চিলেকোঠায় সমাপ্তি পর্ব ২+৩

0
669

#চিলেকোঠায়_সমাপ্তি
দ্বিতীয়_অধ্যায়
দ্বিতীয়_পর্ব + তৃতীয়_পর্ব
~মিহি

“এই মেয়ে সত্যি করে বলো কে তুমি? আমার উপর এমন নিকৃষ্ট অভিযোগ কেন লাগিয়েছো তুমি? আমি তো তোমাকে চিনিও না।” কথা শেষ করে আয়াশ পেছনে ঘুরতে যাবে এমন সময় রুফু তাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে। আয়াশ ছাড়াতে চেষ্টা করে কিন্তু রুফু ছাড়ে না। আচমকা হাততালির শব্দে দরজার দিকে তাকায় আয়াশ। সিদ্ধি দাঁড়িয়ে। আয়াশ রুফুকে ফেলে সিদ্ধির দিকে দৌড় দেয়।

সিদ্ধি আয়াশের কোন কথাই শুনছেনা। সে এ বাড়িতে থাকবে না। আয়াশ যতই সিদ্ধিকে বোঝানোর চেষ্টা করছে, সিদ্ধি কানেই নিচ্ছে না। ঘরে ঢুকে ব্যাগপত্র গুছিয়ে নিচ্ছে সে। আয়াশ করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।

-“এতটুকুই ছিল আমার প্রতি তোমার বিশ্বাস?”

-“বিশ্বাসের প্রশ্ন তোমার মতো বিশ্বাসঘাতকের মুখে মানায় না। আমার আগেও তোমার জীবনে কেউ ছিল তাহলে তাকে নিয়েই থাকতে। আমার জীবনটা কেন নষ্ট করলে?”

-“আমি সেই ছোট থেকেই শুধু তোমাকেই ভালোবাসি।”

-“উফ! আবার নাটক। তোমার সাথে আমার দেখাই হয়েছে কলেজ লাইফে আর তুমি কিনা আমায় ছোট থেকে ভালোবাসো? ফাজলামি করতেছো আমার সাথে?”

-“তোমার ওসব মনে নেই সিদ্ধি কিন্তু প্লিজ আমায় ভুল বুঝো না। আমি শুধু তোমাকেই ভালোবাসি।”

-“তোমার সাথে আমি কোন কথা বলতেই ইচ্ছুক না।”

আয়াশকে সামনে থেকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে সামনে এগোয় সিদ্ধি। আচমকা মাথাটা ঘুরে উঠে। টাল সামলাতে না পেরে পড়ে যেতে নেয় সিদ্ধি। আয়াশ সিদ্ধিকে ধরে ফেলে, কোলে করে বিছানায় বসায়। সিদ্ধি নড়ছে না। আয়াশ পানি ছিটায় সিদ্ধির মুখে, লাভ হয় না। চিৎকার করে মা আর নাফছীকে ডাকে।

আচমকা আয়াশের এমন চিৎকারে জোহরা বেগম আর নাফছী ভয় পেয়ে যায়। তাড়াহুড়ো করে ঘরে ঢুকে দেখেন সিদ্ধি জ্ঞান হারিয়েছে। আয়াশ চটজলদি ডাক্তারকে কল করে। নাফছী সিদ্ধির পাশে বসে আছে। জোহরা বেগম দোয়া পড়ছেন। আচমকাই কী হলো মেয়েটার!

ডাক্তার সাহেবা আসতে আসতে আধঘণ্টা লাগলো। তিনি এসে সবাইকে ঘর থেকে বের হতে বললো। ডাক্তার সাহেবা চেকআপ করলেন। বেশ কিছুক্ষণ পর জ্ঞান ফিরলো সিদ্ধির। ডাক্তার সাহেবাকে দেখেই সে কিছুটা বিচলিত হলো।

-“ডাক্তার সাহেবা আপনি? কী হয়েছে আমার?”

-“আরে শান্ত হোন মিসেস.চৌধুরী। আপনি মা হতে চলেছেন।”

-“আলহামদুলিল্লাহ। কিন্তু ডাক্তার সাহেবা, এ কথা আমার পরিবারকে জানাবেন না।”

-“সে কী! কেন?”

-“আমি তাদের নিজের মুখে বলতে চাই।”

-“বেশ বেশ। আমি আসছি তাহলে।”

ডাক্তার সাহেবা হাসতে হাসতে বেরিয়ে গেলেন। ডাক্তার সাহেবা চলে যেতেই আয়াশ দৌড়ে এসে সিদ্ধিকে জড়িয়ে ধরে। সিদ্ধিও আলতো করে জড়িয়ে ধরে আয়াশকে। কানের কাছে মুখ এনে বলে,”আপনি বাবা হচ্ছেন আয়াশ সাহেব।” সিদ্ধির বলা এক বাক্যে আয়াশের সারা শরীরে বিদ্যুতের ন্যায় কম্পন সৃষ্টি হয়। সিদ্ধিকে কোলে তুলে চিৎকার করে ওঠে আয়াশ। জোহরা বেগম মুখ টিপে হাসছেন আর নাফছী তো নাচতে শুরু করেছে। আয়াশের খুশির কোন কূল-কিনারা নেই। কিন্তু কথায় আছে না যেখানে সুখ, সেখানেই দুঃখ। রুফু মেয়েটা ঘরের এককোণে এসে দাঁড়ালো। রুফুকে দেখতেই রাগে সিদ্ধির মুখ লাল হয়ে উঠলো। এই মেয়েটাকে সে বিন্দুমাত্র সহ্য করতে পারে না। রুফু এসে সিদ্ধির পাশে বসে। কাঁদো কাঁদো গলায় বলে,”আপা, আপনার বাচ্চারে নিয়ে আপনি থাকেন, আমার স্বামীরেও নেন কিন্তু একটাবার আমার কথা ভাবেন। সারা গ্রামে চুনকালি পড়ছে আমার মুখে যে আমার স্বামী আমারে রাইখা চইলা গেছে। আমার কী হবে বলেন।” বলতে বলতেই রুফু কেঁদে ওঠে। সে ভেবেছিল সিদ্ধি আবারো আয়াশের উপর চড়াও হবে কিন্তু তা হলো না বরং সিদ্ধি বেশ শান্ত ভঙ্গিতে বললো,”তোমার আর কোথাও যেতে হবে না। এ বাড়িতেই থাকো। তোমার আমি আবার বিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করবো।” সিদ্ধির এমন কথায় রুফু খানিকটা থতমত খেয়ে যায়।

-“কী রুফাইদা? থাকবা না?”

-“আবার বিয়ে কেন? আমার স্বামী তো আছেনই।”

-“ডিভোর্স দিবে আয়াশ তোমায়।”

-“আসতাগফিরুল্লাহ! ওমন কথা কইয়েন না আপা।”

-“তুমি এখন যাও। আমি পরে কথা বলবো তোমার সাথে।”

রুফু মাথা নেড়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যায়। সিদ্ধি নাফছীকে ইশারা করে রুফুর পিছনে যেতে। নাফছী খুব সাবধানে রুফুর পেছন পেছন যায়। আয়াশ অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সিদ্ধির দিকে। মেয়েটা করছেটা কি!

-“কী করছো তুমি সিদ্ধি? কিছুইতো আমার মাথায় ঢুকছে না। তুমি কী কোনভাবে রুফুকে ট্র্যাক করার চেষ্টা করছো?”

-“রুফু কী রে? রুফাইদা ডাকবি। তোর আসল বউ নাকি ঐটা?”

-“ইশস! মায়ের সামনে তুই-তুকারি করছো, লজ্জা লাগে না তোমার? কেমন জানি হচ্ছো দিন দিন। বেহায়া!”

-“আহা! তোমার কত হায়া! যাও আমার জন্য অনেকগুলো আইসক্রিম নিয়ে আসো।”

-“এই সময় তো টক খেতে মন চায়।”

-“কয়টা বাচ্চা হইছে তোর? যেটা বলছি সেটা আন।”

সিদ্ধির ঝাড়ি খেয়ে আয়াশ মাথা চুলকাতে চুলকাতে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যায়। আর এদিকে জোহরা বেগমের হাসি থামছে না। আয়াশ যখন পেটে ছিল তখন রফিকউদ্দিন সাহেবের সাথে এমন করতেন তিনি। মুহূর্তগুলো এখন শুধুই স্মৃতি- ভাবতেই চোখ নোনা জলে ভরে আসে তার। সিদ্ধির মাথায় হাত রেখে দোয়া করে ঘর ছেড়ে বের হোন। সিদ্ধি সায়ন সাহেবকে কল দেয়। তিনি যে নানা হচ্ছেন কথাটা তো জানাতে হবে তাকে।

সিদ্ধি বেশ কয়েকবার সায়ন সাহেবকে কল করে কিন্তু কল ওয়েটিং বলছে। সিদ্ধি বুঝে উঠতে পারছে না এত সময় ধরে তার বাবা কার সাথে কথা বলছে। এরই মধ্যে রুফাইদা সিদ্ধির জন্য এক গ্লাস গরম দুধ নিয়ে আসে। সিদ্ধি খায় না, পাশে রেখে দেয়। আয়াশও তখনি আসে সিদ্ধির জন্য তেঁতুলের আচার নিয়ে। আচমকা রুফু আয়াশের হাত থেকে আচারের বয়ামটা নিয়ে কিছুটা আচার মুখে দেয়। তারপর উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলে উঠে,”আমার আবার আচার বড়ো ভালো লাগে তাই একটু নিলাম। লন আপা খান।” সিদ্ধির বেশ মন খারাপ হয়। আচারটা আয়াশ তার জন্য এনেছিল তাও প্রেগন্যান্সির প্রথম সময়ে। কত অনুভূতিমাখা একটা মুহূর্ত নষ্ট করে দিল এই মেয়ে। এর একটা বিহিত করতেই হবে। আয়াশ হেসে আচারের বয়ামটা রুফুকেই দিয়ে দিল। বলল,”ওটা তুমিই খাও। আমার স্ত্রীর জন্য আমি আরো এনেছি।” বলেই আরেকটা আচারের বয়াম সিদ্ধির হাতে দিল। এটা দেখে রুফুর মুখটা বিবর্ণ হয়ে গেল। বয়াম হাতে সে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। সিদ্ধি হাসছে। হাসতে হাসতেই বললো,”তোমায় না আইসক্রিম আনতে বলেছিলাম? তবে আচার কেন?” আয়াশ হাতে লুকিয়ে রাখা আইসক্রিমের বাটিটাও সিদ্ধির হাতে ধরিয়ে দিল। ব্যস! সিদ্ধির খুশি দেখে কে! সিদ্ধি মনের আনন্দে আইসক্রিম খেতে লাগলো।

_________________________

-“কাজ হয়েছে রুফু?”

-“জ্বী না! মালগুলো হেব্বি চালাক। ইচ্ছে করে ঘোরাচ্ছে আমায়। তবে আমার নামও রুফাইদা হক। আপনার কাজ হবেই, ডোন্ট ওয়ারি।”

-“বেশি সময় দিতে পারবোনা আমি। দুইদিনের মধ্যে কাজ শেষ করো। কাগজগুলোর আমার দুইদিনের মধ্যেই লাগবে।”

-“আচ্ছা ঠিক আছে।”

কল কেটে পেছনে ঘুরতেই রুফু দেখলো নাফছী সন্দিহান দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। রুফু কপালের ঘাম মোছার ভান করে নাফছীর সামনে থেকে চলে যায়। নাফছী অবশ্য রুফাইদার কথা শোনেনি কিন্তু মেয়েটা যে কোন একটা ষড়যন্ত্রের জাল পাকাচ্ছে তা স্পষ্ট বুঝেছে। কথাটা ভাবীকে জানাতে হবে, ভাবতে ভাবতেই সিদ্ধির ঘরের দিকে এগোলো নাফছী।

তায়েফউদ্দিনের শরীর আবারো খারাপ হচ্ছে দিনকে দিন। আনিসও আজকাল সব কুকর্ম বাদ দিয়ে ভাইয়ের সেবা করছে। তূর্যর সবদিক একা সামলাতে হচ্ছে। গ্রামে রাস্তা মেরামতের কাজে হাত লাগিয়েছে সে। একটু এদিক থেকে ওদিক হলেই লোকগুলো দায়সারাভাবে কাজ করতে শুরু করবে যেটা তূর্য চায় না। তাই বাড়ির দায়ভারটা আপাতত চাচা আনিসের উপরেই রেখেছে। এত ব্যস্ততার ভিড়েও একটা বিষয় তাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে। সব সত্যিটুকু আয়াশকে বলতে চায় সে কিন্তু সাহসে কুলাচ্ছে না। এত বড় সত্যির মুখোমুখি কিভাবে হবে সে?

চলবে…

[ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। সবাই বেশি বেশি রেসপন্স করবেন?]

#চিলেকোঠায়_সমাপ্তি
দ্বিতীয়_অধ্যায়
তৃতীয়_পর্ব
~মিহি

সিদ্ধি বেশ যত্ন নিচ্ছে নিজের। সবসময় আয়াশের আশেপাশে থাকার চেষ্টা করে। আয়াশের সবটুকু ঘিরে শুধু সিদ্ধি। জোহরা বেগম রোজ নিয়ম করে সিদ্ধিকে দিনে তিনবেলা ভরপেট খাওয়ান। বাচ্চার মতো “খাবোনা খাবোনা” করতে করতে একসময় ঠিকই খেতে হয় তাকে। আয়াশের কাছেই তার যতশত আবদার। কখনো এটা খাবো, কখনো ওটা খাবো। সিদ্ধি এখনো সায়ন সাহেবের সাথে কথা বলে উঠতে পারেনি। সায়ন সাহেবকে সুসংবাদ জানানোর জন্য মন আকুল হয়ে আছে তার। সিদ্ধি ঠিক করেছে আজ বাড়ি গিয়ে সায়ন সাহেবকে এ বাড়িতে নিয়ে আসবে। মেয়েদের প্রথম সন্তান সাধারণত বাবার বাড়িতে হয় কিন্তু ও বাড়িতে তো সিদ্ধির মা নেই। তাই সায়ন সাহেবকেই এ বাড়িতে এনে সবার মধ্যে থাকতে চায় সিদ্ধি। জীবনের এই আনন্দমাখা মুহূর্তে সে তার দুই পরিবারকেই নিজের পাশে দেখতে চায়।

আয়াশের ক্লিনিকে কিছু কাজ আছে, তার উপর আজকের দিন করে সে গ্রামে যায় তবে এ সপ্তাহে মনে হয় গ্রামে যাওয়া হচ্ছে না। সিদ্ধিকে নিয়ে একটা ভালো গাইনোকলজিস্টের কাছে যেতে হবে। আয়াশ মনে মনে ভাবে আজ যদি সে ডেন্টিস্ট না হয়ে গাইনোকলজিস্ট হত, তাহলে কেমন হতো? ভাবতে ভাবতেই আপনমনে হেসে ওঠে সে। ঠিক সেসময় রুফু চায়ের কাপ নিয়ে আসে আয়াশের স্টাডি রুমটাতে। রুফুকে আসতে দেখে দরজাতেই থামিয়ে দেয় আয়াশ।

-“রুফু, আমি কাজ করছি। যাও এখন।”

-“আপনার চা’টা? রেখেই যাই?”

-“আমি সকালে কী খাই না খাই সেটা সম্পর্কে এখনো অবগত নও তুমি। চা’টা বরং তুমি খাও।”

আয়াশের কথা শেষ হতে না হতেই সিদ্ধি এক মগ কফি হাতে ঘরে ঢোকে। রুফু তখনো দরজায় দাঁড়িয়ে। আয়াশ সিদ্ধির হাত থেকে কফিটা নিয়ে তাতে চুমুক দিতে দিতে বললো,” আমার চায়ের অভ্যেস নেই সেজন্যই বললাম তোমায় খেতে। এখন তুমি আসতে পারো।” রুফু ঠোঁটের কোণে হাসি ঝোলালেও তার বিবর্ণ মুখখানি মনের কথাটা বেশ ভালোই তুলে ধরলো। সিদ্ধি বেশ আহ্লাদীভাবে আয়াশের কোলের পর বসলো। সিদ্ধির এমন আচরঢে আয়াশ যেন আকাশ থেকে পড়লো। তার রাগকন্যার হঠাৎ হলো কী আজ? এমন আদর-আহ্লাদ! কী মতলবে এত কাছে আসছে কে জানে! মনে মনে দোয়া-দরুদ পড়ে আয়াশ আবারো কফিতে চুমুক দিল।

-“আয়শু! শুনো না।”

-“আয়শু আবার কে?”

-“তুমি! আনরোমান্টিক ছাগল একটা!”

-“ইশস! এসব আজগুবি নামে না ডেকে কী লাগবে সেটা বলো।”

-“আমি আজ বাবার সাথে দেখা করতে যাবো। চলো না আমায় রেখে আসো।”

-“আজ ডাক্তারের সাথে দেখা করতে যাওয়ার কথা। আমি কাল তোমায় নিয়ে যাবো বাড়িতে। আচ্ছা?”

-“নাহ! আজই যাবো মানে আজই।”

-“যথা আজ্ঞা মহারানি।”

আয়াশ হাসতে হাসতে সিদ্ধিকে জড়িয়ে ধরলো। সিদ্ধি আয়াশের চুল ধরে টানতে লাগলো। কফিটুকু শেষ করে আয়াশ সিদ্ধিকে বললো রেডি হয়ে থাকতে, ক্লিনিকের সামান্য কাজটুকু শেষ করেই সে এসে সিদ্ধিকে নিয়ে যাবে।

সিদ্ধি তো বেশ খুশি তবে তার লজ্জা লাগছে। বাবাকে নানা হওয়ার সংবাদ দিতে গিয়ে লজ্জা পাবে না তো সে? পাওয়াটাই স্বাভাবিক না কি? মাত্র তো বিয়ে, এখন বাচ্চা- এবার বুঝি পরিপূর্ণ হতে চলেছে সিদ্ধির সংসার। লাল পাড়ের হালকা সাদা একটা শাড়ি পড়ে সিদ্ধি, চুলগুলো খোঁপা করে খোঁপায় কাঁটা গোঁজে। সিদ্ধির কাছে বরাবরই নিজের চোখজোড়া বড্ড প্রিয়। সে নিজেও জানে না সে কেন এমন। বড়োই যত্ন করে চোখজোড়ায় কাজলের ছোঁয়া দেয় সে। এখন রেডি সে। চুপচাপ বিছানায় বসতেই নাফছী ছুটে এসে সিদ্ধির কাছে বসে।

-“ভাবীইইইইইই। আমি ফুপু হবো। ইশস! কী সুন্দর, গোলুমোলু দুটো বাচ্চা আমার কোলে বসে থাকবে।”

-“ওরে বাবা! দুটো?”

-“হ্যাঁ। দেখো তোমার টুইন বেবী হবে। তোমার জন্য আমি অনেকগুলো জোড়া কলা এনেছি।”

-“পাগলী মেয়ে!”

হাসতে হাসতেই সিদ্ধি দরজার দিকে তাকাতেই খেয়াল করল রুফু আয়াশের স্টাডিরুমে উঁকিঝুঁকি মারছে। আয়াশ তো ক্লিনিকে, তাহলে এই মেয়ে ও ঘরে উঁকি দিচ্ছে কেন? সিদ্ধি কিছু বলতে যাবে তার আগেই আয়াশের গলা শুনতে পেল। আয়াশ ডাকছে সিদ্ধিকে। নির্ঘাত আয়াশ ক্লিনিক থেকে চলে এসেছে। সিদ্ধি নাফছীকে বিদায় জানিয়ে জোহরা বেগমের ঘরের দিকে এগোলো। তিনি তখন বিশ্রাম নিচ্ছেন। সিদ্ধি আর বিরক্ত করলো না তাকে। নাফছীকে বলে রাখলো তারা দ্রুতই চলে আসবে। নাফছী মাথা নেড়ে স্বাচ্ছন্দ্যে সায় দিল। আয়াশ আর সিদ্ধি বেরিয়ে পড়লো। আয়াশ-সিদ্ধি বেরোতেই রুফু আড়ালে হেসে ওঠে। নাফছীর প্রথম থেকেই রুফুকে বেশ সন্দেহ হচ্ছে কিন্তু আপাতত এসবে পাত্তা দিল না সে। বাড়িতে নতুন সদস্য আসছে, তাই একটা ঘর সাজাতে হবে। নাফছী ব্যস্ত হয়ে পড়ে একটা ঘর সাজাতে।

________________________

-“তূর্য! আমায় মাফ করে দাও প্লিজ। আমি সত্যিই এসবের কিছুই জানতাম না।”

-“জানতেন না মানে? এতবড় পাপকর্ম করে এসে আপনি বলছেন জানতেন না? আপনার একটা অবৈধ সন্তান আছে, এ কথা যদি গ্রামের কেউ জানতে পারে, তাহলে তো আমাদের বংশের মুখে চুনকালি পড়তে বাদ রইবে না।”

-“এখন কী করবো তুমিই বলো।”

-“আপনার সন্তানকে ভুলে যান। সে যে আপনার সন্তান এটাও ভুলে যান। সে যে পরিচয়ে বড় হয়েছে, সে সেই পরিচয় ঘিরেই বেঁচে থাক। তার জীবনে কোনরকম অধিকার দাবি করবেন না আপনি।”

-“তাই বলে একটাবার নিজের সন্তানকে দেখতে পাবো না?”

-“এই একুশ বছরে যখন না দেখে থেকেছেন, তখন বাকি জীবনটাও পারবেন। দয়া করে নিজের স্বার্থের জন্য কারো ঘর ভাঙতে উদ্যত হইয়েন না।”

তূর্যর কথায় সলজ্জভাবে মাথা নত করে আনিস। সত্যিই তার মতো নির্লজ্জ, নিচ মানুষ এ পৃথিবীতে হয় না। যদিও সে নিজের ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করতে চায় কিন্তু সব ভুলের কি প্রায়শ্চিত্ত করা সম্ভব হয়? হয় না তো। আনিসের এখনো মনে আছে মেয়েটার কথা। বিবাহিত হলেও মেয়েটার রূপের মায়ায় পড়েছিল। মেয়েটার স্বামী বেজায় রাগী প্রকৃতির। সেজন্য মন খারাপ থাকতো মেয়েটার। দুর্বল জায়গাটাতেই আঘাত করেছিল আনিস। মিষ্টি মিষ্টি মুখের কথায় প্রেমের জালে ফাঁসায় মেয়েটাকে। অতঃপর সর্বনাশ করেই যোগাযোগ বন্ধ। মেয়েটাও একদিন স্বামী নিয়ে গ্রাম ছাড়লো। তারপর আর মুখোমুখি হতে হয়নি তার সাথে। আচ্ছা মেয়েটার স্বামী কি জানে সন্তানটা আসলে তার না? অনুশোচনায় চোখ বেয়ে ক্রমাগত অশ্রু ঝরছে তার। কেন যেন আজ নিজেকে এ পৃথিবীর নিকৃষ্টতম কীট মনে হচ্ছে। মাথার উপর ফ্যানটা ঘুরছে সজোরে অথচ কুলকুল করে ঘামছে আনিস। চোখ উপরে ঘূর্ণায়মান ফ্যানটার দিকে।

_________________

সিদ্ধি বেশ ফুরফুরে মেজাজে কলিং বেল চাপলো। উৎসাহে কুলাচ্ছে না, পরপর তিনবার কলিং বেল চাপতেই দরজাটা খুলে গেল। ভেতর থেকে এক ভদ্রমহিলা, বেশ সুসজ্জিত সাজে দরজাটা খুলে দিলেন। পোশাক জানান দিচ্ছে তিনি বেশ সম্ভ্রান্ত ঘরের কোন মহিলা, বয়স সর্বোচ্চ চল্লিশের কোঠায়। সিদ্ধি আর আয়াশ হতভম্ব দৃষ্টিতে একে অপরের দিকে তাকিয়ে আছে। ভদ্রমহিলা ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছেন ওদের দিকে।”কে এসেছে শোভা?” বলতে বলতে সায়ন সাহেব ভদ্রমহিলার পাশে এসে দাঁড়ালেন।সামনে আয়াশ আর সিদ্ধিকে দেখে সায়ন সাহেব যতটা না আশ্চর্য হয়েছেন, তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি আশ্চর্য হয়েছে সিদ্ধি।

সোফার একপাশে নিশ্চুপ হয়ে বসে আছে সিদ্ধি, মুখোমুখি বসে আছেন শোভা নামক ভদ্রমহিলা। বাড়ির পরিবেশ থমথমে, কেউ কোন কথা বলার সাহস পাচ্ছে না। শোভা অবশ্য সবার জন্য চা করে এনেছে কিন্তু সিদ্ধি তা মুখেই দিচ্ছে না। আর দিবেই বা কিভাবে? যে বাবা কয়েকদিন আগেও তার মায়ের কথা ভেবে কাঁদতেন, সে বাবাই কিনা আরেক মহিলাকে বাড়িতে এনে তুলেছেন? অন্তত নিজের মেয়েকে জানাতে পারতেন, সিদ্ধি তো মানা করতো না। বরং সেও চায় তার বাবা ভালো থাকুক। শোভা সিদ্ধির হাতে চায়ের কাপ ধরিয়ে দেয় কিন্তু সিদ্ধি ধরে না। কাপটা মেঢেতে পড়ে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যায়। ভেঙে যাওয়া কাপটার দিকে তাকাতেই চোখ বেয়ে অশ্রু গড়ায় সিদ্ধির।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here