#ক্যামেলিয়া
#সাদিয়া_খান(সুবাসিনী)
#পর্বঃ২৯
চোখের সামনে প্রিয় কিছুর কষ্ট মেনে না নিতে পারাটা মানব হৃদয়ের বৈশিষ্ট্য।মার্জার গোত্রের সুন্দরী জিজেল মাশহুদের ভীষণ প্রিয় ছিল।তাই মায়ের দ্বিতীয় বিয়েতে তাকে উপহার হিসেবে দিয়েছিল সে।কিন্তু প্রিয় জিনিসের খেয়াল যে প্রিয় ব্যক্তি রাখবে এমন কোনো শর্ত ছিল না।প্রিয় জিনিস গুলো প্রিয় ব্যক্তিটা অবহেলা করে ফেলে রেখেছে দায়সারা ভাবে।
জিজেল বলে ডাক দিতেই দৌড়ে তার পায়ের কাছে চলে এলো বিড়ালটা।তাকে কোলে তুলে নিয়ে মাশহুদ বলল,
“আপনার স্বামী পুলিশের হেফাজতে আছে মা।আপনি চাইলে দেখা করে আসতে পারেন কিন্তু ছাড়াতে যাবেন না।আপনি হয়তো আর্থিক দিক দিয়ে হেরে যাবেন।”
“তুমি কি সব বলছো?কেন তাকে ধরে নিয়ে গেল?”
“কারণটা অজানা নয় আপনার।আপনি কখনো জানতে চেয়েছেন জুয়াতে হেরে গিয়ে আপনার স্বামী ব্যবসার সব হারিয়ে এখন কী করে সংসার টানছে?”
কিছুটা অবাক চোখে মাশহুদের দিকে তাকিয়ে রইল তার মা।ভদ্র মহিলা জানেন না তার স্বামী জুয়াতে হেরেছেন। এইতো গত দুদিন আগেও তার এফডির কাগজ নিয়ে ব্যাংক থেকে টাকা তুলে এনেছেন। ব্যবসায় না কি লাগবে।মাশহুদের কথায় মিথ্যে নেই এটা বুঝতে তার বিন্দু মাত্র সময় লাগেনি।
“সে কী টাকার জন্য তোমার কাছে যায়?”
“মা আপনার বিয়ের আংটিটা কই?বাবা যে দিয়েছিল?”
“সেটা তো ওয়ারড্রবে।”
“আমি যাওয়ার পর দেখবেন খুঁজে।পাবেন না কারণ সেটা আমার বাবার কাছে।ছয় মাস আগে আপনার স্বামী বিক্রি করতে গিয়েছিল বাবার পরিচিত একটা শো-রুমে।ডিজাইন দেখেই ভদ্রলোক চিনতে পেরেছিলেন। তারা ভেবেছিল আংটিটা চুরি গেছে। বাবাকে কল দিলে বাবা দেখতে পায় আপনার স্বামী বসে আছে।তাকে ন্যায্য মূল্য দিয়েই আংটিটা নিয়ে আসেন বাবা।এখন সেটা বাবার কাছেই আছে।”
মাশহুদের মা কিছু বলেনি।চুপচাপ চেয়ার ধরে বসে রইলেন।মাশহুদ চলে আসার পূর্বে তার মাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“মা,বাবা আপনাকে ভালোবাসতো।হয়তো সে অন্যভাবে আপনাকে চেয়েছিল।আমার প্রচন্ড অসুস্থতায় কিংবা দুঃস্বপ্নের রাতগুলোতে আমি যেভাবে চেয়েছি আপনি পাশে থাকুন,বাবাও হয়তো চেয়েছিল আপনি প্রতিটা ভোরে অফিস যাওয়ার পূর্বে বাবার টাইটা ঠিক করে দিন।ছোটো বেলায় দেখেছি,যেদিন আপনি বাসায় থাকতেন আর অফিসে যাওয়ার আগে বাবার টাইটা নিজ হাতে বেঁধে দিতেন সেদিন বাবার মুখে অন্যরকম হাসি।সেই হাসিটা বাবা এখন আর হাসেন না।আমাদের সবার ভালোবাসার ধরন ভিন্ন।কিন্তু এই ভিন্ন ধরনেও প্রয়োজন ব্যক্তিগত মানুষটাকে বুঝতে পারাটা এবং কিছুটা সমঝোতার। সেই সমঝোতাটা আপনি করেছেন,অন্যের সন্তান মানুষ করছেন কিন্তু করেন নি বাবার ক্ষেত্রে।আপনাদের সমান সমান ইগো এবং ক্যারিয়ার ওরিয়েন্ট মানসিকতা আমার ছোটোবেলাটা একটা বদ্ধ রুমে বন্দী করে ফেলেছিল।দুজনে দুজনেরটা বুঝে আমাকে অদেখা করে এগিয়েছেন।যাক সে কথা, কিছু মনে করবেন না।আমার সামনে যখন আপনার নতুন সন্তানেরা মা বলে ডাকে তখন কষ্ট হয়।যে কষ্টটা আপনি কোনো দিন বুঝতে পারবেন না।”
জিজেলকে পশু হাসপাতালে রেখে মাশহুদ কল দিল কুঞ্জকে।বার কয়েক বার রিং হওয়ার পর কল রিসিভ করে কুঞ্জ বলল,
“বল কই তুই?”
“জাফরিনের মেইলের এক্সেস নিতে পেরেছিস?”
“তুই জানলি কি করে?”
“কি পেলি?সেই আগের মেইলের মতোন খালি?”
“হ্যাঁ,ভেবেছিলাম কোনো হিডেন ফাইল রয়েছে তবে তেমন কিছুই পাইনি।কিন্তু তুই জানতে পারলি কীভাবে?”
“জাফরিনের ফোন আমার কাছে ছিল।আচ্ছা শোন আমি।চাইছি এই বিষয়টা এই অবধিই থাকুক।”
“তোর মাথা ঠিক আছে?আমাদের এতবড় রিস্ক নিয়ে কাজটা এভাবে হারিয়ে যাবে?”
“দেখ এসব আমার বা তোর ছিল না, সবটা কিন্তু শিকদার সাহেবের ছিল।আমরা ভেবে নিবো উনার মৃত্যুর সাথে এটাও হারিয়ে গেল।”
“ফিরিয়ে আনার সামর্থ্য আমাদের আছে তবে কেন আনবো না?”
“কারণ আমি চাইছি না।এই মুহুর্তে এটার থেকেও আরো গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে।”
“আমার মনে হচ্ছে না এটার থেকে গুরুত্বপূর্ণ কিছু আছে।আর তুই কি এটা থেকে সরে আসতে চাইছিস কেবল।জাফরিনের নিরাপত্তার জন্য?তোর কি মনে হয় আমরা এটার পিছনে লেগে থাকা বাদ দিয়ে দিলেই জাফরিনের নিরাপত্তা ঠিক হবে?”
“জাফরিন আমার দায়িত্ব, আমি দেখে নিবো।আর আমিই যেহেতু চাইছি না তবে কেন এত প্রশ্ন করছিস?”
“যদি এটাই চাইছিস তবে কেন মেয়েটাকে এদেশে নিয়ে এলি?আর এখন আগুনের মুখে দাঁড় করিয়ে তুই চলে যাচ্ছিস।ও যদি দেশেও ফিরে যায় তবুও ওর মুক্তি নেই।”
“তুই এতোটা নিশ্চিত কীভাবে?”
“বাইরের শত্রু মোকাবেলা করা যায়,কিন্তু তোর শত্রু আমাদের আশেপাশের কেউ।যে আমাদের প্রতি মুহুর্তে খেয়াল রাখছে।”
“যাই হোক,আপাতত এটা বাদ দিতে হবে।আর শোন আমি ইদানীং ব্যস্ত থাকবো পরিবার নিয়ে।দেশ থেকে দাদার স্ত্রী কে নিয়ে এসেছি, তাদের সাথে আমার পরিবারের দেখা করানোর প্রয়োজন।”
“তাহলে জাফরিন?”
“তোর কাছে থাকবে।এই কয়েকটা দিন তুই ওর দেখাশোনা করবি।আর তোর সেই বাঙালি বোনটা কোথায়?”
“শালা তুই খালি ওর দিকে যাস কেন?”
“তুই আমার শালা,আমি না। দুলাভাই ডাক। শোন ওকে এনে তোর কাছে দিন কয়েক রাখবি জাফরিন কিছুটা স্বস্তি পাবে।”
“তুই তো প্রেমে পড়ে গেছিস রে।”
“একদম, এই প্রেম আমার জীবনে মহামারী হয়ে এসেছে রে।তাকে না দেখলে থাকতে পারছি না।”
হাসপাতালের কেবিনে ঢুকে মাশহুদ সুচিত্রার মুখোমুখি হলো।আর জাফরিন প্রথমবার দেখতে পেল মাশহুদ কে।তাকে দেখেই সুচিত্রা দাঁড়িয়ে বলল,
“আপনি এখানে?”
“সেটা তো আমার জিজ্ঞেস করা উচিৎ।”
“আমাকে এমিলি বলেছিল, যার সাথে দেশ থেকে এসেছি সেই মেয়েটা অসুস্থ। এই হাসপাতালে ভর্তি।তাই আমিও দেখতে এলাম।”
মাশহুদ ভ্রু-কুঁচকে বলল,
“মিস এমিলি?”
“জি।”
গায়ের কোট খুলে কাউচের উপরে রেখে সে জাফরিনের দিকে এগিয়ে এলো।জাফরিন এক দৃষ্টিতে তাকে দেখে যাচ্ছিলো।লোকটার হাবভাবে বুঝিয়ে দিচ্ছে সে জাফরিনকে বেশ ভালো ভাবেই চিনে।কিন্তু জাফরিন স্পষ্ট মনে করতে পারছে এই লোককে সে আগে কোনো দিন দেখেনি।সুচিত্রার সাথে কথা বলতে বলতে এগিয়ে গেল ওয়াশরুমের দিকে।হাত পরিষ্কার করে এসে জাফরিনের কপালে হাত রেখে বলল,
“শরীর এখন কেমন?সুস্থির লাগছে?”
পুরো শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে এল নাম না জানা এক অদৃশ্য স্রোত। এমন অনুভূতি হলো যে এই স্পর্শটা তার চেনা, ভীষণ ভালো করে চেনা।কপাল থেকে হাত সরিয়ে নিয়ে সেবিকার থেকে জাফরিনের শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলো।অপর দিকে জাফরিন ভেবে অস্থির হয়ে যাচ্ছে তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা কে এই সুপুরুষ? সে কী সেই পুরুষ? যে তার ভীষণ বিপদে তাকে আগলে রাখে ঠিক অভিভাবকের মতোন?
জাফরিনের চুলে মাশহুদের আংটি লেগে যেতেই মাশহুদ নিচের দিকে তাকালো।প্রথম বার জাফরিন দেখতে পেল তার তন্দ্রাঘোরে থাকা সেই দুটি চোখকে, যে দুটো চোখ জেগে থাকতে বাধ্য করে।
চলবে। (