#ক্যামেলিয়া
#সাদিয়া_খান(সুবাসিনী)
#পর্বঃ৩১
জাফরিনের নিশ্চুপ, স্থির চাহনী।চিন্তামগ্ন মেয়েটার সামনে থাকা খাবার গুলো প্রায় ঠান্ডা হয়ে আসছে।সেদিকে তার খেয়াল নেই।পাশে রাখা ঘড়ির টিক টিক শব্দ এবং শব্দহীন রুমে যে মুহুর্তে ফোন বেজে উঠেছিল সেই মুহুর্তে জাফরিন নিজেও ভয় পেয়েছিল।ফোনটা যেন গগনবিদারী অট্টহাসি হেসে চলেছে।স্ক্রীনে ইউভানের নাম।
“ভাইয়া কিছু পেলে?”
“না।ফুপা তোর কোথাও যাওয়ার টিকিট বুক করেছিল না।”
“কোনো টিকিট বা রিসোর্ট?”
“বাঙালি বাবারা এতোটাও ফ্রি হয়ে উঠেনি যে মেয়েকে বিয়ের পর হানিমুন ট্রিপ স্পন্সর করবে।”
“তবে নতুন কোনো প্রপার্টি?”
“সেটাও নয়।ব্যাংক স্টেটমেন্ট চেক করিয়েছি।”
“অহ।”
“ঈশানের বাড়িতে পুরো এক সংসার জিনিস পাঠিয়েছে তোর বাবা।”
“ওগুলো আমি দান করে দিয়েছি।তাছাড়া দানের জিনিসের কি হলো সেটা জানার আমার কোনো প্রয়োজন নেই।”
“কিছু জানতে পেরেছিস?”
“কোম্পানিতে বাবার বেশ ভালো একটা সুনাম আছে।আমি এই মুহুর্তে স্পেশাল ট্রিটমেন্ট পাচ্ছি।”
“কিন্তু এতো কিছু কিসের জন্য? বস্তুটা কী?কিছু বুঝতে পেরেছিস?”
“আমি প্রথমে ভেবেছিলাম কোনো দামী হিরে মুক্তোর কোনো গোপন কিছু কিন্তু এমন নয়।মাশহুদের টাকার অভাব নেই। যে এসব করছে নিশ্চয়ই সে টাকার জন্য করছে তবে যার জন্য বাবা মারা গেলেন সেটা টাকা নয় আমি নিশ্চিত।”
“এতেও তো লাভ হচ্ছে না।কারণ তুই সেই ঘুরে ফিরে একই স্থানেই আছিস।”
“বাবার মৃত্যু নেহাৎ হৃদযন্ত্র অচল নয় এটা আমি তোমাকে প্রমাণ করে দিব।আমি সাধারণ একজন মেয়ে হতে পারি কিন্তু আমি আমার বাবার আদরের মা।জেদটাকে সফল করেই ছাড়বো।কোনো কিছুর প্রয়োজন হলে আমাকে জানাবে, আর মায়ের খেয়াল রেখো।আমি রাখছি।”
স্লিভলেস টকটকে লাল রঙা ক্রপটপ পরিহিত একজন নারী প্রবেশ করেছে কেবিনে।জাফরিনের মনোযোগ তখন ইউভানের কথাগুলোতেই।মাশহুদ নামের এই রহস্য তাকে কেমন উলট পালট করে দিচ্ছে।তাকে ভাবতে বাধ্য করছে সকল ঘটনা শুরু থেকে ভাবতে।নিশ্চয়ই সে সকল রহস্যের উন্মোচন করতে পারবে। যার ভিনদেশে একজন বিজনেস ম্যান কেন একজন সাধারণ কর্মচারীর লাশ নিয়ে যাবে?হ্যাঁ জাফরিন তাকে চিনতে পেরেছে। সে আর কেউ নয় তার বাবার লাশ হস্তান্তর করার সময় সাথে যাওয়া লোকেদের মাঝে একজন।যে বসেছিল তার পাশে।তাকে স্বান্তনা দেয় নি অথচ তার দৃষ্টিতে বুঝিয়ে দিয়েছিল সে আছে।
আমাদের জীবনে কিছু মানুষ থাকে, যাদের আমরা ধরে রাখতে পারি না, ব্যর্থ হয়ে যাই কিন্তু তারা থাকে আমাদের আশেপাশেই।আমাদের প্রতিটি বিপদের আশ্বস্ত করে সে আছে।তার উপস্থিতি কষ্টের উপশম ঘটায়।এই মাশহুদের উপস্থিতিটা ছিল ঠিক সেই রকম।কিন্তু এই মুহুর্তে মনে হচ্ছে মাশহুদ নিছক এক মরিচীকা।
মেয়েটা কেবিনে প্রবেশ করেই বলল,
“স্যার কোথায় ম্যাম?”
“দুঃখিত আমি সঠিক বলতে পারছি না।”
সেই মুহুর্তে মাশহুদ ভিতরে প্রবেশ করলো।ইশারায় মেয়েটিকে বসতে বলে এগিয়ে এলো জাফরিনের দিকে।তার কপালে হাত রেখে বলল,
“জ্বর তো নেই।তবে খাবার কেন খাচ্ছেন না?”
“আমি এতোটা সাদামাটা খাবারে অভ্যস্ত নই। হয় মিষ্টি না হয় ঝাল কিছু খেতে পারবো।”
“মিষ্টি খেলে ইনফেকশন বাড়বে।আপনাকে নিয়ে আমি কোনো ঝুঁকি নিতে চাচ্ছি না।আমি বলে দিচ্ছি আপনার জন্য স্পাইসি কিছু আনবে।তার আগে এটা খেয়ে শেষ করুন তো!”
জাফরিনের গলা শুকিয়ে এলো।সে দিব্যি অনুভব করতে পারলো এই মানুষটার মাঝে তার বাবার বৈশিষ্ট্য। কেন এত মিল রয়েছে দুজনের। আর কেনই বা সে এই ব্যক্তিটাকে তার কাছে আসার অধিকার দিচ্ছে?অযাচিত এই মেলামেশা অদূর ভবিষ্যতে কেবলি যে কষ্টের কারণ হতে চলেছে।
জাফরিনকে বসে থাকতে দেখে মাশহুদ তার পাশে বসলো।রুমে উপস্থিত অন্য একজন রমনী অবাক চোখে দেখছে।মাশহুদ নিজ হাতে খাবার তুলে ধরেছে জাফরিনের মুখে।অপর দিকে কাজের নির্দেশনা দিয়ে চলেছে মেয়েটাকে।নিশ্চয়ই কোনো অনুষ্ঠান হতে চলেছে তার পরিবারে।কেক থেকে শুরু করে ড্রিংক্স অবধি সব কীভাবে কি হবে বুঝিয়ে বলছে।জাফরিনের সামনের খাবার ধীরে ধীরে শেষ হয়ে গেল।মাশহুদ নিজেও যেন ক্ষুধার্ত ছিল।এক চামচ তার মুখে তুলে দিয়ে অন্য চামচ তুলে নিচ্ছিলো নিজের মুখে।জাফরিন কিছুই বলছিল না।তাকে চুপচাপ এটুক সহ্য করতেই হবে।এই ব্যক্তির সাথে জল ঘোলা করা যাবে না।কাছাকাছি থেকেই এসবের রহস্য বের করবে সে।
মেয়েটার দিকে তাকালো জাফরিন। সে নিশ্চয়ই অস্বস্তিতে পড়েছে।খাওয়া শেষ হতেই মাশহুদ কাউকে ডাকলো।সে সবটা পরিষ্কার করে দিয়ে গেলে জাফরিন গা এলিয়ে দিলো। মাশহুদ উঠে বসেছে কাউচে।শার্টের হাতা গুটিয়ে ল্যাপটপে হাত দিয়ে কিছু করছিল সে। পাশ ফিরে তাকাতেই জাফরিন দেখতে পেল মাশহুদের হাতের ঘড়িটা।চমকে উঠে বসলো সে।এটা নিশ্চয়ই সেই কাপল ওয়াচের আরেকটা ঘড়ি।যে ঘড়িটা তার বাবা বিয়ের উপহার হিসেবে তাকে পাঠিয়েছিল।আর তার মাঝেই ছোট্ট মেমরি ছিল।তবে কী বাকীটা এই ঘড়িতে।খুশিতে চক চক করে উঠলো জাফরিনের দুই চোখ।
চলবে