খোঁজ পর্ব ৩

0
626

#খোঁজ তৃতীয়_পর্ব
#লেখক_মোঃ_কামরুল_হাসান

কাজের মহিলাকে আমার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে বুঝতে পারলাম, সে কিছু চাইছে। জিজ্ঞেস করলাম কিছু বলবে? জ্বি, ভাইজান! ঠিক আছে যা বলার তারাতাড়ি বলে ফেলো!

কাজের মহিলা এদিক সেদিক তাকিয়ে বলে, আমি যে কথাগুলো কইলাম। খালাম্মা জানলে, আমারে খুব বকবো! পকেট থেকে কিছু টাকা বের করে তার হাতে দিয়ে বললাম, এই টাকা কয়টা রেখে দাও! আর তুমি কোন চিন্তা করোনা।

আমি তোমার কথা কাউকে বলবো না। তুমি ছাড়াও এই খবর আমি আরও দুজনের কাছ থেকে জানতে পেরেছি।এমন সময় আমার শ্বাশুড়ি এসে জিজ্ঞেস করে, তুমি এতোক্ষণ কোথায় ছিলে সায়েম? এদিকে আমি তোমাকে খুঁজে খুঁজে হয়রান হয়ে যাচ্ছি! খুঁজে না পেয়ে ভাবলাম তুমি বাইরে গেছো।

জ্বি, আম্মা! আমি বাইরে গিয়ে একটু খোঁজ খবর করতেই অদিতির ঘনিষ্ঠ বান্ধবী মিথিলার সাথে দেখা হয়ে গেল। মিথিলার কথা বলতেই উনার মুখের উপর একটা কালো ছায়া নেমে এলো। আমিও আঁড়চোখে একবার তার মুখটা ভালো করে দেখে নিলাম।

আমার কথা শুনে তিনি গম্ভীর কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, মিথিলার সাথে তোমার কেমন করে দেখা হলো? আমি জবাবটা আগেই তৈরি করে রেখেছিলাম। তৎক্ষনাৎ বললাম, অদিতির কাছে ওর এতো বর্ননা শুনেছি যে দেখেই চিনতে পারলাম। আর মিথিলার ছবি অদিতির মোবাইলে ছিলো আমি তা অনেকবার দেখেছি। ( এটা অবশ্য আমি আন্দাজে ঢিল ছুঁড়ে মারার মতো বলে দিলাম) তিনি নিশ্চয়ই বিশ্বাস করতে বাধ্য?

উনার দিকে ফিরতেই তিনি মুখে কৃত্রিম হাসি ফুটিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তা সে কিছু বললো, তোমাকে? জ্বি আম্মা! অদিতি নাকি এখানে আসেনি। তার দাবী তারা দুজনেই এতোটা ঘনিষ্ঠ যে, এতো কাছাকাছি থাকলে কেউ কারও সাথে দেখা না করে থাকতে পারবে না! আরও একজন অবশ্য তাই বলেছে।

এবার শ্বাশুড়ি আম্মার মনে হচ্ছে দম ফুরিয়ে এসেছে। তিনি ধপাস করে সোফার উপর নিজের দেহটাকে ছেড়ে দিলেন। কতক্ষণ চুপ করে থেকে বলে উঠলেন, সত্যি অদিতি আমার মান সম্মান বলে কিছু রাখলো না বাবা! এতোদিন ধরে কোথায় কিসের জন্য নিখোঁজ হয়ে আছে সে?

আমি তার কথা শুনে চমকে উঠে জিজ্ঞেস করলাম, এমন কথা কেন বলছেন আম্মা? আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে অদিতি ইচ্ছে করে পালিয়ে আছে! প্লিজ আমার সাথে আর লুকোচুরি খেলবেন না! দয়া করে সত্যি কথাটা বলে, আমার অশান্ত মনটাকে একটু শান্ত করুন!

বেড়াতে আসার একদিন পর থেকেই এই নাটক চলছে আমার সাথে! আমি আর এই নাটকে অভিনয় করতে পারছি না। অস্থির হতে হতে ক্লান্তি ও অবসন্নতায় পেয়ে বসেছে আমাকে। বলুন সত্যি ঘটনাটা কি?

আমার শ্বাশুড়ি আমার কাছে এসে বসে বলে, তুমি কিছু মনে করো না বাবা! আমি তোমার কাছে লুকিয়ে রাখতে চেয়েছি, কারণ তুমি শুনে যদি অদিতিকে ভূল বোঝে দূরে সরে যাও? এই একটা ভ*য় আমাকে সবসময় গ্রাস করেছে! আমি কখনো চাইনা তোমার আর অদিতির মাঝে কোন ধরনের ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হোক।

উনার কথা শুনে আমি শান্ত গলায় বললাম, একজন মা হিসেবে আপনার চাওয়াতে কোন অন্যায় নেই। যদিও আমাকে আরও আগেই জানানো উচিৎ ছিলো আপনার।আচ্ছা যাইহোক, এখন অদিতি কোথায় আছে সেটা বলুন আমাকে?

উনি আমার কথা শুনে আঁচলে মুখ ঢেকে কাঁদতে শুরু করলেন। মহা মুশকিল হলো উনার এমন কান্নার কারণে। বুঝতে পারলাম না তিনি সত্যি কাঁদছেন না-কি পুরোটাই আমাকে দেখাতে? কারণ এই কান্নার কারণে বারবার কথার মোড় ঘুরে যাচ্ছে! আমি এবার আর উনাকে কথার মোড় ঘোরাতে দিবো না!

তাই বললাম কাঁদবেন না, আম্মা! অদিতি কোথায় আছে সেটা বলুন প্লিজ! তিনি কান্না জড়িত কন্ঠে জবাব দিলেন আমি জানি না বাবা! জিজ্ঞেস করলাম আপনাকে অদিতি কিছুই বলে যায়নি! এটা কোন কথা হলো?

বলেছে বাবা! যাবার সময় বলে গেছে এক বন্ধুর সাথে দেখা করে তারপর ওর বড় খালার ওখানে গিয়ে কয়েক দিন থাকবে। কিন্তু সেদিন রাত থেকেই ওর মোবাইল বন্ধ। আমি উত্তেজিত হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ওর সেই বন্ধুর কি নাম? আমি জানি না বাবা! জিজ্ঞেস করলাম তার ঠিকানাটা জানেন? নাহ্! সেটাও জানি না!

উনার এমন না, না, শুনে রাগান্বিত হয়ে জিজ্ঞেস করলাম তবে কি জানেন আপনি? সেটাই বলুন আমাকে! তিনি এবার ফুপিয়ে কেঁদে উঠে বলেন, আমি কিছুই জানি না! তুমি আমার অদিতি কে খোঁজে এনে দাও বাবা! আমি এই ব্যাথা আর সইতে পারছি না।

বুঝতে পারলাম উনাকে এতোটা কড়া গলায় কথা বলাটা আমার উচিত হচ্ছে না। হাজার হলেও তিনিই অদিতির মা! তার চাইতে ওর উপর কার বেশি মায়া থাকতে পারে? তাই নরম কন্ঠে বললাম আমার কথায় কিছু মনে করবেন না আম্মা! সত্যি বলতে আমি আপনার মেয়ের চিন্তায় অর্ধেক পা*গল হয়ে গেছি।

শ্বাশুড়ি চোখের জল মুছে বলেন, সে আমি জানি বাবা! তুমি কতোটা ভালোবাসো অদিতিকে। আমি যেমন কষ্ট পাচ্ছি, তুমিও তার চেয়ে কম কষ্ট পাচ্ছো না! তাই তো কথাটা এতোদিন তোমার কাছ থেকে গোপন করে ছিলাম।

সোফা ছেড়ে উঠে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি আমার সাথে যাবেন আম্মা? তিনি জিজ্ঞেস করেন কোথায় যাবে? থানায় যাবো আম্মা! আমাদের সামনে এখন এই একটা রাস্তাই আছে অদিতিকে খুঁজে বের করার। তিনি আমার দিকে তাকিয়ে বলেন, এটা কি ঠিক হবে? এটা কেমন কথা বলেন আম্মা? ঠিক হবে না মানে?

তিনি আমতাআমতা করে বলেন, আরেকটু দেখলে হয় না? আমার আপা ভাতিজারা তো খোঁজ করছেই! রাগান্বিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলাম, এভাবে কাজ হবে বলে আপনার এখনো মনে হচ্ছে? অনেক দেরি হয়ে গেছে আম্মা! পুলিশ নিশ্চয়ই এই দেরি করার কারণ জিজ্ঞেস করবে। আমি তো সেটাই ভেবে পাচ্ছি না, কি জবাব দেবো?

তবুও শ্বাশুড়ি বলেন, যদি লোক জানাজানি হয়। তবে অদিতির নামে সমাজে বদনাম রটে যাবে! তখন সেই বদনামের কারণে তরুর বিয়েটা দিতে অনেক কষ্ট হবে বাবা! তুমি আরও একটু অপেক্ষা করতে পারো না? আমি কড়া গলায় জবাব দিলাম না, পারি না!

শ্বাশুড়ি আম্মা আমার কথায় এমন কিছু বুঝতে পারলেন যে,এরপর আর টু শব্দটিও করলেন না! আমার পিছনে পিছনে থানায় এসে উপস্থিত হলেন। থানা সেখান খুব একটা দূরে নয় বলে পায়ে হেঁটেই চলে এলাম। যা ভেবেছিলাম তাই হলো।

একজন মানুষ নিখোঁজ হওয়ার এতোদিন পরে কেনো থানায় আসার প্রয়োজন হলো? তার জবাব দিতে দিতেই ক্লান্ত হয়ে গেলাম। তবুও তাদের স*ন্দেহ ও রুক্ষ কথার হাত থেকে রক্ষা পেলাম না।

অফিসার তার কথায় আমাদের একরকম ধুয়ে দিলেন! বললেন এই আপনাদের মতো লোকের জন্য পুলিশের বদনাম হয়। এখন যদি এরমধ্যে মেয়েটির কিছু হয়ে যায়, তবে এর দায় গিয়ে পড়বে পুলিশের উপর! জনগণের মুখে মুখে রেট বেড়াবে পুলিশ কোন কাজের নয়! অথচ ভুলটা করেছেন আপনারা। বিশেষ করে পুলিশের কথার চাবুক আমার দিকেই বেশি আসতে লাগলো।

তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, মনে হচ্ছে আপনার আর আপনার বউয়ের মধ্যে সম্পর্কটা খুব একটা মধুর না! অনেক রাত করে বাড়ি ফিরে আসেন বুঝি আপনি? নেশায় মত্ত হয়ে! আমি সোজাসাপ্টা জবাব দিলাম সেরকম কিছু নেই আমার।

অফিসার হেসে বলেন, সেটা তো আমরা দেখবোই! তারপর বলুন।

অদিতির সাথে মাঝেমধ্যেই ঝগড়া ঝামেলা সৃষ্টি হয় আপনার, তাই না? আচ্ছা এমন তো নয়, আপনি নিজেই কোন কিছু করেছেন অদিতির সাথে! নয়তো আপনার স্ত্রী নিজেই বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গেছে?

না স্যার তেমন কিছু নয়। আপনি শুধু শুধু এসব কথা জিজ্ঞেস করে সময় নষ্ট করছেন। অফিসার আমার কথা শুনে পাল্টা জিজ্ঞেস করে তবে আপনি কিসের জন্য এতোদিন সময় নষ্ট করেছেন? যাতে কোন প্রমাণ না থাকে! সেই কারণে তাই না?

স্যার, আপনি আমার উপর স*ন্দেহ করে থাকলে ভুল করবেন। আমিই তো থানায় এলাম অদিতির খোঁজ পাওয়ার আশায়। অফিসার একটু রাগান্বিত কন্ঠে বলে, থামুন! সন্দেহের উর্ধে কেউ নয় এখানে। আর সন্দেহ করাই আমাদের কাজ! সন্দেহ না করলে আপনাদের মতো ভালো মানুষ সেজে থাকা অপরাধীদের কেমন করে ধরবো বলুন তো?

আমি এসব শুনে ভীষণ অবাক হয়ে গেলাম। তিনি আমার দিকে তাকিয়ে আবার জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা আপনার বউয়ের সাথে অন্য কারও লাইন নেই তো! যার কারণে ঝগড়ার সৃষ্টি। আর সেই ঝগড়ার কারণেই অদিতি নিখোঁজ?

জবাব না দিয়ে রা*গের মাথায় জিজ্ঞেস করলাম, আপনার কি সত্যি মনে হচ্ছে আমিই অপরাধী। অদিতির নিখোঁজ হওয়ার পিছনে আমার হাত আছে? হাত দুটি বাড়িয়ে দিয়ে বললাম, নিন আমাকে গ্রেফতার করে জেলে পুরে দেন!

অফিসার হেসে বলেন, বেশ রাগ হচ্ছে দেখি আপনার! তা এই রাগটাই সব সর্বনা*শের আসল কারণ নয়তো? চুপ করে রইলাম। স্থীর করলাম আর কিছুই বলবো না। অফিসার আমার চুপ করে থাকা দেখে বললেন, ঠিক আছে। সত্যিটা তো আমরা বের করেই ছাড়বো। তখন দেখা যাবে আপনি কতোটা নির্দোষ? তবে আমার মনে হচ্ছে অদিতির নিখোঁজ হওয়ার পিছনে আপনার হাত না থেকে যায় না!

আমাকে বকতে দেখে আমার শ্বাশুড়ি বললেন, এতে সায়েমের কোন দোষ নেই। সব দোষ আমার! লোক জানাজানি হয়ে যদি কোন কেলেংকারী ঘটে! তাই আমিই এতোদিন পরে অদিতির নিখোঁজ হওয়ার কথাটা বলি। স্যার, আমার আরেকটা মেয়ে আছে।

তার কথাও আমাকে চিন্তা করতে হয়! ধরেন গিয়ে অদিতি ফিরে এলো কিন্তু শুধু শুধু লোক জানাজানি হওয়ার কারণে সমাজে যে কুৎসা রটবে তার ভোগান্তি কতোটা ভ*য়ংকর হবে বুঝতে পারছেন। নিশ্চয়ই এর প্রভাব আমার ছোট মেয়ের উপর গিয়ে পড়বে?

অফিসার বলেন, সে যাইহোক না কেন, এতোদিন পরে আমরা কি করতে পারবো? বলতে গেলে অনেক প্রমাণ নষ্ট হয়ে যেতে পারে এতোদিন পরে। বলতে গেলে আপনাদের মেয়ে কে খুঁজে পাওয়ার আশা অনেকটা আপনারাই নষ্ট করে দিয়েছেন।

অফিসারের কথা শুনে বললাম স্যার! আমাদের ভুল আমরা স্বীকার করে নিচ্ছি।এখনো হয়তো খুব বেশি দেরি হয়ে যায়নি। দয়া করে অদিতির খোঁজটা যদি শুরু করে দিতেন। তবে আমাদের অনেক উপকার হতো!

অফিসার আমার দিকে তাকিয়ে বলেন, ঠিক আছে ঘটনা আগাগোড়া সঠিকভাবে আরেকবার বলুন দেখি। তাই অফিসারের সামনে আমি ও আমার শ্বাশুড়ি যা জানি হুবহু তাই বলে গেলাম।

তিনি সব শুনে বললেন, আপনারা এখন আসুন! দেখি আমরা কতদূর করতে পারি। আপনাদের সকলের নামধাম পরিচয় ও মোবাইল নাম্বার দিয়ে যান। তদন্ত অফিসার আসলেই কাজ শুরু করে দিবে। সে অন্য আরেকটা মিশনে আছে।

থানা থেকে বের হতে যাবো, এমন সময় দেখতে পেলাম আমার বন্ধু লিটু! আমার চোখে চোখ পড়তেই জিজ্ঞেস করে, তুই এখানে? আমিও অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম আমিও তো অবাক হচ্ছি, তোকে এখানে এমন ভাবে দেখে। লিটু এই থানার তদন্ত অফিসার!

সে আর আমি স্কুল জীবনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। কিন্তু ওর বাবার বদলি হয়ে যাবার কারণে পরে দুই তিনবার দেখা হয়েছে আমাদের। আর গত সাত আট বছরের মধ্যে কোন যোগাযোগ ছিলো না আমাদের। প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম ওর কথা!

কিন্তু আজ এখানে ওঁকে এভাবে দেখতে পেয়ে খুব খুশি হলাম। সব ঘটনা খুলে বললাম ওর কাছে। লিটু সব শুনে বলে, তুই কোন চিন্তা করিস না। আমি সবকিছুর নিজের দায়িত্বে দেখবো। আর তো কেউ নয়। বন্ধুর বউ বলে কথা!

দুদিন পরে লিটু থানা থেকে ফোন করে বললো,

যে বন্ধুর সাথে অদিতির দেখা করার কথা। সেই বন্ধুর খোঁজ পাওয়া গেছে। বাসস্ট্যান্ডের সাথেই একটা খাবারের দোকানে অদিতি ও তার সেই বন্ধুকে বসে থাকতে দেখা গেছে। লিটু বললো তাঁকে দেখে সনাক্ত করতে হবে। কি পরিচয় সেই বন্ধুর?

সাথে সাথেই আমি এবং আমার শ্বাশুড়ি সেখানে গিয়ে উপস্থিত হলাম। ভিডিওটা দেখা মাত্র আমি তাঁকে চিনতে পারলাম। যদিও তার মুখটা আমি দেখতে পাইনি। কারণ সে ক্যামেরার উল্টো দিকে মুখ করে বসে ছিলো। তবুও আমার কোন সন্দেহ নেই এটা যে মিথিলা!

চলবে,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here