#চতুষ্কোণ /পর্ব:-০৭
Sharifa Suhasini
চোখের জল ফেলে সে ভাবির কাছে হাতজোড় করে বললো,
—যা ঘটেছে, তা এই ঘরের বাইরে প্রকাশ করো না ভাবি। তুমি তো জানো, তোমাদেরকে আমি কত সম্মান করি। তোমাদের সংসারে অশান্তি হোক, এমন সুযোগ আমি রাখতে চাই না। আজই আমি এই বাড়ি থেকে আলাদা হয়ে যাবো। নাবিলাকে নিয়ে আমি তোমাদের থেকে অনেক দূরে সরে যাবো। অনেক দূর।
এতক্ষণ পর নাবিলা শামীমের দিকে ফিরে তাকায়। তার সেই ফেরানো দৃষ্টিতে নিদারুণ অসহায়ত্ব। শামীম কী সত্যিই আলাদা হয়ে যাবে? আর আলাদা হলে সে কী আর কোনোদিন মাহদীকে দেখতে পাবে? পাবে না তো। নাবিলার বুকের ভেতর সব যেন কেমন দুমড়েমুচড়ে যেতে লাগলো। অজান্তেই নিজের বিবেকের বিপরীতে দাঁড়িয়ে সে নিজেই নিজেকে বলতে থাকে, “মাহদীকে না দেখতে পেলে কী খুব বেশি ক্ষতি হবে? কীভাবে হবে! ওর সন্তান আজ আমার কোলে। আজ আমার কাছে মায়ান আছে। শামীম যদি আমাকে নিয়ে আলাদা থাকতে চায়, তো থাকুক না। কিন্তু ওর সাথে এভাবে কতদিন থাকবো আমি? কীভাবে জয়িতা ক্লিনিকে মাহদীর ব্যাপারটা ম্যানেজ করেছিলাম, সেটা যদি ও জেনে যায়-তাহলে আরও হৈহৈ রইরই ব্যাপার শুরু করবে। এতে কী তখন মাহদীর সম্মানের কিছু বাকি থাকবে? আমি তো শুধু মাহদীর স্মৃতি চেয়েছিলাম, তার সংসার কিংবা সম্মান কাড়ার উদ্দেশ্য আমার তো ছিল না। না, না, আমাকে শামীমের সাথেই থাকতে হবে। ওকে যেকোনোভাবে বুঝিয়ে আমার প্রতি আনুগত্য রাখতে পারলে আর কখনোই এসব টপিক নিয়ে মাহদীর সামনে আসবে না। এটাই এই মুহুর্তে সবচেয়ে উপযুক্ত সিদ্ধান্ত। ”
ভাবতে ভাবতে নাবিলা যেন চিন্তার অন্তরালেই হারিয়ে গেছে। শামীম ওর দিকে তখনও বিরক্তি ভরা দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। নাবিলা ”হ্যাঁ ” বলুক কিংবা “না”, এবাড়িতে তার যে আর ঠাঁই নেই, এইটুকু সে নিজের চোখের দৃষ্টির গভীরতা দিয়ে খুব ভালো করেই বুঝিয়ে দিচ্ছে।
শামীম একবার পিছন ফিরে ভাই ও ভাবির দিকে তাকিয়ে দেখলো, আতিয়া দূরে ব্যাগ ফেলে তার স্বামীর পাশেই দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখে বেদনার জল এবং স্বামীর প্রতি অবিশ্বাসের পাপের অনুশোচনা দুটিই একসাথে খেলা করছে। নীরব কেবল তাদের একমাত্র মেয়ে ইলা। শামীম ইলার উপর থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নাবিলাকে ইশারায় তার ঘরের ভেতর চলে যেতে নির্দেশ দিলো। আর নাবিলাও এই প্রথম বাধ্য মেয়ের মত শামীমের এককথায় সোজা ঘরের ভেতর চলে গেল। যদিও ঘরে ঢোকার সময় একবারও মাহদীর দিকে সে ফিরে তাকায়নি, কিন্তু এবারই প্রথম মাহদী আড়চোখে নাবিলার দিকে চেয়েছিল। ক্ষীণ দৃষ্টি, পাতলা ঠোঁট, নির্লিপ্ত চোখ, কাঁধের সামান্য নিচ অব্দি চুল- ঠিক অপরুপ সুন্দরী বলা যায় না, তবে যেকোনো পুরুষকে আকৃষ্ট করতে ওই রুপ যথেষ্ট। এই মেয়েটি তার জন্য এতকিছু করতে পারে- ব্যাপারটা ভাবতেই পারছে না সে।
মাহদী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আতিয়ার লাগেজ টেনে ঘরের দিকে পা বাড়াতেই তার বাবা রহমান খান উপস্থিত হলেন। তার মর্নিং ওয়াক বহু আগে শেষ হলেও এতক্ষণ চায়ের আড্ডাতেই সময় কাটিয়েছেন। কর্মজীবন থেকে অবসর নেবার পর সবকিছু প্রচন্ড সীমিত সীমায় এনে নামিয়েছেন তিনি। ঘরেও খুব একটা থাকেন না। পাড়ার বয়স্ক বন্ধুবান্ধবদের সাথে চায়ের দোকানে আড্ডা দেওয়া, শহরের বাইরের বাওড়ে সপ্তাহান্তে মাছ ধরতে যাওয়া, বইপড়া আর সন্ধ্যার পর সন্তান-পরিবারহীন মল্লিক শেখের বারান্দায় ভাঙাচোরা হারমোনিয়াম নিয়ে বেখাপ্পা স্বরে অর্ধরাত্রি অব্দি গানবাজনা নিয়েই তার জীবন চলছে। সংসারের যাবতীয় দায়িত্ব থেকেও অব্যাহতি নিয়েছেন বহু বছর আগেই। বাড়ির মধ্যে পা দিয়ে দুই ছেলে আর বউমার দিকে একপলক চেয়ে তিনি অবাক বিস্ময়ে জিজ্ঞাসা করলেন,
—আতিয়া, এই সাত সকালে কোথায় যাচ্ছো?
—কোথাও না, বাবা। আপনার আজ এত দেরি হলো যে? সব ঠিকঠাক আছে তো!
বাবার প্রশ্নে পাল্টা প্রশ্ন করলো মাহদী। কিন্তু ছেলের এই প্রশ্নোত্তর পর্ব বিশেষ পছন্দ হলো না রহমান খানের। তিনি বেশ গম্ভীর স্বরে বলে উঠলেন,
—পাল্টা প্রশ্ন করার জন্য তোমাকে ঠিকাদারির দায়িত্ব দিয়েছি আমি? আতিয়া নিশ্চয় রাগ করে বাবার বাড়িতে যাচ্ছিল। কারণ কী মাহদী? বাড়িতে কী চলছে বলো তো।
কিন্তু রহমান খানের প্রশ্নের জবাবে কেউই কিছু বলার সাহস পেল না। নাবিলার এইরুপ বিচ্ছিরি কর্মের বার্তা সে বাবার কানে কীভাবে দেবে! আর বাবা এসব জানলে তার সামনেই কী আর মুখ তুলে তাকাতে পারবে কেউ? দুই ভাই এবং আতিয়া একে অপরের দিকে মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে থাকে। সেদিকে লক্ষ্য করে রহমান খান কাউকে আর দ্বিতীয়বার প্রশ্ন করলেন না। কিছুক্ষণ মৌণব্রত পালন করে সোফায় গিয়ে বসলেন। তারপর ইলার হাতে চিপসের একটি প্যাকেট ধরিয়ে দিয়ে বললেন,
“যাও দাদু, তুমি তোমাদের বারান্দায় বসে খেলো আর খাও। কেমন?”
ইলা লক্ষী বাচ্চার মত নিজেদের ঘরের ভেতর চলে যেতেই রহমান খান চোয়াল শক্ত করে উপরের দাঁত দিয়ে নিজের নিজের ঠোঁট কামড়ালেন। এরপর বললেন,
—মায়ানকে নিয়ে কী ভাবছো? ওকে বরং নাবিলার সাথেই থাকতে দাও।
রহমান খানের কথায় প্রত্যেকেই চমকে উঠলো। এসব তিনি কী বলছেন! নাবিলার সম্পর্কে তো তার জানবার কথা নয়। শামীম রাফিয়ান আমতা আমতা করে প্রশ্ন করলো,
—বাবা, আপনি এসব কী বলছেন?
—তাছাড়া আর কী করবে? ছেলেটা যে তোমার নয়, তা আমি জানি। এমনকি, সে যে পরোক্ষভাবে মাহদীর সন্তান-সেটাও জানি। আর মাহদী, শোনো, তুমি আমাকে না জানিয়েই তোমার জীবনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছো। তুমি স্পার্ম ডোনেট করো, একথা আমি গত পরশুই জানতে পেরেছি। এতবড় হয়ে গেছো যে, নিজে নিজেই অমন সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলে? শোনো, আমার বয়স হয়েছে, বুড়ো হয়েছি। কিন্তু বুদ্ধি-বিবেচনা থেকে সটকে পড়ে যাইনি। এত দূরে আমি সরিনি যে,আমার ঘরের খবর আমি জানবো না।
রহমান খানের কথার উপর আর কেউ কথা বলার সাহস পেল না। এমনকি, দ্বিতীয় কোনো প্রশ্ন করবার দুঃসাহসও কেউ দেখায় না। রহমান খান নিজেই একনাগাড়ে যা বলে গেলেন, তা শামীম কিংবা মাহদীর পক্ষে খুঁজে বের করতে গেলে বছর কেটে যাবে।
“মাহদীকে নাবিলা মনে মনে অনেক পছন্দ করতো। তার পছন্দের মাত্রাটা এত অধিক ছিল যে,শামীম নাবিলাকে দেখতে যাবার আগের দিন অব্দিও নাবিলার ফোনের গ্যালারি ভর্তি ছিল মাহদীর ছবিতে। তবে সেইসব ছবিই মাহদীর সদ্য যৌবনকালের, যখন সে ইউনিভার্সিটিতে পড়তো। নাবিলার এক দূর সম্পর্কের মামাতো ভাই ছিল, নাম আরাফাত। ছেলেটা মাহদীর সাথেই পড়তো। খুব ক্লোজ বন্ধু তারা ছিল না বটে, তবে ক্লাসমেট হবার সুবাদে টুকটাক যতটুকু আলাপ হবার দরকার, ততটুকুই হত। আর এই আরাফাতের মাধ্যমেই নাবিলা প্রথম মাহদীর সম্পর্কে জানতে পারে। ইউনিভার্সিটিতেও মাহদীকে দেখেছে সে। সেই থেকেই মাহদীকে সে ভালোবাসে। এরমধ্যে আরাফাত কোথায় গেছে বা কী হয়েছে, সে বিষয়ে রহমান খানের কাছে সুনির্দিষ্ট ধারণা নেই। কিন্তু আরাফাতের অনুপস্থিতিতে নাবিলা আর মাহদীর খোঁজ নিতে পারেনি। যতদিনে খোঁজ পেয়েছে, ততদিনে মাহদী বিবাহিত। তবে শামীম যে মাহদীর আপন ভাই- এটা শামীমের সাথে নাবিলার বিয়ের আগে জানতো কি-না, সে বিষয়ে তিনি নিশ্চিত নন।
কিন্তু নাবিলা কোনোভাবেই মাহদীকে ভুলতে পারেনি। সে দূর থেকেই মাহদীর ব্যক্তিজীবন সম্পর্কে সমস্ত তথ্যই যোগাড় করে আসতো। আর সেই সূত্রেই মাহদী যে স্পার্ম ডোনেট করতো, এটা নাবিলা জানতো। জয়িতা ক্লিনিকে তার এক বান্ধবী চাকরি করে। খুব সম্ভবত তার মাধ্যমেই নিজেকে নিঃসন্তান প্রমাণ করে ইন-ভিট্রো পদ্ধতিতে এই কাজটি করেছে।”
কথাগুলো শেষ করে রহমান খান শামীমের দিকে চেয়ে বললেন,
—শামীম, আমি তোমার কাছে দুটি জিনিস চাইবো। এক, এখনই নাবিলাকে ডিভোর্স দিয়ে সমাজে আমার সম্মান নষ্ট করবে না। দুই, রাগের বশে তাকে হ*ত্যা করবে না। তোমরা দুই ভাই আমার দুটি কলিজার টুকরো। কোনো নষ্ট মেয়ের জন্য আমি তোমাদের হারাতে পারবো না। আর হ্যাঁ, নাবিলার সেই বন্ধুটি কে এবং আরাফাত কোথায় আছে, সেটা খুঁজে বের করো।
রহমান খান আর একটি কথা বলার সুযোগও পেলেন না। শরীরের ভিতর তার কেমন যেন পাকিয়ে উঠতে শুরু করলো। তিনি চোখ বন্ধ করে সোজা ওয়াশরুমে চলে গেলেন। শামীম এবং মাহদী অবাক হয়ে সেই পথের দিকে চেয়ে রইলো। যে বাবার থেকে লুকোনোর জন্য এতকিছু, সেই বাবা তাদের সব জানেন। এই প্রথম দুই ভাই নিজেদের কাজের প্রতি প্রচন্ড লজ্জাবোধ করছে। আসলে বাবারা অনেক কিছুই জানেন, কিন্তু সন্তানদের ব্যক্তিগত জীবনে নাক গলাতে চান না বলে না জানার ভান করেন। শামীমের আর বুঝতে বাকি রইলো না, সেদিন হাসপাতালে বাচ্চাটিকে নিয়ে শামীমের প্রতিক্রিয়া দেখে রহমান খান বসে থাকেননি। একা একাই নাবিলার সম্পর্কে তথ্য বের করে এনেছেন। কিন্তু নাবিলার এই বান্ধবীটিই বা কে!
(চলবে…)