চতুষ্কোণ পর্ব ১০

0
138

#চতুষ্কোণ /পর্ব ১০
Sharifa Suhasini

শামীমের পাশে বসে তাকে বুঝাচ্ছে আতিয়া। কিন্তু শামীম নির্বাক। সোফায় আধাশোয়া করে হেলান দিয়ে নাবিলার ছবির দিয়ে চেয়ে আছে। কাল রাতে অনেক কান্না করেছিল। আজ সকাল থেকেই সে নির্বাক, নিশ্চুপ। এমনটা তো হবার কথা ছিল না। নাকি ছিল?
আতিয়া ওর কাঁধে হাত রেখে প্রশ্ন করে,
—কীভাবে কী ঘটেছে শামীম?

ঘরভর্তি উৎসুক জনতা শামীমের মুখের দিকে চেয়ে আছে। নাবিলার মৃত্যুর বর্ণনা এখন তাকে দিতেই হবে। সে মিটিমিটি চোখে একবার চারপাশটা দেখে নিলো। এই মুহুর্তে সায়লা বেগমও থেমে গেছেন। শামীম আহত পক্ষীর মত শাশুড়ীর দিকে চেয়ে লম্বা করে একটি শ্বাস নিলো। সায়লা বেগম আতিয়াকে বললেন,
—ও আর কী বলবে রে মা? যা ঘটলো, সব তো আমার সামনেই ঘটলো। আমার মেয়ে জামাই ওকে ধরার জন্য জানপ্রাণ দিয়ে চেষ্টা করছে৷ কিন্তু পারেনি। নাবিলা ‘মা’ বলে চিৎকার দিয়ে একেবারে পাহাডের খাদে পড়লো। হে আল্লাহ, কোন পাপের সাজা তুমি আমার মেয়েটারে দিলা! আমার এইটুকুন নাতি ছেলে। মা’ছাড়া বড় হবে কী করে!

সায়লা বেগমের কান্নার বেগ বাড়লো। ভদ্রমহিলার কান্না দেখে আতিয়ার বেশ খারাপ লাগছে। সেই খারাপ লাগার সীমা এত গভীরে গিয়ে ঠেকলো যে, তার চোখও ভিজে এসেছে। হিজাবের কোণা দিয়ে চোখ মুছে আতিয়া আবার শামীম রাফিয়ানের দিকে ফিরে তাকালো। শামীম আর কালবিলম্ব করে না। আজ হোক বা কাল, নাবিলার মৃত্যুর বর্ণনা তাকে দিতেই হবে। পুলিশের কাছেও দিয়েছে। সায়লা বেগমকে সাথে নিয়েই দিয়েছে। হিমছড়ি ট্যুরিস্ট পুলিশ টানা সাড়ে পাঁচ ঘন্টা তাদেরকে নানান বিষয়ে প্রশ্ন করে করে রীতিমতো মাথা খারাপ করে দিয়েছে। পুলিশের চোখ নাকি শকুনের চোখ। একথার প্রমাণ সে নাবিলার মৃত্যুর পর একেবারে কড়াগন্ডায় পেয়েছে।

শামীম বললো,
—নাবিলার আগ্রহেই আমরা কক্সবাজার গেছিলাম। ওর সমুদ্র দেখার শখ ছিল খুব। নাবিলা বলেছিল, হিমছড়িতে পাহাড়ে উঠলে একদিকে সমুদ্র, আরেকদিকে পাহাড়ের সারি দেখতে পাওয়া যায়। কথামতো আমরা তিনজন মায়ানকে সাথে নিয়ে কক্সবাজার ভ্রমণের উদ্দেশ্যে রওনা দেই। প্রথমদিন বীচের পাড়েই ঘুরাঘুরি করেছি। পরদিন দুপুরে সমুদ্রস্নান করে বিকালে রওনা দেই হিমছড়িতে। সিঁড়ি ভেঙে উঠতে নাবিলার বেশ কষ্ট হয়েছে। সদ্য ডেলিভারি থেকে রিকভারে ছিল তো সে। অনেকবার নিষেধ করলাম। কিছুতেই কথা শুনলো না। বললো, ‘তিনমাস পার হয়ে গেছে। আর আমি নিয়মিত ট্রিটমেন্ট নিচ্ছি। এসব কোনো ব্যাপার না।’’ কিন্তু কে জানতো, এসবই ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে! প্রায় সত্তর ভাগ সিঁড়ি পার হবার পরেই ডান দিকে একটু ফাঁকা জায়গায় দাঁড়াতে গিয়ে ওর পা পিছলে গেল। আর সেখান থেকেই সোজা নিচে। উপরে আমি আর নিচে আমার শাশুড়ী দুজনেই চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া আর কিছুই করার ছিল না।

কথা বলতে বলতে শামীমের গাল বেয়ে অশ্রু ঝরতে শুরু করে। তার পক্ষ থেকে আর কথা এগোয় না। সায়লা বেগমও মেয়ে-জামাইয়ের সাথে পাল্লা দিয়ে কান্না জুড়েছেন। তার কান্নার সাথে সাথে ইনিয়েবিনিয়ে মেয়ের মৃত্যুর গল্পও টুকটাক বেরিয়ে আসে। “আমি মায়ানকে কোলে নিয়ে উপরের দিকে তাকিয়ে দেখছিলাম। শামীম ওর কিছুটা নিচেই ছিল। আমার মেয়েটা বোধহয় ওর জন্যই দাঁড়াতে চাইছিল। মায়ানকে সামলাতে গিয়ে আর খেয়াল করিনি পরে। তারপর চোখের নিমিষেই…”

উপস্থিত সকলের চোখের পাতা ভারি হয়ে আসে। ঘটনা বিশ্বাসযোগ্য। পাহাড় থেকে পড়ে মৃত্যুর ঘটনা খুব নতুন কিছু নয়। তবুও ব্যাপারটা ঠিক হজম হচ্ছে না আতিয়ার। সে আড়দৃষ্টিতে শামীমের দিকে চেয়ে মাথা দুলালো। এরপর ফিসফিস করে বলে,
—একটু বাইরে এসো। তোমার সাথে জরুরি কথা আছে।

আতিয়ার ইশারায় শামীমের বুকের ভিতর ধক করে ওঠে। সে না শোনার ভান করে আবার মাথা নিচু করলেও লাভ হলো না। আতিয়া ঠিকই তার কানের কাছে পুনরায় বাইরে বের হবার নির্দেশ দিয়ে নিজে বের হয় যায়। শামীম জানে, এরপর হাজার চাইলেও তাকে অবজ্ঞা করার ক্ষমতা ওর নেই। আশেপাশের পরিবেশে শোকসভায় সবাই ধ্যানমগ্ন হয়ে এলে সুযোগ বুঝে সেও বাইরে বেরিয়ে আসে।

আতিয়া ভাবি সদর গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। তার দুই হাত একটির মুষ্টির মধ্যে অপরটি আটকে রাখা। দৃষ্টি বাসার জানালার দিকে। সেখানে দোপাটি গাছের চারা লাগানো হয়েছে। আতিয়ার দৃষ্টি সেদিকেই নিবন্ধ হয়ে আছে। শামীম এসে ওর ঠিক পাশে দাঁড়ায়। আতিয়া শামীমের দিকে ফিরে জিজ্ঞাসা করলো,
—এটা সত্যিই এক্সিডেন্ট ছিল?

—হঠাৎ এমন প্রশ্ন?

—আমার কেন জানি বিশ্বাস হচ্ছে না। দেখো ভাই, তোমাকে শুরু থেকেই বলে এসেছি, কোনো ভুল সিদ্ধান্ত নিও না। ভুল কাজ করতে যেও না। শেষে আইনী ঝামেলায় ফেঁসে গেলে আজীবন ভোগান্তিতে পড়তে হবে। অপরাধ যত সূক্ষই হোক, তার প্রমাণ ঠিক কোথাও না কোথাও হিরের খনির মত মজুদ থাকে। তাপ আর আলো পেলে যথাসময়ে চিকচিক করে উঠবে।

—যতক্ষণ প্রমাণ না হচ্ছে যে আমি অপরাধী, ততক্ষণ আমি নিরপরাধ। তাই নতুন করে কোনো আত্মপক্ষ প্রমাণ পেশ করার প্রয়োজন নেই আমার। বললেও বিশ্বাস করবে না। পৃথিবীতে বেশিরভাগ পাপীই তার পাপের সাজা পেয়ে যায়। নাবিলাও হয়তো তার কর্মের প্রতিদান পেয়েছে। এখানে আমার বিরুদ্ধে এত গবেষণা করে লাভ আছে?

আতিয়া জবাব দেয় না। শামীম কেমন যেন হয়ে গেছে। তার জবাবগুলোও বড্ড বেশি বেমানান, অসহিষ্ণু ধাঁচের। আতিয়া জানে, এ নিয়ে শামীমকে বিশেষ প্রশ্ন করেও আর লাভ নেই। সে চুপচাপ অন্যপাশে মুখ ফিরিয়ে নেয়। শামীম আবার বললো,
— মাহদী ভাইকে দেখছি না। উনি সেই সকালে এসে একবার পাশে বসলেন। এরপর থেকেই হাওয়া।

—বউ মরেছে তোমার, তার তো না। সেজন্য অফিস থেকে বেশিদিন ছুটি পাচ্ছে না।

—নাবিলার বাচ্চার বিষয়টা আমাদের পরিবার ছাড়া আর কেউ জানে? মানে ভাইয়ার কলিগ, তোমার পরিবারের কেউ।

—না। এসব কী জানানোর মত কথা?

—হুম, না জানানোই ভালো। পরে সেধে বিপদ ডেকে আনার দরকার নেই। লোকে আমাদেরকেই সন্দেহ করবে। তাই না?

প্রশ্নাত্মক চোখে তাকালো শামীম। কী এমন রহস্য তার চোখেমুখে! কেউ ধরতে পারছে না। আতিয়াও পারলো না। জবাবহীন থেকেই সে নীরবে সেখান থেকে প্রস্থান করলো। আতিয়া চলে যাবার পর শামীম উদাস হয়ে আকাশের দিকে তাকালো। যত ব্যস্ততাই থাকুক, মাহদী ভাই তার এই অসময়ে পাশে থাকবে না? নাবিলার ওই একটা ঘটনা ভাইয়ের প্রতি ভাইয়ের এত ঘৃণা তৈরি করে দিয়েছে? কিন্তু কেন!
“আমি তো সব সমাধান করেই দিয়েছি। নাবিলা আর আমাদের মধ্যে বেঁচে নেই। ভাইয়া, ভাবি, বাবা, তোমরা দেখো। আমি তোমাদের সব সমস্যার সমাধান করে দিয়েছি। নিজে হাতে আমার ভালোবাসাকে আমি খু*ন করেছি। নাবিলাকে মা*রার পরিকল্পনা করতে আমার খুব কষ্ট হচ্ছিলো। খুব মানে খুব। সে যাই হোক,আমি তাকে ভালোবেসেছিলাম। আর ভালোবাসাকে নিজে হাতে মা*রার সাহস সঞ্চার করাটা কী চাট্টিখানি কথা? কখনোই না। আমি সেই অসাধ্য সাধন করেছি। নাবিলা, তোমার অন্যায়ের প্রতিদান তোমাকে আমি দিয়েছি। তোমাকে আমি মাফ করতে পারিনি। কিন্তু আমাকে কী তুমি মাফ করতে পারবে? যদি না পারো, তবে আমিও তোমার কাছেই চলে আসবো।”

কথা বলতে বলতে শামীম পাগলের মত হেসে ওঠে। সেই হাসির কারণ সে জানে না। তবুও হাসতে ইচ্ছে করছে ওর। মনের ভেতর ভালোবাসা আর ঘৃণা যখন একসাথে দ্বন্দ তৈরি করে,মানুষ তখন দিকভ্রান্ত হয়ে যায়। আজ শামীমের অবস্থাও ঠিক সেই পর্যায়ে। তার আর কোথাও যাবার নেই, ভাবার নেই। তবে নাবিলার কাছে যাওয়াটাই বোধহয় উত্তম।

শামীমের মোবাইল ফোন বেজে উঠলো। পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে স্ক্রিণে তাকিয়ে দেখে অচেনা নাম্বার। কল রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে একটি সুরেলা নারীকন্ঠ ভেসে এলো।
“শামীম রাফিয়ান বলছেন, নাবিলার হাজবেন্ড?

—হ্যাঁ, বলছি। কিন্তু আপনি…

—আমি নাবিলার বান্ধবী এশা খন্দকার। আপনি আমাদের ক্লিনিকে আমার খোঁজ করেছেন শুনলাম। আমি জরুরি কাজে ভারতে ছিলাম ছ’মাস। গতকালই এসেছি। আপনি হঠাৎ আমার খোঁজ করছেন, তাই কল দিলাম।

—করেছিলাম কিছু কারণে। তার আর এখন প্রয়োজন নেই। তবুও আপনি যখন এসেছেন, একবার দেখা করাই যায়। আপনি এখন কোথায় আছেন?

—ক্লিনিকের সামনেই। মাত্র রিপোর্ট করলাম। এখন বাসায় চলে যাবো।

—ওখানেই অপেক্ষা করুন। আমি আসছি।

শামীম কল বিচ্ছিন্ন করলো। তবে এশা বিচ্ছিন্ন হতে পারলো না। সে চায়নি, শামীমের সাথে তার কথা হোক। কিন্তু ক্লিনিকের সুপারভাইজার বারবার বলে দিয়েছেন,সে যেন অবশ্যই শামীমকে কল দিয়ে তাকে রিপোর্ট করে। চাকরি বাঁচাতে কল তাকে করতেই হত। প্যারামেডিকেল শেষ করে এই ক্লিনিকেই তার চাকরি জুটেছিল। এখন সেখান থেকে পিছিয়েই বা সরবে কোথায় সে?

শামীম এলে ঠিক কী প্রশ্ন করবে ওকে? কোনো ঝামেলায় জড়ায়নি তো? ক্লিনিকের পাশের ক্যান্টিনে ধোঁয়া ওঠা কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে ভাবে সে। পরমুহূর্তেই ফোনের রিংটোন বেজে উঠলো। শামীম রাফিয়ানের নাম্বার। সে চলে এসেছে। এশা হাত উঁচিয়ে শামীমকে নিজের টেবিল ইশারা করে দেখিয়ে দিলো। শামীম এসে ওর পাশে বসতেই এশা খেয়াল করে-মানুষটার চোখ দুটো ফুলে লাল হয়ে আছে। এশার আর সাহস হয় না তাকে কিছু জিজ্ঞাসা করার। শামীম নিজে থেকেই তাকে প্রশ্ন করে,
—তাহলে আপনিই নাবিলার সেই বান্ধবী, যে এতবড় কর্মকাণ্ডের স্রষ্টা? দেখুন মিস এশা, আমার কাছে ভণিতা করবেন না। আমি সব জানি। নাবিলার বাচ্চা কার, সেটাও জানি। কিন্তু আপনি জানেন না,নাবিলার বাচ্চা যে ভদ্রলোকের, তিনি আমার আপন ভাই। আপনি জানেন না, আপনি আমার ভাইয়ের সম্মান নিয়ে কতবড় জঘন্য একটি কাজ করেছেন।

এশা কাচুমাচু ভঙ্গিতে শামীমের দিকে তাকালো। তারপর বললো,
—আমি এসব জানতাম না। শুধু আমার বান্ধবীর জন্য এটা করেছিলাম। আমাকে মাফ করে দিন। কিন্তু আপনার ভাইয়ের সম্মান নিয়ে আমি কিছুই করিনি। উলটো আপনার ভাই’ই তো নাবিলাকে এতবড় দুঃসাহসিক কাজের জন্য পরোক্ষভাবে উৎসাহ দিয়েছে। একলা আমার বেচারী বান্ধবীকে কেন দোষ দিচ্ছেন?

(চলবে…)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here