#চোরাবালি_৮
রেশমা আক্তার
আজ দু’দিন যাবৎ লানার জ্বর। আঙুলের জখমটা বেশ গভীর। গতকাল সন্ধ্যা পার করে বাগানের দোলনায় বসে থাকায় বেশ ঠান্ডাও লেগেছে। কাশি আর গলা ব্যথা।
জোহার বাঁধা দিতে পারেনি। কেমন ভূতগ্রস্থের মত সোহার হাত ধরে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকল, বুঝতেই পারেনি সে। একটার পর একটা গান শুনিয়ে মন্ত্রমুগ্ধ করে রেখেছিল সোহা, জোহারকে। সোহা যে এত সুন্দর গায়, এতগুলো বছরে একটাবারের জন্যও জানতে পারেনি সে। জোহারের মনে হয়েছিল, এটা কোন স্বাভাবিক ঘটনা নয়। হয় সে স্বপ্ন দেখছে, নয়তো সোহার কোন মারাত্মক সমস্যা হয়েছে। এ সোহা তার পরিচিত সোহা নয়। এ তার মনের গভীরে আজন্ম কাঙ্খিত অন্য কোন সোহা। ঠিক এমন একজন সোহার জন্য সে হাজার বছর বাঁচতে চেয়েছিল কিংবা এখনই মরতে প্রস্তুত।
কিন্তু জোহার জানে, এ সময়টুকু সত্যি নয়। হয়তো একটু পরেই সোহা পাল্টে যাবে। ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে হাতের কাছে যা পাবে তাই দিয়ে আঘাত দেবে তাকে। হয় নিজের ক্ষতি করবে, নয় জোহারের। কি জানি, হয়তো ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেবে দোলনা থেকে। সে ভয়ও ছিল।
তবু আড়ষ্ট হয়ে সোহার হাতটা ধরেই বসেছিল জোহার। কখনও সোহা তার মাথাটা এলিয়ে দিয়েছিল জোহারের কাঁধে। অনেক জড়তা থাকা সত্বেও জোহার কাছে টেনে সোহার কপালে এঁকে দিয়েছিল ছোট্ট একটা চুমু।
চোখ বন্ধ করে শান্ত মেয়ে হয়েছিল সোহা। লজ্জাবনত হয়েছিল তার চিবুক। এ দৃশ্যও মনরোম, জোহার তাকিয়ে ছিল মুগ্ধ চোখে। আর বেশি কাছে যাবার ইচ্ছে থাকলেও সাহস হয়নি। প্রাপ্তিকে দূরে থেকে উপভোগ করাই হয়ত প্রকৃত প্রেম। কাছে গেলেই হয়ত উবে যাবে ভালোবাসা। ভোগে তৃপ্তি আছে সত্য, তবু প্রেম অপ্রাপ্তিতেই যেন অমর।
জোহার যে অনুভূতি কখনই পায়নি, আজ তাই এ পরম প্রাপ্তিটুকুর দখল নিয়ে নষ্ট করতে ইচ্ছে হল না। মনে হল, থাকনা, এ অনুভূতিটুকুই বেঁচে থাক।
জোহারের কাঁধে মাথা রেখে ঝাপসা হয়ে এসেছিল লানার চোখদুটি। যদি স্বপ্নই এত সুন্দর হয়, তবে এটুকু স্বপ্ন হয়েই থাক।
কতক্ষণ কেটে গিয়েছিল মনে নেই। সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে এসেছিল তখন। হঠাৎ মুনের কান্নার আওয়াজে সম্বতি ফিরেছিল দুজনারই। তড়িঘড়ি করে চলে এসেছিল বাড়ির ভেতরে দুজনেই।
আর তারপর রাত বাড়ার সাথে সাথে এলো জ্বর। পুরো একদিন অচেতন হয়ে থাকল লানা।
ডক্টর পার্থ এলেন। আঙুলটা দেখে আফসোস করলেন। বললেন ‘ ইনফেকশন ‘
জোহার বলল
– এত দ্রুত…?
– হুম, সেটাও আশ্চর্য।
লানা গত দু’রাত নিজের ঘরে শুয়েছিল। যদিও বাঁধা দিয়েছিল জোহার। বলেছিল
– জ্বর গায়ে একা শোবে? রাতে বাড়াবাড়ি হলে?
লানা বলেছিল
– জ্বরটা যদি ভাইরাস হয়, মুন এফেক্টেড হবে। একটা অষুধটসুধ থাকলে খাইয়ে দাও, শুয়ে পড়ি। সকালে ঠিক হয়ে যাবে।
জোহার মলিন মুখে তাই করেছিল। লানারও কষ্ট হয়েছিল খুব। কিন্তু সে তো জানে, সকালে ঘুম ভেঙে সে আর এখানে থাকবে না। হয়তো সাজেকে, হোটেলের রুমে কিংবা কি জানি, ওরা হয়তো অন্য কোথাও রওয়ানা হয়ে গেছে।
লানার ঘুম ভেঙেছিল এখানেই, নিজের ঘরে, বেলা করে। জোহার তার পাশটাতে বসে কপালে জলপট্টি দিচ্ছিল। তীব্র শীতে কাঁপছিল লানা। জোহার একটা কম্বল চাপা দিয়ে জড়িয়ে থেকেছিল অনেক্ষণ। জোহারের শরীরের শীতলতাটুকু যেন শুষে নিতে চাইছিল তার জ্বরতপ্ত শরীরটা।
আজও সারাদিন তীব্র জ্বরে আচ্ছন্ন লানা। বিকেল নাগাদ ডক্টার পার্থ এলেন। সব দেখেশুনে একটা ইঞ্জেকশন পুশ করলেন। অষুধপত্র দিয়ে বাইরে এসে বললেন।
– অষুধগুলো সময় ধরে দিও, ঠিক হয়ে যাবে।
– ডক্টর…
– বলো…
– আমার মনে হচ্ছে, সোহার ভেতরে বড় ধরনের কোন পরিবর্তন এসেছে। এতটা এর আগে কখনই চোখে পড়েনি।
– যেমন…?
– ও সেদিন গান গাইছিল ডক্টর। কি অপূর্ব গানের গলা আমি আপনাকে বোঝাতে পারব না। আচ্ছা আপনি বলুনতো, সেই ছোট্টবেলা থেকেইতো আপনি ওকে জানেন। সোহার গান কখনও শুনেছেন?
ডক্টর পার্থ হো হো করে হেসে উঠলেন, বললেন
– এই কথা…? তা, এতদিন ওর গাওয়ার সাধ হয়নি, তাই গায়নি। আর ও যেহেতু এর আগে গায়নি, আমাদেরও জানার সুযোগ হয়নি যে, ওর গানের গলা কেমন।
– শুধু গান নয় ডক্টর, আমি যেন সোহার মাঝে সম্পূর্ণ অন্য কাউকে দেখছি। একদম নতুন কেউ…
– হা হা হা… এমনটা হয় জোহার। শি ক্যান প্লে মাল্টিপল বিহেভিয়ার। তবে তোমাকে সচেতন থাকতে হবে। বিভ্রান্ত হলে চলবে না।
ডক্টর পার্থ আরও কিছু উপদেশ দিয়ে চলে গেলেন। জোহারের মাঝে মাঝে মনে হয়, ডক্টর পার্থ যতটা না ডাক্তার, তার চেয়ে অনেক বেশী সোহার শুভাকাঙ্ক্ষী। তবে স্নেহ বাৎসল্যে রোগীর রোগটা এড়িয়ে যাওয়াতো কোন ডাক্তারের প্রফেশনাল বিহেভিয়ার হতে পারে না।
লানা যতবার জ্বরের ঘোর থেকে চেতনায় আসছে, ততবার আগে নিজের জায়গাটা বুঝে নিচ্ছে। তবে পরিপূর্ণ জ্ঞান ফিরল তার আরও একদিন পরে এবং সে অবাক হয়ে লক্ষ্য করল, সে এখানেই আছে। এটা অস্বাভাবিক।
পুরো চারদিন টানা এভাবে, এর আগে স্বপ্নে আটকে থাকেনি সে। তবে কি এটা তার স্থায়ী অসুখে পরিণত হচ্ছে? হয়তো এখন সে বাস্তবে সাজেক, রাঙামাটি, বান্দরবন ঘুরে বেড়াচ্ছে। অথচ সে যে আসলে কোথাও নেই, কেউ বুঝতে পারছে না।
‘ব্লু সি বিচ’ কোম্পানী হয়ত একটা বড় ধরনের সমস্যায় পড়ে গেছে। জোহারকে ফোনে অনেক কথা বলতে হচ্ছে। লানা আজ একটু হাঁটতে পারছে। সে লক্ষ্য করল, জোহার ভীষণ বিচলিত। সে মুনেরও ঠিকঠাক খেয়াল রাখতে পারছে না। এমনকি দুপুরের খাবারটা পর্যন্ত লানাকে ম্যানেজ করতে হয়েছে। রুমকি মেয়েটা সকাল থেকে বিকেল অবধি থাকে মুনের সাথে। তবে বাইরে, লনে। ভেতরে আসা নিষেধ। সোহা নাকি তাকে পছন্দ করে না। অথচ লানার একটুও খারাপ লাগছে না মেয়েটিকে। একটি সাধারণ, অল্পবয়সী পাহাড়ী মেয়ে। খারাপ লাগার কি আছে তাই তো বোঝে না লানা।
তবু, এখানে যেহেতু সে সোহা, সুতরাং সোহা কেমন, তাকে তেমনভাবেই চলতে হবে।
আচ্ছা, সোহা কেমন? ধরা যাক, এটা লানার স্বপ্ন। তবু সোহা বলে এরা যাকে জানে, সে কেমন? এদের কথাবার্তায় বোঝা যাচ্ছে, সোহা একটা সম্পূর্ণ অন্যরকম মেয়ে। সে লানার মত নয়, শারীরিক বা মানসিক কোনভাবেই নয়। কিন্তু লানা হঠাৎ এমন স্বপ্ন কেন দেখবে, যেখানে সে নিজের শরীরে নয়, অন্য কারো শরীর বহন করছে? লানা ভাবছে তার স্বপ্ন ভেঙে যাবার সাথে সাথে এখানকার সব কর্মকান্ড স্থবির হয়ে যাচ্ছে। আসলেই কি যাচ্ছে?
ব্যাপারটা কি একটু তলিয়ে ভাবা বা দেখা যায়?
প্রথমত স্বপ্নে এসে লানা একটা ধারাবাহিক ঘটনাপ্রবাহ অতিক্রম করছে। তবে সে আসছে একেকবার একেক দিনে। সময়টা ক্রমশ পেছন থেকে সামনে আসছে। গত কয়েকবারের তুলনায় এবার বেশ খানিকটা ব্যবধানে চলে এসেছে লানা। স্বপ্নে প্রায় একবছর পার হয়ে গেছে এবং বেশ কয়েকবার আসা যাওয়া হয়ে গেছে। অথচ বর্তমান বা বাস্তব সময়টা তার নির্দিষ্ট গতিতে এগোচ্ছে। এসব কি কোন বিশেষ নিয়ম বা কারণে হচ্ছে? স্বপ্ন বলে লানা যেটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা ভাবছে, সেটা কি আসলেই স্বপ্ন? লানা ভাবছে এটা তার কোন মানসিক ব্যাধি। সেদিন রাইসুলের পার্টিতে সেবন করা নতুন ধরণের একটা ড্রাগের রিএ্যাকশনও হতে পারে। এই যা কিছু হতে পারে বলে ভাবছে লানা, যদি তা না হয়?
বেশি চিন্তা করতে গিয়ে মাথাটা কেমন দপদপ করছে লানার। এসব চিন্তা সে করত না। কিন্তু এই টানা চারদিনের থেকে যাওয়াটা আজ সত্যি ব্যাপারটা নিয়ে ভাবাচ্ছে।
ওই যে বাইরে বারান্দায় একটা টেবিল বসিয়ে জোহার কোম্পানীর ফাইলপত্র নিয়ে বসেছে, এই যে বলা হচ্ছে ‘ ব্লু সি বিচ’ কোম্পানীর বেহাল অবস্থার কথা। নামটা এর আগেও কোথাও দেখেছে বা শুনেছে কি? এসব কি হচ্ছে? সত্যিই কি এই নামে কোন কোম্পানীর অস্তিত্ব আছে? এই যে বাংলো বাড়িটা। একটা পাহাড়ের ওপরে, চারিদিকে নির্জনতা, গাছপালা, প্রকৃতি। কোথায় এটা? এর কি কোন বাস্তব ভিত্তি আছে? এ জায়গাটার কি কোন নাম আছে? কোন জেলা, কোন শহর বা কোন দেশ?
লানার হঠাৎ সেদিনকার জোহারের লকারের নিউজ পেপারগুলোর কথা মনে পড়ে গেল। সেখানে পিহু নামের একটা বাচ্চার মৃত্যুসংবাদ ছাপা ছিল। ঢাকার ধানমন্ডি এলাকার ‘নীলকুঞ্জ’ নামক বাড়ির খবর। সেখানে তারিখ, দিন ক্ষণেরও উল্লেখ ছিল। ‘ব্লু সি বিচ’ কোম্পানীর মালিকের নামও উল্লেখ ছিল সেখানে। এসব কি স্বপ্নে ঘটছে?
রুমকি, মুনকে নিয়ে বাইরে গেছে। জোহারের কাছে দু’জন লোক এসেছে। তাদেরকে নিয়ে জোহার বাগানে একটা শেডের নিচে, পাথুরে টেবিলে বসেছে। তাদের সামনে অনেক ফাইলপত্র। মনে হয় জটিল কোন সমস্যা।
লানা আজ একা একাই নিজের অষুধ খেল। এক মগ কফি নিয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল স্টাডির দিকে। আজ তার খুব ঘুরে ঘুরে বাড়িটা দেখার সাধ জাগছে। জোহার ব্যস্ত আছে, এই সুযোগে একটু স্টাডিটা ঘুরে আসা যাক।
স্টাডির করিডোর ধরে হাঁটতে হাঁটতে লানা সেদিনের সেই খাটো দরজাটার সামনে এসে দাঁড়াল। সেদিন সে এই দরজাটার ব্যাপারে কৌতূহল থাকা সত্বেও ঢুকতে পারেনি। মজার ব্যাপার হল, এখন আর কোন ঘটনা বা বিষয়ই বিচ্ছন্ন মনে হচ্ছে না। লানা সেবার স্টাডিতে এসেছিল প্রায় এক বছর আগে। অথচ সবকিছু আগের মতই আছে। তবে প্রচুর ধূলো জমেছে। নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে।
লানা হাতল বিহীন দরজাটায় চাপ দিল।
চারপাশে দেয়ালে কোন সুইচ নেই। সুতরাং সে আবছা অন্ধকারেই ভেতরে ঢুকল। মাথা নিচু করে ঢুকতে হল তাকে। কেমন দমবন্ধ হয়ে আসছে। আলোহীন অন্ধকার ঘর। চোখ সয়ে আসতে সময় লাগল।
যেমনটা হবার কথা তেমনই। কিছু পুরানো বাক্স পেঁটরা। কয়েকটা পুরানো ধূলো পড়া শেল্ফ। কিছু বই ধূলোর আস্তরণে ঢেকে আছে। তবে এত ময়লা, ধূলোর মাঝেও বেশ চকচকে দুটো কাগজের কার্টুন। মনে হয় সম্প্রতি রাখা হয়েছে। কার্টুনগুলোর মুখ আলগাই আছে।
অন্ধকার ভাবটা চোখ সওয়া হয়ে এসেছে।
লানা কফির কাপটা একটা শেল্ফের ওপরে রাখল, তারপর বসল হাঁটুভেঙে। একটা কার্টুনের পাল্লা সরাল। ভেতরে কিছু বই, কাগজপত্র জাতীয় জিনিস। আরেকটা কার্টুনের পাল্লা খুলতেই দেখা গেল কিছু বাঁধানো ছবি, কয়েকটা ক্রেস্ট, একটা ছোট্ট টর্চ, একটা পুরানো আমলের খাপ ওয়ালা চাকু। একটা মোটা হাতুড়ি।
এসব অব্যবহার্য জিনিস হয়তো বাক্স বন্দী করে এখানে স্টোর করা হয়েছে। লানা টর্চটা টিপতেই আলো জ্বলে উঠল। তার মানে এখানে যাতায়ত আছে কারও। কৌতূহল বশতই টর্চটা বের করে নিল । উঠে দাঁড়িয়ে টর্চ মেরে চারিদিকটা দেখল। কফিতে চুমুক দিয়ে ভাবছে বেরিয়ে যাবে কিনা। তবে বাইরে গিয়েই বা কি করবে। জোহার ব্যস্ত, মুনও বাইরে। ঘরে গিয়ে শুয়ে থাকার চাইতে এখানে কিছু করা যায় কিনা দেখা যাক। কফির মগটা রেখে হঠাৎ কি মনে হতেই আবার বসল সে।
প্রথম কার্টুনের মধ্যে বই সদৃশ্য জিনিসগুলোর উপর আলো ফেলতেই সেদিনকার সোহার কাবার্ডের এ্যালবাম আর ডায়েরী, নোটবুকগুলো চোখে পড়ল। এগুলো তাহলে এখানে এনে রাখা হয়েছে? কে রেখেছে…জোহার? জোহার ছাড়া আর কেইবা রাখবে?
লানার সেদিনকার অপূর্ণ কৌতূহলটা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। একটা মোটা, চওড়া নোটবুক হাতে তুলে নিল সে। একটা বসার জায়গা পেলে ভালো হত। চারপাশে তাকিয়ে তেমন কিছু পেল না।
হাঁটুর ওপর নোটবুক রেখে, টর্চ জ্বেলে পাতা ওল্টাতে থাকল।
২২-৪-০৪
রকি ( পোষা এ্যালসেশিয়ান)
একটা মৃত রক্তাক্ত কুকুরের ছবি।
পৃষ্ঠার পেছনে নোট লেখা: রকি কে মেরেছি একটা সবজি কাটার চাকু দিয়ে। ওকে হেইট করি আমি। মম্ সারাক্ষণ ওকে দিয়ে আমার ওপর নজরদারি করে। কোথাও একা যেতে পারিনা আমি। ধারাল চাকু দিয়ে ওর মাথাটা এক কোপে ফাটিয়ে দিলাম। দু’ তিনবার মারতেই লুটিয়ে পড়ল রকি। ওর ছটফটানি দেখে ভীষণ মজা লাগল। কারো ছটফট করে মৃত্যুদৃশ্য এত আনন্দময় আগে জানা ছিল না।
পরের পৃষ্ঠা।
০৭-০৯-০৫
টুই, টেটম ( তিহামের পোষা টিয়া)
(দুটি মৃত টিয়া পাখির ছবি)
ছবির পেছনের পৃষ্ঠায় নোট: টুই আর টেটম কে আজকাল আমার অসহ্য লাগে। তিহাম ওদেরকে নিয়ে একটু বেশিই আদিখ্যেতা করে। তিহাম ইদানিং ওদেরকে এমন এমন শব্দ শেখায়, যেটা শুনলে আমি রেগে যাই। তিহাম জানে না, জীব জন্তুর মৃত্যু যন্ত্রনা আমি কতটা উপভোগ করি। বেশ কিছুদিন মেরে ফেলার মত কিছু পাচ্ছি না। আজ টুই, টেটমের শেষ দিন। আহ্ কি সুন্দর, শরীর থেকে ওদের বিচ্ছিন্ন মাথাগুলো পরে আছে একধারে। তিহাম চিৎকার করে কাঁদছে। আহ্ তিহামের কান্নাটা এত মজা লেগেছে শুনতে।
লানা এর পরের পৃষ্ঠাতে একটা ষোল সতের বছরের মেয়ের ছবি দেখে কিছুটা আতকে উঠল।
মেয়েটার গলা কেটে রক্ত ঝরছে। জিহবা বেড়িয়ে এসেছে ঠোঁটের ফাঁক গলে।
ছবিটা এতটা জীবন্ত যে মুহূর্তে কেঁপে উঠল হাত। পড়ে যেতে গিয়েও নোটবুকটা সামলে নিল লানা,
১৮-০১-০৬
আতিকা ( বাড়ির মেইড)
ছবির উল্টো পাতায় নোট: আমার নামে মম্ কে নালিশ জানিয়ে মারাত্মক ভুল করল আতিকা। মম্ আজ আমাকে চড় মেরেছে। আর ঠিক তখনই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, আতিকা মরবে আজ। এই প্রথম মানুষের মৃত্যুযন্ত্রণা দেখার সাধ জাগছে। প্রতি রাতে আমার ঘরের মেঝেতে ঘুমায় আতিকা, মমের নির্দেশে। গভীর রাতে নিচে তাকিয়ে দেখলাম চিৎ হয়ে মুখ হা করে অঘোরে ঘুমাচ্ছে আতিকা। আমার বালিশের নিচ থেকে বের হল ধারাল ব্লেড। নিচে এসে ওর পাশে বসে, উন্মুক্ত গলায় ক্ষিপ্র হাতে কয়েকটা পোচ, তারপর বালিশ চাপা দিয়ে দিয়েছিলাম ওর মাথাটা, একটুও শব্দ পায়নি কেউ। আতিকার গায়ে অনেক শক্তি। আজ প্রথম বুঝলাম, আমার গায়ে আতিকার চাইতেও অনেক বেশি শক্তি। তবে আজ একটা বিষয় বুঝলাম, মানুষের মৃত্যু যন্ত্রণার দৃশ্য অনেক অনেক বেশি আনন্দময়।
লানা জোরে জোরে নিশ্বাস নিচ্ছে।
তার হাত কাঁপছে। তবুও কৌতূহল মিটছে না। কারণ এরপর নোটবুকে আর কোন জীবজন্তুর ছবি নেই। সব মৃত মানুষের ছবি। এসব কি সত্যি? না না না সে তো আছে এক অবাস্তব জগতে। এখানে সব মিথ্যে, নিশ্চই মিথ্যে…
১৬-০৭-০৭
তিহাম ( ছোট ভাই, বয়স আট)
হাস্যমুখের একটি দশ বছরের সুন্দর, মিষ্টি ছেলের ছবি।
ছবির পেছনে নোট: তিহামকে অনেকবার মারার প্ল্যান করেও পারিনি। কিন্তু ওকে মরতেই হবে। মম্ আর ড্যাডের আদরের ছেলে। আমার জীবনের সবচেয়ে বড় শত্রু। আজকাল সবকিছুতে ওর জন্য মম্ ড্যাডের কাছে বকা খাই আমি। ও না থাকলে মম্ ড্যাড সবচেয়ে ভালোবাসত আমাকেই। তবে মানুষ মারলে খুব ঝামেলা হয়। তিহামকে মারা সবচেয়ে সহজ। ওর এ্যাজমা আছে। সময়মত ইনহেলারটা সরিয়ে মুখে একটা বালিশ চাপা দিতেই সব শেষ। তিহামের জন্য আমি অনেক কেঁদেছি। ওর মৃত্যুতে আমার খুব কষ্টও হচ্ছে আবার আনন্দও হচ্ছে। আজ থেকে এ বাড়িতে থাকব আমি একা। বাড়িভর্তি লোকজনের সামনে ওর লাশের ছবি তুলতে পারলাম না। এটাই আফসোস।
লানা কখন ধূলোর মধ্যে বসে পড়েছে জানে না। সে আরেকবার হাস্যোজ্জ্বল তিহামের ছবিটা দেখে চোখ বন্ধ করল।
কে? কে এই খুনী? জোহার…?
( চলবে)