গোপনে
৫
অন্তিম পর্ব
#রিমা_বিশ্বাস
পর্দার সামান্য দোলায় অরিত্রর বুকের ভিতর ধাক্কা খেল।দম বুঝি আটকে গেছে।আচমকা এরকম একটা অপ্রত্যাশিত চমক এসে যে মগজের সেট-আপ এমন উল্টে পাল্টে রেখে দেবে তা তো আর জানত না।আর একটা ব্যাপার যেটা লক্ষ করছে তা হল গোলাপি রঙটা। সেই কবের থেকে এই গোলাপি রঙটা তাড়া করে চলেছে ওকে।গোলাপি সিল্কের শাড়ি। গোল্ডেন পাড়।মোটা একখান বেনী কাঁধ বেয়ে বুকের কাছে এসে থেমেছে।আর এখন বোঝা যাচ্ছে ঐ ক্ষুদেকে এত চেনা লাগছিল কেন!সে তার হাঁটুর কাছটায় দাঁড়িয়ে মুখ তুলে বলছে…”মামণি মামণি কোলে…”
মেয়ের মা বললেন…. “না বাবু পরে।তুমি মায়ের কাছে যাও মাসি এখন ব্যস্ত সোনা..”
তাকে অরিত্রর ঠিক মুখোমুখি বসানোর জন্য একটা চেয়ার আনা হয়েছে।সে বসল অরিত্রর সামনে।
মেয়ের বাবা এতক্ষণ পর আবার এসেছেন। গম গমে গলায় বললেন….”অরিত্র এই হল মেঘা।আমার মেয়ে।তোমরা এবার দু জনে কথা বলে নাও!”
অরিত্র ভদ্রলোকের দিকে একবার শুধু তাকাল।তারপর ঢোক গিলল।সকলে ওদের দিকে উদগ্রীব হয়ে চেয়ে।অর্থাৎ এত লোকের মাঝেই অরিত্রকে কথা বলতে হবে ওর হবু সঙ্গীনিটির সঙ্গে।এ কি করে সম্ভব? এত জনের মাঝে হয়?
আবার কার সঙ্গে! যার সঙ্গে দেখা হচ্ছে এত গুলো বছর পরে।শুধু তাই নয় এ যে অরিত্রর হৃদযন্ত্রের এমন এক তার যাতে সামান্য টান পড়লে অরিত্রর চেতনা ওর অবচেতন এক সঙ্গে ঝঙ্কার দিয়ে ওঠে!
মেঘা..সেই মেঘা যাকে অরিত্র শুধু স্বপ্নে দেখত।যে বাস্তবে এ ভাবে জীবনের অংশ হওয়ার অধ্যায় হয়ে আসবে তা কি কল্পনা করেছে কখনো?
এ কি সম্ভব?
মেয়ের মা বললেন… “তোমার যা জানার জেনে নাও!”
অরিত্র মেঘার দিকে তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নিল।এখনও সেই কলেজ কালের সংকোচ।কে জানে অরিত্রের কোনও প্রশ্নে এত লোকের মাঝে যদি সে ফিক করে হেসে বলে “তাই বুঝি?”
শুধু কি তাই ওকে সামনে দেখে বুকের ভিতর যে হারে হাতুড়ি পড়ছে তা না থামলে অরিত্র স্বাভাবিক হতেও যে পারবে না।বহু দিনের ভালোলাগার মানুষকে এমন অপ্রত্যাশিত ভাবে কাছে পেলে নার্ভাস সিস্টেম ভরকে যায়ই..
….”মেঘা কিন্তু ভালো গান জানে।জান অরিত্র! এই মেঘা একটা গান কর না..কি অরিত্র শুনবে?”ওপাশের জটলা থেকে বললেন প্রৌঢ়া।
অরিত্র ঘাড় নেড়ে শুধু হ্যাঁ বলতে যাচ্ছিল কিন্তু মেঘার সঙ্গে চোখাচোখি হওয়ায় বেচারা থমকাল।
মেঘা সকলের নজর বাঁচিয়ে ওকে চোখ পাকাচ্ছে।অর্থাৎ গান শুনবে?শখ তো মন্দ নয়..
অরিত্র মাথা নেড়ে বলল…”থাক গান দরকার নেই! “
…”কিছু জানার থাকলে…”পিসে মশাই বললেন।
অরিত্র বলল…”না আমার কিছু জানার নেই..”
কিছুক্ষণ মেঘা বসে রইল ঘাড় হেঁট করে।কোলের উপরে বিছান আঁচলটাকে টান করছে।অরিত্র ওকে দেখছিল অভিভূত হয়ে। মেঘা যে আরও সুন্দর হয়েছে।হয়তো বা আরও গভীর হয়েছে ওর ভাবনা চিন্তা।ও কি কখনো ভেবেছিল অরিত্রকে নিয়ে?কোনও দিন?
অরিত্র ছোট শ্বাস ফেলে ওর সামনে রাখা কাচের গ্লাসটা তুলে তাতে চুমুক দিল।
ওর সেই ছোট হতাশা কি বিস্ময়ের শ্বাস ফেলার শব্দ যেন শুনতে পেল মেঘা।মুখ তুলে চাইল অরিত্রর দিকে। অরিত্রর চোখে চোখ পড়তে মেঘা দু চোখের মণি নাকের কাছে এনে জরো করতে অরিত্র জোর বিষম খেল।কাশছে জোরে জোরে।মেঘা বসে নির্বিকার। কে একজন এসে হাত থেকে গ্লাসটা নিয়ে তালুতে চাপড় মারছে।জোরে কানে ফুদিতেই সারা শরীরে কাতুকুতু হতে লাগল।বেয়াদব কাশিও বাগ মানে না আর তার ফু এর ফোর্সও কমে না।মাথা থাবড়ে থাবড়ে ফোলানো চুল মিইয়ে গেল বোধহয়। অরিত্র নিজেকে কল্পনা করতে পারছিল ঠিক ভেজা বেড়ালটার মতনই নিশ্চয়ই দেখাচ্ছে ওকে!
কাশি থামার পর নিজেকে বেশ বিধ্বস্ত মনে হচ্ছিল।এই শোচনীয় অবস্থার পর আর কি কথা বলবে?
কথা আর হল না।তবে ওপক্ষ বলল,ফোনে সব জানা যাবে ক্ষণ।
ওদেরর বাড়ি থেকে বেরিয়ে এক ঘোরের মধ্যে ডুবে যাচ্ছিল অরিত্র।কি হল এসব…অরিত্র তো ভেবেছিল স্মার্টলি বসে থাকবে।যে মেয়ের বাড়ি এত নিয়ম কানুনে বদ্ধ তাকে কাটা কাটা কয়টা কথায় বিদ্ধ করবে।ভালো করে বুঝিয়ে দেবে আধুনিকতা কাকে বলে।আর মেয়ে যে ওর কথার দাপটে ঘাবড়ে যাবে এমনটাই তো মনে মনে ভাবছিল অরিত্র। যেখানে অরিত্র সুপ্রিম আর সে বেচারি নেহাতই নিরিহ..সেখানে ওকে যে এভাবে.. যাক সে কথা আর বার বার ভাবতে মোটে ইচ্ছে করছে না কারণ অরিত্র বুঝতে পারছে কালে চক্রে মেঘা এই আসরে আসতে বাধ্য হয়েছে এ বিয়েতে ওর মোটে সায় নেই।কি করে হবে যে কলেজেই একরকম হাসির ছলে নিয়েছিল অরিত্রকে সে কি আর তাকে সিরিয়াসলি নিতে পারে কখনো? নইলে অমন কি কেউ করে?কখনো চোখ পাকাচ্ছে কখনো ট্যারা হচ্ছে..
অরিত্রর ভালো লাগছিল না।ভালই তো ছিল অরিত্র একটা ভালোলাগায় আচ্ছন্ন হয়ে।একটা কল্পনার প্রেমিকা যার কাছে অরিত্র মিছে প্রেমর প্রত্যাশা তো করতে পারত!তার সান্নিধ্যের কল্পনায় মিলত দু দন্ড কল্পনার স্বস্তি।কিন্তু সে সব কেমন করে যেন শিকড় সমেত তুলে দিল বিধাতা। ওপাশ থেকে যখন “না” শুনতে হবে! তখন কি থাববে মেঘার চিন্তার মধ্যে এমন ভালোলাগার স্বাদ?
মোবাইল বাজতে অরিত্রর চিন্তা ছিন্ন হল।ওলির ফোন।মনে পড়ল কাল মেয়েটার গানের প্রোগ্রাম। মোবাইল রিসিভ করে অরিত্র বলল…. “আরে তোমার কথাই ভাবছিলাম! “
ওপাশ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল…”বাজে কথা!”
…”কেন? বাজে কেন হবে?”
…”সব খবর রাখি স্যার!ইশিদি বলেছে!”
…”কি বলেছে?”
…”বলেছে বিয়ের পিড়িতে বসার ব্যবস্থা করতে গিয়েছিলে আজকে।তা কেমন হল হবু প্রিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ? “
…”হবু প্রিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎটা যদি ফুটবল স্টেডিয়ামে হত তবে মনে হয় আজকের চাইতে বেটার হত!”
…”মানে?”
…”আর মানে!ছাড়। তোমার প্রিপারেশন কেমন?কাল প্রোগ্রাম তো?”
…”হুম!তুমি আসছ? “
…”হান্ড্রেড পারসেন্ট! “
…”তবে কাল দেখা হচ্ছে কেমন?”
…”ওকে বাই!”
ফোন রাখার পর শব্দ করে একটা নোটিফিকেশন এল।শ্রুতি বন্ধুত্বের আর্জি পাঠিয়েছে। অরিত্র তাতে সাড়া দেওয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে মেসেঞ্জারে বার্তা ঢুকল…”হাই!কেমন আছ?তুমি তো খুঁজলে না।তবে আমি দেখছি মানুষের খোঁজ খবর নিতে বেশ ভালো পারি!”
অরিত্র লিখল “ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম। তোমার কথা হামেশাই মনে হত..”
…”তাই?কি ভাবতে?মেয়েটা বোকা?ইন্টিলিজেন্ট? বেশি কথা বলে না ওভার স্মার্ট?
ওয়েট ওয়েট..তুমি তো কনফিউজড করে দিলে।আমি যে একেবারে অন্য কথা ভেবেছি।
কি?
মেয়েটা স্বচ্ছ!
স্বচ্ছ?হোয়াটস দ্যাট?আই নো বেঙ্গলী বাট অতটাও না…”
তা তো বলব না।এটা তোমাকে বুঝে নিতে হবে।আর আমি তাই ভাবি যেটা বললাম।
ওয়েট ওয়েট আই সার্চ ইট ইন গুগল..
কিছুক্ষণ পরের বার্তা…”ওয়াও ইউ থিংক আম ট্রান্সপেরেন্ট?আম ক্লিয়ার। রাইট?
ইয়েস ট্রান্সপেরেন্ট লাইক ওয়াটার!
আর জলে যে রঙ মেশে জল সেই রঙের হয়ে যায়।জান তো?
জানি।আর সেইটাই চিন্তার
কেন?
কারণ… ওয়েল তুমি ভাববে আমি বুড়োদের মতন তোমাকে জ্ঞান দিচ্ছি!
না।ভাবব না প্লিজ বল..
বি কেয়ারফুল শ্রুতি! দুনিয়া তোমার মতন স্বচ্ছ নয় যে…
আই নো।সেই জন্য এমন একজনকে চাই যে আমায় আগলে রাখবে।যে জলকে দূষিত হতে দেবে না!
তুমি নিশ্চয়ই এমন একজনকে পাবে শ্রুতি যে তোমাকে আগলে রাখবে!
পাব?তার মানে তুমি বলতে চাইছ এখনো পাইনি?
অরিত্র আর কিছু লিখতে পারছিল না।শ্রুতি কি ইঙ্গিত করতে চাইছে তা বোঝা কি খুব কঠিন কিছু?
কিন্তু অরিত্র কি লিখবে?এই মেয়েটাকে অরিত্র ভালোবাসে না। আবার খারাপও তো বাসে না।মেয়েটা ওর সঙ্গে প্রথম থেকে ভালো। মেয়েটা বুঝিয়ে দিচ্ছে ওর পছন্দ অরিত্রকে।এমন একজনের মুখের উপর কি বলা যায় আমি তোমাকে ভালোবাসি না?না এতটা নির্দয় হতে পারবে না অরিত্র। কিন্তু প্রেম বললে হৃদয়ের যে তন্ত্রীতে টান পড়ে সে যে মেঘা…
ওপাশ থেকে উত্তর না পেয়ে আবার বার্তা ঢুকল, চিল ইয়ার।কই টেনশন লেনে কি জরুরত নেহি।বাই অ্যান্ড সুইট ড্রিম।স্বপ্নো মে আ কর তুমে পারেশান করুঙ্গি..
সবুজ চিহ্ন নিভে গেল।অর্থাৎ অফ লাইন হল শ্রুতি।
অরিত্রর মুডও অফ হয়ে গেল।আজ যেন ঝাঁক ঝাঁক হতাশা পাক খাচ্ছে মাথার উপর।
অরিত্রর জীবন ওর ইচ্ছের বাইরেই একেবারে ঘটনা চক্রেই এখন তিন জন নারীর সঙ্গে জড়িয়ে।সরাসরি ভাবে না হলেও কোনও না কোনও রকম ভাবে তারা তার সঙ্গে নিজেদের যেন পাক খাইয়ে ফেলছে।এর মধ্যে মেঘা যদিও সেভাবে নেই।তবু একেবারেই কি নেই?অরিত্রর নিরাশ মন কি এখনো এই আশায় নেই হয়ত বা হ্যাঁ আসবে ওদিক থেকে। আর যদি তাই হয় তবে শ্রুতি কি ওলি এরা কি আর থাকবে অরিত্রর আশেপাশে?
অরিত্র ভালবাসে না ওলিকেও।একবারের আলাপে কি প্রেম হয়?হয়তো বা হয়েও থাকতে পারে মেঘাকে সিঁড়ির মুখে ঐ প্রথম দিন দেখেই তো অরিত্র শুধু ওর কথাই ভেবেছিল
তা তো আর হয়নি কখনো। সে কি ছিল শুধুই কাচা বয়সের দুর্বলতা?
হয়তো তাই!
কিন্তু দুর্বলতা যাই থাক অরিত্র সবল বন্ধুত্বের খাতিরেই গেল ওলির গানের প্রতিযোগিতায়।প্রতিযোগী নেহাত কম নয়।প্রায় পশ্চিবঙ্গের সব ডিস্ট্রিক্ট থেকেই এসেছে ছেলে মেয়েরা।প্রত্যেকেই ভিন্ন বয়েসের।গান কেউ কেউ খুব ভালো গাইল।কেউ মাঝারি গোছের।একেবারে মন্দ নয় কেউই।ওলির গান অরিত্র বেশ মন দিয়ে শুনল।আর ওর গান শোনার পর মনে হল মন দেওয়ার দরকার পড়ে না মন আপনা হতেই নিবেশিত হয়ে যায় এমন গান শুনলে।ওলি সত্যি ভালো গায়।যদি এই প্রতিযোগিতায় কারচুপি না থাকে তবে ওলিই জয়ী হবে এমনটাই অরিত্র মনে মনে ভাবছিল।আর হলও তাই।
ওলিকে বিজয়ী ঘোষণা করে বিখ্যাত শিল্পীদের সঙ্গে গানের সিডি বেরর করার কথাও বলা হল।হল থেকে ওলি এক রকম লাফাতে লাফাতে বেরিয়ে এসে অরিত্রর হাত চেপে ধরল.. “ইউ আর মাই লাকি চার্ম!তুমি না এলে আমি জিততামই না!”
ওর হাতের উপর আলত হাত রেখে অরিত্র বলল…”ইউ আর দ্য বেস্ট!আমি না এলেও তুমি জিততে! “
ওলির দু চোখ আনন্দে জ্বলে উঠল। ওর মুখময় আত্মবিশ্বাসের ছটা।
…”অরিত্র.. অরি..”কিছু বলতে গিয়েও থামল ওলি।
…”কি? বল?”
…”তোমার কখনো এমন হয়েছে যাকে… যাকে ফার্স্ট দেখেই ভালোবেসে ফেলেছ?”
ওলি ওর মুখের দিকে চেয়ে।সে চাওনি যেন উত্তর চাইছে।যেন শুনতে চাইছে হ্যাঁ দেখেছি আর সে তুমি ওলি।তুমি…
কিন্তু কি করে বলে সে কথা অরিত্র? ওকি ভালোবাসে এই সরল মেয়েটাকে যাকে নির্মম ভাবে ঠকিয়েছিল একটা ছেলে।না ভালোবাসে না অরিত্র। ওর চোখের দিকে চোখ রেখে অরিত্র বলল… “মেঘা…আমি আসলে সেভাবে..এখনো ভাবিনি..মানে..”
ওলি কিছুক্ষণ স্থির চোখে চেয়ে রইল অরিত্রর দিকে। তারপর স্মিত হেসে বলল… “জানি আমি অত..তবে মেঘাকে আমার হয়ে অনেক শুভেচ্ছা জানিও!”
মুহুর্তে হকচকিয়ে গেল অরিত্র। ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে ওলির দিকে।মনে একটাই প্রশ্ন মেঘার নাম ওলি কি করে জানল?
সে কথা বোধহয় পড়ে নিল ওলি।হেসে বলল…”তুমিই একটু আগে আমায় ওলি বলতে গিয়ে মেঘা বলেছ!বুঝতে পারছি অরিত্র কেউ তোমার অবচেতন মনে লুকিয়ে থেকে তোমার চেতনার উপরও প্রভাব ফেলছে!তবে সে লাকি এ কথা মানতে হবে!”
…”কেন বললে?”
…”কারণ তুমি কখনো কাউকে কষ্ট দিতে পারবে না।এমন মানুষ মেলা কি সহজ?”
না সত্যি সহজ না কাউকে কষ্ট না দিয়ে সবাইকে সুখী করে এগিয়ে চলা।অরিত্র জানে ওর জন্য কষ্ট পাবে ওলি।হয়তো বা কষ্ট পেতেও পারে শ্রুতি। যদি না ওর অরিত্রর প্রতি মোহ নেহাতই খামখেয়ালিপনা না হয়।
কিন্তু অরিত্র নিজে?
ও কি কষ্ট পাবে না একটা হ্যাঁ শুনতে না পেয়ে?
ফোন একটা আসবে তা অরিত্র জানত।কিন্তু তা যে কি বার্তা আনবে তা ছিল সংশয়ের।অরিত্র যদিও ধরে নিয়েছিল ও তরফ থেকে “না”- টাই শুনতে হবে।কিন্তু অফিসের কাজে ব্যস্ত অরিত্র যখন মা’য়ের ফোনটা ধরে অতি ব্যস্ততায় উত্তর দিছিল তখনও কি জানত চমক আচমকাই আসে?
কানে মোবাইল। অরিত্রর চোখ কম্পিউটারে। একটু আগে ইশিকাদি কিছু ইন্সট্রাকশন দিয়ে গেছে।
…”লাঞ্চ এখনো করিনি মা।তুমি যা দিয়েছ পিওনকে দিয়ে গরম করিয়ে তারপর খাব!এখন রাখি?”
…”আরে শোন শোন..”
…”ওফ আবার কি হল?আমি বিজি!বাড়ি গিয়ে শুনলে হত না?”
…”ও পরে শুনবি!ঠিকাছে ছোট্ট করে বলছি।মেঘা রাজি আছে।তোর মতটা জানতে চাইছে।তোর বাবা তো মেয়ের বয়স বেশি বলে গাইগুই করছে।আমার তো সবই পছন্দ। এজ ডিফারেন্স নিয়ে আমি ভাবছি না।এত ভালো ফ্যামিলি… অমন মিশুকে..মেয়ে অমন সুন্দরী। কচি মেয়ে বিয়ে এ হত আগেকার দিনে। তোর বাপ তো চিরকালের সেকেলে…ও তোর বুঝি দেরি হচ্ছে?ঠিক আছে বাড়ি আয় তারপর নয় কথা হবে!”
অরিত্র চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়েছে…”কি বললে?মেঘা রাজি?”অরিত্রর মনে হচ্ছিল ও ভুল শুনছে।
..”হ্যাঁ রে। তা তোর কি অমত..মানে তোর বাবার মতন যদি তুইও ভাবিস তবে আমি জোর করব না…”
…”না না আমি তা মোটে ভাবি না।“অরিত্র বলল হড়বড়িয়ে।
…”আসলে ওরা বায়োডেটায় বয়স ঠয়স অত কিছু লেখেনি।দিয়েছিল মেয়ের কোয়ালিফিকেশন আর হবিজ..তাই আর…’”
..”মা..”
…”হ্যাঁ বল।“
…”তুমি ওদের বলে দাও আমার আপত্তি নেই!”
…”তাড়াহুড়োর কিছু নেই অরি।বাড়ি এসে নয় ধীরে সুস্থে…”
…”আমি রাজি আছি!”
…”আচ্ছা।তবে বলে দিই ওদের।বিশ্বাস কর আমি এই সম্বন্ধে খুব খুশি! আচ্ছা রাখলাম!”
অনেকক্ষণ হল মা ফোন রেখে দিয়েছে কিন্তু অরিত্র যে এখনও ঘোরে।ভালোলাগা। প্রেম। না এত দিনের সুপ্ত ইচ্ছের পরিণতি প্রাপ্তির উত্তেজনা ?
সে যাই হোক অরিত্রর কিন্তু কিছুই যেন বিশ্বাস হচ্ছিল না।মেঘা?সেই স্বপ্নের মেঘা অরিত্রের হতে চলেছে শেষমেশ! এমন্ব কি হয়?
বিয়ে খুব শিগগিরই। কারণ মেয়ের বাবা চাকরি সুত্রে মেঘালয়ে থাকেন।তার ইচ্ছে বিয়েটা তাড়াতাড়ি মিটে গেলে ভালো। নইলে মেঘালয় আর কলকাতা করা তাদের পক্ষে বেশ চাপের।এখন তারা মেঘালয়ে ফিরে গেছেন সপরিবারে। অরিত্রর মনটা টনটন করছে বিরহে।ভেবেছিল বিয়ের আগে যদি কয়েকটা বার দেখা সাক্ষাৎ করা যায়।কিছু কথা।চোখের দিকে চেয়ে মনের গভীরতা মাপা!আর একটা কথা খুবই জানতে ইচ্ছে করছে তা হল মেঘা কি বরাবর পছন্দ করত অরিত্রকে?সেই কলেজ বেলা থেকে? লজ্জা পেত কি মেয়েটা? তাই স্বীকার করেনি সে কথা কখনো?
অরিত্রর এ কথা মনে পড়ে বছরের মাঝ পথে হুট করেই কলেজ ছেড়ে দিয়েছিল মেঘা।পরে জেনেছিল ওর বাবার বদলি হয়েগেছে।কোথায় বা কখনো আবার কলকাতায় ফিরবে কি না এ সব অরিত্র আর জিজ্ঞেস করেনি কাউকে। কেন যেন মনটা ভেঙে গিয়েছিল।মনে হয়েছিল থাক না!কি দরকার আবার করে দুঃখ খোড়ার?
অরিত্রর বাবা অবশ্য এ বিয়ে নিয়ে সামান্য বিবাদ তুললেন। বললেন…. “সম্বন্ধ করে সমবয়সীতে বিয়ে এ জম্ম বয়েসে শুনিনি!লোকে তো বলবে ও প্রেম করেছে!”
শুনে অরিত্রর মা খানিকটা হাসলেন। তারপর বললেন….”তবে আমার গর্ব হবে। আমার যত গুলো বন্ধু আছে তাদের সব কটা ছেলে মেয়ে প্রেম করে বিয়ে করেছে। সবাই ভাবে আমি বুঝি মেনে নেবো না বলে ছেলে আমার প্রেম করতে ভয় পায়।এবার যদি লোকে ভাবে অরি প্রেম করে বিয়ে করেছে তাতে,আমার মুখ থাকে!”
…”তোমার যত সব।আমার কিন্তু মোটে ভালো লাগছে না ব্যাপারটা!”
…”কেন? বলি সমস্যাটা কোথায়?”
…”বউকে যদি বয়স্ক লাগে? মানে যদি মনে হয় বরের চাইতে বেশি বয়েসের।সমবয়সী হলে এমন লাগতেই পারে।মেয়েরা বেশি ম্যাচুয়র দেখতে হয়। তখন কেমন লাগবে?রাস্তায় বেরলে মনে হবে দিদি তার ভাইকে নিয়ে বেরিয়েছে!”
..”বল কি?”বলে গালে হাত দিলেন অরিত্রর মা….”তোমরা এত ভাব?আর যখন বয়েসের চাইতে দশ বারো কি পনেরো বছরের ছোট মেয়েকে বিয়ে কর তোমরা? তখন লোকে ভাবে না বাবা মেয়েরকে নিয়ে বেরিয়েছে? “
অরিত্রর বাবা খিঁচিয়ে উঠলেন…”কি বলছ কি?এগুলো কি ফেসবুকের গল্প পড়ার প্রভাব?যত সব ডি গ্রেডের লেখা পড়বে আর আজে বাজে বকবে!আমাদের সমাজে যা হয়ে আসছে তুমি কি বলতে চাইছ সব ভুল?ছেলেদের বয়স বেশি থাকে কারণ তারা অনেক বেশি বয়স পর্যন্ত যৌনক্ষম হয়।যা মেয়েরা হয় না।কথাটা বলতে চাইছিলাম না ছেলের বাপ হয়ে কিন্তু বলতে হল!”
…”তার মানে বিয়েটা কেবল দীর্ঘ সময়ের যৌন তৃপ্তির জন্য করা।আর কিছু না?এই ভাব তুমি?একটা দুটো সন্তানের জন্মের পরেও ভোগ দীর্ঘায়িত করার জন্য এই ব্যবস্থা? “
…”আহ! বাজে বক না।তোমার কি মনে হয় এজ ডিফারেন্সে যে সব বিয়ে হয়েছে তাতে প্রেম নেই?সে কি নিছকই ভোগ?”
…”একশ বার প্রেম আছে।আমি তো বয়েসের তফাতের বিয়ের বিরোধী নই।প্রেম থাকলে আবার বয়স কিসের বাধা?কিন্তু তুমি যে কথাটা বললে তা কি সমর্থনযোগ্য? ছেলেদের বেলায় এক আর মেয়েদের ক্ষেত্রে সব উলটে যাবে?অরি যদি আমার ছেলে হয় তবে এ বিয়ে করবে।বয়সের অজুহাতে এড়িয়ে যাবে না!”
অরিত্র সব শুনল মুখ বুজে। এ বিয়ে যে ওর কাছে কতটা কি তা কি আর জানে মা বাবা?ওরা অহেতুক লড়ছে!
যদিও প্রচন্ড লজ্জা করছিল মা বাবার সামনে দাঁড়িয়ে এ সব আলোচনার মুখোমুখি হতে।মা রেগে গেলে কিছু খেয়াল আর কিছু খেয়াল থাকে না।বরাবর যুক্তিবাদী অরিত্রর মা।তবে বাবার সঙ্গে এমন বিষয়ে ঝগড়া করতে অরিত্র এর আগে দেখেনি তাকে।
বাড়ি থেকে বেরিয়ে অরিত্র হেঁটে চলল লম্বা রাস্তা ধরে। ভাবছে।ভাবেছে শুধু মেঘার কথা।এর বাইরে কিছু যে ভাবনা আসেই না আজকাল।
অরিত্র বিয়েতে নিমন্ত্রণ করেছিল ইশিকাদিকে।ওলিকে আর শ্রুতিকে।অরিত্রর অন্যান্য বন্ধুদের মধ্যে শ্রুতি আর ওলি ছিল বিশেষ। ওরা এল।শ্রুতি ওর কানের কাছে ফিসফিস করে বলল,অরিত্র তুমহারা কই ভাই নেহি হ্যায়?
অরিত্র হেসেছে।তারপর স্কুলের লাজুক ছেলে মেঘদূতকে দেখিয়ে দিয়েছে।মেঘদূত অরিত্রর ছোট বেলার বন্ধু।লাজুক। ভালো মানুষ গোছের।অরিত্র জানে মেঘদূত ধরে রাখতে পারবে শ্রুতির স্বচ্ছতা।বেচারা বরাবর ঠকেছে।পরীক্ষায় ওর লেখা টুকে অনেকে ওর চেয়ে বেশি নাম্বার পেয়ে ওরই পিঠ ঠুকে বলেছে বেটার লাক নেক্সট টাইম।খেলত ভালো বলে ফুটবল মাঠে বেইমানির স্বীকার হয়েছে বারবার।চাকরির ক্ষেত্রেও ঠকিয়েছে অনেকে। খেটেখুটে প্রেজেন্টেশন তৈরি করেছে।ক্রেডিট নিয়ে চলে গেছে অন্যে।বসকে বলেছে সব তাদের প্ল্যান।প্রমশন পর্যন্ত আটকে গেছে ওর সরলতার জন্য।তাই অরিত্র জানে মেঘদূত ঠকতে পারে কিন্তু ঠকাবে না কখনো…
ওলি আর ইশিকাদি বসে অরিত্রর বিয়ের মন্ডপের পাশে।ইশিকাদি নিজের দিদির জায়গাটা নিয়ে নিয়েছে কখন কি ভাবে তা কেউ খেয়ালও করেনি।মেঘা আর অরিত্রর গাঁটছড়া বেধে দিল ইশিকা।ওলি ভিডিও করে গেল ওর মোবাইলে।
অরিত্র জেনেছে ওলির গানের সিডি হিট হয়েছে।আর দুর্গাপুর ফেরা হবে না ওলির।এখন হাতে প্রচুর ওফার।ওলি হয়তো আর পিছন ফেরার সময়ই পাবে না।
কিন্তু অরিত্রর সামনে যে ফুলশয্যার রাত..
ফুলশয্যার রাতে অরিত্র বুকের ভিতর ধুকপুক নিয়ে যখন ঢুকল ওদের ঘরে তখন মনে হল ফুলের মাঝে বুঝি অপেক্ষা করছে শকুন্তলা রাজা দুষ্মন্তের জন্য!নিজের মধ্যে রাজা রাজা ভাব নিয়ে অরিত্র ঢুকল।হাতে গোলাপ ফুল।ইশিকাদি ধরিয়েছে বলেছে বউ বলে কি প্রপোজ করতে নেই নাকি?আজ রাতে প্রপোজ করবি!
অরিত্র বলেছে যদি না বলে?
চোখ পাকিয়ে ইশিকদি বলেছে তুই কি কোনও দিনও শুধরবি না?
হাতে গোলাপ ফুলটা নিয়ে খাটের কাছে এসে দাঁড়াতেই মেঘা বলল,ওটা কি হাতে ধরেই থাকবে?
অরিত্র নার্ভাস হয়ে হাসল।মেঘাকে কি ভয় পাচ্ছে অরিত্র?
মেঘা একটা পাশ বালিশ টেনে তাতে ভর দিয়ে আধশোয়া হল।অরিত্র ওর কাছে এসে বসেছে।
…”তোমার ভাবতে কেমন লাগছে মেঘা আমরা হাসবেন্ড ওয়াইফ?”বলল অরিত্র।
অরিত্রর দিকে স্থির দৃষ্টিতে খানিকক্ষণ চেয়ে থেকে মেঘা মুখে হাত দিয়ে খিলখিল করে হেসে ফেলল। সেই ওর পুরনো ভঙ্গি যাতে কাবু হয়ে যায় অরিত্র।
হাসি থামিয়ে মেঘা বলল…”তোমার কি একবারও মনে হয়নি এগুলো কি করে হচ্ছে?আইমিন কাকতালীয়ওর তো একটা সীমাবদ্ধতা থাকে? হ্যাঁ? “
অরিত্র যেন আকাশ থেকে পড়ল।বলল…”তার মানে?”
…”মানে তোমার কি মনে হয়।তুমি আমাকে বিয়ে করলে না আমি তোমাকে?”
…”আমরা দুজন দুজনকে!”
মেঘা আবার হাসছে…. “আজ্ঞে না।আমি রীতিমতো খান তল্লাশি করে তোমার খবর বের করে তবে এই মিলন হয়েছে প্রভু!”
অরিত্র একেবারে হতবম্ভ।
ওর মুখের দিকে চেয়ে মেঘা ওর লম্বা তর্জনী অরিত্রর চিবুক বরারর ঘুরিয়ে বলল….”বলি মগজটা কোথায় রাখ? আলমারির তাকে না মায়ের গয়নার বাক্সে!যখন টুক্কুশ হেসে বলল”তাই বুঝি?”তখনও কিছু বোঝনি?”
অরিত্র দু পাশে মাথা নেড়ে বলল… “কে কুট্টুশ?”
হি হি হাসিতে গড়াল মেঘা…”কুট্টুশ না টুক্কুশ!আমার দিদির মেয়ে।কি গো তুমি?যেদিন আমায় দেখতে এলে ও তোমায় নাম জিজ্ঞেস করেনি?”
অরিত্র আগে পিছে মাথা নেড়ে বলল…”করেছে!”
…”নাম শুনে বলেনি,তাই বুঝি?”
…”হ্যাঁ বলেছে!”
…”উফ বুদ্ধু ওটাই তো কোড ছিল!”মেঘা টোকা মারল অরিত্রর মাথায়।
অরিত্র ওর আরও কাছে এল।নিবিড় হল মেঘার সঙ্গে। মেঘা বাধা দিল না।বলল….”আর বুঝি শোনার দরকার নেই কিছু?”
…”আছে।শুনি আমার মিসেসের গোয়েন্দাগিরি! “
অরিত্রর গলায় নিজের দু হাতের মালা জড়িয়ে মেঘা বলতে শুরু করল….”বাড়ি থেকে যখন আমার বিয়ের জন্য সম্বন্ধ খুঁজতে লাগল আমার কেমন যেন বিরক্তি লাগল।মনে হল যাদের চিনি না জানি না হুট করে বিয়ে করব কি করে?মনে যে তুমি ছিলে না তাও তো নয়।কলকাতা থেকে মেঘালয়ে আসার পর কত ভেবেছি ভিতু সব সময় হেজিটেট করতে থাকা ছেলেটার কথা।যে নিজের নাম বলেছিল আর আমি বলেছিলাম,” তাই বুঝি!”আমার তোমায় খুব ভালো লেগেছিল অরিত্র কিন্তু ভালবাসার আগেই আমরা আলাদা হয়ে গেলাম।তারপর আমার মাসির ছেলে বুবুন একদিন ওর অফিস পার্টির ছবি দেখাচ্ছিল।সেখানেও দেখি তোমার ছবি।ব্যস প্ল্যান ছকে ফেলি।বুবুন তোমার অফিসেরই।ওর ভালো নান সোহম।ওকে লাগালাম তোমার পিছনে।খোঁজ করলাম তুমি প্রেম ঠেম কর কি না।চরিত্র ঘুন ধরেছে কি না।সব ক্লিয়ার মেলায় লেগে পড়লাম আমি আর বুবুন মিলে।কলকাতায় ঘটক যোগাড় করা তাকে আমার ছবি তোমাদের কাছে পাঠানো এ সবের পিছনে বুবুনের ডেডিকেশন প্রচুর।প্ল্যান আমার হলেও এফোর্ট তো ও বেচারাই লাগিয়েছে।আমি কঠি নাড়িয়েছি মেঘালয়ে বসে বসে।“
অবাক হয়ে অরিত্র বলল… “এত কিছু!”
…”জি হা!”
অরিত্র আরও ঘন হল মেঘার।ওর কপালে চুমু খেয়ে বলল….”ইউ ডোন্ট নো মেঘা হাউ মাচ আই লাভ ইউ!”
ফিক করে হেসে ফেলল মেঘা। অরিত্রর কানের কাছে ঠোঁট এনে ফিসফিস করে বলল…. “তাই বুঝি?”
অরিত্রর বাহুতে মেঘা আটক এখন।দু জনে মগ্ন দুজনেতে।
অরিত্রের মন আকাশ যে এখন মেঘাময়।
না না মেঘলা কি আর থাকে? এখন যে চারিদিক শুধুই রোদ্দুর আর রোদ্দ্রুর..
★★সমাপ্ত★★
©রিমা বিশ্বাস