বিচ্ছেদময় সুখ পর্ব ১

0
1170

আমার বান্ধবীর সঙ্গে আমারই ভালোবাসার মানুষ দু’জন দু’জনকে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছে! আর সেই নিষ্ঠুর দৃশ্য দেখছি আমি! দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করার পর নিজের ভালোবাসার মানুষটিকে এক পলক দেখবার জন্য ছুঁটে গিয়েছিলাম তার বাড়িতে। তারই পাশে অন্য একটি মেয়েকে জড়িয়ে ধরে দেখতে পাবো এটা কল্পনাতেও আসে নি আমার! কল্পনাতীত হয়নি বলেই বোধহয় ধা’ক্কাটা খুব প্রচুর ভাবে লেগেছে মনের গহীন কোনে! আবার সেই মেয়েটিই কি-না আমার বান্ধবী! উনি তো বলেছিলেন ফিরে আসবে আমার কাছে তাহলে?
নিজের ভালোবাসার মানুষটির সঙ্গে অন্য কাউকে বাহুডোরে আবদ্ধ দেখলে যে কিরকম লাগে সেটা একমাত্রই সে-ই বুঝতে পারবে যে এরকম পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছে। রুহিন তিশাকে আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে রেখেছে আর আমি পাশ থেকে নিরব দর্শকের মতন দেখে যাচ্ছি। বুকের বা পাশটায় বড্ড কষ্ট হচ্ছে! না চাইতেই গাল বেয়ে অশ্রু কনারা গড়িয়ে পড়তে লাগলো। কি করে সইবো আমি এই বিচ্ছেদের যন্ত্রণা? এতো আমাকে প্রতি মুহুর্তে মুহুর্তে দ’গ্ধ করবে! গালের অশ্রু কনা মুছে নিয়ে আরো গভীর ভাবে পর্যবেক্ষন করতে লাগলাম ওদের দু’জনকে।

রুহিন এখনো সেই ওয়র্স্ট্রান ড্রেস পড়া তিশার দিকে তাকিয়ে স্নিগ্ধ ভুবন হাসি হেঁসে যাচ্ছে! মেয়েটিও তাকিয়ে রয়েছে রুহিনের দিকে এইভাবে তাকানো যে আর পাঁচটা সাধারন দৃষ্টি নয়, এটা ভালোবাসার দৃষ্টি! দু’জন দু’জনকে যে ভালোবাসে সেটা আর বোঝার কোনো অবকাশ নেই। আমি নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে আছি তাদের দিকে আর তারা দু’জন দুজনের দিকে তাকিয়ে আছে। আর আমি নিথর দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছি রুহিনের দিকে যা রুহিন বুঝেও বুঝে নি কোনোদিন! ভাগ্যের পরিহাসে যার দৃষ্টিতে নিজেন ভুবন ভোলাতাম তারই দৃষ্টি এখন অন্য কারোর মায়া আবদ্ধ রয়েছে!

এইসব দৃশ্য আর সহ্য করার বিন্দু পরিমান শক্তিও আমার ভেতর অবশিষ্ট নেই! এখানে যতোক্ষণ দাঁড়িয়ে আছি ততোক্ষণই রুহিনের পাশে ওই তিশাকে দেখে নিজেকে ক্ষ’তবি’ক্ষত করার ক্ষমতা নেই! কষ্ট ক্রমশ বেড়েই যাচ্ছে রুহিনের সঙ্গে তিশাকে দেখতে পেয়ে। কিন্তু সেই কষ্ট বোঝার ক্ষমতা কি রুহিনের আছে? তার কি মনে পড়েনি মিরা বলেও আদৌ একজন মানুষ আছে! হয়তো মনে পড়েনি।

রুহিনদের বাড়ির এই দিকটায় কেউ আসেনি বলে হয়তো রুহিন আর তিশা এই পাশে এসেছে। আমিও এসেছিলাম রুহিনের জন্য, ওকে এক পলক দেখবো বলে নিজের মনের অব্যক্ত অনুভুতি গুলো আবারো জানানোর জন্য কিন্ত তা তো অব্যাক্তই থেকে যাবে দেখছি! রুহিন এই ক’টা বছর বাহিরে ছিলেন, চাচাকে ব্যবসার কাজে সাহায্য করবেন বলে, রুহিন বাংলাদেশে থাকা কালীন উনার পিছু পিছু ঘুরতাম, অসময়ে উনাদের বাড়িতে গিয়ে বসে থাকতাম শুধু এক পলক উনাকে দেখবো বলে। তখন বোধহয় উনি আমাকে বাচ্চা ভেবে পাত্তা দেয়নি কিন্তু এখন তো আমি যথেষ্ট ম্যাচুয়েড! সেটা বয়সের দিক দিয়েও এখন যদি উনার সামনে গিয়ে দাঁড়াই উনি নিশ্চয়ই আমাকে ফেরাতে পারবে না? এখন আর আমি সেই স্কুলের মেয়ে নই এখন তো কলেজের ছাত্রী হয়ে গেছি। কিন্তু পরক্ষণেই যখন দৃষ্টি গিয়ে নিক্ষেপ হলো রুহিন আর তিশার দিকে তখনই বেহায়া মনকে বুঝ দিয়ে ছুট লাগালাম বাড়ির উদ্দেশ্য!

বাড়ির উদ্দেশ্য ছুট লাগাতে গিয়ে হো’চট খেয়ে পড়ে গেলো মিরা! জ্ঞান ফিরতেই নিজেকে রুহিনের বাড়িতে দেখে চমকে ওঠলাম! আমি তো নিজের বাড়িতে যাচ্ছিলাম তাহলে এই রুহিনদের বাড়ির ভেতরে আসলাম কি করে তা-ও কিনা তন্ময় ভাইয়ের রুমে? তন্ময় ভাই হচ্ছে রুহিন ভাইয়ার নিজের ভাই, ওনাদের পিঠাপিঠি বয়স দেড় দু বছর গ্যাপ দু’জনের বয়সে। রুহিনরা দু ভাই আর এক বোন, রুহিনের একমাত্রই বোনই হচ্ছে আমার বেস্ট্রফেন্ড লিপি! আর এক বৃদ্ধ দাদীমা এই ছয়জনের ফ্যামিলি উনাদের। রুহিন ভাইয়াদের বাসা আমাদের বাসা থেকে পায়ে হেঁটে যেতে আধা ঘন্টার মতন লাগে বেশিক্ষণ না। এদিকে বলা বাহুল্য আমার আব্বু আর রুহিন ভাইয়ার আব্বু একই এলাকার হওয়ায় বন্ধুত্বপূর্ন সম্পর্ক তাদের। আর সেই সুত্র ধরে লিপির সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব হয়, লিপির জন্য প্রায়শই আমি ওদের বাড়িতে যেতাম আর সেখান থেকেই রুহিনের প্রতি আকৃষ্ট হওয়া। তবে রুহিন কোনো কালেই আমাকে পাত্তা দেয়নি! কিন্তু উনাদের বাড়িতে যতোবারই গেছি ততোবারই তন্ময় ভাইয়া মানে রুহিনের ছোটো ভাই সে বেশ করে আমার পিছু লাগে, বলা যায় এক প্রকার হেনস্তা করে!

-‘ কি মিরা মনি? এখানে অজ্ঞান হয়ে পড়লে কি করে? কি এমন দেখলে যে একেবারে অজ্ঞান হয়ে গেলে?’

তন্ময় ভাইয়ের কথায় আরো খারাপ লাগলো। না চাইতেও চোখের দু পাতায় রুহিন আর তিশার জড়িয়ে ধরার মুহুর্ত মনে পড়ে গেল! নিজেকে আটকাতে পারলাম না, তন্ময় ভাইয়ের সামনে অশ্রু নির্গত হতে লাগলো। কি করে বাঁধ দিবো আমি? এতোবছরের তিল তিল করে গড়ে ওঠা ভালোবাসা আমার, আজকে চোখের সামনেই সবটা যেনো মিথ্যা হয়ে গেলো!

-‘ কি হলো কাঁদছো কেনো? আমি কি ভূল কিচ্ছু বলেছি? ‘
তন্ময়ের কথা পাত্তা না দিয়ে আমি ওখান থেকে চলে গেলাম নিজের বাড়িতে! হেঁটে নয় একটা রিক্সা নিয়েই চলে গেলাম। যাবার সময়ও লিপিদের ড্রয়িং রুমে রুহিন ভাইয়াকে নিয়ে বেশ আলোচনা হচ্ছিলো। ওই মানুষটাকে দেখলে আগে মনের ভেতর প্রশান্তি হতো এক রাশ ভালো লাগা কাজ করতো। আর এখন উনাকে যতোবারই দেখছি ঠিক ততোবারই যেনো আগের ঘটনার কথা মনে পড়ে যাচ্ছে!

বাড়িতে এসে স্বাভাবিক ভাবেই রুমে গেলাম নয়তো মা, ভাইয়া কারন জিগেস করবে আর সেই কারন আমি বলতে পারবো না। চোখেমুখে পানি দিয়ে মনটাকে ফ্রেশ করে তুলতে ছাঁদে চলে গেলাম সেই কালো ফুলের টবের কাছে!
স্কুলে থাকতে একুশে ফ্রেব্রুয়ারিতে রুহিনকে একদিন ফুল দিয়েছিলাম উনি প্রত্যুত্তুোরে আমাকে বলেছিলেন ” অন্যদের মতন আমার লাল গোলাপ ভালো লাগে না”
আমিও সেদিন আগ্রহের সহিত বলেছিলাম তাহলে? উনিও উত্তর দিয়েছিলেন “কালো গোলাপ” উনার নাকি কালো গোলাপ ভালো লাগে। সেই থেকে যখনি শুনেছিলাম উনি আর ক’মাস পর দেশে ফিরবেন তখুনি কালো গোলাপের চারা এনে লাগাই। ভেবেছিলাম উনাকে দিবো তাই, কিন্তু উনার পছন্দ অনুযায়ী উনাকে ফুল দেবার জন্য তো লোক এসে পড়েছে! তাই এই গাছগুলো রাখা তো বৃথাই এক প্রকার! তাই ছিঁড়েই ফেলি।

-‘ ফুলগুলো যেই মানুষটার জন্য লাগিয়েছিলিস তাকে না দিয়েই ছিঁড়ে ফেলছিস যে মিরা? ‘

পিছন ঘুরে দেখি লিপি এসেছে। লিপি হচ্ছে আমার বেস্ট্রফ্রেন্ড সেই হিসাবে আমার সব কথাই ও জানে। এটাও জানে ওর ভাইয়ের প্রতি আমি দুর্বল!

-‘ এসব ছাড় তো। কখন এসেছিস তুই? ‘

-‘ ছাড়লেই ছেড়ে দেওয়া যায় না মিরা! তুই আমাদের বাড়িতে গিয়ে রুহিন ভাইয়ার সঙ্গে দেখাও করলি না কথাও বললি না এভাবেই চলে এলি? আবার আমাদের বাড়ির দিকে অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলিস তখন তোকে তন্ময় ভাইয়া নিয়ে আসেন, আবার তুই নাকি কাঁদতে কাঁদতে চলে এসেছিস আমাদের বাড়ি থেকে? এই এতোকিছু হবার পরও আমি তোর বাড়িতে না এসে থাকতে পারি? ‘

-‘ কিচ্ছু হয়নি বললাম তো! ‘

-‘ তোর থেকে বেশি চিনি আমি তোকে বুঝেছিস? তাই সোজা সাপ্টা বলে ফেল কি হয়েছে? নিশ্চয়ই রুহিন ভাইয়া তোকে কিছু বলেছে? ‘

লিপির কথা শুনে মনের ভেতর বারবার আবারো সেই কিয়ৎক্ষন পূর্বে ঘটে যাওয়া ঘটনা চোখের সামনে ভেসে ওঠছে! কষ্টে বুকের ভোতর তোলপাড় হচ্ছে! কিন্তু নিজেকে সামলাতে হবে।

-‘ আচ্ছা কিচ্ছু না বললে চল, মা তোকে আমাদের বাড়িতে যেতে বলেছে। ‘

-‘ ভালো লাগছে না লিপি। ছেড়ে দে আমাকে? ‘

-‘ ভেবে বলছিস তো? মা নিজে তোকে যেতে বলেছে। ‘

চাচির কথা শুনে আর আটকাতে পারলাম না। লিপির সঙ্গে চললাম ওদের বাড়ি। ড্রয়িং রুমে ক্রস করার সময়ই লিপি ওর নিজের রুমে চলে যায়। আমার চোখ যায় সোফায় বসে থাকা রুহিনের দিকে। আমি উনার পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি লিপির ঘরে ঠিক তখুনি উনি ডাক দিলেন।

-‘ মিরা শোন একটু? দরকারি কথা আছে। ‘

রুহিনের মুখে নিজের নামটি শুনে অদ্ভুদ ভালো লাগা বয়ে গেলো মনের ভেতর। কিন্তু উনি কি বলবেন আমাকে? তিশা আর উনার কথা? না-কি আগের মতনই ধ’মক দিয়ে ওঠবেন? কি বলতে চান উনি আমাকে? কিন্তু উনি বলার আগে শেষবারের মতন আমি উনাকে বলতে চাই “ভালোবাসি আপনাকে”

#বিচ্ছেদময়_সুখ — [১]
#মুনিয়া_মিরাতুল_নিহা
#চলবে?

[ নতুন গল্পে সবাই রেন্সপন্স করে পাশে থাকবেন। রেন্সপন্সের ভিত্তিতে পরের পর্ব দ্রুত আসবে। নিজের সবটা দিয়ে চেষ্টা করবো গল্পটি সুন্দর করার। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করুন, আল্লাহকে স্মরন করুন, আসসালামু আলাইকুম সবাইকে]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here