চুপকথার_গল্প #পর্ব_৫

0
983

#চুপকথার_গল্প
#পর্ব_৫
#পুষ্পিতা_প্রিমা

ঝরঝরে মধ্যহ্ন তখন। গরমে ঘেমে উঠেছে সজীব। বিরক্তিতে থিতিয়ে উঠেছে মেজাজ। শপিংমলে ডুকে পড়তেই ঘাম শুঁষে নিতে লাগল আধভেজা শরীর। শপিং মলটি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত । অনেকক্ষণ দাঁড়াল সে শপিংমলে। তারপর এগিয়ে গেল সেলসম্যানের দিকে। সোজাসাপটা বলল,
‘ খয়েরী রঙের চুড়ি দিন। দুহাতে দেওয়া যেতে পারে মতো। বেশি করে৷
মধ্যবয়স্ক দোকানদার হেসে ফেলল।
‘ বউয়ের জন্য?
সজীব মাথা নাড়াল।
‘ জ্বি।
দোকানদার বলল,
‘ বউকে নিয়ে আসতেন?
সজীব কিছু বলল না।
কয়েক ধরণের চুড়ি বের করে দিল দোকানদার। সজীব হাতে নিয়ে নিয়ে দেখল। কল্পনাশক্তি দিয়ে বাছবিচার করে দেখল কোনগুলো বেশি মানাবে কথাকে। তারপর দুই ডজন কিনে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। শপিংমল থেকে বের হয়ে যেতেই আবার দাঁড়িয়ে পড়ল। হিজাব স্টোরে ডুকে পড়ল। কথা হিজাব প্যাঁচায় স্কুলে যাওয়ার সময়। সজীব আবার দোকানে ডুকে পড়ল।
দুইটা হিজাব কিনল। টিস্যু হিজাব।
তারপর পরই বেরিয়ে গেল।
শপিংমল থেকে বেরিয়ে ফোন দিল মাকে। সাজিয়া বেগম বললেন,
‘ বউকে কি রাতে নিয়ে আসবি আব্বা? মানে রান্না বসানোর জন্য বলছি আরকি।
সজীব বলল,
‘ হ্যা রাতে। রান্না করতে হবেনা। ওসব খাবেনা।
সাজিয়া বেগম হেসে ফেলল৷
‘ খাবেনা মানে? চেটেপুটে খাবে দেখিস।
সজীব রিকশায় উঠল। শেখ বাড়িতে পৌছাল।

কথা তার অপেক্ষায় ছিল। সজীবের হাতে শপিং ব্যাগ থেকে দৌড়ে নিজের ঘরে চলে গেল। আশপাশ না দেখে সোজা সিঁড়ি বেয়ে রুমের দিকে গেল সজীব। ড্রয়িংরুমে কলি আর সুমন বসা ছিল। দুজন ফিসফিস করল। দরজার কাছে এসে জুতো খুলল সজীব। টেবিলের উপর ব্যাগটা রেখে দিল। গায়ের ঘর্মাক্ত শার্ট খুলতে গিয়ে থমকে গেল কথাকে দেখে৷ কথা ঘুরে দাঁড়াল। ঠোঁটে হাসি। তাকে বর লজ্জা পাচ্ছে।
সজীব শার্ট হাতে নিয়ে ওয়াশরুমে ডুকে পড়ল। কথা দৌড়ে গেল ব্যাগের কাছে। হাত ডুকিয়ে বের করল খয়েরী রঙের চুড়ি। চোখজোড়া চকচক করে উঠল।
খয়েরী রঙের চুড়িগুলো নিয়ে নড়াচড়া করল। পড়তে গিয়ে ও পড়ল না। সজীব অনেক্ষণ পর ওয়াশরুম থেকে বেরোলো। গায়ে টিশার্ট।
দৌড়ে গেল কথা। সজীবের চোখে কৌতুহল। কি চাইছে মেয়েটা?
কথা চুড়িগুলো ধরিয়ে দিল সজীবের হাতে।
সজীব তার হাতের দিকে তাকাল । হাতটা দেখিয়ে ইশারায় বলল,
‘ পড়িয়ে দিন।
সজীব ধরল কথার হাত। পড়িয়ে দিল। তারপর আবার সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। কথা চুড়িগুলো নড়াচড়া করতে করতে হাসল। সজীবের দিকে চোখ পড়ায় হাসি থেমে গেল। সজীব ভীষণ অবাক।
‘ মেয়েটা এভাবে পাগলের মতো হাসছে কেন?
কথা চুড়িগুলোর দিকে চেয়ে চেয়ে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। আয়নায় সজীবের প্রতিভিম্ব দেখা যাচ্ছে।
ছোট্ট ছোট্ট এই পাওয়াগুলো অনেক কিছু তার কাছে। ঠিক এভাবে একদিন এই লোকটার দামী মনটা চুরি করে বসবে সে। করবেই।
সজীব শপিং ব্যাগটার দিকে তাকাল। দুইটা হিজাব এনেছে মেয়েটা দেখেনি কেন? আশ্চর্য!
এগুলো কি ফেলে রাখার জন্য এনেছে? খুলে ও দেখেনি। না আনাটাই ভালো ছিল। বেশি বাড়াবাড়ি করে ফেলেছে সে। যত্তসব। ব্যাগটা দূরে ছুঁড়ে ফেলল সজীব।
দৌড়ে গেল কথা। ব্যাগটা দূরে ছুঁড়ে মারল কেন?
ব্যাগটা তুলতেই তার মধ্যে আরও কিছু আছে বলে মনে হলো কথার। হাত ডুকিয়ে দিতেই নরম টিস্যু হিজাব বেরিয়ে এল। খুশিতে চোখজোড়া টলমল করে উঠল কথার। আলমারিতে এমন হিজাব কত যে আছে হিসাব নেই। কিন্তু এই দুটো যেন সব হিজাবের চাইতে অনেক অনেক দামী। বর তার জন্য হিজাব কিনেছে?
মুখ দিয়ে অদ্ভুত শব্দ বের হলো কথার। সজীব সাথে ফিরে তাকাল। চোখে জল মুখে হাসি মেয়েটার। আজব!
দৌড়ে গেল কথা। দু পা পিছিয়ে গেল সজীব। আশ্চর্য! এভাবে কেউ ঝাপটে ধরে?
ছাড়ল না কথা। সজীবের দুহাত নিজের পিঠের দিকে দিয়ে আবার শক্ত করে জড়িয়ে ধরল।
সজীব কিছু বলল না। বেশ খানিকক্ষণ সময় পরে কথা ছাড়ল তাকে। এক মুহূর্ত ও দাঁড়াল না আর সজীবের সামনে। কি জঘন্য কাজ করে ফেলেছে সে? ইদানীং হুটহাট আজব আজব কাজ করছে সে। সজীব কি মনে করছে কে জানে?
মারজিয়াকে দেখাল কথা। মারজিয়া হাসল।
‘ বর এনেছে?
উপরনিচ মাথা নাড়াল কথা। কলি দেখে মুখ মোচড়াল।
‘ তোকে তো অমৃত দিয়েছে মনে হয়? এত খুশি হওয়ার কি আছে? তোর বর যা বড়লোক এর চাইতে ও বেশি কি দিতে পারবে?
মারজিয়া ধমক দিলেন।
‘ তোর বর কি দিয়েছে তোকে?
তোতলালো কলি।
‘ দেয়। আমি খুঁজিনা তাই দেয়না আরকি?

রুমে গিয়ে ফুলের টব আছাড় মারল কলি। ভ্যাবাছ্যাকা খেয়ে গেল সুমন। কলি চিল্লিয়ে বলল,
‘ কিছু আনতে পারোনা আমার জন্য। খুঁজিনা বলে কি দেবেনা?
সান্ত্বনা দিল সুমন।
‘ আনব, আনব। আর রাগ করোনা তো। পুরো শপিংমল এনে দেব তোমায়।
রাগ কমল না কলির।
সন্ধ্যার দিকে বের হলো কথা আর সজীব। সজীবের দেওয়া শাড়ি আর হিজাব পড়ে নিল। হাতে চুড়ি।
গাড়িতে চড়ে যাবেনা সজীব। রিকশায় যাবে। কথা ও তাই চায়।
রিকশা আগে থেকে এনে রেখেছে মোতালেব সাহেব। মেয়েটার ঠোঁটে হাসি দেখলে এত শান্তি লাগে তার! হাসিখুশি ভালো থাকুক মেয়েটা। ছেলেটা ভালো রাখুক তার মেয়েকে। তার যা করতে হয় সে তা তা করবে। তারপর ও মেয়েটা ভালো থাকুক।
রিকশায় সজীবের পাশে গিয়ে বসল কথা। ভয়ে ভয়ে হাত রাখল সজীবের হাতে। সজীব তাকাল না তার দিকে। এ যেন হওয়ারই কথা। নিজের দুহাত দিয়ে কথা ধরল সজীবের হাত। কাঁধে মাথা রাখল। কোনে হেলদোল নেই সজীবের। কথার মনে হলো যেন কোনো পাথরের কাঁধে সে মাথা রাখল। মাঝরাস্তায় রিকশাচালককে থামিয়ে দিল কথা। দোকানে গেল নেমে। কাগজ বাড়িয়ে দিল দোকানদারের দিকে। পান সুপারি শ্বাশুড়ির জন্য। আর ও অনেককিছু নিল। সজীব আঁড়চোখে দেখল কথার কান্ড। অনেক্ক্ষণ পর আসল কথা। দুই ব্যাগ জিনিস কিনেছে মেয়েটা। সজীব ভীষণ বিরক্ত। কথার ঠোঁটে হাসি।
ছেলে, আর ছেলের বউকে দেখে সাজিয়া বেগম খুশিতে আত্মহারা। দু তিনজন মহিলা বাসায়। সাজিয়া বেগম ডেকে এনেছেন বোধহয়। সাজিয়া বেগমকে পা ছুঁয়ে সালাম করল কথা। জড়িয়ে ধরল।
ভেতরে নিয়ে গেল কথাকে। মাঝরুমে বসালো। সজীব তার রুমে শুয়ে রইল।
সাজিয়া বেগম ডাকলেন,
‘ আব্বা এখানে আয়না? এই সজীব?
সজীব বলল,
‘ ওখানে আমার কাজ নেই আম্মা।
কথা হেসে ফেলল। তার দেখাদেখি সাজিয়া বেগম ও হাসল। বলল,
‘ এমন ত্যাড়া ত্যাড়া জবাব দেয়।
কথা হাসল। সাজিয়া বেগম বলল,
‘ শাড়িতে খুব সুন্দর লাগছে মা।
কথা ঠোঁট এলিয়ে হাসল।
সাজিয়া বেগম বিশাল পদের রান্না করেছেন। ছেলে টিউশনির বেতন পেয়ে মায়ের হাতে দিয়েছে। এবার আপাতত এক্সট্রা কোনো খরচা নেই।
সাজিয়া বেগমকে কাজে সাহায্য করতে চেয়েছিল কথা। মাকে ও কাজে সাহায্য করে। পেঁয়াজ কেটে দেয়। পানি নিয়ে দেয়। বয়মে তেল,মরিচ ঢেলে দেয়। কিন্তু সাজিয়া বেগম না না করে উঠলেন। বললেন, তুমি কি রোজ আসো। আজ একদিন আসলে কাজ করে খাওয়াবে। আমি খাওয়ায় বরং। কথার বলতে ইচ্ছে হলো আমি তো এখানেই থাকতে চাই। কিন্তু কে শোনে?
সাজিয়া বেগমের কথা শুনল না কথা। রান্নাঘরে গেল। হিজাবটা খুলে নিয়েছে। লম্বা চুল ক্লিপ দিয়ে আটকানো। একটু ঢিলা হয়ে পড়ে রয়েছে সামনের দিকে। গ্যাসের চুলার কাছে দাঁড়িয়ে কি রান্না হচ্ছে তা দেখতেই নাকের ডগা ঘেমে উঠল কথার। কি রান্নার সুগন্ধি! শ্বাশুড়ির রান্না নিশ্চয়ই মায়ের মতোই মজা হবে।
জগ নিয়ে এল সজীব। তেষ্টা পেয়েছে। জগে দেখল পানি নেই। আম্মা আবার কোথায় গেল?
সজীবের চোখ গেল চুলার কাছে মেয়েটির কাছে। কোমরে শাড়ি গুঁজে নিয়েছে। পানি ঢালছে পাতিলে। হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে ঢলে নিল নাকের ডগা। চোখ সরিয়ে নিল সজীব। ফিল্টারের কাছে গিয়ে দাঁড়াল সে। কথা দৌড়ে এল। জগ কেড়ে নিয়ে পানি ভরে দিল সজীবকে। হাত বাড়িয়ে নিল সজীব।
হাসল কথা৷
সাজিয়া বেগম দৌড়ে আসল। পুড়ে গিয়েছে রান্না? নিচে গেলাম শসা বিক্রেতা এসেছে তাই। কথা মাথা নাড়িয়ে বুঝাল,
‘ পুড়েনি।
সজীব পানির জগ নিয়ে চলে গেল। দু তিনজন মহিলা এল আবার। এটা ওটা জিজ্ঞেস করল কথাকে। অসহায় হয়ে চেয়ে রইল সে সাজিয়া বেগমের দিকে।
সাজিয়া বেগম ভীষণ অবাক। সবাই জানে মেয়েটা কথা বলতে পারেনা তারপর খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে কথা বলার কি দরকার?
সজীব তার রুম থেকে ডাক দিল,
‘ কথা?
চমকে উঠল কথা। ধড়ফড় করে উঠল বুক। গলা শুকিয়ে কাঠ। মস্তিষ্ক হলো এলোমেলো। খাট থেকে নেমে খালি পায়ে দৌড়াল কথা।
মহিলাগুলো অবাক চোখে তাকিয়ে দেখল কথার দৌড়ে যাওয়া। এত বড়লোকের মেয়ে হয়েও জামাইকে কিভাবে মান্য করে। কপাল করে এমন বৌমা পেয়েছ সজীবের মা।
সাজিয়া বেগম হাসলেন। ছেলের মুখে তিনি ও এই প্রথম কথার নাম শুনলেন। খুশিতে নেচে উঠল মনটা। মহিলা গুলোর প্রতি রাগ কমে গেল। কথার আনা নাশতা দিয়ে সাজিয়া বেগম বলল
‘ এগুলো আমার বৌমা এনেছে আমার জন্য। খেয়ে দেখো। অনেক বড় স্কুলের মাস্টারনি আমার সজীবের বউ। কত সুন্দর ছবি আঁকে জানো?

বারান্দায় দৌড়ে গেলে ও সজীবকে দেখল না কথা। বের হলো ঘর থেকে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে সজীব। সামনে দৃষ্টি নিবদ্ধ করা। পকেটে হাত রাখা। কোনে আভিজাত্যর ছিটেফোঁটা নেই এই ছেলের মাঝে। তারপরে ও এত দামী কেন এই ছেলে? ছেলেটার সবকিছুই যেন বহু মূল্যবান।
নামটা যদি আরেকবার ডাকত?
কথা গিয়ে দাঁড়াল সজীবের পাশে।। সজীব ভীষণ বিরক্ত এই মেয়ের প্রতি। ওখানে বসে বসে মহিলাগুলোর কথা গিলার কি দরকার?
কথা হাত মোচড়ামুচড়ি করল নিজের। সজীব কেন কথা বলছেনা আর?
সজীব দাঁড়িয়ে রইল। কথা ও দাঁড়িয়ে রইল। কোনো কথা বলল না আর। কথার আবারও মন খারাপ হলো। সে শুনতে পায় লোকটা কি তা জানেনা? কথা বলেনা কেন? শুনতে ইচ্ছে হয় কথার। লোকটা যদি সারাক্ষণ বকবক করে তার মাথা খেয়ে নিত?
সজীব আচমকা হাত ধরল কথার। নিজের রুমে নিয়ে গিয়ে ফ্যানের নিচে বসিয়ে দিল। এই ঘেমে উঠা মেয়েটার প্রতি সে ভীষণ ভীষণ বিরক্ত। তার বাসায় এসি নেই, এই ফ্যানের বাতাস খেয়ে থাকতে হয়। কথা অবাক। এই ছোট্ট ছোট্ট কেয়ারিং গুলো তাকে বলে আর ও বেশি করে সজীবকে ভালোবাসতে।
টিস্যু পেপার এনে দিল সজীব। কথা নিয়ে মুখ মুছল। তার ঘরে আয়না নেই। ছোট্ট গোলগাল একটা আয়না এনে দিল সজীব। একটা চিরুনি ও এনে দিল।
তারপর বসে রইল কথাকে পিছু করে। হাসল কথা। মেয়েদের কি কি লাগে সব জানে এই লোক? কিন্তু বউয়ের কি লাগে সেটা জানেনা?
চুল আঁচড়াল কথা। কি এক ভালোলাগা কাজ করছে? আয়নাটা দিয়ে সে দেখল সজীবকে। বিছানার দুপাশে হাতের ভর দিয়ে বসে আছে সজীব। কথা হাসল আনমনে। এই ঘাড়ত্যাড়া ছেলেকে ভীষণ ভালোবাসতে মন চায়। কেন কে জানে? তেমন কিছু তো নেই ছেলেটার।

রাতের খাওয়া হলো সাজিয়া বেগমের রুমে। খাটের উপর দস্তানা বিছিয়ে। পা কুড়িয়ে বসে খেতে ভীষণ মজা লাগল কথার। সজীবকে টেনে এনে পাশে বসিয়ে দিল সাজিয়া বেগম। নিজে ও বসল। কথা নিজ হাতে বেড়ে দিল খাবার। ধীরে ধীরে নড়াচড়া করে খেল সজীব। কথা খেল কব্জি ডুবিয়ে।
একদম যেতে ইচ্ছে করল না কথার। সাজিয়া বেগমকে দৌড়ে এসে ঝাপটে ধরল। হেসে ফেললেন তিনি। বুঝে গেলেন ছেলের বউয়ের অব্যক্ত কথা। ছেলের বউ রাখার জন্য কোনে রুম নেই এই বাসায়৷ সোজাসুজি তিনটা রুম। তিনি তারপরও রেখে দিলেন কথাকে। বললেন,
আজ তুমি আমার সাথে ঘুমাবে। তোমার বর ওই সামনের রুমে। মাথা নাড়াল কথা৷ থাকবে এই রাতটা। মোতালেব শেখ ফোনের উপর ফোন দিল। সজীব মেসেজ পাঠাল শুধু।

টিউশনির উদ্দেশ্য বের হতেই কথাকে নিয়ে বের হলো সজীব। কথাকে রিকশায় তুলে দিয়ে ঠিকানা বলে দিল৷ সে চলে গেল টিউশনিতে।
কথাকে ফিরতে দেখে মারজিয়া দৌড়ে এল।
‘ কেমন লাগল রে শ্বশুরবাড়ি?
হাসল কথা।
‘ ভীষণ ভালো লেগেছে তার।
কলি আসল পিছুপিছু।
‘ একদিনের বেশি তো রাখেনি। কেমন শ্বাশুরি?
মারজিয়া ধমক দিলেন।
‘ তুই তো একদিনের জন্য ও যাসনি রে।
দুমদাম পা ফেলে চলে গেল কলি। কথায় কথায় আম্মা ও খোঁটা দেয়।

___________

ক্যানভাসে মাত্রই রং তুলেছে কথা। সামনে তার এক্সিবিশন। এবার এক মধ্যবিত্ত যোদ্ধার ছবি প্রদর্শন করবে সে। তারজন্য প্রচুর চর্চার দরকার। রাত তখন সাড়ে দশটা। সুমন এসে চেয়ার টেনে বসল কথার কিছুটা দূরে। বলল,
‘ আমার ও তো একটা ছবি আঁকতে পারো আদিঘরওয়ালী।
ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল কথা ৷ মুখ দিয়ে উঃ উঃ শব্দ বের হলো ঘৃণার।
হাত নাড়িয়ে সুমনকে চলে যেতে বলল কথা৷ যখন তখন তার ঘরে চলে আসে এই লোক৷ কলির গলার আওয়াজ ভেসে আসল। সুমনকে ডাকছে৷
সুমন আওয়াজ করল কথার ঘর থেকে। কলি ডুকে পড়ল কথার ঘরে।
‘ কি করছ তুমি এখানে?
সুমন হেসে বলল,
‘ কথা ডেকে আনল আমাকে। তার নাকি ভালো লাগছেনা একা একা। তুমি তো ওকে একটু সময় দিতে পারো কলি।

তেলে বেগুনে জ্বলে উঠল কলি। আমার জামাইকে কেন লাগবে তোর? তোর জামাই তোকে সময় দেয়না বলে এখন আমারটা নিয়ে টানাটানি লাগিয়েছিস? ওই ছোটলোকের বাচ্চা থেকে কি এখন আমার বরকে তোর মনে ধরেছে। গাল বেয়ে তপ্ত জল গড়াল কথার। সজীব ততক্ষণে রুমে দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। জুতো খুলে সে ডুকে পড়ল রুমে। মারজিয়া দৌড়ে এল। কি হয়েছে রে কলি? এভাবে চিল্লাচিল্লি করছিস কেন? সুমন আর তুই কি করছিস এখানে?
সজীব হাতের ঘড়ি খুলতে ব্যস্ত। কথা মাকে দেখে এবার আওয়াজ করে ঠোঁট বাঁকিয়ে কেঁদে দিল৷
মারজিয়া বলল,
‘ কি হয়েছে মা? কাঁদছিস কেন? কি হয়েছে? কলি কি বলেছিস তুই ওকে?
সজীব তাকাল কথার দিকে। ঠোঁট টেনে টেনে কাঁদছে মেয়েটা। সমস্যা কি?
কলি চিল্লালো।
‘ ওর একটা জামাই দিয়ে হচ্ছেনা মা। বেয়াদব মেয়ে। আমার জামাইকে নিয়ে টানাটানি শুরু করেছে।
মারজিয়া গালে শাড়ির আঁচল গুজল।
কলি আবারও বলল,
‘ বেয়াদব মেয়ে। তোর একটা জামাই দিয়ে হচ্ছে না আব্বাকে গিয়ে বল না? তোর বর তোর দিকে তাকায় না। আর আমার বর তাকাবে? কোন রূপসী হয়ছস তুই? একটা দিয়ে না হলে আর ও দুইটা তিনটা কর বিয়ে। তারপর ঘুমা। আমারটার দিকে চোখ দিবিনা বেয়াদব।
সাথে সাথে রুম কাঁপিয়ে আওয়াজ হলো। চোখ বন্ধ করে নিল সবাই। এত জোরে গালের পাশে চড় পড়ায় দূরে ছিটকে পড়ল কলি।
এত জোরে চড় বসিয়ে ও কোনো উত্তেজনা, বিকার দেখা গেলনা সজীবের। মারজিয়া হয়ে পড়লেন বাকহারা। কথা চেয়ে রইল সজীবের দিকে। সুমন এসেই কলার চেপে ধরল সজীবের।
‘ এই ছোটলোকের বাচ্চা, কোন সাহসে তুই আমার বউয়ের গায়ে হাত তুললি? কোন সাহসে? তোকে পুলিশে দেব আমি। পায়ে পড় আমার বউয়ের। পড়। ক্ষমা চা। নইলে।

নাক বরাবর ঘুষি পড়ল সুমনের। সে গিয়ে পড়ল কলির কাছে। শান্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে শান্ত কন্ঠে বলল সজীব।
‘ তুই চাহ ক্ষমা তোর বউয়ের কাছে। কারণ তাকে ছেড়ে আবার নিজের শালির দিকে চোখ বাড়াচ্ছিস বলে। নে৷ ক্ষমা চাহ।
রাগে কিড়মিড় করল সুমন। উঠে দাঁড়িয়ে জুতো হাতে নিল দরজার কাছ থেকে। চিল্লিয়ে উঠল মারজিয়া। রুম থেকে বের হতেই মোতালেব শেখ এসে হাজির। ডাক দিল,
‘ সুমন? কি করছ? পাগল হয়ে গেছ?
সজীব এগিয়ে গেল। ধাক্কা দিয়ে বের করল সুমনকে। কলিকে ও ধাক্কা দিয়ে বের করে দিল। সবার মুখের উপর ধপ করে বন্ধ করল দরজা। কথার দিকে ফিরে চাইল তারপর। চোখের ভাষায় খানিকটা সম্মতি পেয়ে তার কাছে এসে শক্ত করে তাকে জড়িয়ে ধরল কথা। বুকের কাছে শার্ট ভিজিয়ে দিল নোনাজলে। সজীব এই প্রথম নিজ ইচ্ছায় বাহুবন্ধনে আবদ্ধ করল কথাকে। কথা আর ও জোরে কাঁদল। তার কাছে তার প্রাণপুরুষই সবচাইতে সুদর্শন পুরুষ। সে তাকে ছাড়া অন্য কারো কথা ভুলেও ভাবতে পারেনা। বোনের বরকে তো কখনোই নয়। কখনোই না।
গর্জন ভেসে এল সুমনের। ভেসে এল কলির জোরে জোরে কান্নার আওয়াজ। ভয় হলো কথার সজীবকে নিয়ে।

________________

রাতের খাবার টেবিলে সুমন কলিকে দেখা গেলনা। সজীব বসে পড়ল মোতালেব শেখের পাশে। বলল,
‘ আপনার বড় মেয়ের জামাই যে বাড়িতে থাকবে সেই বাড়িতে আমি আর থাকব না। আজকেই শেষ।
‘ আর আমার মেয়ে?
সজীব বলল না কিছু। টিউশনি দুটো চলে গিয়েছে। দুটোই বেশি অ্যামাউন্টের ছিল। কথাকে নিয়ে সে অন্য বাসায় উঠতে পারবেনা এখন। অত টাকা নেই। মায়ের ঔষধ খরচ, বাড়ি ভাড়া, সংসার খরচ পোষায় না। তারমধ্যে কথা!
মোতালেব শেখ থেকে আর একটা কানাকড়ি ও নিতে পারবেনা সে।
মোতালেব শেখ বললেন
‘ সুমন আর কলিকে অন্য বাসায় পাঠিয়ে দেব আমি। তোমাদের যেতে হবেনা কোথাও।
কিছুই বলল না সজীব।
কলিকে তাড়িয়ে ও সে থাকবে না এই বাড়িতে। তার আগে কলির অধিকার বেশি এই বাড়িতে। এটা তার বাপের বাড়ি।
সজীব বলল,
‘ আমার কুঁড়েঘরে থাকতে পারলে আপনার মেয়েকে বলবেন কালকে সকালেই রেডি হয়ে থাকতে। নিয়ে যাব।
মোতালেব শেখ বললেন,
‘ আমার মেয়ে ওরকম পরিবেশে অভ্যস্ত নয়। পারবেনা ও।
সজীব বলল,
‘ তা হলে থাকুক এখানে। আমাকে আসতে বলবেন না।
কথা দৌড়ে এল। বাবার হাত ধরে মাথা ঝাকিয়ে বলতে চাইল,
‘ সে যাবে। সে থাকতে পারবে। মানিয়ে নিতে পারবে।
সজীব তার পরের দিনই নিজের বাসায় হাজির হলো কথাকে নিয়ে। সাজিয়া বেগম বললেন
‘ বাসা পাল্টাবি না আব্বা?
সজীব বলল, না।
কথা সাজিয়া বেগমের হাতে সজীবের আড়ালে টাকা তুলে দিল। ইশারায় বুঝাল বাসা ভাড়ার টাকা সে দেবে।
সাজিয়া বেগমের জোরাজুরিতে বাসা পাল্টাতে হলো সজীবকে। কিন্তু সে দৃঢ়প্রতিজ্ঞাবদ্ধ সে কিছুতেই টাকা নেবেনা কথার কাছ থেকে। কিছুতেই না।

চলবে,
গঠনমূলক মন্তব্য আশা করছি।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here