চন্দ্রাক্ষী পর্ব ৪

0
550

#চন্দ্রাক্ষী
#সাদিয়া_খান(সুবাসিনী)
#পর্বঃ৪

আমার স্বামী বিয়ার তিন মাসের মাতায় আরেকটা বিয়া কইরা আনে। তার খালাতো বইনেরে। তহন আমি দুই মাসের বাচ্চা পেটে পালতাছি।
আমি আমার বাপ মায়ের সাত নাম্বার মাইয়্যা। গায়ের চামড়া কালা বইলা খুব একটা আদর যত্নাদি পাই নাই।
তারপর গ্রামে আইলো এক রোগ। আমারে নাকী পোলিও রোগে ধরছে।
ছোট্ট বেলা থাইকাই খোড়াই হাটতাম।
বাপ-মায়ের গালি, বোনেগো কটু কথা কততা শুনছি। ভাবছি জীবন একদিন ঠিক হইয়া যাইব। কিন্তু জীবন ঠিক হয় না গো বইনে ঠিক হয় না।

জামাইয়ের বাড়ি পয়লা তিন মাস খুব সুখেই কাটলো। জামাই আমারে ওঝা দিয়া ঝাড়ফুঁক করায়, নিজে পা মালিশ কইরা দেয়, চুলে তেল দিয়া দেয়। আরো কত কিছু কিন্তু অভাগীর আর কপাল!
যে দিন বিয়া কইরা আনলো হেদিন থাইক্যা শুরু অইলো আমার আরেক নরকবাস। খাইতে বইতে ছোট বউয়ের খোটা দেয়৷
জামাই তো এক রাইতেই বইদলা গেলো। একদিন পুকুর ঘাট থেইকা পানি আনবার যাইয়া পিছলা খাইয়া পড়লাম। আর পেটের বাচ্চাডারে হারাইলাম। তারপর আর জামাইয়ের ভাত কপালে জুটলো না। এহন এই গ্রামেই থাকি।
তোমাগো লিগা রান্দাবারি করবার দায়িত্ব পাইছি।
চলতে আমার কষ্ট তয় আমারে ঘেন্না কইরো না মা৷

পঞ্চাশের মহোনায় ভদ্রমহিলার বয়স৷ কাঁচাপাকা চুল উঁকি দিচ্ছে ঘোমটার আড়ালে। সে বসে আছে শিমুল গাছটার নিচে।
একা ঘরে বসে ছিল আরীকাহ্। তাকে দেখে কথা বলতে এলেই শুনতে পেলো তার জীবন কাহিনী।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আরীকাহ্ উঠে দাড়ায় শিমুল গাছের নিচটায়।

“আমাদের সবার জীবনের একটা গল্প থাকে। সে গল্পটা কখনো কাউকে বলা হয় না তবুও বলতে ইচ্ছে করে।”

নতুন জায়গায় পুরো টিম নিয়ে খুব দ্রুত সব গুছিয়ে নিয়েছে এশাদরা৷ কাল থেকেই শুরু হবে গ্রাম বাসীর কান্নাহাসির গোপন কথা শোনা।
নিজের জন্য বরাদ্দকৃত রুমে বসে এশাদ ফোন হাতে নিলেন।
অল্প সল্প কথায় খুব দ্রুত নূরীর সম্পর্কে একটা ছোট্ট মুঠোবার্তা পাঠিয়ে দিলেন আরীকাহ্-এর ফোনে।

নূরী শুধুই কলিগ। কখনো বন্ধু অবধি হয়নি। এক তরফা ভালোবাসা শুধু নূরীর দিক থেকে শুরু থেকেই ছিল। এতদিন আরীকাহ্ কে জানায়নি কারণ প্রয়োজন হয়নি তবে এখন আরীকাহ্-এর জানা প্রয়োজন। কারণ একজন স্বামীর সকল কিছুতেই থাকে স্ত্রীর অধিকার।

মেয়েদের মাথার দুপাশে এবং মাথার পিছনে দুজোড়া অদৃশ্য চোখ থাকে। যে চোখ দ্বারা তারা বুঝতে পারে কেউ তাদের দেখছে।
আরীকাহ্-এর এই মূহুর্তে মনে হচ্ছে কেউ তাকে দেখছে। সবাই রাতের বেলা খেতে বসেছে।
এক সাথে, খাওয়ার সময় হচ্ছে নানান আলোচনা। আরীকাহ্ এক মনে খেয়েই চলেছে বললে ভুল হবে।
তার মাথায় চলছে কুহুকপুরে কন্যা সন্তান জন্মের দায়ে জীবন্ত কবর দেওয়ার নিউজটা।
হাত দিয়ে ভাত নড়াচড়া করছিল আরীকাহ্। হঠাৎ বাম হাতের উপর কারো স্পর্শ অনুভব করতেই তাকিয়ে দেখে এশাদ হাত বাড়িয়ে হাত ধরেছে।
মুচকি হেসে নিজ প্লেটের আধ খাওয়া ইলিশ মাছের পেটির টুকরো তুলে ধরেছে আরীকাহ্-এর মুখের সামনে৷
কোনো কিছু না ভেবেই আরীকাহ্ এশাদের হাত থেকে খাওয়া শুরু করে৷

আরীকাহ্ শুনেছে একজন নারীর জন্য না কী তিন জন পুরুষ বেহেশতে যাবে অথবা দোযখে যাবে।
বাবা,ভাই এবং স্বামী।
অদ্ভুত ব্যাপার হলো আরীকাহ্-এর বাবা, ভাইয়ের সাথে এশাদের বড্ড মিল।
ভাই ঠিক এভাবেই খাইয়ে দিতো। আচ্ছা!ভাইয়ের
খুব কী প্রয়োজন ছিল এভাবে ফাকি দেওয়ার?

আরীকাহ্ কে অন্যমনস্ক দেখে এশাদ জিজ্ঞেস করে,

“কি হয়েছে? ”
“আর না খাই? ”
“আর একটু। চলো গল্প করতে করতে খাবার শেষ করে ফেলি?”
“হুম।”
“কেমন কাটলো আজ দিন?”
“ভালো।”
“ম্যাসেজ পেয়েছিলে?”
“হুম।”
“রাগ হচ্ছে?”
“আরে না।”
“আরু! ভাত মুখে দাও। এভাবে বসে না থেকে।”
“হুম।”
“কিছু হয়েছে?”
“কাল ভাইয়ার………”
“মনে আছে। কী করতে চাইছো?”
“এখানে ছোট বাচ্চাদের কিছু আছে?”
“এখানের মানুষ নিজেরাই নিজেদের চালাতে পারে না। তারা কীভাবে এতিমখানা চালাবে?”
“একটু বাহিরে খোলা হাওয়ায় নিয়ে যাবে? ”
“এক শর্তে!”
“কী?”
“শাড়ি পরবেন। হাতে একগুচ্ছ শুভ্র সাদা রেশমী চুড়ি।”

রাতে যখন এশাদ, আরীকাহ্ বেরিয়েছে তখন হালকা বাতাস বইছে। কিছুটা শীত লাগছে তবুও যেন এভাবেই ভালো লাগছে।বাতাসের সমুদ্রে বসন্তের সৌরভ।
এশাদের ফোনে হুট করেই কল এলো।
এক হাতে আরীকাহ্-এর হাত ধরে সে কথা বলায় ব্যস্ত হয়ে যায়।
আরীকাহ্ এশাদের হাত ধরেই সামনে আশেপাশে তাকিয়ে দেখছিল।
দমকা বাতাসে ভ্যাপসা গন্ধ ভেসে আসছে।
বাজে গন্ধ, গন্ধের কারণ খুঁজতে খুঁজতে আরীকাহ্ দেখতে পেলো

হাত দশেক দূরে একটা গাছের মধ্যে কোনো একটা বাচ্চা মেয়েকে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে।
তার গা দিয়ে আসছে রক্তের হিমশীতল গন্ধ।
অদ্ভুত ব্যাপার হলো মেয়ের শরীরের নারী অংশ কেউ কেটে নিয়েছে। নৃশংস ভাবে কেটে নেওয়া হয়েছে। রক্ত জমাট বেধে গেলেও উল্টো ঝুলিয়ে রাখা মেয়েটার চোখেমুখে ভয়৷ রক্তহীন চোখে তাকিয়ে আছে আরীকাহ-এর দিকে।
হঠাৎ আরীকাহ-এর মনে হলো মেয়েটা তাকে দেখে হাসছে৷
মৃত্যুর হাসি।

চলবে
#ছবিয়ালঃনিশাত

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here