চুপকথার_গল্প #পর্ব_১৪

0
899

#চুপকথার_গল্প
#পর্ব_১৪
#পুষ্পিতা_প্রিমা

ঝিরিঝিরি বৃষ্টি মাথায় নিয়ে সেদিন সাড়ে এগারোটার দিকে সিলেট থেকে ফিরল সজীব। কাউকেই জানায়নি সে ফিরবে। মারজিয়া তাকে দেখে চুলায় ভাত বসালেন। ছেলেটা কি ঠান্ডা ভাত খাবে? কথা তখন ঘুমিয়ে পড়েছে। সজীব দরজা ঠেলার সাথে সাথে দরজা খুলে গেল। এই মেয়েটার বদঅভ্যাস এখনো ঠিক হয়নি। দরজা খুলে ঘুমোনোর অভ্যাসটা সাড়বে কখন?
কথা গুটিসুটি মেরে ঘুমোচ্ছে। সজীব চেন্জ করে মুখহাত ধুঁয়ে নিল। মারজিয়ার ডাক ভেসে আসছে নিচ থেকে। সজীব তো খেয়ে এসেছে। সজীব নিচে গেল। মারজিয়াকে বলল,
‘ আমি খেয়ে এসেছি। আপনি শুধুশুধু এসব করছেন। যান ঘুমিয়ে পড়ুন।
মারজিয়ার মন খারাপ হলো। ছেলেটা তাকে আম্মা ডাকেনা। আপনি আপনি করে বলে। নিজের জঠর থেকে জন্ম না দিলে আসলেই মা হওয়া যায়না। মারজিয়া মন খারাপ হতে দেখে সজীব ঘরে গিয়ে শপিং ব্যাগটা নিয়ে আবার নিচে নেমে এল। মারজিয়ার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
‘ আপনার জন্য, মিঃ শেখের জন্য আর কথার আপুর জন্য এনেছি।
মারজিয়া সাথেসাথে জিজ্ঞেস করল।
‘ কথার জন্য?
সজীব মাথা নামিয়ে বলল
‘ জ্বি, এনেছি। ওরটা ঘরে।
মারজিয়া খুশি হলো। সজীবের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,
‘ ভাত দুটো করে খাও। রেঁধেছি কষ্টকরে। সেই কখন খেয়েছ, পেটে আছে। আসো দুটো করে খাও শুধু। বসো আমি দিচ্ছি।
মা জোর করলে অনিচ্ছাস্বত্ত্বে ও খেতে হতো সজীবের। আজ আর ও একটা মায়ের আবেদন ফেলতে পারল না সে। মায়ের কথা মনে পড়ছে খুব। কেন মা এত একা করে চলে গেল? গালভরে সে আম্মা ডাকেনা কতদিন? মায়ের বকুনি শোনেনা কতদিন। মায়ের আদর খায়না কতদিন। মায়ের কোলে মাথা রেখে ঘুমায়না কতদিন। দুনিয়ার এত কঠিন নিয়ম কেন? চলেই যখন যাবে এত টান তৈরি হয় কেন? মায়া মমতায়, ভালোবাসার জালে আটকে ফেলে উপরওয়ালা আবার কেড়ে নেয় কেন? ভালোবাসার মানুষগুলো থেকে গেলে কি হয়?
মারজিয়া নিজ হাতে খাইয়ে দিল সজীবকে। বলল,
‘ আমি খাওয়ায়। তোমার মা নাকি তোমাকে খাইয়ে দিত।
সজীব একদৃষ্টে চেয়ে থাকে মারজিয়ার দিকে। ভাত গালে নিয়ে বসে থাকে। মারজিয়া মাথা নিচু করে ভাত মাখতে মাখতে বলে,
‘ খাও।
সজীব গাল নাড়িয়ে খেল। খাওয়া শেষ হলো। মারজিয়া বলল,
‘ তোমার শ্বাশুড়ি না আমি৷ মা ডাকতে পারো। আর তোমার শ্বশুরকে বাবা। তোমার ইচ্ছা। জোর নেই।
সজীব চলে যেতেই যাচ্ছিল। মারজিয়া বলল,
‘ কাল তোমার আম্মার কবরটা জিয়ারত করে আসিও।
সজীব বলল,
‘ আচ্ছা।
আর তোমার বাবারটা? একদিন গ্রাম থেকে ঘুরে আসিও।
সজীব বলল,
‘ কথা যাবে?
মারজিয়া খুশি হলো। কথাকে নিয়ে যাওয়ার কথা বলবে তিনি ভাবেননি। বললেন,
‘ আমি বলব যাওয়ার জন্য।
সজীব বলল,
‘ ও যাবেনা। বলার দরকার নেই।
মারজিয়া বললেন,
‘ আচ্ছা।
সজীব চলে গেল। মারজিয়া হাসল। বউয়ের উপর রেগে আছে নাকি?

___

কথা তখনও বেঘোর ঘুম। বাইরে বৃষ্টি এখনো থামেনি। সজীব কাচ খুলে দিল। ঠান্ডা বাতাস আসছে। কথা এসি বন্ধ করে ঘুমোচ্ছে। সজীব ঘরের লাইট জ্বালিয়ে দিল। যদি কথার ঘুম ভাঙে। না ঘুম ভাঙল না। কথাকে ডাকল ও না সে। পাশে গিয়ে শুয়ে পড়ল। কথার নড়াচড়া টের পেয়ে সে ফিরল কথার দিকে। কথা চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে। অস্বাভাবিক নয় কিছু। স্বাভাবিক চাহনি। সজীবের এখানে থাকাটা স্বাভাবিক। কথা এক হাত বাড়িয়ে সজীবের গাল ছুঁল, নাক,কপাল, ঠোঁট। না এ তো সত্যি সত্যি। সজীব কথার কান্ড দেখল চুপচাপ। কথা হাত নিয়ে ফেলল দ্রুত। ওপাশ মুখ করে শুয়ে থাকল। মানুষটা কখন এসেছে? আসবে তাকে জানানোর প্রয়োজন মনে করেনি। আজ ও মানুষটার কেউ হয়ে উঠতে পারলনা কথা। প্রিয়জন হওয়া এত সহজ নয়। কথা হয়তো তা কখনো পারবেও না। প্রিয় মানুষের স্মৃতি সহজে ভুলার নয়। প্রিয় মানুষগুলো হারিয়ে যায় ঠিকি, কিন্তু স্মৃতিগুলো ভীষণ পুড়ায়। কি করবে কথা? পারেনা সহ্য করতে, পারেনা মানিয়ে নিতে। হিংসে নামক বস্তুটি আঁকড়ে ধরে তাকে৷ মায়া মেয়েটি কি মায়া করল এই মানুষটাকে ?
যে হারিয়ে গিয়েছে কিন্তু নিজের অস্তিত্ব বপন করে দিয়ে গেছে মানুষটার মধ্যে।
সজীব কথার কিছুটা কাছাকাছি গিয়ে শুয়ে পড়ল। বলল
‘ কথা তোমার জন্য শাড়ি এনেছি।
কথা ফিরল না। বলল
‘ হুম।
সজীব বলল
‘ কাল গ্রামের বাড়ি যাব।
কথা বলল
‘ ঠিক আছে।
সজীব বলল
‘ তুমি আমার সাথে এভাবে কেন কথা বলছ?
কথা বলল
‘ আমার ঘুম পাচ্ছে।
সজীব আর বিরক্ত করল না কথাকে। সোজা হয়ে শুয়ে থাকল। চোখের উপর হাত। কিছুক্ষণের মধ্যে কথার মাথা উঠে এল তার বুকের উপর। বিড়বিড় করল কথা। স্পষ্ট না সে ভাষা। সজীব এক হাত দিয়ে রাখল কথার পিঠের উপর। ঘুম নামল চোখে।

________

সকাল দশটার দিকে গ্রামের উদ্দেশ্যো রওনা দিল সজীব। সাথে কথা। মনে হচ্ছে বহুদিন পর যেন কাকে দেখতে যাচ্ছে। কত আশা নিয়ে তার পথ চেয়ে আছে কেউ একজন। দুরুদুরু বুক নিয়ে সজীব গাড়ি থেকে নেমে হাঁটা ধরল গ্রামের দিকে। পথ,ঘাট,মাটি,বায়ু যেন সব চেনে সজীবকে। ঠান্ডা হাওয়া বইছে। তার হাতের মুঠোয় কথার হাত। কথা চেয়ে তার দিকে। গ্রামকে যেন গিলে খাচ্ছে সে চোখ দিয়ে। কাকে যেন খুঁজছে।
কয়েকটা কলেজের স্টুডেন্ট দাঁড়িয়ে পড়ল তাকে দেখে।
সালাম দিল।
কেমন আছেন স্যার? এটা কি আমাদের ম্যাডাম? গ্রামে কতদিন থাকবেন?
এ জাতীয় প্রশ্ন ছুঁড়ল। সজীব তাদের প্রশ্নের উত্তর দিয়ে ছুঁটল বাড়ির দিকে। বাড়িটার উঠোনে জমা পড়েছে গাছের পাতা। কেমন জীর্ণশীর্ণ হয়ে আছে। ঘরের দরজার কাছে শুয়ে আছে একটি কুকুর। যেন পাহারাদার সে এই বাড়ির। সজীব বাড়িটার দিকে তাকিয়ে রইল একদৃষ্টে। দরজা খুলে হাসিমুখে আম্মা বের হয়ে আসল না। খুশি হয়ে ডাকল না,
‘ আব্বা! এই সজীব আয় বাবা ভেতরে আয়।
সজীব তাকিয়ে থাকল দরজার দিকে। মনে হলো কেউ দাঁড়িয়েছে আছে এলোমেলো শাড়ি গায়ে। তাকে দেখে মুচকি হেসে বলল,
‘ আমার জন্য চকলেট এনেছেন? না আনলে আজ ঘরে ডুকতে দেবনা।

কথা চাইল সজীবের দিকে। চোখের কোণা টলমলে সজীবের। কথা চোখ ফিরিয়ে নিল। সজীব এদিকওদিক তাকিয়ে দেখল যেখানে আম্মা করলা গাছ লাগাত, নানান ধরণের সবজি গাছ লাগাত। নেই গাছগুলো, কিছুই নেই। আম্মা নেই, তাই কিছু নেই। সজীব বিড়বিড় করল
‘ আম্মা তুমি না গেলে ও পারতে। শ্বাশুড়ি বউ মিলে প্ল্যান করে চলে গেলে আম্মা। আর আমাকে রেখে গেলে। তোমাদের অভাব আমাকে বড্ড কষ্ট দেয় আম্মা। বড্ড পুড়ায়। আর আমি আমার সাথে কথাকে পুড়ায়। আমি ভালো নেই আম্মা। আমি ভালো থাকতে পারছিনা। কথাকে ভালো রাখতে পারছিনা। তোমার আর মায়াকে ভীষণ মনে পড়ে। ভীষণ।

চাবি দিয়ে দরজা খুলতে গেল সজীব। তালাটাতে ময়লা জমেছে। খুলতে ভীষণ কষ্ট হলো। এবার নতুল তালা লাগিয়ে দিয়ে যাবে।
ঘরের ভেতর ডুকতেই চারপাশ হাহাকার। কথা সজীবের দিকে তাকিয়ে তাড়াতাড়ি সব জানালা দরজা খুলে দিল। বাড়িটা আলোকিত হয়ে উঠল।
রান্নাঘর থেকে সেই টুংটাং শব্দ ভেসে এলোনা। না ভেসে এল মায়ের সেই ডাক।
‘ আব্বা খেতে আয়। আজ তোর পছন্দের রান্না করেছি।
সজীব হেঁটে হেঁটে গেল রান্নাঘরে। মাথায় হাত দিল সজীব। ব্যাথা হচ্ছে ভীষণ। আম্মা কেন নেই? কেন নেই আম্মা? আম্মা ভীষণ পাষাণ, মায়াবিনীর মতো। বড্ড নিষ্ঠুর।
সজীব কথাকে নিয়ে গেল নিজের ঘরে। দরজা ঠেলে ডুকে লাইট জ্বালিয়ে দিতেই ঘরের দেয়ালে দেয়ালে ফুটে উঠল মায়ার ছবি। একটা জায়গা ও খালি নেই।

মায়ার মারা যাবার পর প্রায় তিনমাসের মতো সজীব ঘরবন্দী ছিল। তখন তার রোজকার কাজ ছিল মায়ার ছবি দিয়ে ঘর সাজানো। মায়ার বাড়ি থেকে অনেক ছবি নিয়ে এসেছিল সে। পুরো ঘরটা মায়া মায়া। কথা ঘুরে ঘুরে দেখল। মায়া আর সজীবের বিয়ের ছবি। ঘুরতে যাওয়ার ছবি। মায়ার ফুচকা খাওয়ার ছবি। সজীবের সাথে দুষ্টুমিষ্টি খুনসুটির ছবি। কি সুন্দর মানিয়েছে মেয়েটাকে সজীবের সাথে!
কত শত স্মৃতি! কথা ভাবে মানুষটা বেঁচে আছে কেমনে? এত এত কষ্ট নিয়ে মানুষটা তারসাথে ভালো থাকার চেষ্টা করে কি করে? নিজেকে উচ্ছিষ্টর মতো লাগলো কথার। এই দুজনের ভালোবাসা কেন এত তাড়াতাড়ি হারিয়ে গেল? এমন ভালোবাসাগুলো দেখতে ও ভালো লাগে। এমন ভালোবাসাগুলো হাজার হাজার বছর বেঁচে থাকুক। ম্লান না হোক। কথা মায়াকে বাঁচিয়ে রাখবে সজীবের মনে। হারাতে দেবেনা। নইলে ভারী অন্যায় হবে সজীবের সাথে। কথা হয়ে উঠবে মায়া। যাতে মায়ার স্মৃতি গুলো না হারিয়ে আর ও জীবন্ত হয়ে থাকে সজীবের সামনে। সজীবের মনে হয় মায়া হারায়নি। মায়া থাকে তার আশেপাশে।
সজীব পেছনে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে দেখল মায়া আর তার সেই বিয়ের ছবি। বিয়ের দিন কনের মুখ থাকে লজ্জামাখা। মায়ার ও ঠিক সেই অবস্থা।
সজীব হাত বুলিয়ে দিল সেই ছবিতে। কথার দিকে তাকালো। কথার টলমলে চোখে তাকালো তার দিকে। সজীব এগিয়ে গেল কথার দিকে। হাত আবার ধরে বের হলো ঘর থেকে। বাড়ি থেকে বের হয়ে আবার তালা ঝুলিয়ে দিল। এ বাড়ির মায়া তাকে ছাড়তে হবে। ছাড়তে হবে।

সজীব গেল সেই কোচিং সেন্টারে। পা দিতেই যেন সব স্মৃতি ভেসে উঠল চক্ষুেপটে। মায়ার সাথে তার প্রথম দেখা। সেই ভীতিকর চাহনি। সবটা। কোচিং সেন্টারটির এখন আগের মতো নামডাক নেই। মায়ার মতো কেউ আর পড়তে ও আসেনা। কারণ এখন এই কোচিং এ সজীব আসেনা। সজীব আসেনা তাই মায়া ও আসেনা। প্রেমে ও পড়ে না কেউ কারো। বড্ড ভয় ভালোবাসায়। বড্ড যন্ত্রণা। বড্ড কষ্ট।

কথা দেখল সেই কোচিং। এই কোচিংই তাহলে সেই প্রেমের বাগান! যেখানে ফুল ফুটেছিল আবার সেই ঝড়ে গিয়েছিল!
সজীব কথাকে নিয়ে গেল একটি রুমে।
কথা ফার্স্ট বেঞ্চে বসল। সজীব দেখল বেঞ্চটা। মায়া বসত এই বেঞ্চে। মেয়েটা একদম অবুঝ ছিল, কিভাবে তার নাম আর নিজের নাম লিখে বরবাদ করে ফেলল বেঞ্চটা।
কালো কলমের দাগ। লাভ শেপের ভেতর লিখা সজীব প্লাস মায়া। মায়া প্লাস রাগী টিচার। সজীবের দেখাদেখি কথা ও দেখল। সবখানে সজীবের নাম লিখা। কি পাগল ছিল মেয়েটার! বেশি ভালোবাসতো রাগী টিচারকে! খুব বেশি! কথার চাইতে ও বেশি! তাহলে ছেড়ে গেল কেন? হারিয়ে গেল কেন? কেন মানুষটাকে এভাবে নিঃস্ব করে চলে গেল? কথার আর সহ্য হয়না মানুষটার কষ্ট।

কয়েকজন টিচার এল। কথা বলল সজীবের সাথে। সজীব বলল,
‘ কোচিংটা যাতে আবার ও শুরু হয়। যারা এখন বেকার আছে তাদের ও আয়ের সুযোগ হবে। সজীব আর ও বলল
‘ এই বেঞ্চটা যাতে এরকম থাকে। কোথাও যাতে না সরায়।
সজীব কথাকে নিয়ে আবার ও হাঁটা ধরল। গেল মায়ার বাড়িতে। আফজাল হোসেন আর মাজেদা কেঁদে উঠল সজীবকে দেখে। সজীব মাথা নামিয়ে দাঁড়িয়ে থাকল। কথাকে দেখে ঝাপটে জড়িয়ে ধরল মাজেদা। হাত বুলিয়ে ঘনঘন আদর করে দিয়ে বলল,
‘ কতদিন মেয়েটাকে ছুঁইনা। আদর করিনা। একদম স্বার্থপরের মতো চলে গেল আমাদের ছেড়ে। আমাদের কথা ভাবেনি, ছেলেটার কথা ও ভাবেনি। ছেলেটাকে ভেঙেছুড়ে দিয়ে চলে গেল হারামি।
কথার চোখে ও জল। ভাবল সে, একটা মেয়ে কতগুলো মানুষকে নিঃস্ব করার ক্ষমতা রাখে?
মাজেদা রান্না বসালো কথা আর সজীবকে। কাজ করে আবার কাঁদে। পুরোটা সময় কাঁদল। মায়া মায়া করে। কথা চোখ মুছে দিল। রান্নায় সাহায্য করল। মাজেদা বলল,
‘ ছেলেটাকে ভালো রেখো মা। আমি তাকাতে পারিনা ওই ছেলের দিকে। হাহাকার করে বুকটা। তার মা টা ও তাকে ছেঁড়ে চলে গেল। তুমি ছাড়া এখন ওর পাশে কেউ নেই। তাকে কখনো ভুল বুঝোনা। পাশে থেকো। আগলে রেখো মা।
কথার গাল বেয়ে জল গড়ালো। মায়া দোষী। ভীষণ দোষী। কেন ছেড়ে চলে গেল? কেন সবাইকে এত কষ্ট দিল?
মাজেদা নিজ হাতে খাওয়ালেন কথাকে। মাথায় তেল দিয়ে চুল আচঁড়ে দিয়ে দিয়ে কাঁদলেন। বললেন,
‘ আমি মাথায় তেল দিয়ে দিলে মেয়েটা নাক ছিটকাতো। মাথায় তেল দিতে চাইতোনা একদম। এত পাজি মেয়ে ছিল।
কথা চুপচাপ শুনল সবটা। ইশশ মেয়েটা কি এসব দেখছে? তাকে তার প্রিয়জনগুলো কত ভালোবাসে? দেখছে?
সন্ধ্যার দিকে বাবার কবরের দিকে গেল সজীব। কথা দূরে দাঁড়িয়ে ছিল। বাবার কবর জিয়ারত করালো সজীব। কবর ছুঁয়ে বলল,
‘ আব্বা তোমার পাশে মাকে আমি দিতে পারিনি। আমায় ক্ষমা করো আব্বা। আমি এতটাই ভেঙ্গে পড়েছিলাম আমার হুশ ছিলনা। আমায় ক্ষমা করো আব্বা।
সজীব বাবার কবরের পাশ থেকে একমুঠো মাটি নিল একটি পলিথিনের প্যাকেটে। মায়ের কবরের পাশে ফুলগাছে দেবে এই মাটি।

আফজাল সাহেবের অনুরোধে মায়াকে তাদের বাড়ির সামনে মসজিদের পাশেই দাফন করা হয়। যাতে মেয়েকে তিনি রোজ মসজিদের গেলে দেখতে পান। মাজেদা ও দেখতে পায়। মায়ার কবরে গেল সজীব। কবরের আশেপাশে ফুলের গাছ লাগিয়েছে মিজান আর আফজাল হোসেন। মেয়ের আর বোনের মাটির ঘরের উপরটা সাজায়। পরিষ্কার, ঝকঝকে করে রাখে তারা। কথার মাথায় সাদা ওড়না প্যাচানো। চোখ দুটো তার অসম্ভব লাল। দূরে দাঁড়িয়ে রইল সে।
কবর জিয়ারত করিয়ে সজীব বসে পড়ল কবরের পাশে। কবরের মাটি হাতে নিতেই চোখ থেকে গরম জল খসে পড়ল। মিশে একাকার হয়ে গেল কবরের মাটিতে। চোখ তুলে একটি গাছ থেকে সে গাঁদা ফুল ছিঁড়ে কবরের একপাশে গেঁথে দিল। বলল,
‘ আমি তোমাকে আজ ও ভালোবাসি মায়াবতী। আজ ও। তোমাকে বোধহয় ভালো না বাসলে আমি নিজেই নিঃশেষ হয়ে যাব। তোমাকে ভালো না বেসে আমি থাকতে পারিনা। তোমাকে ভুলার যতই চেষ্টা করি ততবার তোমার স্মৃতিগুলো আমার মনে পড়ে। চোখের পাতায় ভেসে উঠে। আমার রাতের ঘুম কেড়ে নেয়, আমার কাজের মনোযোগ কেড়ে নেয়। তুমি চলে গিয়েছ ঠিক কিন্তু আমাকে ছিন্নভিন্ন করে গিয়েছ। তারপরও আমি চাই তুমি ভালো থেকো, যেখানেই থেকো ভালো থেকো। আলবিদা প্রিয়তমা। আলবিদা।

কবরের দিকে তাকিয়ে পিছু পিছু হেঁটে সজীব চলে যায়। হাতের মুঠোয় থাকা মাটিগুলো ওই প্যাকেটে ভরে এগিয়ে দেয় কথার দিকে। বলে,
‘ কথা এই মাটি আম্মার কবরের পাশে দেব, তার ঘরের রাণী আর স্বামীর কবরের মাটি। তারা তিনজনই ভালো থাকুক কথা।
বলতে না বলতেই কথার সম্মুখে চোখের জল ছেড়ে দেয় সজীব। গলার ভেতর থেকে কথা আটকে আটকে আসে। কথা ও কেঁদে দিল। মাথা নাড়িয়ে ঘনঘন বুঝাতে চাইল,
‘ কাঁদবেন না। আমি সহ্য করতে পারিনা। আমার সহ্য হয়না আপনার এত কষ্ট।
সজীব আঙুল দিয়ে মায়ার কবর দেখিয়ে দিল। এলোমেলো সুরে বলল,
‘ দেখোনা কথা, ও কিভাবে আরাম করে শুয়ে আছে। কিভাবে শুয়ে আছে কথা। প্রিয়জনকে কাঁদিয়ে এভাবে কেউ ঘুমায়? ঘুমায়? আমি তো পারিনা কথা। তুমি পারবে? পারবে? পারবেনা। কিন্তু ওই মায়াবিনী সব পারে কথা। সব। সে এত মায়া জানে জানলে আমি কখনো তাকে ভালোবাসতে যেতাম না কথা। সে আমার সাথে এত বড় ছলনা করবে জানলে আমি তাকে কখনো ভালোবাসতাম না। ও জানত আমি আমার সবটা দিয়ে ওকে ভালোবাসি। ও জানে। ও জেনেই এমনটা করল।
কথা টিস্যু বের করে গাল মুছে দিল সজীবের। সজীব কথার হাত সরিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল কথাকে। তার চোখের লোনা জলে ভিজে গেল কথার কাঁধ। এই শক্তপোক্ত মানুষটা এভাবে কাঁদতে জানে? কাঁদুক। কেঁদে আজ হালকা হোক ব্যাথা।
সজীব ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল,
‘তুমি ওকে হিংসে করোনা কথা। ও নেই এই পৃথিবীর কোনো প্রান্তে। তুমি ওরজন্য আমার সাথে রাগ করবেনা। আমাকে অবহেলা করবেনা। আমাকে ছেড়ে চলে যাবেনা। ও আর আসবেনা কথা। ও আসবেনা।
কথা ও কাঁদল। সে ভুলের উপর ছিল। মায়াকে হিংসে করবে না সে। আজ থেকে সে নিজেই মায়ার অস্তিত্ব। সজীবের জীবনে সে থাকবে মায়া হয়ে। মায়াকে ভুলিয়ে দিয়ে মায়া হয়ে সে সজীবের কাছে থাকবে। পাশে থাকবে। আগলে রাখবে।

তারপরের দিন শহরে চলে এল কথা আর সজীব। আসার সময় মাজেদার সে কি কান্না! মিাজন আর আফজাল সাহেব ও কাঁদলেন। মাজেদা কথাকে ছাড়তেই চাইলেন না। কথা তাদের সবাইকে শহরে চলে আসতে বললো। মিজানের চাকরি সজীবের কোম্পানিতে। সে ম্যানেজারিং পদে থাকবে। গ্রামের শিক্ষিত যুবকগুলোকেও চাকরির আবেদন করতে বলে আসল সজীব। তার বন্ধুরা ও সব তার আন্ডারেই কাজ করে। কৃতজ্ঞতার শেষ নেই সজীবের প্রতি।

এভাবে চলল আর ও কয়েকমাস। সময় চলতে থাকে তার নিজস্ব গতিতে। থেমে থাকেনা কারো জন্য। কিছুর জন্য। আমরা যে বলি প্রিয়জন মরে গেলে আমরা ও মরে যাব। আমরা ও শেষ হয়ে যাব। আসলে সত্যি এটাই, আমরা মরিনা। আমরা বেঁচে থাকি। আমরা মানিয়ে নিই। আমাদের মানিয়ে নিতে হয়।
কারো জন্য কেউ মরেনা। মরে যায় স্বপ্নগুলো। স্মৃতির কালো পাতায় তা রয়ে যায়। কিন্তু মুছে যায়না।
কথার লড়াই তার প্রাণপুরুষকে ভালো রাখার। ভালোবাসার। যাতে মানুষটা সেই আগের রূপে ফিরে আসে। কথার মাঝে ভালোবাসার মানুষটাকে খুঁজে পায়। পাগলের মতো ভালোবাসা মানুষগুলোর প্রতি আমরা কোনো না কোনো সময় ঠিকই দুর্বল হয়ে পড়ি। ঠিকই তাদের ভালোবেসে ফেলি। সজীব ও তাই। সে কথাকে ভালো না বাসতে ও ভালোবেসে ফেলল। কথার অবহেলায় সে হয় চূর্ণবিচূর্ণ। কথার দুঃখে হয় দুঃখিত। কথার হাসিতে সেও হাসে। কথার চোখে সেই মায়াবী চোখ দুটো খুঁজে পায়। সেই আগের সবকিছু। যার প্রতি শ্বাস প্রশ্বাস তার নাম আওড়াতো। তাকে খুঁজে পায় সজীব। যে তার গালের সাথে গাল লাগিয়ে, বুকের মধ্যিখানে মাথা রেখে বিড়বিড় করত,
‘ আপনি শুধুই আমার।
সজীব ভাবে আবার ও সে ভালোবাসল? কথাকে? কথা ও হারিয়ে যাবে না তো। তাই সে দেখায় না কথার প্রতি তার দুর্বলতা। কথাকে কথায় কথায় বলে,
‘ কথা না বলা পাখি তুমি ভালোবাসার মাত্রা কমাও। আমার ভয় হয়। হারানোর। আমি আর কিচ্ছু হারাতে পারব না। কিচ্ছু না।
কথা হাসে। প্রিয় মানুষের কাঁধে মাথা রেখে তার মনের সাথে ফিসফিস করে,
‘ আমি কম ভালোবাসতে জানিনা। মাত্রা কমাতে জানিনা। আমি শুধু, শুধুই ভালোবাসতে জানি। একটু বেশি, একটু বেশি। বারবার ভালোবাসি।

চলবে
আগামী পর্বেই শেষ। সবার মন্তব্য চাই।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here