চাঁদের কলংক পর্ব ৭

0
1521

#চাঁদের_কলংক (৭)
#রেহানা_পুতুল
বাজারে পা রাখতেই শয়ন যা শুনল। তাতে সবার আফসোস হলেও তার কোন দুঃখবোধ হলনা।

শয়ন সামনের চা দোকানটায় ঢুকে বসল। গ্রামের মফিজ আলীর চায়ের দোকানে সবসময় ভীড় লেগেই থাকে। সে একজন সৎ চা বিক্রেতা। বাজারের পাশেই তার বাড়ি। তার মালাই চায়ের বৈশিষ্ট্য হলো, নিজের পালা গরুর দুধ দিয়েই সে চা তৈরি করে। দুধে কোন পানি মেশায়না সে। বিশুদ্ধ চা বলা যায়। তার চায়ের জনপ্রিয়তা ও বিক্রি বেশির কারণে পাশের চা বিক্রেতাদের চক্ষুশূল সে। তাকে নানাভাবে উচ্ছেদ করতে গিয়েও অন্যরা পারেনি। কারণ এই দোকান তার নিজের। বহু বছর আগে তার দাদার কেনা জায়গা ছিল এটা। তাই পৈত্রিক সূত্রে প্রাপ্ত। ঘটনাক্রমে তারা সচ্ছল থেকে অসচ্ছল পরিবারের খেতাব পেয়ে যায়। সে আরেক কলংকিত ইতিহাস।

শয়ন আস্তে আস্তে চা খাচ্ছে চুমুক দিয়ে। শুনতে পাচ্ছে অন্য মানুষদের বলা কথাগুলো।

” আদিল ছেলেটা কত ভালো ছিল। সবাইর বিপদ আপদে এগিয়ে আসে সবসময়। আল্লাহর যা ইনসাফ। এত বড় বাইক এক্সিডেন্ট কিভাবে হলো? ”

” সেটাই তো ক্লিয়ার করে জানিনা। সেতো এই কয়মাস গ্রামেই ছিলনা। হুট করে কখন আসল। আবার কখন এটা ঘটল। ঢাকা থেকে নাকি সে প্রায়ই মোটরসাইকেলে আসা যাওয়া করে গ্রামে। আচ্ছা এমন হলে কি বাঁচে?”

তাদের কথার মাঝেই শয়নকে চেনা কনক নামে এক ছেলে ঢুকল দোকানে। বয়সে শয়নের বেশ ছোট।

” আরেহ শয়ন ভাই। আপনার শশুর বাড়িতো আদিল ভাইদের পাশেই। আপনি জানেন নাকি মূল কাহিনী? ”

শয়ন অবাক হলো। আগ্রহভরা দৃষ্টি নিয়ে বলল,
“আমি কিছুই জানিনা। কি হয়েছে কনক ? ”

” আদিল ভাই ছিল ঢাকায়। গতরাত নাকি বাড়িতে এলো। এবং ঘটনাও নাকি রাতেই ঘটেছে। বাইক এক্সিডেন্ট করেছে নাকি বাড়ির সামনে এসেই। উনার পু’ রু’ ষা’ ঙ্গ নাকি কাটা পড়েছে। রাতেই সদর হাসপাতালে ভর্তি করেছে। তাদের মরা বাড়ি মরা ঘর হয়ে আছে।”
শয়ন বিষ্পোরিত জ্বলজ্বল চোখে চেয়ে রইলো।

” কি বাজে বকছ। তুমি কিভাবে জানলে? ”

” আদিল ভাইয়ের আপন চাচাতো ভাইয়ের সাথে আমার ক্লোজ সম্পর্ক। সে গোপন সূত্রে জানিয়েছে আমাকে। তারা এটা গোপন রাখছে নাকি। কাউকেই বলছেনা। ভিন্ন কথা বলছে। লজ্জায় হয়তো লুকাচ্ছে।”

শয়ন চা খাওয়া শেষ করল দ্রুত। চিন্তিত মুখে নিজে নিজেই বলল,
কিভাবে এক্সিডেন্ট হলে এমন হতে পারে বোধগম্য হচ্ছেনা আমার?

” ভাই আপনি ভাবিকে জিজ্ঞেস করলেইতো পারেন। আমি সত্যি না মিথ্যে বলছি তখন বুঝবেন।”

” ফাজিল ছেলে। সে নতুন বউ। এমন কথা বলবে আমার কাছে? যেখানে তুমি বলছ ওরা গোপন রাখছে এই কথা। সেখানে পাশের বাড়ির লোকজন না জানাটাই স্বাভাবিক। ”

” হুম তাও কথা। খারাপই লাগছে আদিল ভাইয়ের জন্য। জীবনে নাকি আর বিয়েই করতে পারবেনা শুনলাম। ”

” কেন পারবেনা। এখন প্রযুক্তির কল্যাণে চিকিৎসা বিজ্ঞান অনেক এগিয়ে। শরীরের যেকোনো কাটা অংশ অনায়াসেই জোড়া লাগানো যায়। তবে সেরে উঠতে সময় লাগবে কয়েক মাস।”

” ভাই ঘটনাতো আরোও ভিতরে চাপানো। ”

চোখের পাতার ইশারায় শয়ন অবাক হয়ে জানতে চাইলো,
” কিইই কনক?”

” ভাই। উনার সেই অঙ্গই নাকি খুঁজে পায়নি। জোড়া দিবে কিভাবে বলেন। এজন্যইতো তার ঘরের লোক বুক চাপড়ায়ে বিলাপ করছে। উনার অবস্থাও নাকি শোচনীয়। প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছে।”

শয়ন কনকের সামনে আক্ষেপের সুর তুলল বেশ। কাজ আছে বলে তাড়া দিয়ে বের হয়ে গেল দোকান থেকে। ব্যস্ত পায়ে একটা রিকশা নিয়ে চলে গেল বাড়িতে।

বাবা মায়ের রুমে গিয়ে বিষয়টা জানাল।
তার বাবা বলল,
” আমিও শুনছি। তুই বের হয়ে যাওয়ার পর। তাহের ভাই ঢাকা থেকে আমাকে ফোন দিয়ে জানিয়েছে। কিন্তু সবার কাছেই এটা ধোঁয়াশা। কিভাবে এক্সিডেন্ট হলে এমন হতে পারে আল্লাহ মালুম। তুই কি বৌমাকে একটা ফোন দিবি নাকি?”

” নাহ। তাকে ফোন দেওয়ার কারণ আছে নাকি? ”

” স্বামী স্ত্রীকে ফোন দিতে কারণ লাগে। এটা আমার জানা ছিলনা। ”
ব্যথিত চিত্তে বললেন কামরুল মির্জা।

শয়ন পিতার কথার প্রতিউত্তর না দিয়ে নিজের রুমে চলে গেল। ভিতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিল। ইজি চেয়ারটায় আরাম করে বসে দুলতে লাগল। দুই ঠোঁটের মাঝে একটি সিগারেট রাখল। গ্যাসলাইটটা দিয়ে জ্বালিয়ে নিল সিগারেটটি। মুখভর্তি ধোঁয়া ছাড়ল উপরের দিকে লম্বা করে।

উড়ে যাওয়া ধোঁয়াগুলোর দিকে তাকিয়ে চিন্তা করতে লাগল একেই বলে প্রকৃতির বিচার। কোথায় নিজের হাতে খু’ন করব বলে ঠিক করেছি। সেখানে আমার কাজটা পকৃতিই করে দিল। হাহ! পাপ বাপকেও ছাড়েনা আবার বিশ্বাস করলাম আজ।

————-

বিয়ের পরেরদিন সকালেই আদিলকে মেসেজ দেয় তন্দ্রা।
” আদিল ভাই। আপনার কথাই সত্যি। শয়নের সাথে আমার বাসর হয়নি। বাকি জনমেও মনে হয় হবেনা। সে আমাকে গ্রহণ করেনি। বাসায় অকথ্য আচরণ করেছে। সে আগে জানলে আমাকে বিয়েই করতনা। আমি আমাদের বাড়ি চলে যাব দুদিন বাদে। আপনি আমাকে নিয়ে যান। নয়তো মৃত্যুই হবে আমার শেষ আশ্রয়। আপনার মেসেজের অপেক্ষায়।”

আদিল খুশীতে টগবগ করে উঠে। সারামুখে বিশ্বজয়ের অবাধ্য হাসির ঝিলিক।
তড়িতেই রিপ্লাই দিল,
” আমি যেখানেই আছি পরশু রাতে আসব। রাতেই তুই আমাদের বাড়ির সামনে থাকিস। ভয় পাবিনাতো আবার? আমি কাছাকাছি এসে মেসেজ দিব। বাইকে করে তোকে নিয়ে অন্যদিকে চলে যাব। তারপর কাজী অফিসে গিয়ে বিয়ে করে ফেলব। ”

” আচ্ছা আদিল ভাই। নাহ ভয় পাবনা।”

” অমাবস্যা চলছে। তিমির আঁধারে ছেয়ে আছে রাতের নিস্তব্ধ প্রকৃতি ও চারপাশ। গা ছমছমে ভুতুড়ে পরিবেশ। তন্দ্রা আগেই সুযোগ করে লুকিয়ে ছুরির মাঝে শান দিয়ে নিল। কোরবান ঈদের সময় এই ছুরিটা দিয়েই সব বাঘা বাঘা গরুর গলার র’ গ কাটা হয়। আর সেখানে সামান্য কয়েক ইঞ্চির মাংসপিণ্ড কাটা যাবেনা তা কি হয়ে হয়। আগে আদিলকে খু’ ন করব। তারপর তার লি’ঙ্গ কুচিকুচি করব। তারপর জেলখানায় পঁচে মরব। ব্যাস। কলংকিত জীবন নিয়ে কারো গলগ্রহ হয়েই থাকবনা। দূর আকাশের চাঁদের মতো দূর বহুদূরে থাকব।

এমন বিষাদগ্রস্ত ভাবনার মাঝেই,
কয়েকফোঁটা অশ্রুকণা গড়িয়ে পড়ল টুপটুপ করে তন্দ্রার আঁখিকোন হতে। সময়, পরিবেশ, পরিস্থিতি একজন মানুষকে কতটা সাহসী করে তোলে তা তন্দ্রা নিজেকে দিয়েই আবিষ্কার করল।

আদিল তন্দ্রাকে মেসেজ দিল বাড়ির কাছাকাছি এসে। সময় রাত এগারোটার পরে। গ্রামে এ সময় মানেই বহুরাত। পকৃতিতে নির্জনতা নেমে আসে হুড়মুড় করেই।

তাহের উদ্দীন ঢাকায় চলে গিয়েছে ব্যবসায় তাগিদে। এই কয়দিন বিয়ের ধকল সামলাতে গিয়ে রাহেলার কোমর ব্যথা বেড়ে দিগুণ হয়ে গিয়েছে। ম্যাচম্যাচ শরীরটা নিয়ে গভীর নিদ্রায় অচেতন হয়ে আছে সে। তনু মরার মতো ঘুমাচ্ছে। তার পাশে এখন বাঁশ কাটলেও হুঁশ হবেনা আর৷

ঘুমালে মানুষ প্রায় অর্ধমৃত হয়ে যায়। কথাটা অনেকটাই সত্যি। তন্দ্রা বড় একটি ওড়না দিয়ে মাথা ঢেকে নিল। কাঁধে নিল তার ভার্সিটির বড় ব্যাগটি। ওড়নার নিচে হাতের মধ্যে ছুরিটি লুকানো। আদিল আসার আগেই তন্দ্রা পৌঁছে গেল তাদের বাড়ির সামনের বাগানের ভিতরে।

তন্দ্রা বিশাল আমগাছটার আড়ালে চেপে দাঁডিয়ে আছে। সূক্ষ্ম দৃষ্টি সামনের পথপানে। আচম্বিততে তন্দ্রা দেখতে পেল অন্ধকারের মধ্যে আদিল বাইক নিয়ে কাত হয়ে পড়ে গেল। উঠতে পারছেনা। তন্দ্রা তার কাছে গেল। মোবাইলের আলো ফেলে দেখতে পেল,
প্রচন্ড যন্ত্রণা হচ্ছে আদিলের শরীরে। কপাল থেকে গলগলিয়ে রক্ত বের হচ্ছে। সে চোখ দুটো খোলা রেখে পুরো মুখ ওড়নার পাতলা আবরণে ঢেকে ফেলল। আদিলের উরুর কাছে বসে পড়ল।বিদুৎ গতিতে জিন্সের প্যান্টের জিপার খুলে নিল। টের পেল আদিল। চিৎ হয়ে পড়া থেকে কুঁকিয়ে বলল আদিল,
তন্দ্রা আসলি তুই। উরুর ওখানেও কেটে গেল নাকি?

তন্দ্রা নিরুত্তর। হাতের ধারালো ছু’রিখানা দিয়েই একটানেই কেটে নিল আদিলের গোটা লি’ঙ্গখানি। সেটা হাতে নিয়েই চটজলদি উঠে দাঁড়ালো।

ওহ মাগো! বলে চাপা আর্তনাদ করে উঠলো আদিল। চাইলেই দাঁড়াতে পারছেনা।

” ওই মা’গী’ ওই। কি করলি তুই। খোদার কসম বেঁচে থাকলে তুই শেষ। ”

তন্দ্রার এসব শোনার সময় নেই। নিষ্ঠুরের সাথে নিষ্ঠুর না হলে টিকে থাকা যায়না। যে অপরাধের বিচার আইন করতে পারবেনা। সেই অপরাধের বিচারকার্য নিজের হাতেই অর্পণ করে নিতে হয়।

তন্দ্রা প্রায় দৌড়ে পুকুর পাড় অতিক্রম করে তাদের বাড়ি চলে গেল। এই পুকুরপাড়ের একপাশটায় আদিলদের বাড়ি। অপরপাশটায় তন্দ্রাদের বাড়ি। বলতে গেলে এক বাড়ির মতই। নিজের রুমে বসে কয়েকটুকরো করে নিল আদিলের লি’ঙ্গটাকে। কাগজের প্যাকেটে মুড়ে খাটের তলায় লুকিয়ে রাখল। কাল দিনে রান্না শেষে মাটির চুলার গনগনে কয়লার ভিতর দিয়ে দিয়ে ছাইঁ করে ফেলবে। ভারি ভারি নিঃশ্বাস ছাড়ছে তন্দ্রা। গলা তুলে দুই গ্লাস পানি খেয়ে নিল।

_______

কাকপক্ষীও সাক্ষী রইলনা নিশি রাতের এই বিভৎসতায়। তার ঠিক পনেরো দিন পর এক ভোরেই আদিল মারা গেল হাসপাতালের বিছানায়। কিন্তু তার পরিবার ডাক্তারদের সাথে তোড়জোড় শুরু করেছে। তাদের বিশ্বাস আদিলের মৃত্যু স্বাভাবিকভাবে হয়নি। তাকে হত্যা করা হয়েছে। তারা মামলা দিবে বলে আদিলের চিকিৎসা করা ডাক্তারকে হুমকি দিল। তন্দ্রার অধর জুড়ে প্রষ্ফুটিত হলো প্রলম্ভিত হাসি।

চলবে ঃ ৭ ( মন্তব্য ও শেয়ার চাইই।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here