চোরাবালি পর্ব ৭

0
167

#চোরাবালি_৭
রেশমা আক্তার

সবকিছু আগের চাইতে একটু অন্যরকম। মনে হয় সময়টা এক রাতের ব্যবধানে এগিয়ে গেছে অনেকটা। লানার সবচেয়ে বেশী মজা লাগছে এটা দেখে যে, মুন কথা বলছে।
খুব স্পষ্ট বাক্য না হলেও সে বেশ ভালই নিজের মনের ভাব বোঝাতে পারছে। তবে কেমন সংকুচিত হয়ে আছে জোহার। সে যেন কিছুটা ভয়ে ভয়ে তাকাচ্ছে লানার দিকে। চোখে চোখ পড়লেই পিছলে যাচ্ছে দৃষ্টি।
লানা স্পষ্ট বুঝতে পারছে, জোহার তাকে এড়িয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কেন? জোহার কি জানে, গত একটা রাত ও দিনের পরে লানা তাকে কতটা মিস করতে শুরু করেছে? স্বপ্ন থেকে জেগে উঠে সে সাজেকে, একটুও খুশি হতে পারেনি। এমনকি বন্ধুদের, নিজের স্বাভাবিক বাস্তব জীবনে একটুও স্বস্তি পায়নি।

মনে হয়েছিল, কোথায় গেল সবকিছু? তার স্বামী, জোহার। তার ছোট্ট মেয়ে, মুন। হোক না দেখতে সে অন্য কেউ, তবু কয়েকটাবারের এই যে আসা যাওয়া, লানা সত্যিই মিস করতে শুরু করেছে জোহার, মুন আর এই বাড়িটাকে। যদি সত্যিই এটা লানার কোন ভয়ঙ্কর মানসিক ব্যাধি হয়ে থাকে, লানা চাইবে না, এর নিরাময় হোক। একদম চাইবে না।

মুন তার হাত ধরে টানছে। লানা দ্বিধাগ্রস্থ। এই পোশাকে নিশ্চই নিচে সমাগত এত অতিথিদের সামনে যাওয়া যায় না? সে কি সেদিনকার মত একটা শাড়ি পড়তে পারে না?
লানা মুনের হাত ছাড়িয়ে দিয়ে বলল,
– মুন, তুমি নিচে যাও, আমি তৈরি হয়ে যাচ্ছি।

জোহার, মুনের হাতটা ধরে নিচে নিয়ে গেল। লানার বুকের ভেতর কেমন তোলপাড় হচ্ছে। আচ্ছা, জোহার কি ভুলে গেছে যে, লানা একা শাড়িটারি পড়তে পারে না?

লানা নিজের ঘরে ফিরে এসেছে। সবকিছু আগের মত হলেও, কেন জানি তার মনের মধ্যে খচখচ করছে। কিছু কিন্তু, দ্বিধা, অস্বাভাবিকতা উঁকিঝুঁকি মারছে।
কেবিনেট খুলে দেখল, একটিও শাড়ি নেই। অনেক পুরানো, মলিন সব কাপড়চোপড় ঝুলছে। লানা ভাবার সময় নিল না। চলনসই একটা গাউন পরে তৈরি হল। আয়নায় বোঝার চেষ্টা করল, সোহার চেহারা বা শরীরে কি কি পরিবর্তন এসেছে।

সোহা আগের চেয়ে অনেক বেশী সুন্দরী হয়েছে। তার শরীর থেকে কিছুটা মেদ ঝরে গেছে। শরীরে টানটান লাবণ্য উপচে পড়ছে। কিন্তু চোখের নিচে কালি। মনে হয় নির্ঘুম, ভীষণ ক্লান্ত চোখদুটো।

নিচে নেমে লানা পুরনো অনেককেই চিনতে পারল। তবে লোকজন কম। মাত্র কয়েকটা পরিবার। দু’চারটা বাচ্চাকাচ্চা। দূরে একটা সোফার কোণায় ডক্টর পার্থ। ভদ্রলোকের বয়স বেড়েছে যতটুকু তারচেয়ে বেশী বুড়োটে লাগছে। মাথার টাক টা প্রশস্ত হয়েছে। চিকন চোখে সে দূর থেকে তাকিয়ে আছে লানার দিকে।

মুনকে দিয়ে কেক কাটানো হল। আজ ঘরের মধ্যেই খাওয়া দাওয়ার আয়োজন। আগত অতিথিরা নিজেরাই নিজেদের খাবার পরিবেশন করে নিল। লানা ভদ্রতাসূচক সবাইকে তদারকি করতে লাগল।

জোহার আর ডক্টর পার্থকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। লানার কৌতূহল বাড়ল। সে একটু একটু করে খুঁজতে শুরু করল তাদের। বাইরে দুপুরের রোদ এসে পড়েছে কাঁচের কার্নিশে। নিচ তালায় স্টাডির পাশাপাশি দুটো শোবার ঘর আছে। লানা দেখল, একটা সামান্য ফাঁক হয়ে থাকা দরজার ভেতরে জোহারের পিঠের অংশ। চাঁপা গলায় জোহার কিছু বলছে কাউকে। তবে ভেতরের মানুষটা যে ডক্টর পার্থ, না দেখেও যেন আন্দাজ করতে পারল লানা।

– সোহাকে দেখেছেন ডক্টর? আজ প্রায় একমাস পর ও ঘর থেকে বের হল। কতটা স্বাভাবিক লাগছে ওকে। বহুদিন পর ও মুনকে স্পর্শ করল। আর এমন মন খুলে হাসছে, মনে হয় এ অন্য কোন সোহা…

– হুম, ব্যাপারটা আমিও ভাবছি
– গত এক সপ্তাহ ধরে ওর আচরণে এক ধরণের অস্থিরতা লক্ষ্য করছি ডক্টর। কেন যেন মনে হচ্ছে, কোন অশুভ কিছু এগিয়ে আসছে সামনে, ভয় লাগছে আমার..

ডক্টর পার্থ, জোহারের পিঠ চাপড়াল, বলল
– এভাবে ভাবার কোন কারণ নেই জোহার। আমি ওর ডাক্তার, আমি ওর ভেতর তেমন অস্বাভাবিক কিছুই দেখিনি। তবে হ্যা, ওর কিছু ডিসঅর্ডার আছে, যেটা চিকিৎসা করে সারিয়ে তোলা সম্ভব । তবে যতটা ভয়াবহ তুমি ভাবছ, ততটা নয়।

– না হলেই মঙ্গল। এ বাড়িতে আমার আর একটুও ভালো লাগছে না ডক্টর। সমস্ত বাড়িটা কেমন রহস্যময়, অন্ধকার করে রেখেছে সোহা। এতবড় বাড়ির কোন তদারকি করা যাচ্ছে না। বেশিরভাগ ঘর তালাবদ্ধ করে রাখা হয়। বাইরের কোন সাহায্যকারী ঢুকতে পারে না বাড়িতে । বাড়িটা রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ব্যবসা বাণিজ্য সব স্থবির হয়ে আছে। ‘ব্লু সি বিচ’ কোম্পানীর অর্ধেকেরও বেশি শেয়ার বিক্রি করে দিতে হয়েছে। আমি কোনদিক সামলাব বুঝতে পারছি না ডক্টর। মাঝেমাঝে মনে হয় আমিও সোহা আর মুনকে নিয়ে চলে যাই আমেরিকাতে

হাসল ডক্টর পার্থ
– আমার বন্ধু রিজভি, বড় ভরসা করে এই বিশাল প্রপার্টি আর তার মেয়েটিকে তোমার হাতে দিয়ে গিয়েছিল জোহার। সোহাকে তুমি সামলাতে পারবে বলেই সবকিছু ছেড়ে নিশ্চিন্তে আমেরিকায় পাড়ি জমিয়েছিল। আর একটু ধৈর্য্য ধর। আমার মনে হয়, সব ঠিক হয়ে যাবে।

– আমিও ভীষণভাবে ধৈর্য্য ধরতে চাইছি ডক্টর। আপনি শুধু এ পরিবারের ডাক্তারই নন, আপনি সোহার বাবার পরম বন্ধু। আপনিতো জানেন, এ পরিবারে এসে দুজন মানুষের অপমৃত্যু দেখেছি আমি। তার মধ্যে একজন আমার নিজের সন্তান। আমি কতটা ভেঙে পড়েও উঠে দাঁড়িয়েছি, সেটা আপনি জানেন। শুধু সোহাকে স্বাভাবিক দেখব বলে। এই ব্যবসা আর প্রপার্টি রক্ষার বিশাল দায়িত্ব আমার কাঁধে। আজকাল মনে হয়, আমি কিছুই আর পারছি না

– কিপ পেশেন্স মাই সান
ঠিক পেছনে কারও উপস্থিতি টের পেয়ে ঘুরে দাঁড়াল জোহার। সোহা দাঁড়িয়ে আছে হাসিমুখে

– আমি কি তোমাদের আলোচনায় ব্যাঘাত করলাম?

ডক্টর পার্থ আর জোহার মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। পার্থ বলল
– নট এট অল ডিয়ার।
লানা প্রশ্নাতুর চোখে তাকাল জোহারের দিকে। বিভ্রান্ত জোহার। কাল পর্যন্ত যে চোখে ক্রুর, অবিশ্বাসী চাহনি ছিল, আজ সে চোখে এত সরলতা আর মায়া কোত্থেকে এলো? এ কোন সোহা? একে কি বিশ্বাস করা যায়?

গত সপ্তাহে জোহার নিজের চোখে দেখেছে সোহার সেই ভয়ঙ্কর মূর্তিটা। কতটা নৃশংস, কতটা কুটিলভাবে সে ধারাল চাকু দিয়ে কুপিয়ে মেরেছিল পোষা বিড়ালটাকে। অথচ বিড়ালটা একটুও বিরক্ত করেনি তাদের। সারাদিন বাইরের লনেই ঘুরে বেড়াত। একটু দূরেই বাগানের ওদিকটায় উন্মুক্ত প্রাঙ্গনে, শেডের নিচে ঝুল দোলনায় রুমকি, মুনকে নিয়ে দোলাচ্ছিল। দৃশ্যটা তাদের জন্যও ছিল ভয়াবহ। জোহার এগিয়ে যাওয়ার সাহস করেনি। সে শুধু তাকিয়ে ছিল সোহার হিংস্র মুখাবয়বের দিকে।

– ওদের খাওয়া প্রায় শেষ, তুমি আসবে না?

– হুম, এইতো…
জোহার, ডক্টর পার্থকে নিয়ে এগিয়ে এলো। লানা রয়ে গেল পেছনে। সে জোহার আর পার্থর অস্পষ্ট কিছু কথোপকথনের মর্ম উদ্ধারের চেষ্টা করতে লাগল।
আলোচনা হচ্ছিল সোহাকে নিয়ে। সোহা এমন কিছু করেছে বা করছে যেটা জোহারের পছন্দ নয় বা জোহার সেটা নিয়ে চিন্তিত। এখানে লানাইতো সোহা। স্বপ্নের এ দৃশ্যপটে লানার অনুপস্থিতিতে তো কিছু ঘটা সম্ভব নয়। কিন্তু লানা বুঝতে পারছে এখানেও একটা ঘটনাপ্রবাহ চলছে। আমরা যেমন একই স্বপ্ন বারবার দেখি। ভেঙ্গে যাওয়া স্বপ্ন আবার ঘুমিয়ে পড়লে যেমন জোড়া লেগে অন্য কোন দৃশ্যপট তৈরি করে, তেমন। লানা একই স্বপ্নে ফিরে আসছে, তবে ভিন্ন দৃশ্যপটে, ভিন্ন সময়ে।

আজকের পার্টি তেমন জমল না। কোথাও যেন কমতি রয়ে গেল খানিক। লানা ঘুরে ঘুরে দেখছে সব। আজ তার এ বাড়িটা নিজের বাড়ি লাগছে।অতিথিরা চলে গেছে। জোহার খাবার ঘরটা পরিষ্কার করছে। লানার কি তাকে সাহায্য করা উচিৎ? কিন্তু লানা তো এসব করেনি কখনও। জোহারের মুখটা গম্ভীর। সে মাঝেমাঝে তাকাচ্ছে লানার দিকে। মুন তার সদ্য পাওয়া বার্থডে উপহার নিয়ে ব্যস্ত। কার্পেটের ওপর দু’পা ছড়িয়ে বসে সে নিজের উপহার খুলছে।

লানা একপা, দু’পা করে এগিয়ে গেল কিচেনের দিকে। বেসিনে অনেক এঁটো থালা বাসন। সংকুচিত হাতে লানা হাত বাড়াল ওয়াশারের দিকে। অনভ্যস্ত হাতে পানির কল ছেড়ে টেনে নিল প্লেট। অবাক চোখে দেখছে জোহার। এসব তো সোহা করেনি কোনদিন। শুধু বড়লোকের মেয়ে বলে নয়, আসেপাশে দু’ চারটা পরিচারিকা নিয়ে চলার অভ্যেস যার। এ পর্যন্ত কোনদিন জোহার সোহাকে এসব করতে দেখেনি।

সে এগিয়ে এসে একটা হাত টেনে ধরল লানার, বলল
– এসব কি করছ? তুমি পারবে না, ছাড়ো….
লানা হেসে ফেলল, বলল
– চেষ্টা করলেই পারব। এত কাজ তুমি একা করবে, তাই কি হয়?
জোহার চিন্তিত চোখে তাকিয়ে আছে। সোহার জন্য এ বাড়িতে কোন পরিচারিকা রাখা সম্ভব হয়নি। শেষবার যখন তারা ঢাকা থেকে এখানে ফিরে এসেছিল, একটি মহিলাকে রাখা হয়েছিল সাহায্যের জন্য। কিছুদিন ভালই চলল। কিন্তু হঠাৎ কি হল, মহিলা সোহাকে দেখে ভয় পেতে শুরু করল। ক’দিন পরেই মহিলা একদিন রক্তাক্ত কপাল নিয়ে ছুটে এলো জোহারের কাছে। বলল
‘ সাহেব, আমি আর তোদের বাংলোয় কাজ করতে পারব না। মেমসাহেবের মাথা খারাপ আছে, আমাকে মেরে ফেলতে চায়। এই দেখ, কেমন কপাল ফাটিয়ে দিয়েছে আমার।

জোহার দেখছে, সোহা খুব চেষ্টা করছে, কিন্তু কাজটা ঠিকঠাক পারছে না করতে। সে এগিয়ে এলো, সোহার হাতদুটো ধরে প্লেট ধোওয়ার ব্যাপারটা শিখিয়ে দিল কয়েকবার। লানার খানিকটা ঘিনঘিন লাগছে, তবু মজাও লাগছে। তাছাড়া জোহার একা সবসময় এসব কাজ করবে, তাতো হতে পারে না। স্ত্রী হিসেবে তারও তো কিছু কাজ করতে হবে। সংসারটা তো তারও।
বড়লোকের বখে যাওয়া মেয়ে লানা, যে কিনা ঘর সংসার, স্বামী সন্তান ব্যাপারগুলোর সাথে বরাবর আড়াআড়ি দূরত্বে চলেছে। আজ সে নিজের অজ্ঞাতেই এক সন্তানের জননী হয়ে, জোহারের বউ হয়ে একটা গোছানো সংসারের কর্ত্রী হয়ে গেছে। একদম অনাকাঙ্ক্ষিত, অবাস্তব একটা স্বপ্ন বটে। তবে ভালো লাগছে, লানার এখানটাতে ভীষণ ভালো লাগছে।
আচ্ছা, সে কি জোহারের প্রেমে পড়ে গেছে? সেকি কখনও এমন একজন বিবাহিত পুরুষের প্রেমে পড়ার কথা ভেবেছিল?

কি সব ভাবছে সে। জোহার তো এখানে পরিপূর্ণরূপে তার স্বামী। আর সে সোহা। তাকে নতুন করে প্রেমে পড়তে হবে কেন? যুক্তি তা বললেও, লানা ভীষণভাবে অনুভব করছে, সে লানা। আর লানার কাছে জোহার এক অচেনা, অজানা পুরুষ। আর সেই অচেনা মানুষটার প্রতি সে তীব্র আসক্তিবোধ করছে। এ অনুভূতি একদম নতুন, একদম সদ্য প্রেমে পড়ার অনুভূতি।
লানার মনে হচ্ছে, জোহারের জন্য সব করতে পারে সে। ওই যে ভালোবাসায় টলমল করা হৃদয় নিয়ে গম্ভীর মুখে, লম্বা রডের ঝাড়ু দিয়ে ঘর পরিষ্কার করছে লোকটা, সে সোহাকে নিয়ে হতাশ আর দুশ্চিন্তাগ্রস্থ। কেন দুশ্চিন্তাগ্রস্থ জানে না লানা। তবে তার মনে হচ্ছে, এ স্বপ্নদৃশ্যটা পাল্টে দিতে পারে সে। ইচ্ছে করলেই সে হয়ে উঠতে পারে জোহারের প্রিয়তমা, আদর্শ স্ত্রী, মুনের মম্। একবার চেষ্টা করলে ক্ষতি কি? এখানে তো কেউ বিধি নিষেধ নিয়ে তাকিয়ে নেই।

প্লেটগুলো ধোওয়া হয়ে গেছে। জোহার কাছাকাছি এসে বলল, এবার তুমি কিছু খেয়ে নাও সোহা। দুপুর গড়িয়ে গেছে, তোমার খাওয়া হয়নি। তুমিতো আবার এসব বাইরের খাবার খাবে না, একটু দুধ কর্ণফ্লেক্স করে দিই?

লানা তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ, বলল
– তুমিও তো খাওনি? তাছাড়া, আমি এসব খাইনা কে বলল? ইনফ্যাক্ট, এসব আমার খুবই পছন্দের খাবার। তুমি টেবিলে বসো, আমি সার্ভ করে দিচ্ছি। আজ আমরা একসাথে বসে খাব।

জোহারকে টেবিলে বসিয়ে দিয়ে লানা কিচেনে গিয়ে প্লেটে খাবার নিল। প্যাকেটজাত, হোটেলের খাবার অর্ডার দিয়ে আনা হয়েছিল। লানা চাকু দিয়ে লেবু কাটার চেষ্টা করছে। কাজটা যতটা সহজ ভেবেছিল, মনে হয় অতটা সহজ নয়। কয়েকটা পোচ দিতে গিয়ে আঙুলের অনেকটা কেটে ফেলল সে। ‘আহ’ শব্দ করতেই ছুটে এলো জোহার। দৌড়ে এসে আঙুলটা চেপে ধরল লানার।
– এতবার বারণ করছি, শুনছ না। কি ভূত চাপল আজ তোমার? কাজ কাজ করে পাগল হয়ে গেলে?

লানা অপরাধী মুখে টেবিলে এসে বসল। এইতো জোহার স্পর্শ করছে তাকে। কি স্পষ্ট অনুভূতি। হঠাৎ মাথার মধ্যে যেন ক্রুদ্ধ কারো গোঙানী টের পেল লানা। কেমন ভোঁতা একটা ব্যথা।

জোহার ফার্স্ট এইড আনতে গেছে। লানার এমন লাগছে কেন? এমন একটা ভোঁতা ব্যথা সে আগেও টের পেয়েছে। এমন ব্যথা হলেই তার ঘুম পায়। তার স্বপ্ন ভেঙে যায়। আজ, এখনই কি তার স্বপ্নভঙ্গ হবে? না না, সে এখনই জেগে উঠতে চায় না। সে জোহারের সাথে থাকতে চায় কিছুক্ষণ। মাথার মধ্যে অদ্ভূত গোঙানীর শব্দ। কি হচ্ছে এসব? স্বপ্ন বলেই কি এমন উদ্ভট ব্যাপার ঘটছে?

জোহার নেমে আসছে নিচে, হাতে এইড বক্স। পাশে বসে পরম যত্নে লানার আঙুলটা ব্যান্ডেজ করল জোহার। বলল
– ইস, অনেকটা কেটে গেছে। কি যে কর তুমি সোহা। একদম কথা শোন না আমার।
– সরি…
– সরি…? তোমার সাথে সরিটা ঠিক মানাচ্ছে না…
হাসল লানা।
এ হাসিটাও যে সোহার মুখে বেমানান,
বলতে চেয়েও বলতে পারল না জোহার। সে প্লেটে করে খাবার নিয়ে এলো। চামচ নিয়ে একটু একটু করে খাইয়ে দিল সোহাকে। এই যত্নটুকু, এই কেয়ারটুকু পরম তৃপ্তিতে গ্রহন করল যেন লানা। তার দু’চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে। এত আপন করে এত আদর নিয়ে তাকে কেউ কোনদিন খাইয়েছে, মনে পড়ছে না।

জোহারকে জড়িয়ে ধরে বলতে ইচ্ছে করছে, আই লভ ইউ জোহার, প্লিজ আমার এই স্বপ্নটা ভেঙে দিও না। আমি আজীবন এই মিথ্যে স্বপ্নটার মধ্যে আটকে থাকতে চাই, প্লিজ.. প্লিজ… প্লিজ…

মুন একরাশ প্যাকেটের মাঝখানে, কার্পেটের ওপর ঘুমিয়ে পড়েছে। জোহারের খাওয়া শেষ হলে সে মুনকে কোলে নিয়ে উপরে চলে গেল। লানা এসে কার্পেটের ওপর বসে মুনের প্যাকেটগুলো খুলতে লাগল। বেশ মজা লাগছে তার। আঙুলটা যদিও টনটন করছে।

লানার মনে পরপর কয়েকটা কথা ভেসে উঠল। শাহের বলছিল, সে ইমাদকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিতে চেয়েছে। আবার ইমাদের সাথে তাকে বেশ অন্তরঙ্গভাবেও দেখা গেছে। আচ্ছা লানা যখন স্বপ্নদৃশ্যে তখন তার আচরণ কিভাবে পাল্টে যাচ্ছে? স্বপ্ন থেকে জেগে উঠলে স্বপ্ন থেমে যেতে পারে, কিন্তু বাস্তবতাতো থেমে নেই। আর সেখানে লানা কি করছে, কি বলছে তার ওপরও লানার কোন নিয়ন্ত্রণ নেই। ইমাদ তাকে নিজের ঘরে বা তার ঘরে কেন ডেকেছিল? ভাবতেই ঘিনঘিন করছে গা। না জেনে বুঝে, অবচেতনে সে এমন একটা মানুষের সংস্পর্শে গেছে যাকে সে একটুও পছন্দ করে না। হঠাৎ এই জটিল মানসিক অবস্থার জন্য লানার মনে এক ধরনের বিতৃষ্ণা এলো। তীব্র অস্বস্তি আর কষ্টে অভিভূত হল সে।

জোহার নিচে নেমে এসে সোহাকে কোথাও দেখতে পেল না। মনের মধ্যে দুশ্চিন্তা উঁকি দিচ্ছে। দ্রুত গিয়ে সোহার রুমের দরজায় নক করল। সাড়া না পেয়ে নব ঘোরালো। কেউ নেই ঘরে। নিচে নেমে এসে দু’টো শোবার ঘর তল্লাশী করল। কোথাও নেই সোহা। স্টাডির দরজা বন্ধ। ওদিকটায় যাবার কোন কারণ নেই যদিও, তবু বলা যায় না। সোহা মাঝেমাঝে দীর্ঘ সময়ের জন্য স্টাডির ভেতরে লাইব্রেরীর মধ্যে গিয়ে সময় কাটায়। আবার একা একা বেরিয়ে আসে। জোহার সেদিকে এগোতেই দেখল, বাইরের দরজাটা হাট করে খোলা। ধ্বক করে উঠল বুকটা। সোহা কোথাও চলে যায়নি তো?

দরজার বাইরে এসে জোহার অদ্ভুত একটা দৃশ্য দেখল। বাগানের দোলনায় বসে দোল খাচ্ছে সোহা। গুনগুন করে গানও গাইছে। কি মিষ্টি সুরেলা কন্ঠ। সোহা তো কোনদিন গান গায়নি বা শেখেওনি। এত সুন্দর করে গাইছে কীভাবে?

জোহার মন্ত্রমুগ্ধের মত এগিয়ে যাচ্ছে। গানটাই টেনে নিয়ে যাচ্ছে যেন তাকে। এত চমৎকার গলায় গাইছে সোহা?
লানা জোহারকে আসতে দেখে গান থামাল। লাজুক চোখে তাকাল জোহারের দিকে। জোহারও কাছে এসে থেমে গেল। একটা স্মিত, লাজুক হাসি সোহার ঠোঁটে। এ যেন অন্য কোন সোহা। কি মিষ্টি, কি স্নিগ্ধ লাগছে সোহাকে। কি সরল আর মায়াবী চাহনি সোহার চোখে, যা এর আগে কখনও দেখেনি জোহার। জহুরীর চোখে তাকিয়ে যেন নতুন করে চেনার চেষ্টা করছে সে সোহাকে।

লানা আচমকা নিজের হাতটা বাড়িয়ে দিল জোহারের দিকে। স্পর্শ করতে চাইল জোহারকে। দ্বিধাগ্রস্থ জোহার। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে নিজেও হাত বাড়িয়ে স্পর্শ করল সোহাকে। লানা টানল তাকে। লোহার দোলনায় নিজের পাশে বসার জায়গা করে দিল জোহারকে। বলল

– এসো দোলনায় বসি
জোহার যেন সহজ হতে পারছে না। লানা তার নিজের হাতের মুঠোয় এখনও ধরে আছে জোহারের হাতটা। লানা জানে, যে কোন মুহূর্তে ঘুম ভেঙে যাবে তার। কিন্তু জোহারকে স্পর্শ করার এ অনুভূতিটুকু মনে প্রাণে ততক্ষণ অনুভব করতে চায় সে। এটা তার জীবনের সবচেয়ে প্রিয় অনুভব, প্রিয়ক্ষণ। জোহার যদি তার খুব কাছাকাছি সরে এসে বসে, সে একটুও বাঁধা দেবে না তাকে। সে ভালোবাসে, সে জোহারকে ভালোবাসে।

( চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here