#চুপকথার_গল্প
#পর্ব_৯
#পুষ্পিতা_প্রিমা
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
শীতের সকাল। হাড়কাঁপানো শীতকে ডিঙিয়ে গায়ে খয়েরী রঙের শাল জড়ানো মেয়েটা ঠকঠক করে কাঁপতে এসে পৌঁছাল কলেজের পাশে স্টুডেন্ট কেয়ার কোচিংয়ের সামনে। সাথে তার বাবা আফজাল হোসেন৷ মাথার টুপিটা দিয়ে কান ঢেকে তিনি কিছুটা দূরে গিয়ে সিগারেট ধরালেন। মেয়েকে ডেকে বললেন,
‘ স্যারেরা কি ভেতরে আছে মায়া?
উপরনিচ মাথা নাড়াল মায়া। বলল,
‘ জ্বি আব্বু।
আফজাল হোসেন তাড়াতাড়ি টেনে শেষ করল সিগারেট। মাফলার দিয়ে মুখ মুছে নিয়ে মেয়েকে বলল,
‘ চলো। ভেতরে যায়।
ভয়ে ভয়ে কোচিং সেন্টারে পা রাখল মায়া। কলেজের পাশের সুনামধন্য এই কোচিং সেন্টারে মেধাবী স্টুডেন্ট এডমিট করানো হয়। টিচাররা দায়িত্ব নিয়ে পড়ায় প্রত্যেক স্টুডেন্টদের। তবে এরজন্য স্টুডেন্টদের ও দায়িত্ব নিয়ে পড়তে হয়। রুলস রেগুলেশনের যে নোটসটা দেওয়া তার মধ্যে থেকে একটা নিয়ম ব্রেক করলে টাকাসমেত সেই স্টুডেন্টকে কোচিং থেকে বের করে দেওয়া হয়। সরকারি কলেজে চান্স পেয়েছে মায়া। কয়েকমাস চলে গেল কিন্তু কোচিং ধরা হয়নি। তার সহপাঠী সবাই এই কোচিংয়েই পড়ে। তারও ভালো গাইড দরকার। তাই বাবাকে নিয়ে এসেছে কোচিংয়ে ভর্তি হওয়ার জন্য।
স্কুলের মতো লম্বা কোচিং সেন্টারটাতে চলছে স্কুলের মতোই ক্লাস। প্রত্যেকটা রুমে রুমে ক্লাস চলছে। স্টুডেন্টরা নীরব, দর্শক শ্রোতা। মায়া আর আফজাল সাহেবকে দেখে পাতলা গড়নের একটা ছেলে বের হয়ে গেল। জিজ্ঞেস করল,
‘ আপনারা এডমিশন ডিপার্টমেন্টে যেতে চাইছেন?
উপরনিচ মাথা নাড়াল মায়া। ছেলেটা হাত নাড়িয়ে দেখালো, একদম বামপাশে গিয়ে দেখবেন এডমিশন ডিপার্টমেন্ট।
মায়া আর আফজাল সাহেব এগোলেন। মধ্যবয়স্ক চশমাপড়া একটা লোককে দেখা গেল। ওনি কোচিংয়েরই টিচার। একজন বেসরকারি কলেজের টিচারও। আফজাল সাহেবের সাথে হ্যান্ডশেক করে তিনি জানালেন ওনার নাম তৌহিদ ইসলাম। সবাই ওনাকে তৌহিদ স্যার নামেই চেনেন। মায়া আর আফজাল সাহেবকে চেয়ার টেনে বসিয়ে চলে গেলেন। আর ও অনেকে এসেছে এডমিশনের জন্য। যিনি এডমিশন নেবেন তিনি আসেননি বলে সবাইকে অপেক্ষা করতে হচ্ছে।
প্রায় আধঘন্টা পর হলে ডুকল লম্বা চওড়া মসৃণ চেহারার একটি ছেলে। গায়ের চকচকে কালো কোর্টটি খুলে রেখে ছেড়ে দিল মাথার উপরের ফ্যান। সবাই হতভম্ব ছেলেটার কান্ড। এত শীতের মাঝে ও ছেলেটা ফ্যান কেন ছেড়েছে। মায়ার আগে বসা মহিলা কিছু বলতেই যাচ্ছিল। ওনার ছেলে হাত চেপে ধরলে। ফিসফিসিয়ে বলল,
‘ মা ওনি এই কোচিংয়ের টিচার। সজীব স্যার। ম্যাথ আর ইংরেজি পড়ায়। আমাদের ইংরেজি পড়াবে।
মহিলা বসে রইল। সামান্য বিরক্তি নিয়ে বলল,
‘ এমন শীতে কেউ ফ্যান ছাড়ে। দেখতো কেমন শীত করছে।
চেয়ার টেনে বসা ছেলেটার কন্ঠস্বর ভেসে এল।
‘ কথা বাইরে গিয়ে বলুন যারা বলতে চান। আর যারা প্রথমে এসেছেন তারা একে একে আসুন। সিরিয়াল মেইনটেইন করবেন।
মায়া তার বাবাকে নিয়ে বসে থাকল এককোণে। দেখতে দেখতে একে একে চলে গেল। মায়ার সিরিয়াল এল। এতক্ষণে টিচারের বলা কথাগুলো মায়া মন দিয়ে শুনেছে। তবে সব টিচারের সামনে গিয়ে বসার সাথেসাথে আউলায় গিয়েছে। শুকনো ঢোক গিলল মায়া। আফজাল সাহেব তার পেছনে।
সজীব এডমিশন ফরমে কিছু একটা লিখতে লিখতে বললেন,
‘ বসুন।
মায়া আর আফজাল সাহেব বসল। সজীব লিখতে লিখতে জিজ্ঞেস করল,
‘ নাম?
মায়া থেমেথেমে জবাব দিল,
‘ মুনতাহিনা জান্নাত মায়া।
সজীব উচ্চারণ করে লিখল।
‘ মায়া।
মায়া বলল,
‘ জ্বি?
সজীব জিজ্ঞেস করল,
‘ ক্লাস, স্কুল এন্ড কলেজ, লাস্ট ক্লাস টিসি?
মায়া থেমে থেমে বলল,
‘ ইন্টার ফার্স্ট ইয়ার। পটিয়া সরকারি কলেজ।
তারপর টিসি বের করে দিল।
সজীব এডমিশন ফরম পূরণ করে কলম রেখে সোজা হয়ে বসে সামনে তাকাল। মায়া মাথা নিচু করে বসা ছিল। চোখ তুলে সজীবকে দেখে আবার চোখ নামিয়ে ফেলল। সজীব আফজাল সাহেবকে বলল,
‘ এই কোচিং সম্পর্কে কতটুকু জানেন?। আফজাল সাহেব বললেন,
‘ মেয়ে যতটুকু বলেছে ততটুকু।
‘ আচ্ছা।
চ্যাত করে টান দিয়ে ফরম থেকে একটি কাগজ ছিঁড়ল সজীব। আফজাল সাহেবের দিকে বাড়িয়ে দিল। বলল,
‘ আপনার মেয়েকে কোচিংয়ে ভর্তি করিয়েছেন এখানেই কিন্তু সব শেষ নয়। এখানেই সব শুরু। আমরা টিচাররা আপনার মেয়েকে টিচ দেব মাত্র তিনঘন্টা। বাকি একুশ ঘন্টা থাকবে আপনাদের দায়িত্বে। আমরা পড়া দেব, শিখিয়ে দেব, বুঝিয়ে দেব কিন্তু পড়া শিখে আসা, হোমওয়ার্ক রেডি করা এন্ড বাকি সব কাজ আপনাদের উপর। তিনঘন্টার কফিয়ত আপনারা নেবেন আমাদের কাছ থেকে। আর বাকি একুশ ঘন্টার কফিয়ত আমরা নেব আপনাদের কাছ থেকে। যদি দিতে পারেন তবেই এডমিশন সাকসেস।
আফজাল সাহেবের ভীষণ ভালো লাগল এই সোজাসাপ্টা কথা বলা ছেলেটাকে। মেয়ে হিসেবে মায়াকে নিয়ে কোথাও একটা ভয় ছিল এই কোচিংয়ে ভর্তি করা নিয়ে, ভয়টা ও কেটে গেল মুহূর্তে। তিনি হেসে বললেন,
‘ সহমত।
সজীব আওয়াজ করে নিজের স্বাক্ষর বসিয়ে এডমিশন ফরম ধরিয়ে দিল আফজাল সাহেবের হাতে। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে যেতে যেতে মায়াকে বলল,
‘ আপনি আমার সাথে আসুন।
আবার থেমে গেল। জিজ্ঞেস করল,
‘ কি নাম বলেছিলেন?
মায়া ভড়কালো। তোতলাতে তোতলাতে বলল,
‘ মুমতাহিনা জান্নাত মায়া।
সজীব হাঁটা ধরল। একটি ক্লাসরুমে ডুকে পড়ল। স্টুডেন্টদের হৈচৈ বন্ধ হয়ে গেল মুহূর্তেই। সজীব হোয়াইট বোর্ডের কাছে দাঁড়িয়ে ডাকল
‘ মিস. মায়া এখানে চলে আসুন।
মাথা নিচু অবস্থায় ভয়ে ভয়ে পা রাখল মায়া। গায়ে পেঁচানো শালটা আর ও শক্ত করে ধরে সে ক্লাসরুমে ডুকে পড়ল। দোটানায় পড়ে গেল কোথায় গিয়ে বসবে। একেবারে পেছনে চোখ গেল।
পেছনের সিটটাতে গিয়ে ব্যাগ রেখে বসে পড়ল সে। কিছুক্ষণের মধ্যে চলে এল আরও একটা মেয়ে। বেশ চটপটে। মায়াকে বলল, ওইপাশে যাও। আমি এপাশে বসব। নতুন নাকি?
মায়া উপরনিচ মাথা নাড়াল। নীতু অবাক হলো।
‘ মেয়েটি কি বোবা নাকি?
জিজ্ঞেস করল নীতু।
‘ কি নাম তোমার?
মায়া বলল,
‘ মুমতাহিনা জান্নাত মায়া।
মার্কার পেন ছুটে আসল নীতুর দিকে। মাথায় হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল সে। কপালের পাশ ঢলতে ঢলতে সজীবকে বলল,
‘ স্যরি, স্যরি সো স্যরি স্যার। আর হবেনা।
মায়ার বুক ধড়ফড় করে উঠল।
‘ স্যারটাকে ভীষণ ভালো মনে হয়েছিল। বাপরে বাপ যে রাগ।
সজীব গলা ভেসে আসল।
‘ মিস. মায়া আপনি নতুন। পরিচিত হয়ে নেবেন ক্লাস শেষ হওয়ার পরে। এখন ফুল কনসেনট্রেশান দেবেন ক্লাসে। বুঝতে পেরেছেন?
মায়া দাঁড়িয়ে পড়ে মিনমিন করে বলল,
‘ ইয়েস স্যার।
নীতু চিমটি বসালো মায়ার হাতে।
‘ শয়তানি তোর জন্য বকা খেলাম।
অবাক না হয়ে হেসে দিল মায়া। মায়ার বোকাসোকা হাসি দেখে হাসল নীতু ও। হাঁফ ছেড়ে বাঁচল মায়া। যাক একজন বন্ধু পাওয়া গেল।
সজীব আবার ডাক দিল।
‘ মিস মায়া. টুডেস ক্লাস টপিক এপ্রোপ্রিয়েট প্রেপোজিশন।
আবারও বুক কাঁপল মায়ার। উফফ আর গ্রামার চোখে দেখল না স্যারটা। শেষমেশ এপ্রোপ্রিয়েট!
মায়ার চোখেমুখে খেলে গেল বিরক্তি। ব্ল্যাক মার্কার দিয়ে হোয়াইট বোর্ডে কষকষ করে লিখে ফেলল সজীব।
Abide by মিনস মেনে চলা
Abide in মিনস বাস করা, এগেইন
Abide with মিনস সঙ্গে থাকা
ফর এক্সামপল
I shall Abide by your decision.
I Abide in Dhaka
She abides with me.
তারপর স্টুডেন্টদের খাতার দিকে তাকিয়ে এপাশ ওপাশ হাঁটতে হাঁটতে বলল,
ইউজিং দ্য রং প্রেপোজিশন কজেস দ্য সেন্টেন্স টু গো রং।
সো উই নিড টু বি এওয়ার অপ দি ইউজ অফ দিস এপ্রোপ্রিয়েট প্রেপোজিশন এন্ড প্রেক্টিস ইট মোর এন্ড মোর। আন্ডারস্ট্যান্ড মিস. মায়া?
মায়া লিখা থামিয়ে দিল। চোখ তুলে তাকাতেই সজীব বলল,
‘ সরি। আন্ডারস্ট্যান্ড এভরিওয়ান?
সবাই সমস্বরে বলে উঠল,
‘ ইয়েস স্যার।
সজীব আবার ও ব্ল্যাকবোর্ডের কাছে গেল। কষকষ করে আবার ও লিখে বিষবাক্য। মায়ার কাছে তাই মনে হয়। একগাদা পড়া আর হোমওয়ার্ক দিয়ে ক্লাসের সমাপ্তি টানল সজীব। হাফঁ ছেড়ে বাঁচল মায়া। ব্যবসা শিক্ষার স্টুডেন্ট হওয়ায় ফিন্যন্স ক্লাস করার জন্য বসে থাকতে হলো। তৌহিদ স্যার এলেন। ভীষণ মজার মানুষ। হাসিঠাট্টার ছলে ছলে ম্যাথ বুঝালেন। মায়ার ভীষণ ভালো লাগল স্যারের ক্লাস। তারপর আর ও একজন স্যার এল, সজীবের সমবয়সী। মনির স্যার।
একাউন্টিংয়ের ক্লাস নিয়ে চলে গেল। ডেবিট ক্রেডিট জপতে জপতে বাড়ির উদ্দেশ্যে পা রাখল মায়া। হেঁটে যাওয়া যায় বাড়িতে। তাই মায়া হাঁটা ধরল। হাঁটতে হাঁটতে জপল
‘ Abide by মিনস মেনে চলা
Abide in মিনস বাস করা,
Abide with মিনস সঙ্গে থাকা
এই রাগী স্যারটার পড়া শিখতে হবে সবার আগে। যেকরেই হোক।
কলেজ থেকে ফিরে ভাতঘুম দিলনা মায়া। সময়মতো নামাজটা পড়ে রাতদিন একাকার করে শিখল পড়া। মায়ার মা মাজেদা খুশি হলেন মেয়ের পড়াশোনা দেখে। মায়ার বড়ভাই মিজান এসে জিজ্ঞেস করল কোচিংয়ের পড়া কেমন লেগেছে। মায়া বলল
কোচিং মানেই মনেহচ্ছে প্যারা।
তারপরের দিন যথাসময়ে কোচিং পৌঁছালেও ক্লাস শুরু হয়ে গিয়েছিল। হাত পা ঠান্ডা হয়ে গিয়েছে মায়ার। সজীবের গলার আওয়াজ ভেসে আসছে ক্লাস থেকে। ক্লাসের বাইরে দাঁড়িয়ে মায়া জিজ্ঞেস করল
‘ মে আই কাম ইন স্যার?
লেকচার থামিয়ে সজীব দেখল মায়াকে। বলল,
‘ নো। আপনি দেরি করে এসেছেন কেন? পাঁচ মিনিট লেট।
মায়া বিড়বিড় করল,
‘ পাঁচ মিনিট নাকি লেট?
মিনমিন করে বলল মায়া।
‘ আর হবেনা স্যার।
সজীব বেশ খানিক্ষন পর সময় নিয়ে বলল,
‘ কাম ইন। ফার্স্ট বেঞ্চে বসুন।
মায়া নীতুকে খুঁজল। দেখা গেল না। একরাশ মন খারাপ নিয়ে বসল। সজীব মাঝখান থেকে আঙুল দিয়ে ইশারা করে নীতুকে ডাকল।
‘ নীতু ফার্স্ট বেঞ্চে চলে আসো। মায়ার পাশে এসে বসো।
মায়া নীতু দুজনই খুশি হলো। মায়া বুঝে পেলনা এই ফার্স্ট বেঞ্চে কেউ আগে বসল না কেন?
পড়ায় চোখ বুলানোর সুযোগ না দিয়ে সজীব পড়া নিতে গেল মায়ার কাছে। নীতু ঢুলে ঢুলে পড়া শিখতে লাগল।
মায়া কাঁদোকাঁদো মুখে আল্লাহকে ডাকল।
‘ আল্লাহ এইবারের মতো। এইবারের মতো বাঁচিয়ে দাও আমায়।
পান্তাভাতের মতো সহজ করে শিখা পড়াগুলো গরমভাতের মতো উত্তপ্ত মনে হলো মায়ার। কয়েকটা বলে আর বলতে পারল না মায়া। সজীব বলল,
‘ নতুন হিসেবে পানিশমেন্ট দিচ্ছিনা। তবে দাঁড়িয়ে থাকুন।
মায়ার মুখ কালো হয়ে গেল। সজীব নিতুর কাছ থেকে পড়া নিল। কোনোমতে বলল নীতু। সজীব পেছনের টুলে গেল। পড়া নিল। তারপরের টুলে গেল।
মায়ার মনে হলো মেয়েটি যা বলছে তা বেশিরভাগই ভুল বলছে কিন্তু স্যার ধরতে পারছেনা কেন? আশ্চর্য হলো মায়া? স্যারের মন কোথায়?
পিছু ফিরে সজীবকে চাইল মায়া। সজীব বইয়ে চোখ দিল। বলল,
‘ সিট ডাউন।
চোখফেটে জল পড়ার অবস্থা হলো মায়ার। ভুলভাল বলেছে মেয়েটা তাকে বসিয়ে দিল?
নীতুকে চিমটি বসালো মায়া।
‘ ওই মেয়েটা ভুল বলেছে না?
নীতু বলল,
‘ কে জানে? হয়ত তোর মাথা গিয়েছে নয়ত স্যারের।
হাতের মুঠি দিয়ে বেঞ্চে ধুপধাপ মারতে লাগল মায়া। ক্ষীণ আওয়াজ হচ্ছে, সেই আওয়াজ পৌঁছানো সম্ভব নয় একদম পাঁচ বেঞ্চ পেছনে দাঁড়ানো ছেলেটার কানে। কিন্তু এই অসম্ভবটা সম্ভব হলো। মায়া পিছু ফিরতেই আবার সামনে ফিরে গেল চট করে। স্যার তার কান্ড দেখছিল? আল্লাহ আল্লাহ কি হচ্ছে এসব? কি করলিরে মায়া
নীতু বলল,
‘ তুই ভাই হাসিস ও না। কাঁদিস ও না। নড়িস ও না চড়িস ও না। তুই মায়ার উপর ছায়ার মতো নজর রাখিতেছে আমাদের ইংরেজি মাস্টার।
মায়া হাত মোচড়াতে মোচড়াতে বলল,
‘ নীতু কি বিড়বিড় করছিস? স্যার আমাকে বসতে কখন বলবে?
নীতু বলল,
‘ পড়া নেয়া শেষ হোক। তুই বসে গেলে পেছন থেকে কি তোকে দেখা যাবে?
মায়া নীতুর মাথায় চাটি মারল। আবার পিছু ফিরে সজীবের চোখ দেখে ভড়কে গেল। কাঁপা-কাঁপা কন্ঠে বলল,
‘ নীতু স্যার আজকে আমায় মেরেই ফেলবে। তোকে মেরেছি দেখে ফেলেছে।
নীতু গালে হাত দিয়ে বলল,
‘ দেখছিরে বইন কে কাকে মারল।
মায়া কিছু বুঝল না।
পড়া নিয়ে পড়া দিয়ে চলে গেল সজীব। মায়াকে বসতে বলল না। আর ও বলে গেল,
‘ নেক্সট ক্লাসের স্যার আসা অব্ধি দাঁড়িয়ে থাকবেন।
মায়া ভেতরে ভেতরে ফুঁসল।
অফিসে গিয়ে মার্কার পেন জায়গামতো রেখে চেয়ারে বসে পড়ল সজীব। উচ্চস্বরে হেসে উঠল নিজে নিজে। আশেপাশের সবাই হতবাক। মনির বলল,
‘ তোর কি মাথা গেছে ভাই?
সজীব হাসি থামানোর চেষ্টা করতে করতে বলল,
‘ কিছুই হয়নি তো। তোদের জন্য কি হাসতে ও পারব না? আশ্চর্য!
সজীব বের হয়ে গেল অফিস থেকে। পকেটে ফোন রেখে অফিস থেকে বের হতেই কানে এসে বাজল,
‘ তুই দেখিস নীতু। এই কোচিং-এ আমি আর পড়ব না। কোনোমতে একমাস পড়ে পল্টি দেব। মাথা খারাপ হয়ে গেল আজ। স্যার আমার সাথে অন্যায় করল।
গলা খাঁকারি দিল সজীব। মায়া সেখানে দাঁড়িয়ে পড়ল। চোখদুটো বড় বড় হয়ে গেছে। হাত পা কাঁপছে। গলা শুকিয়ে এসেছে। নীতু লাগাল একদৌড়।
‘ আমার দেরী হয়ে যাচ্ছে মায়া। তুই আয়।
মায়া নতজানু হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। পায়ের নখ দিয়ে জুতো কুটছে।
সজীব বলল,
‘ পানিশমেন্ট বরং কাল দিই।
মায়া হকচকিয়ে তাকাল। আবার ও চোখ নামিয়ে ফেলল। মিনমিন করে বলল,
‘ সরি স্যার। আসলে,
সজীব গম্ভীরমুখে বলল,
‘ সরিতে কাজ হবেনা। পানিশমেন্ট চলবে কাল।
মায়া দাঁড়িয়েই থাকল।
সজীব চলে গেল। ঠোঁটের কোণায় মৃদু হাসির ছটা।
_________
প্রথম পরিচ্ছেদ,
সজীব আর কথাকে একসাথে ছাদ থেকে নামতে দেখল হালিমা বেগম। হামান দিস্তায় পান ধুঁকে চামচে করে তা গালের ভেতর দিয়ে তিনি ডাকলেন,
‘ এই ছোট নাতজামাই এখানে আসো। আমার পাশে এসে বসো।
সজীব কথার দিকে তাকাল।
কথা সরে গেল।
সুমন বসে রয়েছে হালিমা বেগমের অপরপাশে। সজীব গিয়ে হালিমা বেগমের পাশে গিয়ে বসল। দৃষ্টি মেঝেতে। হালিমা বেগম বাকি পানটুকু হামান দিস্তায় ধুঁকতে ধুঁকতে বলেন,
‘ একটা প্রশ্ন করি তোমাদের দুজনকে। যে বলতে পারবে তাকে পান খাওয়াবো। আর যে পারবেনা তাকে লাঠির বাড়ি দেব একটা।
সুমন চলে যেতে চাইল। হালিমা বেগম ডাক দিল। এই মিয়া যাও কই? বসো চুপচাপ।
সুমন আবার বসে পড়ল।
হালিমা বেগম প্রশ্ন করলেন,
‘ তোমরা বাচ্চা নিবা কবে? এই বাড়িতে কি বাচ্চাকাচ্চা আসবেনা?
সুমন কেশে উঠল। খুকখুক করে কাশতে কাশতে সে বলল,
‘ আমাকে একটা লাঠির বাড়ি দেন। আমি চলে যায়।
মোতালেব শেখ ঠোঁট টিপে হাসলেন।
সুমন লাঠির বাড়ি খেয়ে পালালো।
হালিমা বেগম সজীবের দিকে তাকালেন।
‘ তুমি কবে নিবা?
সজীব নিচু করা মাথা উপরে তুলল না আর।
‘ ছিঃ এসব কেমন কথা?
হালিমা বেগম লাঠি খুঁজলেন মারার জন্য। কিন্তু খুঁজে ফেলেন না।
কথা লাঠি দেখিয়ে হালিমা বেগমকে ইশারায় বুঝাল।
‘ লাঠি দিয়ে তোমাকে একটা দেব? কেমন লাগে তারপরে বুঝবে।
হালিমা বেগম বললেন,
‘ ওররে আমার জামাই দরদীরে। লাঠি নিছস তয় কি হইছে? আমি ওর কান ধরতে পারিনা?
কথা দৌড়ে এল। সজীবের হাত টানতে লাগল। সজীব উঠে গেল। সজীবকে নিয়ে যেতে যেতে কথা মুখ ভাঙাল হালিমা বেগমকে।
হালিমা বেগম হাসলেন শুধু।
চলবে,
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদে অতীত দেখানো হবে।