প্রথম বাচ্চার ডেলিভারির দিনেই আমার স্বামী আমার হাতে ডিভোর্স পেপার ধরিয়ে দিচ্ছে। আমি সবেমাত্র অপারেশন থিয়েটার থেকে বের হয়ে ক্লিনিকের বেডে শুয়ে রিলাক্স করছি। আর ওদিকে আমার স্বামী শামীম রাফিয়ান আমার বেডের ঠিক পাশেই সদ্য জন্মানো বাচ্চাটার দিকে ঘৃণাভরা দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। ওর চোখেমুখের অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, এক্ষুণি সে আমার সদ্যজাত সন্তানকে গলা টিপে খুন করে ফেলবে। আজ ওর ওই অবস্থা দেখে ভাবতেই অবাক হচ্ছি, এই মানুষটাকে আমি কীভাবে বিশ্বাস করে বিয়ে করেছিলাম!!
অবশ্য এটাই হবার ছিল।
ক্লিনিকের বিছানায় শুয়ে শুয়ে শামীমের দিকে চেয়ে এসবই ভাবছে নাবিলা। সে তার মনকে বিশ্বাসই করাতে পারছে না, শামীম তাকে এই মুহুর্তে ডিভোর্স দিতে পারে। সে ভেবেছিল, শামীম পুরনো সেসব কথা, প্রমিস সবকিছু ভুলে গেছে বোধহয়। কিন্তু সেটা হলো না। শামীম নিজের ওয়াদায় একেবারে বদ্ধ পরিকর। একদিকে শরীরের ব্যথা, অন্যদিকে শামীমের এমন নিষ্ঠুর আচরণ।
একটা মেয়ে তার সারাজীবনের সমস্ত ব্যথার চেয়েও অধিক ব্যথা পায় ডেলিভারির সময়। তবুও আজ সেই ডেলিভারির যন্ত্রণার চেয়ে ওর মানসিক যন্ত্রণাটাই অধিক কষ্ট দিচ্ছে। সে মিটমিট চোখে সারা ঘরটাতে চোখ বুলালো। নাবিলার মা সায়লা বেগম মেয়ের পাশে বসে বিছানা ঠিক করছেন। আর ওদিকে মেয়ে-জামাই জীবনের সবচেয়ে কঠিন সিদ্ধান্ত নেবার জন্য একে অপরের মুখের দিকে চেয়ে অপেক্ষা করছে।
নাবিলা ছলছল চোখে শামীমের দিকে চেয়ে জিজ্ঞাসা করে,
—এসব কীসের কাগজ?
—কেন, তুমি কী জানো না নাকি? আমাদের তো কথাই হয়েছিল, এই বাচ্চাটাকে যদি তুমি পৃথিবীর মুখ দেখাও, তাহলে আমরা আলাদা হয়ে যাবো। কিন্তু তুমি শেষ পর্যন্ত ওকে দুনিয়ায় এনেই ছাড়লে। সে হিসেবে আমাদের একসাথে থাকার কোনো মানেই হয় না। ডিভোর্স পেপার আমি আগেই প্রস্তুত করে রেখেছিলাম। কিন্তু সেই সাথে এটাও দেখতে চাচ্ছিলাম, অন্তত শেষ মুহুর্তে তুমি সিদ্ধান্ত পাল্টাও কি-না। সেটা যখন হলোই না, তখন আমাদের একসাথে থাকার সম্ভাবনাও নেই।
শামীম রাফিয়ান ডিভোর্সের কাগজটা সায়লা বেগমের হাতে এগিয়ে দিলো। কেউ মুখে না বললেও তার আর বুঝতে বাকি রইলো না, শামীম তাকে ঠান্ডা মাথায় নির্দেশ দিচ্ছে-নাবিলার থেকে সাইন করিয়ে নেবার জন্য। সায়লা বেগম তার মেয়ে জামাইয়ের এইসব কান্ডকারখানা কিছুই বুঝতে পারলেন না। পাত্রী দেখার দিন তারা দুজন একে অপরকে পছন্দ করেই তো বিয়ে করেছিল। তবে আজ কেন নিজেদের এই বাচ্চার জন্য ডিভোর্স নিচ্ছে? তিনি হকচকিয়ে শামীমের দিকে তাকালেন।
—তোমাদের ডিভোর্স পেপার মানে? এইসময়, এই অবস্থায় কেউ এমন অলুক্ষণে কথা বলে বাবা? শামীম, আগে তোমাদের ছেলেটাকে তো দেখো। কী সুন্দর হয়েছে! একদম আমার নাবিলার মত।
—হুম,নাবিলার মতই। কিন্তু আমার মত তো নয়। তাই ওই বাচ্চা দেখার ইচ্ছে আমার নেই। আপনার মেয়েকে বলুন এক্ষুণি ডিভোর্স পেপারে সাইন করে দিতে। ও আমাকে কথা দিয়েছিল। এই মুহুর্তে নাবিলা সেই কথার বরখেলাপ করতে পারবে না। কী নাবিলা? নিজের ওয়াদা রক্ষা করবে তো?
নাবিলার কথা বলার শক্তি নেই৷ বিগত আড়াইমাস ধরে সে তার বাবার বাড়িতে আছে। আর এই সময়ের মধ্যে প্রতি সপ্তাহে অন্তত একদিন হলেও শামীম তার খেয়াল রেখেছে, তার পছন্দের সব খাবার এনে খাইয়েছে। মোদ্দাকথা, একজন আদর্শ স্বামী হিসেবে যা যা দায়িত্ব পালন করা উচিত, সেই সবটাই সে করে গেছে। ওর এমন সব কেয়ারিং আচরণ দেখে নাবিলা তো ভুলেই গেছিল, শামীম ওসব মনে রাখতে পারে।
নাবিলা করুণ দৃষ্টিতে শামীমের দিকে তাকায়। তার শরীরে ধীরে ধীরে ক্লান্তি ভর করে। সায়লা বেগম বুঝতে পারেন- এমন হতে দিলে নাবিলা একবারে অজ্ঞান হয়ে যাবে। যেটা ওর জন্য বিপজ্জনক।
তিনি হাতজোড় করে শামীমকে বলতে লাগলেন, —বাবা, তোমাদের রাগ ঝাল যা আছে, সেসব পরে করো। এখন আমার মেয়েটার শরীরের অবস্থা ভালো নয়। জলদি ডাক্তার ডাকো।
কিন্তু শামীম তার কোনো কথাই শোনে না। নিজের জিদ ধরে বসে থাকে। সায়লা বেগম চিৎকার দিয়ে ডাক্তার এবং নার্সকে ডাকছেন। তার চিৎকারে দুজন নার্স ছুটে আসে। নাবিলার শরীরের অবস্থা সত্যি সত্যিই খারাপ। তারা দুজনেই ডাক্তারকে কল করে তাড়াহুড়োর মধ্যে আবার অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যেতে থাকে। শামীম ওদের পিছু পিছু ডিভোর্স লেটার নিয়ে ওটি রুমের দরজা অব্দি এগিয়ে যায়। ডাক্তার এসে রুমে ঢুকলেও শামীম সেখানেই ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকে। আজ মনে হয় ডিভোর্স পেপারে সাইন না করিয়ে সে এখান থেকে যাবে না।
সায়লা বেগম তার ছোট নাতীকে কোলে নিয়ে অপারেশন থিয়েটারের সামনে এসে দাঁড়ালেন। তিনি কাঁদবেনন নাকি অবাক হবেনন-সেটাই বুঝতে পারছেন না। দুজনের পছন্দে খুব ধুমধাম করেই তো তিনি ওদের বিয়ে দিয়েছিলেন। তবে আজ কেন এই সিদ্ধান্ত! হতবিহ্বল হয়ে তিনি মেয়ের জামাইয়ের দিকে তাকালেন। শামীমের দৃষ্টি ছোট বাচ্চাটার দিকে। রাগে আর ঘৃণায় ফুঁসছে। যেদিন সে প্রথম নাবিলার প্রেগন্যান্ট হবার খবর পায়, সেদিনও একইভাবে রাগে আর ঘৃণায় নাবিলার পেটের দিকে চেয়ে ছিল। সেই মুহুর্তটা শামীম আজও ভোলেনি।
সেদিন ঘরে ঢুকেই শামীম নাবিলার হাত চেপে ধরে জিজ্ঞাসা করে,
—তুমি সত্যি সত্যিই প্রেগন্যান্ট?
নাবিলা অত্যন্ত স্বাভাবিক ভঙ্গিতে তাকে জবাব দেয়,
—হ্যাঁ। ডাক্তার তো সেটাই জানালো।
—কিন্তু কীভাবে? দেখো নাবিলা,তুমি আমাকে এটা বুঝিও না যে, যেভাবে অন্য নারীরা হয়। কারণ সেই সুযোগ তোমার নেই। বিবাহিত জীবনের এই একমাসে আমাদের মধ্যে এমন কিছুই হয়নি যে, তুমি প্রেগন্যান্ট হতে পারো। আমাদের প্রথম বাসরেই তুমি বলেছিলে, যেহেতু এটা এরেঞ্জ ম্যারিজ-তাই তোমার কিছুটা সময় দরকার। নিজেদেরকে বোঝাপড়া, একে অপরকে জানতে চাও। আমিও তাই চাইছিলাম। কিন্তু আমাদের জানাজানিটা আজ এমনভাবে হবে-তা কখনো কল্পনাও করিনি৷
নাবিলা ওর কথার জবাব দেয় না। নির্বাক হয়ে জানালার দিকে চেয়ে থাকে। বাইরে ঝুম বৃষ্টি নেমেছে। সন্ধ্যার তাড়াহুড়োয় যে যার ঘরে ছুটে পালাতে ব্যস্ত। সে একমনে সেদিকেই চেয়ে আছে। শামীম যে তাকে প্রশ্ন করছে, সেসব নিয়ে তার বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নেই। এতে শামীম আরও বিরক্ত হয়ে যায়। সে এবার বেশ ধমক দিয়েই প্রশ্ন করে,
—তুমি কী এর আগে…
—না প্লিজ, শামীম। আমাকে বিশ্বাস করো। আমি চরিত্রহীন নই। আমি শুধুমাত্র একজনকেই তো ভালোবাসি। এই সন্তান আমার কোনো পাপের ফল নয়।
—তাহলে কীভাবে তুমি গর্ভধারণ করলে!
নাবিলা তার কথার জবাব না দিয়েই চুপচাপ বসে থাকে। ওর এমন নীরবতাই বলে দিচ্ছে, নাবিলা ওর থেকে কিছু লুকিয়েছে। কিন্তু শামীম নিজের প্রতি যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসী। তাদের মধ্যে এমন কোনো রোমান্টিকতার মুহুর্ত তৈরি হয়নি,যার দরুণ নাবিলা প্রেগন্যান্ট হতে পারে।
শামীম প্রচন্ড রেগে বলে ওঠে,
—তুমি যদি সত্যিটা আমাকে না বলো,তবে আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি-এই বাচ্চা জন্মের সময় আমি তোমাকে ডিভোর্স দেবো।
—তুমি আমাকে ডিভোর্স দিলেও এই বাচ্চাকে আমি পৃথিবীতে আনবোই। তাতে আমার যা কিছু হয়ে যাক। আমাকে মেরে ফেললেও এই বাচ্চাটার পৃথিবীতে আসাটা জরুরি। আর এটাও জেনে রাখো,আমি নাবিলা কোনো চরিত্রহীনা নই। পৃথিবীর যত ধর্মীয় গ্রন্থ আছে, সব এনে রাখো। আমি সেসব স্পর্শ করেও বলতে পারি, আমার চরিত্রে একফোঁটা দাগ নেই।
ওদের পরষ্পরের জিদের কাছে দুজনই জিতে যায় ঠিকই, কিন্তু হেরে যায় সম্পর্ক। সেদিনের পর থেকে কেউ কারো শরীরে বিন্দুমাত্র স্পর্শ করেনি। যদিও শামীমের মন এত ছোট নয় যে,সে স্ত্রীর চরিত্র সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা রেখে তাকে চরিত্রহীনা উপাধি দিয়ে বসবে। এই অল্পসময়ে
সে নাবিলাকে প্রচন্ডভাবে ভালো বেসে ফেলেছে। তাছাড়া, নাবিলা যদি বাচ্চার বাবার আসল সত্যিটা স্বীকারও করে, তবু সবকিছু ক্ষমা করে সে তাকে মেনে নিবে। অথচ নাবিলা সেটাও জানাচ্ছে না।
নাবিলার এই চুপ থাকার বাইরে কিছু তো একটা আছেই। যেটা নাবিলা তাকে বলতে চায় না। আর এই না বলাবলির জিদেই আজ তার হাতে ডিভোর্স পেপার। শামীম একেবারে নির্বাক হয়ে বসে আছে। কিছুক্ষণ পরেই তার বড়ভাই মাহদী মাশরুক, ভাবি আতিয়া এবং বাবা রহমান খান এসে হাজির হলেন। তারা সবাই নাবিলার সদ্য জন্ম নেওয়া ফুটফুটে শিশুটিকে দেখতে এসেছে।
মাহদী তাদের সামনে এসেই সায়লা বেগমের কোল থেকে বাচ্চাটিকে নিয়ে পরম যত্নে আদর করতে শুরু করে। মাহদীর চোখেমুখে যেন খুশির ফোয়ারা ছুটছে। শামীম এর আগে কখনোই তার ভাইকে এত খুশি হতে দেখেনি। সে অবাক হয়ে তার ভাইয়ের কান্ড-কারখানা দেখছে। শুধু মাহদীই নয়, তার সাথে আতিয়া ভাবিও একইরকম পাগলামি করছে। ওদের অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে-বাচ্চাটা নাবিলার নয়, ওদেরই।
এসব দেখে শামীমের প্রচন্ড রাগ হলো। সে চিৎকার দিয়ে বলে ওঠে,
—খবরদার, খবরদার ওই বাচ্চাকে কেউ স্পর্শ করবে না।
(চলবে…)
গল্প— চতুষ্কোণ /পর্ব:—০১ (রহস্য গল্প)
লেখক— Sharifa Suhasini