসামের কি বুঝোস? তোর রুচি আছে? রুচি মনে হয় উন্নত তোর? হেইডা তো তোর বয়ফ্রেন্ড কে দেখলেই বুঝা যায়। গা:ঞ্জাখুরী পোলার লগে রিলেশন করছোস।’

বয়ফ্রেন্ড নিয়ে কথা বলায় তেঁতে উঠলো অর্ষা। চেঁচিয়ে বললো, ‘মুখ সামলে কথা বল অর্পইন্নার বাচ্চা। একদম আমার বয়ফ্রেন্ড কে নিয়ে কথা বলবি না।’

অর্পন কন্ঠ ত্যাছড়া করে বলে উঠে, ‘জ্বলে? মিথ্যে বলেছি আমি? কি করবি তুই? কচু টাও করতে পারবি না। মগের মুল্লুক। ওই পোলা আস্তো একটা ছ্যাঁচড়া বুঝছোস। শালা বারোভাতারি। সময় থাকতে ব্রেকআপ কর নাইলে পরে চোখের পানি নাকের পানি এক করবি।’

– ‘দ্যাট’স নান অফ ইউর বিজনেস। হিংসে হচ্ছে তাই না? রিফাত বুয়েটিয়ান বলে?’

অবাক হয়ে তাকালো অর্পন। তীক্ষ্ণ চোখে অর্ষার দিকে তাকিয়ে বললো, ‘এই জন্য মানুষের উপকার করতে নেই। খাম্বার মতো সামনে দাঁড়াই আছোস কেন? যা সর সামনে থেকে।’

গটগট পায়ে বাসা থেকে বেড়িয়ে গেলো অর্পন। সে সম্পর্কে অর্ষার ফুফাতো ভাই। তারা কক্সবাজারে থাকে। অর্পন সেখানেই বড় হয়েছে। কুমিল্লা খুব বেশি আসা হয় না তার। বছরে এক বার আসলেও দুই তিন দিন থেকে চলে যায়। এবার লম্বা ছুটি নিয়ে এসেছে। আর অর্পন এখানে আসার পরের দিন থেকে দুজনের মাঝে ভাই বোন কম বরং সাপ নেউলের সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। অর্ষা রাগে দাঁত দাঁতে পিষে রুমের চলে আসলো। ধিরিম করে দরজা লাগিয়ে বিছানায় বসে মোবাইলটা দেখলো। ইশ বেচারা নতুন মোবাইল। ডিসপ্লে ভেঙ্গে গেছে। মন ক্ষুন্ন হলো তার। বিষন্ন মনে মোবাইল বিছানার এক পাশে রাখলো। এমন সময় বাহির থেকে চেঁচিয়ে উঠলো অর্ষার মা হাসনা হেনা।

– ‘তোর সাহস তো কম না। দরজা লাগালি কেন? এই তুই দরজা লাগিয়ে কি করছিস? দরজা এখুনি খোল বলছি।’

বিরক্তি মুখে দরজার দিকে তাকালো অর্ষা। বাঙালী মায়েদের এই এক স্বাভাব। দরজা লাগালে তাদের কি এমন ক্ষতি হয় অর্ষার বুঝে আসে না। তাছাড়া সে অনার্সে পরে। যথেষ্ট এডাল্ট সে। একটু তো প্রাইভেসি ডিজার্ভ করে নাকি? কিন্তু না! বাঙ্গালি মায়েরা কখনো দরজা লাগাতে দিবে না। আবারো দরজা ধাক্কালো হেনা। অর্ষা উঠে দরজা খুলে দিলো। হেনা কোমড়ে হাত রেখে অর্ষার মাথা থেকে পা পর্যন্ত ভালো করে দেখলো। চোখ ফিরিয়ে পুরো রুমে একবার চোখ বুলিয়ে অর্ষাকে তীক্ষ্ণ চোখে প্রশ্ন করলো, ‘কতবার নিষেধ করেছি দরজা লাগাবি না। তাও দরজা লাগালি কেন? কি করছিলি রুমে?’

হতাশার চোখে তাকালো অর্ষা। বললো, ‘দরজা লাগালে তোমার ভাড়া ভাতে ছাই পরে?’

রেগে গেলো হেনা। চোখ পাকিয়ে বললো, ‘বেয়াদব মাইয়া। মুখে মুখে তর্ক করছ। তোর বাপে আসুক আজকে। তার দামড়া মাইয়ার সাহস বাড়ছে জানান লাগবো না? আসুক খালি।’

অর্ষা পাত্তা না দিয়ে বিছানার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বলতে লাগলো, ‘হ হ আসুক। যা বলার বইলো। এবার যাও আমি ঘুমাবো।’

হাসনা হেনা রান্না ঘরে কাজ করছিল এতোক্ষণ। সেই কারণে তার কপালে নাকে ঘাম জমে আছে। কোমড় থেকে শাড়ির আচল টেনে ঘাম মুছতে মুছতে রান্না ঘরের দিকে আবারো অগ্রসর হতে লাগলো এবং সাথে চেঁচাল, ‘হ সারাদিন ঘুম আর মোবাইল ছাড়া কোনো কাজ আছে তোর? পারছ তো সারাদিন মোবাইল টিপতে আর ঘুমাইতে। পারলে মোবাইলটাও গিলে খা। ভাত খাওয়া লাগবো না। তোরে মোবাইল কিনে দেওয়াই আমার ভুল হইছে। না করছিলাম তোর বাপরে। তাও আদর কইরা তোরে মোবাইল দিছে। এখন মোবাইল টিপ। সারাদিন টিপ। পারলে গিলে খা।’

মায়ের প্যানপ্যানানি কানে তুললো না অর্ষা। এক কান দিয়ে ঢুকিয়ে অপর কান দিয়ে বের করে দিচ্ছে। অবশ্য মোবাইল নিয়ে কিছু বললে গায়ে একদম লাগে না। মোটেও না। পানির আরেক নাম জীবন হলে মোবাইলের আরেক নাম হবে অক্সিজেন। আর অক্সিজেন ছাড়া কে চলতে পারে? হাহা শত বকলেও বেহায়া আমি জীবনেও মোবাইল ছাড়ছি না।

দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলো। বাহিরে যানবাহনের তীব্রতর আওয়াজ দেয়াল ভেদ করে আসছে। কোলাহলপূর্ণ মানবজাতি তো আছেই। মাথার উপর উল্কাপিণ্ড পশ্চিম পাশে একটু হেলে পরেছে। সূর্যের তীক্ষ্ণ আলোক রশ্মিতে চারপাশ উপতপ্ত হয়ে আছে। ভ্যাঁপসা গরমে শরির জ্বালাপালা করছে অর্ষার। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো বিকেল তিনটা ছয় বাজে। না আর থাকা যায় না। গোসল করতে হবে। আলমারি থেকে জামা খুঁজতে গিয়ে সময় লাগালো আরো দশ মিনিট। তাও কাঙ্ক্ষিত জামা খুঁজে পেলো না অর্ষা। বিরক্ত হয়ে হাঁক ছাড়লো, ‘আম্মু? আম্মুউউউ?? আমার আকাশী কালারের জামা টা কই রাখছো?’

হেনা তার রুমে বসে ছিলো। সেখান থেকেই উত্তর দিলো, ‘দুই নাম্বার ড্রয়ারে দেখ।’

অর্ষা কথা মতো দুই নাম্বার ড্রয়ারে খুঁজলো। কিন্তু পেলো না। আবারো ডাকলো হেনাকে। হেনা পরপর দুইবার বলার পরেও অর্ষা তার আকাশী রঙের জামা পেলো না। ক্রোধান্বিত হলো হেনা। দাঁতে দাঁত পিষে অর্ষার রুমে আসলো। আলমারির দিকে অগ্রসর হয়ে বললো, ‘এখন আমি যদি পাই তোর খবর আছে।’

হেনা এসে দুই নাম্বার ড্রয়ারের একদম কার্নিশ ঘেঁষে রাখা ভাজ করা জামাটা বের করে দিলো। অবাক হয়ে তাকালো অর্ষা। মুখ হা করে জামা হাতে নিয়ে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হেনা তার দিকে চোখ পাকিয়ে বলে উঠে, ‘সারাদিন মোবাইল টিপলে চোখে দেখবি কেমনে? কোনো কাজ তো আমারে ছাড়া পারছ না। সারাদিন মোবাইল টিপে এখন তিনটা বাজে মহারানীর গোসলের সময় হইছে।’

অর্ষা পুরাই তাজ্জব বনে গেলো। মানে এতোক্ষণ তাহলে সে কোথায় খুঁজেছিল? আষ্টর্য ব্যাপার! তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে হেনা চেঁচিয়ে উঠলো, ‘দাঁড়াই আছোস কেন? যা গোসল করতে যা। দেড়ি হইলে পরে ঠান্ডা লাগবো। যা যা।’

অর্ষাকে তাগিদ দিয়ে চলে গেলো হেনা। অর্ষা এখনো আহাম্মকের মতো আছে। অতঃপর সময় নষ্ট না করে ঘন্টাখানেক সময় নিয়ে গোসল করে এলো। অর্ষা আবার ফেমাস বাথরুম সিঙ্গার। গোসল করার সময় গলা ছেড়ে গান গাওয়া প্রত্যেকের অভ্যেস। অর্ষারও তাই। গোসল শেষে খাবার খেয়ে ছাদের উদ্দেশ্যে পা রাখলো অর্ষা। বিকেলের পর ছাদে সময় পার করার মাঝে অন্যরকম ভালোলাগা আছে। ছাদের কার্নিশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে রইলো অর্ষা। রিফাতকে অনলাইন দেখে ম্যাসেজ দিলো কিন্তু উত্তর আসলো না। ক্ষুন্ন হলো তার মন। হয়তো বিজি। নিজেকে শান্ত্বনা বানী দিয়ে লম্বা করে তপ্ত শ্বাস ফেললো। বাতাসে তার চুল উড়ছে। মুহূর্তটা বেশ উপভোগ্য। মন ভালো করতে কয়েকটা সেলফি তুললো। সেখান থেকে সব চেয়ে ভালো ছবিটা দেখে ফেসবুকে প্রোফাইল পিক আপলোড দিলো। সাথে সাথে লাভ রিয়েক্ট পরতে লাগলো ডিপিতে। খুশিতে অর্ষার মন গদগদ। মিনিট পাঁচেক পর অর্ষা খেয়াল করলো অপর্ন তার ডিপিতে হাহা রিয়েক্ট দিয়ে পরপর দুইটা কমেন্ট করেছে।

কমেন্ট ১ : ফিল্টার সুন্দরী (ফাইয়ার ইমুজি)
কমেন্ট ২ : গ্রামের চাচাতো বোন যখন নতুন স্ন্যাপচ্যাট দিয়ে ছবি তুলে :’)

রাগ অর্ষার শরিরে তরতম করে বেড়ে গেলো। রিনরিনিয়ে উঠলো শরির। দাঁতে দাঁত পিষে অর্পনের কমেন্টের দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। ভাবছে সে। এই ছেলে এখানে আসার পর থেকে তার জীবন একদম তেজপাতা বানিয়ে ফেলছে। ইচ্ছে করছে অর্পনকে কক্সবাজারের পানিতে চু’বি’য়ে মা’র:তে। দাঁতে দাঁত চিবিয়ে রাগ দমালো অর্ষা। মনে মনে ভাবতে লাগলো কিভাবে অর্পন কে হ্যানস্তা করা যায়। হঠাৎ শয়তানী বুদ্ধি মাথায় এলো। মুখে বাকা হাসি ফুটে এলো। ফুরফুরে মনে ‘সাইয়া তেরা ট্রিপ্পি ট্রিপ্পি’ গান টা প্লে করলো। গানের সাথে সাথে নিজেও মাথা দুলাতে লাগলো। আহঃ অর্পন কা বাচ্চা। তোর অবস্থা আজ কি হবে ভাবতেই এখন নাগিন ড্যান্স দিতে ইচ্ছে করছে। হাহা!

চলবে..??

চড়ুইপাখির বন্ধুত্ব .
মাইশাতুল মিহির [লেখিকা]
সূচনা পর্ব.

নোট : এটা সম্পূর্ণ কাল্পনিক গল্প। বাস্তবের সাথে কোনো মিল নেই। ভুলত্রুটি মার্জনীয়। কার্টেসি ছাড়া কপি নিষিদ্ধ। হ্যাপি রিডিং!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here