#চুপকথার_গল্প
#পর্ব_১১
#পুষ্পিতা_প্রিমা
মায়ার মামারা সজীবের চাকরি নেই তাই মত দিতে চাইলেন না। আফজাল সাহেব বুঝিয়ে বললেন, ছেলে আজ না হোক কাল তো চাকরি পাবে। এলাকার মানুষ বলছে ছেলেটা ভালো হবে। তাছাড়া কোচিং সেন্টার থেকে ভালো পয়সা কামাই। মায়ার ও মত আছে তা বুঝা গেল। অনেক বুঝানোর পরে মায়ার মামারা রাজী হলেন। আকদটা করে রাখতে বললেন। যখন চাকরি হবে তখন নিয়ে যাবে।
সাজিয়া বেগম ভীষণ খুশি হলেন। এত সহজে সব মিটে যাবে তিনি ভাবতে পারেননি। সজীবের কোনো বিকার দেখা গেলনা। শুধু সাজিয়া বেগমকে বলল,
‘ আম্মা এখন এসব কিছু করার দরকার নেই।
সাজিয়া বেগম ছেলের কথা শুনে মুখ ভাঙালেন। তুই কিছু করিস না, সব আমি করব। পারলে বিয়েটা ও আমিই করব।
সজীব মায়ের কথা শুনে বলল,
‘ আচ্ছা আম্মা।
সাজিয়া বেগম কপাল চাপড়ালেন। এই ছেলে বয়সে বড় হয়েছে, কিন্তু আক্কেল হয়নি এখনো।
মায়া সেদিন নিজ হাতে নারকেলপুরী বানালো। যদিও সব মাজেদা বানিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু ভাই বাবার সামনে নিজের ক্রেডিট দিয়ে চালিয়ে গেল। কোচিং-এ নিয়ে গেল ব্যাগে ভরে হটবক্স করে। সজীবকে খাওয়াবে। কিন্তু হাঁদারামটা আসে টাইমে টাইমে। আগে আগে আসলে কি হয়?
কোচিং-এর সব শিক্ষার্থীরা তখন বাইরে দাঁড়িয়ে গল্পগুজব করছে। সজীবকে দেখার সাথেসাথে সবাই ক্লাসে চলে যেতে লাগল। কয়েকজন দেখেনি সজীবকে। সজীব তাদের ডাক দিল
‘ সবাই ক্লাসে যাও। বাইরে কি?
মেয়েগুলো দৌড়ে ক্লাসে চলে গেল। একজন গেলনা, আশ্চর্যজনকভাবে মেয়েটির পিঠে ব্যাগ ও। সজীব চোখ সরিয়ে নিল। চলে যেতে যেতে মায়ার বিড়বিড়ানি শুনল।
‘ সব কুকুরকে নিয়ে গিয়ে খাওয়াবো আজ।
সজীব থামল। মায়াকে ডাকল,
‘ বলল মিস. মায়া আপনি ক্লাসে যাচ্ছেন না কেন?
তরতরিয়ে রাগ বাড়ল মায়ার। নাক ফুলিয়ে কড়া কন্ঠে জবাব দিল,
‘ যাব না। কি করবেন?
সজীব এদিকওদিক তাকাল তাড়াতাড়ি। উফ এই মেয়েটা এখানে কোনো সিনক্রিয়েট করলে ইজ্জত সম্মান সব শেষ।
সজীব নরম কন্ঠে বলল,
‘ এটা কোচিং সেন্টার।
মায়া কর্কশ কন্ঠে বলল,
‘ তো আমি কি বলেছি এটা বাসর ঘর? আপনি একটু আগে আসতে পারেন না?
সজীব বলল,
‘ আগে আগে এসে কি করব? কি হয়েছে তোমার?
মায়া কোনোকথা বলল না। ব্যাগ সামনে এনে চেইন খুলে একটি বক্স বের করল। বলল,
‘ এটাতে নারকেলপুরী আছে। বিশটা দিয়েছি। অফিসের সবাইকে একটা একটা দিবেন। আর বাকিগুলো আপনার আর আন্টির জন্য।
সজীব বলল,
‘ না না আমি এসব নিতে পারবনা।
মায়া তার হাতে ধরিয়ে দিল। যেতে যেতে নরম গলায় বলল,
‘ আমি বানিয়েছি।
সজীব বক্সটা নাড়াল। হাতদুটো পেছনে পেছনে রেখে হেঁটে অফিসে গেল। সবাইকে বক্স খুলে নাশতা দিল। সবাই খেল। প্রশংসা ও করল। সবাই ভেবেছে সজীবের মা বানিয়ে পাঠিয়েছে। সবাই খেয়ে নিল সবটা। সজীবের কপালে ও জুটল না। পানি খাওয়ার অজুহাতে মায়া এল অফিসে। সবাইকে সব উল্টে খেয়ে নিতে দেখে চোখজোড়া ছলছল করে উঠল। নাক ফুলিয়ে তাকিয়ে থাকল সজীবের দিকে। সজীব মাথা নামিয়ে ফোন টিপছে। ধুপধাপ পা ফেলে হেঁটে চলে গেল মায়া। তৌহিদ স্যার বলল,
‘ সজীব মায়া কি পানি খাওয়ার ছলে তোমাকে দেখতে আসে নাকি?
সজীব শুনেও যেন শুনল না। তৃণা বলল,
‘ আর কি? এখন কোচিংটাকেই প্রেমমহল মনে হচ্ছে।
সজীব ফোন টিপা অবস্থায় বলল,
‘ তুমি তোমার ফোনটা অফিসে রেখে যেও তৃণা। ফোনকলের আওয়াজে স্টুডেন্টদের পড়ায় অসুবিধা হয়।
তৃণা অপমানে লাল হয়ে গেল।
সজীব বলল,
‘ আমি তোমাকে এনেছি এই কোচিং-এর টিচার হিসেবে। সো আমার কথা শুনলে থাকো, নইলে চলে যাও।
গটগট পায়ে হেঁটে ক্লাসে চলে গেল তৃণা।
কোচিং থেকে বাসায় ফেরার সময় রাস্তায় হাজির হলো সজীব। মায়া তখন লম্ব লম্বা পা ফেলে হাঁটছিল। সজীব তার সাথে তাল মিলিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বলল,
‘ সরি ম্যাম।
মায়া আর ও জোরে হাঁটল। সজীব এই প্রথম তার হাত ধরল। আটকালো। বলল,
‘ কি হয়েছে? এত রাগ কেন?
‘ আমি আপনার জন্য নাশতা বানিয়ে এনেছি আর আপনি সেগুলো সবাইকে খাইয়ে ফেললেন?
সজীব হাসল। বলল,
‘ আমি তোমার হাতের নাশতা অনেক খেতে পারব। ওরা তো পারবে না, সুযোগ আসল আর খাইয়ে দিলাম। ভালো করিনি?
রাগের কারণে কথা বলতে পারল না মায়া। সজীব পকেট থেকে চকলেট বের করল। বাড়িয়ে দিয়ে বলল
‘ এই পিচ্চি চকলেট খাও। নাও।
মায়া নিল। তারপর দূরে ছুঁড়ে ফেলল। বলল
‘ আমি খাইনা ওসব ছাইপাঁশ।
সজীব আওয়াজ করে হেসে দিল। তারপর উল্টোপথে হেঁটে চলে গেল। সে যেতেই মায়া চকলেটটি কুড়িয়ে নিল। খুলে গালে দিয়ে বলল,
‘ আমি খাইনা ওসব ছাইপাঁশ।
____________
পহেলায় জুন আকদের তারিখ পড়ল। সাজিয়া বেগম বললেন
‘ আকদ হয়ে গেলে আর কোনো চিন্তা থাকবেনা।
সজীব বলল,
‘ আকদ মানেই তো বিয়ে আম্মা। এখন?
সাজিয়া বেগম ছেলের সাথে কোনোকথা বললেন না। মায়াকে বললেন।
মায়ের ফোন থেকে রাতে সজীবকে কল করল মায়া। সজীব হ্যালো বলতেই ফোঁপাতে থাকল মায়া। ফোঁপানির শব্দ শুনে বুঝে গেল সজীব কে হতে পারে এই নাগিনী।
হাসল সজীব। মায়া এবার চেঁচালো।
‘ মেরে ফেলব আমি আপনাকে।
সজীব হাসতে হাসতে বিছানায় গড়াগড়ি খেল। বলল,
‘ আমি মরতে চাই, সাথে তোমাকে ও নিয়ে যাব।
মায়া ফোন কাটল। সজীব মেসেজ পাঠাল।
‘ বিয়ে করছি না? রাগার কি আছে? আশ্চর্য!
আকদটা হলো সবার সম্মতিতে। পাঁচলাখ দেনমোহর দিয়ে। কোচিং-এর স্যারেরা ছিল। তৃণা আসেনি। নীতু মায়ার কানে কানে এসে বলে গেল
‘ বান্ধবী ছক্কা মারলি৷
মায়া গুঁতো মারল নীতুকে।
‘ আমাকে আজ থেকে ম্যাডাম ডাকবি বেয়াদব।
ওই দূরের রুম থেকে একজোড়া চোখ তার দিকে চেয়ে আছে দেখতেই লজ্জায় নতজানু হলো মায়া। যাহ সে মা বউ সেজেছে। বউদের কথা বলতে নেই।
সাজিয়া বেগম এসে গালে কপালে চুমু দিল মায়ার। বলল
‘ আমার বাড়ি যাবি? তোর শ্বশুরবাড়ি? বিয়ে যে হয়ে গেল!
মায়া ফটাফট জবাব দিল।
‘ হ্যা যাব।
আবার বলল
‘ না না যাব না।
সবাই হেসে ফেলল। সাজিয়া বেগম তার কানেকানে এসে বললেন
‘ তোর বরের চাকরি হলেই তোকে নিয়ে যাব। বুঝলি?
মায়া মাথা নাড়িয়ে সায় দিল। সাজিয়া আবার কি যেন ভেবে বললেন
‘ তোর বরকে বলিস। আমি কি রাজ্য খাই? যে আমাকে খাওয়াতে পারবেন না বলে ঘরে তুলছেন না?
মায়া মাথা নাড়াল।
‘ আচ্ছা বলব আন্টি।
সাজিয়া বেগম বললেন
‘ চড় দেব মেয়ে। মা ডাক।
মায়া হেসে ফেলল। বলল
‘ আর ভুল হবেনা মা।
মায়া বসেছিল মায়ের রুমে। সাজিয়া বেগম আর মাজেদা কথা বলছিলেন। নীতু এসে টেনে তুলল তাকে। বলল
‘ মায়া চল একটা জিনিস দেখবি।
মায়া যেতে চাইল না। নীতু টেনে তুলল তাকে। ভারী শাড়ি নিয়ে হাঁটতে বেগ পেতে হলো তাকে। তৌহিদ স্যার, মামুন স্যার মনির স্যারকে দেখা গেল। তারা মায়াকে দেখে বলল
‘ কনগ্রেছুলেশন মায়া ম্যাডাম।
মায়া হাসল ঠোঁট এলিয়ে। আবার লজ্জা পেল। নীতু তাকে টেনে নিয়ে গেল। তার রুমের ভেতরে ধাক্কা মেরে ডুকিয়ে দিল তাকে। মায়া বলল
‘ এখানে কেন?
দরজা বন্ধ করে চলে গেল নীতু। মায়া দরজা ধাক্কাল।
অনেক্ক্ষণ পর দরজা খুলল নীতু। চমকে তাকাতেই দরজা খোলা মানুষটাকে দেখে চমকে গেল মায়া। খয়েরী রঙের পাঞ্জাবী পড়া মানুষটাকে পূর্ণ দৃষ্টি মেলে দেখতেই গর্বে বুক ফুলে উঠল। তার সুদর্শন স্বামী।
সজীবকে হাত ধরে টেনে এনে রুমে ডুকালো মায়া। দরজায় খিল দিল। সজীব নীরবে চেয়ে আছে। মুখে কথা নেই। মায়া তাকাল সজীবের দিকে। যাহ লোকটা কিভাবে যেন তাকায়। ভীষণ লজ্জা পায় তার।
লাল রঙের বেনারসি, নাকে লম্বা নথ চুলের সাথে। সোজা সিঁথির মাঝখানে লম্বা টিকলি, গলায় অলংকার। পরিপূর্ণ বধূ। মায়া সজীবের কাছে গেল। চোখে চোখ পড়তেই কেঁপে উঠল অন্তর আত্মা। মায়া সরে পড়ার চেষ্টা করল। কিন্তু পারল না শক্তপোক্ত হাতের বাঁধনে আটকা পড়ায়। এসে ঠেকল লম্বা চওড়া মানুষটার বুকের কাছে। আর তাকাল না উপরে লজ্জায়। মাথা রাখল আয়েশ করে স্বামীর বুকে। অনুভূতিদের তখন দফারফা অবস্থা। হাত পা অসাড় হওয়ার পালা। সে মাথা তুলতেই সজীব হাত গলিয়ে দিল মায়ার দুগালের পাশ ডিঙিয়ে কানের নিচে। কন্ঠ খাদে নামিয়ে জিজ্ঞেস করল
‘ লজ্জা পাচ্ছেন কেন মায়াবতী ? বিয়ে বিয়ে করে লাপাচ্ছিলেন না?
সেই অবস্থায় নাক ফুলালো মায়া। সজীবের দুহাত মুখের দুপাশে আঁকড়ে থাকায় কথা বলতে পারল না মায়া। ফোলা নাকটা আর ও ফুলালো সে।
সেই নাকের ডগায় ভালোবাসার প্রলেপ দিল সজীব। চোখজোড়া খিঁচে বন্ধ করল মায়া।
কপালে আর গালের দুপাশে লেগে গেল হিম শীতল ছোঁয়া।
লজ্জায় নিজেকে গুটিয়ে নিল মায়া। পা জোড়া কাঁপল তরতর করে। খানিকটা দম নিয়ে পিছু ফিরতে চেয়ে ও পারল না সে। পেছন থেকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরল তাকে প্রাণপুরুষ। কানের নিচে কাঁধে বেয়ে গেল নামহীন স্পর্শ। বাঁধন আলগা হয়ে আসতেই সামনে ফিরল মায়া। তার হাতের উল্টোপাশ ভিজিয়ে দিয়ে সজীব বলল
‘ আসছি। আবার আসব। তোমাকে নিয়ে যেতে।
চোখজোড়া ছলছল করে উঠল মায়ার। সজীবের গলা ধরে ঝুলে পড়ল সে। গালে গাল লাগিয়ে চুপ করে রইল। সজীব শীতল কন্ঠে বলল
‘ হয়েছে?
মায়া অনেক্ক্ষণ পর বলল
‘ না। আরেকটু।
সজীব বলল
‘ বাইরে সবাই খুঁজবে আমাদের।
‘ খুঁজুক।
সজীব বলল
‘ আমাকে লজ্জায় ফেলে দেবে তুমি।
মায়া ছাড়ল তাকে। সজীবের গলা টেনে এনে কপালে চুমু দিল। বলল
‘ আপনি আমার। মায়াবতীর।
_______
পার হলো সপ্তাহ খানেক। টিউশনির বেতন হাতে এল সজীবের। মায়ের জন্য শাড়ি কিনল প্রতিবারের মতো। এবার একটু ব্যাতিক্রম হলো। খয়েরী রঙের একটি শাড়ি ও কিনল মায়ার জন্য। একগাদা চুড়ি কিনল।
মায়াকে দেখতে যাওয়ার সময় নিয়ে গেল সে। সজীবের দেওয়া শাড়ি সাথেসাথেই পড়ল মায়া। অনুরোধ করল সজীবকে আজ থাকুন। সজীব বলল
‘ না। স্টুডেন্টদের খাতা জমা পড়েছে। অন্য একদিন ম্যাডাম।
মায়া রাগ করল। মাজেদা এসে বললেন
‘ বাবা তোমার মা বলছে থাকতে। থেকে যাও আজ। আমি একটু রান্নাবান্না করে খাওয়ায়!
অনুরোধে থেকে যেতে হলো সজীবের। চিন্তা এল মাথায়। চাকরি কিভাবে পাবে? মায়াকে ঘরে তুলতে হবে। এভাবে চলতে পারেনা।
হাত ভর্তি চুড়ি পড়ল মায়া। রিমঝিম আওয়া তুলল সেই চুড়ি। চোখে গাঢ় কাজল পড়ল। সজীবের কাছে এসে বলল
‘ আমাকে কেমন লাগছে বলবেন না? আপনার দেওয়া শাড়িতে সেজেছি।
সজীব হাসল। বলল
‘ মায়াবতী।
মায়া হাসল নতজানু হয়ে। রাতে নিজ হাতে খাওয়ালো সজীবকে।
তারপর সজীবের মাথা নিজের কোলে রেখে চুলে বিলি কাটল। সজীব উঠে বসে বলল
‘ তুমি ব্যাথা পাচ্ছ।
মায়া বলল
‘ একদম নয়।
তারপর হেসে নিজে জড়িয়ে ধরল সজীবকে। সজীবের গালে গাল লাগিয়ে নরম ঠোঁট ছুঁয়ে দিয়ে বলল
‘ আমাকে কবে নিয়ে যাবেন? আমি চাইলেও আপনাকে ভালোবাসতে পারিনা। কাছে পাইনা।
সজীব নাকে নাক ঘষল তার। বলল
‘ আজকে যে পেয়েছেন?
মায়া নাক ঘষল সজীবের শার্টে। বলল
‘ আপনি আমার।
___________
মাস গেল তিন। নিয়মিত কোচিং-এ আসা মায়াকে কোচিং-এ দেখল না সজীব। মায়াকে কোচিং থেকে বাড়ি পৌছে দেওয়া আবার কোচিং-এ নিয়ে আসা সব যেন অভ্যাসে পরিণত হয়ে গিয়েছে। ওই মায়াবী চোহারাটা না দেখলেই পুরো দিন যেন ফুরোতেই চায়না।
সজীবকে একে একে সবাই জিজ্ঞেস করল মায়া কোচিং-এ আসেনি কেন? সজীব নিজেই জানেনা কেন আসেনি। সোজা মায়াদের বাসায় চলে গেল সজীব। সেইভাবে যেভাবে সে কোচিং-এ আসে। মায়াদের বাসায় গিয়ে জানল মায়াকে হসপিটালে এডমিট করা হয়েছে। কাল রাতেই হঠাৎ জ্বর আক্রমণ করল। সাথে ডায়রিয়া আর বমি ও আছে। সজীবকে জানাননি আফজাল সাহেব। ভেবেছেন মায়ার একটু ভালো লাগলেই জানাবেন। শুধু শুধু চিন্তা করবে ছেলেটা।
হসপিটালে পৌঁছাতেই সবার উপর রাগ দেখালো সজীব। মায়া কেবিনের বেডে শোয়া। চিকিৎসা চলছে তাই ডক্টর ডুকতে দিলনা সজীবকে। যখন ডক্টররা একটু বের হলো সজীব তাড়াতাড়ি ডুকে পড়ল।
ঝাপটে গিয়ে জড়িয়ে ধরল মায়াকে। তুলে তার বুকের সাথে লেপ্টে রাখল। নরম শরীরটা পুড়ে যাচ্ছে জ্বরে। ডক্টরের রিপোর্ট এলে জানা যায় মায়ার টাইফয়েড। ভেতরে ভেতরে জ্বর অনেকদূর এগিয়ে গেছে। ভয়াবহ পর্যায়ে চলে গেছে। সাধারণত জীবাণু প্রবেশ করার ৪০-৫০ দিন পর এই রোগের লক্ষ্মণ দেখা যায়। তার আগে বুঝতে পারলে কিংবা চিকিৎসা চললে রোগীর জন্য ভালো। নাহলে,,,,,
সাজিয়া বেগম আল্লাহ আল্লাহ ডাকতে ডাকতে বসে পড়েন। আল্লাহ যেন তার ছেলেকে নিঃস্ব না বানায়।
সজীব মায়ার কপালে ঘনঘন চুমু খেল। বলল
‘ মায়াবতী কিচ্ছু হবেনা তোমার।
মায়া চোখ খুলে ও সজীবকে দেখল না। বিড়বিড় করল,
‘ আপনার সাথে আমি রেগে আছি। আমাকে দূরে ফেলে রাখেন সবসময়।
সজীব তার বুকের সাথে জড়িয়ে ধরল মায়াকে। বলল,
‘ এবার নিয়ে যাব। আমি যা খাব তাই তোমাকে খাওয়াবো। সত্যি, প্রমিজ।
মায়া চোখ বন্ধ করে তার বুকে লেপ্টে রইল। মিনমিন করে বলল,
‘ শুনুন না? আমার মনে হচ্ছে আমি বেশিক্ষণ নেই।
সজীব তাকে ছেড়ে দিল। চেঁচিয়ে ডাকল
‘ আম্মা?
সাজিয়া বেগম আর মাজেদা দৌড়ে এল। সজীব মায়াকে দেখিয়ে বলল,
‘ আম্মা এই মায়াবিনী কি বলে দেখ? আমি ওকে খুব মারব আম্মা।
সাজিয়া বেগম ছেলেকে শান্ত করায়। মায়া ঘুমে ঢলে পড়ে। মাজেদা মুখ গুজে কাঁদে। মায়ার ভাই আর বাবা বসে থাকেন উদাসীন হয়ে করিডোরে।
ডক্টররা সাধ্যমত চেষ্টা চালায়। এই জ্বর অনেক খারাপ অবস্থায় চলে গেছে।
মায়ার পাশ থেকে সজীবকে কেউ সরাতে পারল না। সবাই বাইরে বসে থাকল। সজীবের ছোঁয়া পেতেই তার বুকে মুখ গুঁজল মায়া। হাত পায়ে বল নেই। কোনমতে সজীবের গালের সাথে গাল লাগিয়ে রাখল। আগে বলত,
‘ আপনার দাঁড়িগুলোতে আমি ব্যাথা পাই।
আজ কিচ্ছু বলল না। সজীব মায়ার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল
‘ এখন কিছু বলতে হবেনা। ঘুমোও।
মায়া গাল ঠেসে লাগিয়ে রাখল। শরীরের সমস্ত ভার ছেড়ে দিল সজীবের উপর। সজীব তাকে শক্তপোক্ত ভাবে ধরে রাখল। আচমকা বিড়বিড় করে উঠল মায়া।
‘ আপনি আমার।
সজীব তখন বেঘোরে ঘুমে। চোখ লেগে এসেছে। চোখ খুলতেই বুক ধুকপুক করল সজীবের। নরম ঠান্ডা শরীরের হাত বুলিয়ে ডাকল,
‘ মায়াবতী? কি করেছেন? এভাবে খামচেছেন কেন? দেখুন কত জ্বালা লাগছে। এমন কেউ করে? এই?
সজীব মায়াকে শুইয়ে দিল বেডে। মেয়েটা এত ঘুমায়? অন্যদিন হলে সারারাত সজীবকে ঘুমাতে ও দিতনা বকবক করতে করতে। কপালে চুমু দিল সজীব। গায়ে কাঁথা জড়িয়ে দিল। সাজিয়া বেগমকে ডেকে বলল
‘ আম্মা ওকে কিছু খাওয়াবো না?
সাজিয়া বেগম বললেন,
‘ তুই ছিলি তাই আর,
সজীব খাবারের বক্স নিল। কেবিনে ডুকল। সাজিয়া বেগম আর মাজেদা বেগম ও ডুকল। সজীব মায়ার মাথার উপর বসল। কপালে হাত বুলিয়ে বলল,
‘ আম্মা ওর তো জ্বর কমে এসেছে না? রাতে গরম ছিল, এখন তো ঠান্ডা।
সাজিয়া বেগম ছুঁলেন মায়ার পা। থেমে থেমে হেঁটে চলে গেলেন ডাক্তার ডাকতে। পা টা ও যেন চলছে না। হাউমাউ করে কেঁদে দিলেন তিনি। বললেন,
‘ আল্লাহ আমার ছেলের সাথে কেন তুমি এত অন্যায় করলে? আমার মাসুম বাচ্চাটা কি দোষ করল আল্লাহ? তুমি তার কাছে তার মায়াবতীকে কেন কেড়ে নিলে? কেন?
ডক্টর এল। মায়াকে মৃত ঘোষণা করল। সজীব শুনল না শুনে ও। বক্স থেকে খাবার বের করে বলল,
‘ এই মায়াবতী উঠো তো। দেখো আম্মা তোমার জন্য চিংড়ি দিয়ে ভাত রান্না করে এনেছে। কত লাকি তুমি শ্বাশুড়ির হাতের রান্না খাচ্ছ? এই?
সজীবের হাত থেকে বক্স পড়ে গেল। চোখ ঝাপসা হওয়ায় মাটি থেকে বক্সটা কুড়িয়ে নিতে সময় লাগল সজীব। নিজের পায়ের কাছে লেগে থাকা বক্সটি ও সে দেখল না। বলল,
‘ বক্সটা কোথায় যে গেল?
ডক্টর চেয়ে রইল সজীবের দিকে। নিজের উপর আক্রমণ এলো জোরে। সজীব ঘুষি বসিয়েছে ডক্টরের মুখে। ছিটকে পড়ল ডক্টর। নার্স এসে ধরাধরি করে নিয়ে গেল। সজীব বক্সটি খুঁজতে খুঁজতে বলল,
‘ ডাক্তারি শেখানো হচ্ছে আমাকে? সামান্য জ্বর হয়েছে। বলে নাকি শী ইজ নো মোর। ফালতু। কোন জায়গায় কোন ইংরেজি বলতে হয় সেটা ও জানেনা। আবার নাকি ডক্টর। আম্মা কোথায় তুমি বক্সটা খুঁজে পাচ্ছিনা কেন? ও কি খাবেনা? নিশ্চয়ই খুব খিদে পেয়েছে। বক্সটা কোথায়?
নার্স এসে বক্সটা খুঁজে দিল সজীবকে। সজীব দেখল খাবার নেই বক্সে। পড়ে গিয়েছে। যেগুলো আছে সেগুলো হাতে নিল সজীব। মায়ার মুখের কাছে নিয়ে গিয়ে বলল,
‘ এই? মায়াবতী? খাবেনা? আমার হাতে খেতে তুমি পছন্দ করো না? উঠো। খাও। জানো আমিও খাইনি। উঠো?
বক্সটা আবার ও পড়ে গেল সজীবের। ছেলের কান্নার আওয়াজ শুনে ছুটে আসতেই মুখ থুবড়ে পড়ল সাজিয়া বেগম। মায়ার মা অজ্ঞান হয়ে পড়ল। বাবা নির্বাক। ভাই মিজান মায়ের কাছে মাথা ফেলে রাখল। সাজিয়া বেগম উঠে কেবিনে যান কোনোমতে।
প্রিয়তমাকে বুকে আগলে ধরে কাঁদছে তার ছেলে। সাজিয়া বেগম মাথা ঠুকল দেয়ালে। আল্লাহ এ কেমন বিচার তোমার? কেমন?
মাজেদা বেগমের যখন জ্ঞান ফিরল তখন তিনি ছুটে যাব বাড়ির বাইরে। দেখেন,
এক বাবা মেয়ের লাশ বহন করছে জানাজার খাটে । এক ভাই, আর এক মামা। প্রাণপ্রিয় স্বামী।
বাবার কাছে আবদার করবেনা মেয়েটি। ভাইয়ের সাথে আর ঝগড়া করার মানুষটি ও নেই। মামার পথ চেয়ে বসে থাকা ভাগিনীটা আর নেই। আর স্বামী?
স্বামীর প্রিয়তমা। মায়াবতী। সে আর নেই। স্বামীর কাছে দুষ্টুমিষ্টি ভালোবাসার পাওয়ার আবদার করবেনা আর। ভালোবাসার জন্য পাগলামি করবেনা। কথায় কথায় বলবেনা ‘ আমি আপনার। শুধুই আপনার।
কবরে রাখতেই প্রিয়তমাকে শেষ দেখা দেখে সজীব। আকাশ ও গর্জন করে উঠে সজীবের কান্না শুনে। কোচিং-এর প্রতিটি স্টুডেন্ট কাঁদল।
মিজান ধরে রাখল সজীবকে কবরে দেওয়ার সময়। ছাড়ল কবর দেওয়া শেষ হলে। মাটি দিতে বলা হলো সজীবকে। কবরে মাটি দিতে দিতে কাঁদল সজীব। চোখের জল ফোঁটাফোঁটা পড়ল সেই কবরের ভেজা মাটিতে। সজীব মাটি আঁকড়ে ধরল, কেঁদে উঠে বলল
‘ আমাদের না হওয়া একটা সংসার পড়ে আছে মায়াবতী। তোমাকে না দেওয়া ভালোবাসাগুলো পড়ে আছে। অনেক স্বপ্ন দেখা বাকি আছে। আমাকে কেন এত নিঃস্ব করে ছেড়ে গেলে মায়াবতী? চলেই যখন যাবে এলে কেন?
তবুও যেখানে থাকো ভালো থাকো। আমি তোমার কাছে খুন শীঘ্রই আসব। ভালোবাসা দিতে একটু ও কার্পণ্যতা করব না তখন।
সাজিয়া বেগম ছেলেকে দেখে ঝাপটে পড়ে।
‘ আব্বা আমার ঘরের রাণীকে কোথায় রেখে এলি? ও আব্বা? সবকিছু শেষ করে মেয়েটা এতবড় কাজ কি করে করল? তোর কথা কেন ভাবেনি আব্বা?
সজীব বলল
‘ ও মায়াবতী না আম্মা। ও মায়াবিনী। ও ছলনা করেছে আমার সাথে। তার মায়ায় আমাকে ফাঁসিয়ে দিয়ে চলে গেছে। ও আমাকে ঠকিয়েছে আম্মা। ঠকিয়েছে। আমি ওকে ভালোবেসেছি আম্মা। ও বাসেনি। বাসেনি।
_______
প্রথম পরিচ্ছেদ,
ছাদে দাঁড়িয়ে আকাশের মস্তবড় চাঁদটার দিকে তাকিয়ে সজীব বলল,
‘ আজ পহেলা জুন প্রিয়তমা। এই দিন আমি তোমাকে প্রথম দেখেছি। এইদিন আমি তোমাকে পেয়েছি। তুমি বিশ্বাস না করলে ও বলব এই দিন আমি তোমাকে ভালোবেসেছি। কিন্তু তুমি বাসোনি প্রিয়তমা। তুমি মায়াবতী নও, তুমি মায়াবিনী ।
বলেই মাথা নামিয়ে ফেলল সজীব। গাল বেয়ে গড়াল অঝোর ধারায় বর্ষণ।
পেছনে এসে দাঁড়াল কথা। সজীবের ঘাড়ে হাত দিতেই সামনে ফিরল সজীব।
কথা ভড়কে গেল। সজীবের চোখের জল দেখে তার দুচোখ ভর্তি হলো জলে। কি হয়েছে মানুষটার?
আচমকা কথাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল সজীব। বাচ্চাদের মতো কেঁদে বলল,
‘ কথা। কথা আমায় ওই চাঁদ এনে দাও। ওই আকাশের চাঁদকে এনে দাও প্লিজ। তাকে ছাড়া আমি ভালো নেই কথা। মাকে ও নিয়ে গেল সে।
কথা চেয়ে রইল চাঁদটার দিকে।
‘ ওই চাঁদের এমন কি আছে? চাঁদটাকে মানুষটা এত ভালোবাসে কেন? চাঁদকে হিংসে হয় কথার। খুব হিংসে হয়।
সজীব পড়ে রইল কথার কাঁধে নিচু হয়ে। কথাকে আর ও শক্ত করে আগলে নিল।
বলল,
‘ কথা আমি কেন তাকে ভুলতে পারিনা। সে তো আমায় ভুলে গিয়েছে। আমি আজও কেন তাকে ভালোবাসি? কেন কথা?
চলবে,
সবার মন্তব্য আশা করছি?