চিলেকোঠায় সমাপ্তি পর্ব ১

0
1039

“আয়াশ ভাইয়া এক্সিডেন্ট করছে ভাবী। আপনি তাড়াতাড়ি আসেন।” তূর্যর কথা শোনামাত্র মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে সিদ্ধির। আজ তার আর আয়াশের প্রথম বিবাহবার্ষিকী আর আজকের দিনে কিনা তার স্বামীর প্রাণ সংশয়ে? সিদ্ধি তাড়াহুড়ো করে ঘর ছেড়ে বেরোতেই দেখল তার বাবা আজও বারান্দায় দাঁড়িয়ে কার সাথে যেন কথা বলছে। সিদ্ধি এইমুহূর্তে সেসবে পাত্তা দিল না। সায়ন সাহেবকে কিছু না বলেই বেরিয়ে গেল।

চিন্তায় হাত পা কাঁপছে সিদ্ধির। না জানি কী হলো আয়াশের, তূর্য তো ঠিকমতো কিছু বলছেও না। বড়সড় কোন দুর্ঘটনা ঘটলো না তো? আয়াশের অনিষ্টের আশঙ্কায় সিদ্ধির চোখ বেয়ে জল গড়াতে শুরু করেছে। আবারো তূর্যর নম্বর ডায়াল করলো সিদ্ধি। লাভ হলো না, নম্বর বন্ধ বলছে। সিদ্ধি কাঁদছে, রিকশাওয়ালা লোকটা একবার পিছনে ফিরে তাকালো। বোধহয় সিদ্ধির জন্য মায়া হলো সামান্য। সিদ্ধি নাফছীর কাছে কল দিল, নাফছীও কল ধরছে না। তূর্যর নম্বরে ক্রমাগত ডায়াল করে চলেছে সে। একটু পর তূর্য কল ধরলো। কল ধরেই বললো,”ভাবী, তাড়াতাড়ি আয়াশের বাড়িতে আসেন। জোহরা খালা আর নাফছী খুব কাঁদছে।” সিদ্ধি কিছু বলার আগেই আবারো কলটা কেটে গেল। সিদ্ধির এখন চিৎকার করতে ইচ্ছে হচ্ছে। কী হচ্ছে এসব তার সাথে? সবেমাত্র আয়াশকে নিয়ে জীবনের সবচেয়ে রঙিন মুহূর্তগুলো শুরু করেছিল সে অথচ শুরুতেই কিনা এমন ঝড় এসে তার জীবনটা উলট-পালট করে দিল? সিদ্ধির ফর্সা মুখ কাঁদতে কাঁদতে লাল হয়ে উঠেছে।

___________________

-“কীরে তূর্য? সব রেডি তো? কেক কই?”

-“উফ আয়াশ! এত টেনশন করছিস কেন তুই? সব হয়ে যাবে। কেক আসছে।”

-“হুশ! তোর কেক আসার আগে যদি সিদ্ধি চলে আসে? এত সুন্দর করে সব প্ল্যান করেছি আর সামান্য কেকের জন্য যদি সব ভেস্তে যায়, তোর খবর আছে।”

-“মাফ কর বাপ। আমি আবার কল দিচ্ছি।”

আয়াশ বেলুনগুলো নিয়ে দেয়ালের সাথে আটকাতে যায়। দেয়ালে সুন্দর করে লেখা হয়েছে হ্যাপী অ্যানিভার্সারি আয়াশ-সিদ্ধি। পাশে বেলুনগুলো লাগালে দেখতে সুন্দর লাগবে। আয়াশ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। ভাগ্যিস কাল হাবিজাবি বুঝিয়ে সিদ্ধিকে বাবার বাড়ি পাঠাতে পেরেছিল নাহলে আজ এতকিছু প্ল্যান করতেই পারতো না। জোহরা বেগম আয়াশের উপর বেশ রেগে আছেন।তিনি বারবার বলছেন,”তোদের এসব প্ল্যানের চক্করে মেয়েটা কাঁদছে নিশ্চিত! ছিঃ ছিঃ! সারপ্রাইজ দিবি ঠিক আছে, তাই বলে এক্সিডেন্টের কথা বলে ডাকার কী আছে? আহা রে মেয়েটা আমার।” তিনি আয়াশের সাথে কোনরকম কথাই বলছেন না কিন্তু আয়াশ তো জানে সিদ্ধিকে ডাকলে সিদ্ধি হুট করে আসবে না, হাজারটা প্রশ্ন করবে। হয়তো বুঝেও যাবে সবকিছু। তাহলে সারপ্রাইজটাই মাটি হয়ে যাবে।

দরজায় জোরে খটখট শব্দ শুনে আয়াশ বুঝে গেল নির্ঘাত সিদ্ধি এসেছে অথচ এই তূর্যর অর্ডার করা কেক এখনো এলো না। কত সাধ করে আয়াশ সিদ্ধির জন্য স্পেশাল চকলেট কেক অর্ডার করেছিল কিন্তু সেই কেক এলোই না। আয়াশ লুকিয়ে পড়লো আর নাফছীকে বললো যেয়ে দরজা খুলতে। নাফছী দরজা খুলে দিতেই সিদ্ধি হড়বড়িয়ে ঘরে ঢুকলো। আশেপাশে কিছুই খেয়াল করলো না, আয়াশকে খুঁজতে লাগলো। এমন সময় আয়াশ আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে বললো,”সারপ্রাইজ! হ্যাপি অ্যানিভার্সারি।” আয়াশের কথা শুনে হতবিহ্বল হয়ে যায় সিদ্ধি। ফর্সা মুখে কান্নার দাগ এখনো দৃশ্যমান। আয়াশের জন্য সারা রাস্তা কাঁদতে কাঁদতে এসেছে সে আর আয়াশ কিনা বিবাহবার্ষিকীর সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য ওকে এভাবে ডেকেছে? কটমট করে আয়াশের দিকে তাকিয়ে আছে সিদ্ধি। আচমকা একটা বক্স হাতে ছেলে এসে সিদ্ধির হাতে কেকটা ডেলিভারি দিল। সিদ্ধি কেকটা বক্স থেকে বের করলো। আয়াশ ঢোক গিলে বললো,”বউ, আসো কেক কাটি।” আয়াশের কথা শেষ হতে না হতেই সিদ্ধি সমস্ত কেকটা আয়াশের মুখে ছুঁড়ে মারলো। শুধু মেরেই ক্ষান্ত হয়নি, আয়াশের সমস্ত মুখে কেকটুকু ভালোভাবে মাখিয়েও দিল। আয়াশ করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সিদ্ধির দিকে। সিদ্ধির রাগ তখনো কমেনি। তূর্যর দিকে এমন দৃষ্টিতে তাকালো যেন ভস্ম করে দেবে ওকে। তূর্য ভয়ে “ভাবী আসসালামু আলাইকুম” বলে কোনরকমে অন্য ঘরে গেল। নাফছীও আর ওখানে থাকলো না। জোহরা বেগম তো অনেক আগেই চলে গেছেন। আয়াশ সমানে ঢোক গিলছে। সে নিশ্চিত এবার সিদ্ধি তাকে কাঁচা চিবিয়ে খাবে। নিষ্পাপ শিশুর মতো মুখ করে আয়াশ বললো,

-“বউ, রাগ করো না প্লিজ।”

-“কে তোর বউ? তুই না মরছিস? মরেই যা।”

-“এত্ত রাগ বাব্বাহ! আমার বউটা রাগ করলে তো একদম টমেটোর মতো লাল হয়ে যায়। আসো তো টমেটো বউ, কেক কাটবো।”

-“তোকে কাটবো আমি। ছুরিটা কই? কীরে, ছুরি কই?”

আয়াশ সিদ্ধির কথা শুনে টেবিলের পাশ থেকে ছুরিটা নিয়ে আলতো করে পকেটে ঢুকালো, সিদ্ধি আশেপাশে ছুরি খুঁজছে। আয়াশ যতই সিদ্ধিকে মানানোর চেষ্টা করছে, সিদ্ধি ততই রেগে আগুন হচ্ছে।

-“ও বউ শোনো না! তুমি না খেয়ে থাকলে তো আমার বেবীটাও না খেয়ে থাকবে।”

-“বেবী? সেটা কবে হলো?”

-“হতে তো দেরী নাই।”

-“তুই…তুই একটা…তোর সাথে কথাই বলবো না আমি। বের হ আমার রুম থেকে।”

-“এত রাগ করলে কিন্তু অন্য কেউ নিয়ে যাবে তোমার বরকে।”

আয়াশের মুখ থেকে কথাটা শোনামাত্র চোখে জল আসে সিদ্ধির। আয়াশকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে। আয়াশ অবশেষে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। রাগ ভেঙেছে মহারানির। আয়াশ মুচকি হেসে সিদ্ধিকে কোলে করে নিচে নিয়ে আসে। সিদ্ধি লজ্জায় চোখ বন্ধ করেছে। তূর্য আরেকটা কেক এনেছে, আগের কেকটা তো আয়াশের মুখে ছেপে গেছে। কেকটা টেবিলে রেখে উপরে সুন্দর করে মোমবাতি সাজালো তূর্য। আয়াশ মুখ ধুয়ে এসে সিদ্ধির পাশে দাঁড়ালো। দুজন এখন একসাথে কেক কাটবে। মোমবাতি নেভাতেই সকলে হাততালি দিল। কেক কাটলো দুজনে। আয়াশ প্রথমে সিদ্ধিকে কেক খাওয়ালো। সিদ্ধি আয়াশকে কেক খাওয়াতে যাবে এমন সময় কেউ আয়াশের নাম ধরে ডেকে উঠলো। আয়াশ ও সিদ্ধি তাকালো সেদিকে। কাঁচা হলুদ রঙের শাড়ি পড়া একটা উনিশ-বিশ বছরের মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে দরজায়। সিদ্ধি অবাক দৃষ্টিতে আয়াশের দিকে তাকালো। মেয়েটা এসেই কাঁদতে কাঁদতে আয়াশের পায়ের কাছে বসে পড়লো। চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে বললো,”আপনি আমায় ছেড়ে কেন চলে এসেছেন? আমি আপনাকে কত খুঁজেছি। নিজের স্ত্রীকে একা ফেলে চলে আসতে লজ্জা লাগলো না আপনার?”

সিদ্ধি অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মেয়েটার দিকে। কী বলছে এই মেয়ে? আর আয়াশই বা কিছু বলছে না কেন? সিদ্ধি হাতে রাখা কেকটুকু মেঝেতে ছুঁড়ে ফেলে সিড়ি বেয়ে উপরে উঠে যায়। আয়াশ কিংকর্তব্যবিমূঢ়। কী হচ্ছে কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না সে। মেয়েটা তখনো মেঝেতে আয়াশের পায়ের কাছে বসে কাঁদছে। আয়াশ একটু জোরেই চেঁচালো মেয়েটার উপর। মেয়েটা উঠে কাঁদো কাঁদো গলায় জোহরা বেগমের কাছে গিয়ে বললো,”আম্মা, আমার নাম রুফাইদা, ছোট্ট করে সবাই রুফু ডাকে। বিশ্বাস করেন, আপনার ছেলের সাথে আমার বিয়ে হয়েছিল। আপনার ছেলে আমার সাথে থাকছেও অনেকদিন। তারপর হঠাৎ করেই শহরে আইসা আমার সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দিছে। আম্মা, আপনিই কন আমি কী করমু।” মেয়েটার কান্নায় জোহরা বেগমের মন খানিকটা মলিন হলো কিন্তু কোন ভিত্তি ছাড়া এই মেয়ের কথায় বিশ্বাস করে তিনি তো নিজের ছেলেকে অবিশ্বাস করতে পারেন না। সত্যিটা কী তা খুঁজে বের করতে হবে। তিনি নাফছীকে বললেন মেয়েটাকে তার ঘরে নিয়ে যেতে। মায়ের এমন কথায় নাফছী ভ্রু কুঁচকে তাকালো। অতঃপর রুফুকে নিয়ে নিজের ঘরের দিকে এগোল। আয়াশ সিদ্ধিকে কী করে বোঝাবে এখন? মেয়েটা দরজা অবধি খুলছে না। রুফু মেয়েটাকে যে বেশ পরিকল্পনা করে এখানে পাঠানো হয়েছে তা বেশ বুঝতে পারছে আয়াশ কিন্তু কে পাঠালো তাকে আর কেনই বা পাঠালো?

চলবে…

#চিলেকোঠায়_সমাপ্তি
দ্বিতীয়_অধ্যায়
সূচনা_পর্ব
~মিহি

[ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। আয়াশ-সিদ্ধি জুটিকে নিয়ে আবার আসলাম। সকলে বেশি বেশি গঠনমূলক মন্তব্য করবেন।??]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here