চুপকথার_গল্প #পর্ব_১৩

0
924

#চুপকথার_গল্প
#পর্ব_১৩
#পুষ্পিতা_প্রিমা

প্রায় সপ্তাহখানেকের মাথায় খবর পাওয়া গেল সুমনের জাল পেপারস গুলো ধরা পড়েছে। মোতালেব শেখ পুলিশে কেস ফাইল করে রাখলেন সুমনের নামে।

আরও সপ্তাহ খানেক পরে ডিভোর্স লেটার দিলেন কলিকে । কলির সে কি কান্না! মোতালেব শেখ বললেন
‘ একজন প্রতারকের জন্য তুমি কাঁদছ? দাও। ওকে ডিভোর্স লেটার ছুঁড়ে মারো। কুত্তার বাচ্চা আড়ালে কেন? সামনে আসুক। কুপিয়ে নদীর জলে ভাসিয়ে দেব আমি।
কলি ডিভোর্স দিতে চাইল না। বলল,
‘ এ-ই লেটার সুমন পাঠাননি আব্বা। তুমি নকল বানিয়েছ।
মোতালেব শেখ ধরা পড়ে যান। সজীবের দিকে তাকান। সজীব এগিয়ে আসল। কলিকে বলল
‘ এটিই আসল। সুমন পাঠিয়েছে আপনার জন্য। ওর বিবাহিত স্ত্রী আছে। আর ওনি অন্তঃসত্ত্বা।
কলি তা শুনে চিৎকার করে কাঁদল। ঠকে গিয়েছে সে। তাকে ঠকানো হয়েছে। কথা এসে ধরল কলিকে। মাথায় হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দিল। ডিভোর্স লেটারে সই করে তা উকিলের কাছে দিয়ে দিলেন মোতালেব শেখ। দুই তিনদিনের মাথায় সুমন ফোন দিল কলিকে অপরিচিত নাম্বার থেকে। বিশ্রী গালিগালাজ দিয়ে বলল,
‘ তুই কি আমাকে ডিভোর্স দিবি। আমিই তোকে দিলাম। যাহ। তোর বুড়ো বাপ আমাকে ঠকিয়েছে। আমি ছাড়বনা তোদের কাউকে। দেখে নিস।
কলি বলল
‘ জানোয়ার। অমানুষ। ডিভোর্স লেটার কেন? তোকে মেরে আমি বিধবা হতে পারলেই শান্তি পেতাম। বিশ্বাসঘাতক।
সুমন ফোন রাখতেই কলি আবার ও কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে।
নিজেকে ঘরবন্দী করে রাখে।
এত বড় বিপদ গেল পুরো পরিবারের উপর হালিমা বেগম গিয়ে ও শান্তিতে থাকতে পারেননি। মেজ আর ছোট ছেলের বউ বাচ্চা নিয়ে আবার ও হাজির। সুমনের কুকীর্তির কথা শুনে সবার চোখ কপালে। কতই না ভালো সেজে ছিল ছেলেটি। আর দেখে মনেই হয়নি আস্ত একটা শয়তান। সজীবকে কতকিছু ভেবে নিয়েছিল তারা। আসলে মানুষ চেনা বড়ই মুশকিল।
কথার মেজ চাচীর এক ছেলে এক মেয়ে। তুরাগ, তুশি । ছোট চাচীর একটাই ছেলে শুধু। আয়ান। তিনোটা মিলে সজীবের মাথা খায় দুলাভাই দুলাভাই ডেকে ডেকে। তুরাগ ক্লাস টেনে,তুশি নাইনে আর আয়ান সেভেনে পড়ে। সজীব এদের দেখে ভেবে পায়না এত ফাইজলামি ও করে? দুলাভাই হওয়া যেন একটা অপরাধ। শুধু ভাই ডাকলে কি হয়? কথা তাদের কান্ড দেখে মিটিমিটি হাসে।

____

কোম্পানির চেয়ারম্যান পদে মোতালেব শেখের পরবর্তী যে সজীব এসেছে তা বলার জন্য বিরাট আয়োজন করলেন তিনি। মেয়ের জামাই নয়, এ তার ছেলেই। তার উপর চোখবন্ধ করে বিশ্বাস করা যায়।
কোর্ট টাই প্যান্ট এনে কথা দিয়েছিল অনেক আগে। সজীব প্যান্ট শার্ট বসেই রইল। আগেরকার মতো। কথা এসেই সজীবকে দেখে বিস্মিত হলো। ফোনের মেসেজ টোন বাজল সজীবের। সজীব কথার দিকে তাকালো। কথা তাকে ইশারায় ফোন তুলতে বলল। সজীব ফোন হাতে নিল। মেসেজে লিখা
‘ শার্টের উপরে কোর্ট পড়তে হবে। টাই পড়তে হবে।
সজীব মেসেজ পাঠাল।
‘ ঠিক আছে। একটু বাইরে যেতে হবে।
কথা পাঠাল।
‘ কাকে?
সজীব লিখল।
‘ কথাকে।
বের হয়ে গেল কথা। ঠোঁটে হাসি।
কিছুক্ষণ পর আবার মেসেজ এলো কথার ফোনে।
‘ টাই পড়তে অসুবিধা হচ্ছে।
আবার রুমে প্রবেশ করল কথা। মেসেজ লিখতে লিখতে এগোলো।
‘ আমি পড়িয়ে দিচ্ছি। শিখে নিয়েছি।
সজীব ফোনটা বিছানায় রাখল। কথা সজীবের সামনাসামনি গিয়ে দাঁড়ালো। তাকালো না সজীবের দিকে। টাই বাঁধাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। কপাল কুঞ্চিত তার। সজীব চোখ তুলে কথাকে দেখল। কপালে ভাঁজ পড়েছে। কয়টা পড়েছে? গুনতে লাগল সজীব। আশ্চর্য কপালের ভাঁজ গুলো ও গোনা যায়!
কথা টাই পড়ানো শেষ হলে সজীবের দিকে তাকালো। কপালে হাত দিল তাড়াতাড়ি। সজীবের ধ্যান ভাঙল। কথার দিকে একবার তাকিয়ে আবার ঘুরে গেল।
কথা ভাবল
‘ কি হলো ব্যাপারটা? লোকটা কিছু বলল না কেন?
কথা মেসেজ পাঠাল।
‘ আজ কোম্পানিতে আপনার প্রথম দিন। বেরোনোর সময় মুরব্বিদের সালাম করবেন।
ইতি আপনার বোবা বউ।
মন খারাপ হয়ে গেল সজীবের। সে কি কখনো বোবা ডেকেছে কথাকে?
কথা বলে ডাকার আগেই কথা বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। সজীবের আহ্বানকে ডিঙানোর সাহস এই প্রথম দেখালো কথা। মানুষটা একটু নিজের মতো করে বাঁচুক। ভালো থাকুক।

বাড়ির মুরব্বিদের সালাম করল সজীব। মারজিয়া তার মাথায় হাত রাখার সাথে সাথে মায়ের চেহারা ভেসে উঠল সজীবের। আজ মা থাকলে কত খুশি হতো। মা তো এমনটাই চেয়েছে। চোখের কোণা জ্বলজ্বল করে উঠতেই মারজিয়া হাত বুলিয়ে দিল সজীবের মাথায়। বলল,
‘ বেঁচে থাকো বাবা। এ বাড়ি বাড়ির মানুষগুলোকে আগলে রেখো। ভালো থেকো।
সজীব মাথা নাড়াল শুধু। মোতালেব শেখ সজীবের পিঠ চাপড়ে বললেন,
‘ যদি নিজের ছেলে হতে তুই করে বলতাম। বলতাম, যাহ বাবার স্বপ্ন পূরণ করে আয়। দেখিয়ে দিয়ে আয় তোর যোগ্যতা। যদি কখনো আমার নিজের ছেলে হয়ে উঠতে পারো, যেদিন আমাদের মা বাবার জায়গায় বসাতে পারবে সেদিন বলো, গর্বে বুক ফুলিয়ে বলব
‘ তুই আমার গৌরব। আমার গর্ব। আমার ভাগ্য।
সজীব তাকিয়ে থাকল মোতালেব শেখের দিকে। তিনি বাড়ি বের হয়ে গেলেন তাড়াতাড়ি। এত আবেগী কখনো হননা তিনি। আজ হয়ে পড়লেন হঠাৎ। মনে হচ্ছে তার নিজের সন্তান হিসেবে আল্লাহ সজীবকে পাঠিয়েছেন। এত শান্তি, সুখ ও ছিল তার কপালে?
সজীব হালিমা বেগমের সাথে কথা বলে বের হয়ে গেল বাড়ি থেকে। আবার মনে পড়ল কথাকে কিছু বলেনি। আবার ফিরে যেতেই দেখল কথা এসে দাঁড়িয়েছে। মেসেজ টোন বাজল সজীবের। ফোন তুলে দেখল মেসেজ।

‘ আমি আছি পাশে বন্ধু হয়ে
আমি থাকব পাশে ছায়া হয়ে
আমি হারাবো না কখনো তারা হয়ে

সজীব আশপাশ দেখল। লম্বা পা ফেলে চলে আসল কথার কাছে। কথা কিছু বুঝে উঠার আগেই সজীবের বক্ষপীঞ্জরে আবদ্ধ হলো সে। সজীব তাকে শক্ত করে চেপে ধরে বলল
‘ আই হেইট ইউ কথা। আমি আজ তাকে মনে করতে চাইনি। চাইনি। তুমি ভীষণ খারাপ কথা।
কথা হাসল শুধু। তার নামটা যতবারই সজীবের মুখ থেকে শুনে ততবারই খুশিতে সে আত্মহারা হয়। তার আর কিচ্ছু চায়না। কিচ্ছু না।
সজীব চলে গেল। কখন ছাড়ল তা টেরই পেলনা কথা।

কোম্পানিতে নতুন যাত্রা শুরু হলো সজীবের। তাকে স্বাগত জানালো কোম্পানির কর্মরত শ্রমিক কর্মী। সুমনের প্যারা তবে শেষ। কিন্তু সবাই আতংকে রইল সজীব কেমন হবে? দেখে বেশ গুরুগম্ভীর লাগছে। মোতালেব শেখকে কিছু বলতে হয়না। মায়ের সুশিক্ষায় বড় হওয়া সজীব তার প্রমাণ দিয়ে দিল প্রথম আলাপেই। সে সরতেই তার কত প্রশংসার ছড়াছড়ি। কি সুন্দর করে কথা বলল।
মোতালেব শেখ তো উত্তেজনায় মারজিয়াকে ফোন দিল। বলল
‘ মারজিয়া আমার মনে হচ্ছে এবার আমি মরলেও শান্তি। আমি আমার উত্তরাধিকার পেয়ে গেছি। একটা সন্তান পেয়েছি। এখন আমি গর্ব করে বলতে পারব আমার একটা ছেলেও আছে। শুধু কলি! কলির জন্য আমি মরলে শান্তি পাবনা মারজিয়া। মেয়েটার সাথে কেন এমন হলো? আমাদের অবাধ্য হয়ে কতবড় ভুল করল সে।

মারজিয়া টালোমালো কন্ঠে বলল
‘ সব ঠিক হয়ে যাবে। সব।
মোতালেব শেখ বললেন
‘ ছেলেটা কথাকে আপন করে নিলেই হলো। তার অতীত ভুলে সে যেন কথাকে মেনে নেয়। আমার মেয়েটা ভালো থাকুক তার কাছে।

প্রায় দুই তিনমাস পার হলো। অফিসের কাজের চাপ ভীষণ। সজীব নিজের চেয়ারম্যানের টাইটেল না দেখিয়ে বেশিরভাগ কাজ নিজেই করে। তলিয়ে পড়া কোম্পানি ধীরে ধীরে উঠতে থাকে। ইংরেজি নিয়ে পড়ায় বিদেশি ক্লায়েন্ট হ্যান্ডেল করতে তার অসুবিধা হয়না। কথা স্কুলের চাকরি ছেড়ে দিল। শুধু ছবি আঁকে। মাঝেমধ্যে সাহায্য করে সজীবের কাজে। কাজপাগলা মানুষটা যখন খুটখুট করে কিবোর্ড চাপে সেই দৃশ্য মনমস্তিষ্কে গেঁথে নেয় কথা। ফুটিয়ে তোলে ক্যানভাসে। আর ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফেরা সজীব ক্যানভাসে নিজের নানান রূপ দেখে হতভম্ব। ভেতর থেকে চলে আসে প্রশংসা।
‘ খুব সুন্দর।
কথা এই ছোট্ট প্রশংসাটা শোনার জন্য সারাদিন গোসল না সেড়ে না খেয়ে ছবি আঁকে। সজীব আসার আগেই ফিটফাট। সজীব একদিন বলে বসল।
‘ তোমার একটা আঁকা দরকার।
ব্যস, কথা এঁকে ফেলল মায়ার সেই হাসিমাখা ছবিটা। যেটি সে সজীবের ওয়ালেটে পেয়েছিল। কি সুন্দর মায়াবী মেয়েটা। মানুষটা সুন্দর চেনে।
ছবিটা পাশে লেখা কথারূপী মায়া। সজীব থমকে গেল কিছুক্ষণের জন্য। মায়া!
কথার কাছ থেকে কেড়ে নিল সেই ছবি। কথাকে ঝাঁকিয়ে আপ্লুত স্বরে আনন্দিত হয়ে বলল
‘ থ্যাংকস কথা। এটি আমি অফিসে টাঙিয়ে দিতে পারব?
কথা মাথা নাড়িয়ে সায় জানাল। খুশি হলো সজীব।
আবার পরক্ষণেই কথার দিকে চেয়ে রইল সজীব।
‘ মায়াকে তুমি কোথায় দেখলে কথা?
কথা ইশারায় বলল
‘ আপনার চোখে।
আর কোনোকিছু বলতে পারল না সজীব। তার দুচোখ অপরাধী। ভীষণ অপরাধী। কথাকে নিজের অজান্তেই সে কষ্ট দিয়ে ফেলে। কথার মাঝে সে আগের কথাকে খুঁজে পাচ্ছেনা। কথা কি পাল্টে যাচ্ছে!
সজীব নিজেকে তিরস্কার। তোর কপালে ভালোবাসা সয়না। সুখ সয়না।
ক্লান্ত শরীর বিছানায় এলিয়ে দিতেই সজীব ঘুমিয়ে পড়ে। একপাশে গুটিসুটি মেরে শুয়ে থাকা মেয়েটি ভুলেও তার বুকের এসে পড়েনা কয়েকদিন ধরে। ওই দূর আকাশের তারাটাকে ভীষণ মনে পড়ে সজীবের। ভীষণ।
সে ছাড়া সজীবকে আর কেউ তেমনভাবে ভালোবাসতে পারবেনা বোধহয়। ভারী হয়ে আসা বুক নিয়ে ঘুমায় সজীব।
সকালে অফিসে যাওয়ার সময় কিছুই মুখে দিতে ইচ্ছে করেনা তার। কথা জোর করে খাওয়ালো। অনেকদিন পর কথার হাতে খেল সজীব। অনেকদিন পর। কথা,তাকায়না তার দিকে। খাইয়ে চলে যেতেই সজীব ডাকল।
‘ কথা!
কথা পিছু ফিরল না। তবে দাঁড়িয়ে গেল।
সজীব বলল
‘ আমি এ কয়দিন বাড়ি থাকবনা। কাজের জন্য সিলেটে যেতে হবে।
কথা ফিরল সাথে সাথে। তারপর আবার চলে গেল৷
‘ তাকে বলার কি দরকার? সে কে হয় তার? কেউ না।

সিলেটে যাওয়ার অষ্টম দিন পার হলো। সজীবের ফেরার কথা ছিল পাঁচদিনের মাথায়। কিন্তু ফিরল না সে। কথার সাথে মেসেজেই কথা হয়। আর মোতালেব শেখের সাথে ফোনে।
ওপাশ থেকে মেসেজ আসেনা সজীবের। কথা দেয়না। সজীব ও দেয়না কথা দেবে বলে। কিন্তু কথা দিল প্রায় তিনদিন পর। সেদিন সিলেটে আসার এগারোতম দিন। মেসেজ পাঠাল কথা।
‘ কেমন আছেন? কবে ফিরবেন?
সজীব ত্যাড়া জবাব পাঠাল।
‘ যাদের আমাকে দরকার নেই আমার তাদের কাছে ফিরতে ইচ্ছে করেনা। ফিরব না আমি। অবহেলা আমি সহ্য করতে পারিনা।
কথা পাঠালো
‘ আমি ও পারতাম না। এখন সয়ে গেছে। আপনি ও সহ্য করে নিন।

চলবে,
গল্প শেষের দিকে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here