#ক্যামেলিয়া
#পর্ব-২৪+২৫
#সাদিয়া_খান(সুবাসিনী)
স্বামীহীন একজন নারীর সমাজে টিকে থাকার লড়াইটা কেউ চোখে দেখে না।হায়েনার দৃষ্টি সব সময় সেই নারীর দিকে লেগেই থাকে।কেউ যদি সাহায্যের হাত বাড়ায় তবে সেই সাহায্যে থাকে এক অদ্ভুত নোংরামো করার দৃশ্য। আর? আরো থাকে দ্বিতীয় থাকে পুনরায় বিয়ে করে নিলেই পারে।শর্ত একটাই নিজের সন্তানকে রেখে আসতে হবে।কারোর
সংসারে দ্বিতীয় স্ত্রী হয়ে তার সন্তানকে মানুষ করতে হয়,অন্যের রেখে যাওয়া সংসারে দায়িত্ব নিতে হয় অথচ নিজের সাথে কিছুই থাকে না। মাশহুদের দাদার প্রথম পক্ষের স্ত্রীর লড়াইটা কারোর চোখে পড়েনি।যুদ্ধের পর যে দুর্ভিক্ষ তৈরি হয়েছিল, সেই সময় মারা যায় তার বাবা।ভাইয়েরা রাখেনি সংসারে।নিজের এক টুকরো জমিতে কোদাল তুলে মাটি ঝুরঝুরে করতে হতো তার। মানুষের বাড়িতে কাজ করতে হয়েছে একটা বছর।কারণ যুদ্ধ থেকে তখনো ফিরেনি তার শ্বশুর। ফিরে এলে একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে কিশোরী।ধীরে ধীরে ফিরতে থাকে দেশ স্বাভাবিক অবস্থায় কিন্তু ওই যে একটা বছর? অভিভাবকহীন ছিল? সেই সময় পুরো রাত ঘুমায়নি সে। ছেলেকে বুকে আগলে ধরে ঘরের দরজা দিয়ে চুপচাপ বসে থাকতো।তার সাথে থাকতো শাশুড়ি। অন্য জায়েরা তখন বাবার বাড়ি থেকে ফিরেইনি।তাছাড়া বাড়তি তিনটে মুখের অন্নের দায়িত্ব কে নিতে চাইবে?
সেই সময়গুলো হুট করেই তার চোখের সামনে ইদানীং ভেসে উঠে।সে এই দেশে আসতে চায়নি।মানুষটার আশায় আশায় থেকে জীবন পার করেছে। এক সময় নিজ থেকেই ভেবে নিয়েছিল সে মারা গেছেন।না হলে এতগুলো বছরে একটা বার তো তাদের সাথে যোগাযোগ করতো।হুট করেই একদিন বিকেল বেলা এই ছেলেটা এলো।সে এসে আধো ভাঙ্গা বাংলায় বলল সে নাকী তার নাতী।শুনেই বুকের ভিতর ধ্ক করে উঠেছিল তার।বার বার দৃষ্টি ভিজে এলো। শূন্য দৃষ্টিতে ত আবছা আলোয় ছেলেটির মুখের দিকে তাকিয়েই বুঝতে পেরেছিল ছেলেটা মিথ্যা বলেনি।এই যে সেই বলিষ্ঠ দেহ, কাধ। পিছন থেকে দেখে তার মনে হয়, ফিরে এসেছে তার কিশোরী বয়স। যে বয়সে একটা ভালো ভবিষ্যতের আশায় তার স্বামী চলে গিয়েছিল বিদেশে। তবুও সে আসতে চায় নি।কিন্তু ছেলের লোভ?লোভের তাড়নায় সে তাকে টেনে হিচড়ে নিয়েই এলো।অথচ সে চেয়েছিল এক বুক অভিমান নিয়েই পাড়ি জমাবে পরকালে।
একটি সম্পর্কের সব থেকে মধুর সময়টা তখন থাকে যখন ধীরে ধীরে তার প্রেমের জলে পা ডুবতে থাকে।ভিন দেশে এসে এই ভিনদেশির প্রতি এক অমোঘ মায়ায় ডুবছে সুচিত্রা।মাশহুদ আজ নিজে এসেছে তাদের খোঁজ নিতে।আজ সকাল সকাল দাদীর শরীর বেশ খারাপ হয়ে পড়েছিল।উপায়ন্তর না পেয়ে সুচিত্রা কল দিয়ে বসে মাশহুদকে।কল রিসিভ করেছিল তার সেক্রেটারি। এমিলি এত সকালে সেখানে কি করছে?ভাবতেই চিন্তার রেখা উদয় হলো তার ললাটে। অপর দিকে দাদীর চিন্তায় ঘাম ছুটে যাচ্ছে।নিজেকে কোনো ভাবে সামলে সে বিস্তারিত বলতেই মাশহুদ নিজে এসেছিল।দাদীর জন্য চিকিৎসার সকল ব্যবস্থা নিজে থেকে করে তারপর ফিরেছেন।সুচিত্রা নিজ হাতে তাকে এক কাপ চা করে এনে দিয়েছিল।এমিলি বাধা দিচ্ছিলো কিন্তু মাশহুদ চায়ের কাপ হাতে নিয়ে দুই চুমুক দেওয়ার পর হাসি ফিরিয়ে দিয়ে বলল,
“আমি চা তে অভ্যস্ত নই।তবুও বেশ ভালো হয়েছে।”
কথাটা শুনে সুচিত্রার মন বেশ খারাপ হয়ে গেল।তার বার বার মনে হতে লাগলো যে কেবল মাত্র তার মন রক্ষার জন্যই মাশহুদ চায়ের কাপটা হাতে নিয়েছিল।
সকালের নাস্তাটা করে যাওয়ার অনুরোধ করলেও মাশহুদ বলল
“আজ নয়, অন্য একদিন।দাদু একটু সুস্থ হলে আপনারা মানসিক প্রস্তুতি নিন।কারণ সময় হয়ে এসেছে আপনাদের কে পরিবারের বাকী সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার। কারণ আপনাদের এই মুহুর্তে পরিচয় প্রয়োজন।দাদা সাহেব কিংবা দাদুর অবস্থা বেশ ভালো নয়।মৃত্যু তো বলে কয়ে আসবে না।”
মাশহুদ চলে যাওয়ার সময় দরজা হাত দিয়ে সুচিত্রা এসে বলল,
“আবার কবে আসবেন?”
“সময় হলে আমায় পাশে পাবেন।”
(৫৪)
ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে মাশহুদের মুখে স্মিত হাসি ফুটে উঠেছে। জাফরিন পায়ের উপর পা বসে বসে আপেল খাচ্ছে।তাকে দেখে মনে হচ্ছে সে যুদ্ধে যাবে।সামনে রাখা আছে কয়েক পদের রান্নার সময় ব্যবহৃত ছুড়ি।একবার তার মনে হয়েছিল,
“মেয়েটা আত্নহত্যাও তো করতে পারে।”
পরক্ষণেই মনে হয়, এটা জাফরিন শিকদার, অন্য কেউ নয়।যে সহজে ছেড়ে দিতে জানে।মাশহুদ ভাবছে তাকে সে নিয়ে এসেছে এটাই জাফরিন মনে করে।কিন্তু মাশহুদ জানে, তাদের এই কাজের এখানে আসার জন্য জাফরিন টোপ ফেলেছে। ওই যে ওই দিন জাফিরিনদের বাড়িতে আগুন লাগার ব্যাপারে মাশহুদ অনেক কিছুই আন্দাজ করতে পেরেছিল।আগুন লাগবে এটা জাফরিন জানতো।কারণ আগুন না লাগলে তার মা-বোনেরা তাকে নিয়ে ব্যস্ত হবেন না।তারা তাকে দেশেই রেখে দিতে চাইবে কিন্তু জাফিরিনের ইচ্ছে এখানে চলে আসার।নিজের জীবনের নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে হলেও।সে ভেবেছিল আগুন লাগবে এটাই ইস্যু হবে কিন্তু তাকে মেরে ফেলার পরিকল্পনা তার চাচা করেছে এটা ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি সে।
এসব অচেতন মনে জাফরিন নিজেই বলছিল।সে ভেবেছিল তার বাবা তাকে উদ্ধার করেছে। বাবার বুকে মাথা দিয়ে হাসপাতালে যাচ্ছে সে।তাই শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলেছিল”
“আব্বা, আব্বা, ও আব্বা।আপনি আসছেন?আপনার কাছে যাওয়ার জন্যই তো এতকিছু।আম্মা যে যেতে দিতে চাচ্ছে না।আমি যে আপনার সেই বাসায় যেতে চাই।আপনার গন্ধ লেগে আছে যে বাসার প্রতিটা জিনিসপত্রে।”
মাশহুদ তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করেছিল”
“আগুন লাগবে যে তুমি জানতে?”
“হুম জানতাম।এজন্যই তো সবাইকে নিরাপদ স্থানে নিয়ে এসেছিলাম।”
“তবে নিজে কেন গিয়েছিলে?”
“আম্মা আর আপাদের ভয় দেখাতে। নইলে তারা রাজি হবে না।আব্বা আমার মাথাটা ফাকা ফাকা লাগছে।আমি কী মরে যাচ্ছি?”
মাশহুদ আলতো স্পর্শে তার চুলে চুমু একে দিয়ে বলেছিল,
“ড্রাইভ ফাস্ট। আদার ওয়াইজ আই উইল ফিনিশড ইউ ব্লাডি বাফেলো’স।”
স্ক্রিনে থাকা জাফরিন নিজেই নিজ হাতের ব্যান্ডেজ খুলছে।গতকাল তার সময় নেওয়া ছিল ডাক্তারের কাছে কিন্তু ঘুমের কারণে যেতে পারেনি।আজ যেতে ইচ্ছে করছে না।হাতের ঘা দেখে তার চোখ বন্ধ হয়ে এলো।হুট করেই ভয় লাগতে লাগলো তার। মাশহুদ স্ক্রিনে থেকে চোখ তুলে নিয়ে এমিলিকে বলল,
“গাড়ি ঘুরিয়ে নাও। মিস শিকদারকে এখন প্রয়োজন।”
তারা যখন কলিং বেল চাপলো তখন জাফরিন নিজের হাতটা ওড়নায় ঢেকে উঠে এলো বাইরের দিকে।স্ক্রীনে দেখা যাচ্ছে এমিলি দাঁড়িয়ে আছে, সাথে দুজন ডাক্তার।দরজা খুলে ফিচেল হাসি হাসে জাফরিন।বুঝতে বাকী রইল না তার হাতের ড্রেসিং করা হবে।এই এমিলিটা কীভাবে সব বুঝে যায়?তার জন্য নিয়ে এসেছে বাঙালি খাবারটাও। কিন্তু ড্রেসিং করা হবে বুঝেই সে বলল,
“আমার হাত ঠিক আছে। আমি ড্রেসিং করবো না।”
“মিস শিকদার, আপনি স্যারের মেয়ে।তার কাছে আমি অনেক ঋণী। তাই আপনার ভালো মন্দের দায়িত্ব অবশ্যই আমাকে দেখতে হবে।”
“কিন্তু!”
তারা ভিতরে প্রবেশ করে ড্রয়িং রুমে বসলেন।এমিলি জাফরিন কে তাগিদে দেয় খাবার খেয়ে নিতে। খাবার খাওয়ার সময় বার বার তার মনে হচ্ছিল একটু পর তার মৃত্যু দন্ড কার্যকর করা হবে বলেই এতো আয়োজন চলছে। খাবার শেষ করে এসে বসতেই সে অনুরোধ করলো,
“লোকাল এনাস্থেশিয়া দিয়ে হাত অবশ করে নিন না।আমার সহ্য হবে না এত ব্যথা।”
ডাক্তাররা একে অপরের দিকে চাইলেন।একজন সম্মতি দেওয়াতে তার হাতে ইনজেকশন দেওয়া হলো।মুহুর্তেই জাফরিনের দুচোখ বুজে ঘুম নেমে এলো।সে ঢলে পড়লো কারোর বুকে।মুখ থেকে মাস্ক খুলে মাশহুদ তাকে পাঁজাকোলে করে নিয়ে গেল বেডরুমে।শক্ত করে বুকের সাথে আগলে ধরে রইল।অপর দিকে চলছিল জাফরিনের হাতের ড্রেসিং।ঘুমে জড়ানো অবস্থাতেই মেয়েটা অপর হাতে জড়িয়ে নিলো মাশহুদের হাত। যেন খুব পরিচিত কাউকে বহুদিন পাওয়ার পর হারানোর ভয়।
চলবে
#ক্যামেলিয়া
#পর্বঃ২৫
#সাদিয়া_খান(সুবাসিনী)
জাফরিনের চুলে আলতো স্পর্শে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে মাশহুদ ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করলো,
“ঠিক হতে কত দিন সময় লাগবে?”
“সার্জারী করালে ভালো হতো। অথবা তেলাপিয়া মাছের চামড়া দিয়ে ট্রিটমেন্ট ওটা করিয়ে দেখতে পারেন।”
“প্রতিদিন ড্রেসিংটা স্কিপ করতে চাচ্ছি।ওর কষ্ট হচ্ছে।”
“তবে দ্বিতীয় পদ্ধতি অবলম্বন করাটাই বেটার হবে।”
“কোনো ক্ষতির সম্ভবনা যদি ১% থাকে তবে অন্য উপায় দেখুন।”
“এটাই সবথেকে ভালো হবে।তেলাপিয়া মাছের চামড়ায় কোলাজেন প্রোটিনের টাইপ ১ ও টাইপ ৩ রয়েছে, যা আগুনে পুড়ে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্থ হওয়া অংশকেও খুব সহজে সারিয়ে তুলতে পারে। এটাকে ব্যান্ডেজের মতোন ব্যবহার করে নিলেই হবে।”
“বেশ তবে এটাই করুন।প্রতিদিন ঘুম পাড়িয়ে, অবশ করলে।ওর অন্য ক্ষতির আশংকা থাকবে।আমি সেটা চাই না।”
“জি আমরা দেখছি।”
ড্রেসিং শেষ করে এমিলি চলে গেল তাদের নিয়ে। মাশহুদ উঠে দাঁড়িয়ে দেখলো যাচ্ছে তাই অবস্থা হয়ে আছে জাফরিনের স্টাডি রুমের।সেখানে পা রাখতেই তার মনে হলো,
“ন জাফরিন এমন অগোছালো করেনি।কেউ একজন এসেছিল এখানে। কিছু একটা খুঁজতে। সে নিশ্চয়ই কাঙ্ক্ষিত বস্তু খুঁজে পায়নি।মুহুর্তেই তার মস্তিষ্কে হাজার খানেক চিন্তার আগমন ঘটে গেল।সে নিজের ফোন বের করে এখানে থাকা সকল ক্যামেরা অফ হওয়ার কমান্ড বাটন প্রেস করলো।এরপর ডেকে পাঠালো অন্য এক স্পেশাল টিমকে।তারা এসে পুরো ঘর থেকে অন্য কারোর লাগানো চারটে ক্যামেরা উদ্ধার করলো।মাশহুদ এমিলির দিকে তাকাতেই সে মাথা নিচু করে রইল,
কেননা একমাত্র মাশহুদের অনুপস্থিতিতে এমিলিই এখানে আসার অনুমতি পেয়েছে।স্পেশাল টিমের সাহায্যে তারা সকল ক্যামেরা অফ করে নতুন করে লাগানো হলো এবং সিস্টেম আপডেট করলো এমন ভাবে যাতে উক্ত ক্যামেরা বাদে অন্য কোনো ক্যামেরা এখানে এক্টিভেট না করা যায়।সাথে সকল কিছুর এক্সেস মাশহুদের কাছে থাকবে।সে ব্যতীত এখানে কেউ আসতে বা বের হতে পারবে না।জাফরিব যদি এখান থেকে বের হতে চায় তবে মাশহুদের ডিভাইসে প্রথমে এক্সেস পারমিশন চাইবে, সে পারমিশন দিলে ফ্ল্যাটের মেইন ডোর ওপেন হবে।প্রায় ৩০ মিনিট সময় লেগেছিল সবটা ঠিক করতে৷ জাফরিন তখন ঘুমে মগ্ন।সবাই ফেরত যাওয়ার পর মাশহুদ ক্লান্ত দেহে গা এলিয়ে দিলো পাশের কাউচে।জাফরিনের হাতটা এবার চিন্তা ফেলছে তাকে।
দীর্ঘ শ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ালো সে।রান্নাঘর থেকে এক মগ কফি বানিয়ে দাঁড়ালো বারান্দায়।স্মৃতি পাতায় তখন ভেসে উঠে মাস ছয়েক পূর্বের এমনি এক সন্ধ্যে বেলা।
“স্যার,আপনি মেয়েকে অনেক ভালোবাসেন?”
“জানো তো?ওর মা ছেলে চেয়েছিল কিন্তু যখন ওর জন্ম হয় ও ওর মা কে দেখে ভ্রু কুঁচকে, ঠোঁট উল্টিয়ে তাকিয়ে থাকতো।তার কোলেও যেতে চাইতো না।অথচ সন্তান হয় মা ভক্ত।আমি কোলে নিলেই সে কী হাসি হাসতো।মেয়েটা আমার কাঁদতে জানে না।আমি কেন যেন ওকেই বেশি আদর করি।”
“তবে ওই ছেলের সাথে বিয়েতে মত দিলেন কেন?”
“জাফরিন পছন্দ করেছে ঈশানকে।আমি ওর এই পছন্দকে সম্মান করি বলে।”
দমকা বাতাসে ঘোর কাটে মাশহুদের।কাউকে না দেখে ভালোবাসা যায়?যায়, যেমনটা বেসেছে মাশহুদ। আজমল শিকদারের মুখে মুখে মেয়েটার কথা শুনে তাকে ভালোবেসেছে।যে মুহুর্তে জাফরিনের বিয়ে ঠিক হলো, সে বার বার চেয়েছে বিয়েটা যেন না হয়।ভেঙ্গে যাক এই বিয়েটা।যে কোনো মূল্যেই হোক।কিন্তু মূল্যটা যে আজমল শিকদারের মৃত্যু হতে পারে তা কখনো ভাবতেও পারেনি সে।
জাফরিনের জেগে উঠার আগ মুহুর্তে সে ফিরে এলো।নাস্তার টেবিলে রেখে এসেছিল ছোট্ট একটা নোট সাথে ডিনার।যেখানে লেখা ছিল,
“ফিনিশ ইট,ডিয়ার লেডি।”
(৫৬)
ভিনদেশে থাকা মেয়ের জন্য মায়ের মন সব সময় কু গাইতেই থাকে।আজ সকাল থেকে মেয়ের জন্য অস্থির হয়ে আছে জাফরিনের মা।বড় ভাইয়ের বাড়িতে এসেছিল সে।তার ভাই অস্থিরতা দেখে বলল,
“একটা কথা বললে শুনবি?”
“কি কথা?”
“আমরা সবাই তো দেখি জাফরিন আর ইউভান কতোটা কাছে। ওদের চার হাত এক করে দেওয়া যায় না।”
“কী বলেন এসব ভাই?ওরা নিজেদের ভাই বোন মনে করে। ”
“আপন ভাই বোন তো আর না।তাছাড়া ইউভানের সাথে যার সম্পর্ক ছিল সে তো এখন বাপ মায়ের পছন্দে বিয়ে করেছে।ওদের চার হাত এক হলে আমার আর তোর থেকে শান্তি কেউ বেশি পাবে না।”
জাফরিনের মা নিজের ভাইয়ের কথায় চিন্তায় পড়লেন।সত্যি তো আর এই পৃথিবীতে কেউ নেই যে ইউভানের মতোন জাফরিনের খেয়াল রাখবে।যদি এমন হয় তো ক্ষতি কীসের?
ঘুম থেকে জেগে জাফরিন দেখতে পেল তার লাগানো দুটো ক্যামেরার কোনোটাই কাজ করছে না।সে ভেবেছিল যান্ত্রিক কোনো গোলযোগপূর্ণ কারণে এমন হচ্ছে।ফুটেজ চেক করে দেখতে পেল এমিলি এবং ডাক্তার সমেত দুজন তার ফ্ল্যাটে প্রবেশ করছে, সে ঘুমিয়ে যাচ্ছে।এরপর আর কিছুই নেই, সব সাদা কালো।দীর্ঘ শ্বাস ফেলল সে। তার বার বার মনে হপ্য কেউ একজন তার অনুপস্থিতিতে এখানে আসে। কে সে?এটাই জানার জন্য লাগিয়েছিল দুটো ক্যামেরা।হয়তো কম দামী বলে নষ্ট হয়ে গেল।দীর্ঘ শ্বাস ফেলে নিচে নেমে এলো সে।তার সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনা তার স্বাভাবিক লাগে না।এমিলি মেয়েটা এত কেন করে?কি সুন্দর তার পুরো ফ্ল্যাট গুছিয়ে রেখেছে।অথচ সে এত বড় কোম্পানিতে জব করে। খাবার টেবিলের কাছে এসে জুসের গ্লাস দেখতে পেল সে। হাতে নিয়ে এক চুমুকে সবটা শেষ করে ফেলেছে।টেবিলে ঢাকা দেওয়া নোটটা দেখে তার ভিতরে সব কিছু জমে গেল।এই মুহুর্তে একটা ভয় কাজ করতে লাগলো।কি লিখেছে এমিলি?
“ডিয়ার লেডি?” মানে কী?সে কেন তার প্রিয় নারী হতে যাবে?তবে কি এমিলি সমকামী?
নাউজুবিল্লাহ, নাউজুবিল্লাহ বলে তিন কদম পিছিয়ে এলো সে। কাউচে বসে নিজের কপালে হাত রেখে বলল,
“এজন্যই বুঝি আমার প্রতি তাহার এত দরদ?এজন্যই কী আমার দিকে এভাবে তাকাতো?তার চোখে আমার জন্য মায়া ছিল না? কী ছিল ওসব?আমি এখন কী করবো?”
জাফরিনের মাথায় তখন শ’খানেক চিন্তা।সে পায়চারি করতে করতে ভাবে,ঘুমানোর পর এমিলি তার সুযোগ নেয়নি তো?”
এমন সময় কলিংবেলের শব্দে তার ঘোর ভাঙ্গে।স্ক্রিনে একজন ডেলিভারি বয় দাঁড়িয়ে আছে।জাফরিন ভাবে এই মুহুর্তে সে কিছু অর্ডার করেছে বলে মনে হয় না।তবে কে এলো?দরজা না খুলে দাঁড়িয়েই স্ক্রীনে দেখতে পায় একজন মুখ ঢাকা লোক দাঁড়িয়ে। সে হেসে বলল,
“মাম ইউর অর্ডার। প্লিজ চেক ইট।”
“কিন্তু আমার কোনো অর্ডার ছিল না।আপনি ভুল ঠিকানায় এসেছেন।”
“জি না ম্যাম, আপনি একটু বেরিয়ে এসে দেখুন।”
“আমি কিছু কিনিনি।আপনি ভুল ঠিকানায় এসেছেন।”
“ম্যাম ঠিকানা এটাই দেওয়া।আপনি দয়া করে রিসিভ করুন। না হলে আমার চাকরিটা চলে যাবে।”
জাফরিনের এবার মায়া হলো।সে দরজা খোলার জন্য কোড চাপতেই কনফার্ম ম্যাসেজ পেলো মাশহুদ। সে তখন ব্যস্ত ছিল মিটিংয়ে। মোবাইল স্ক্রীনে দেখলো বাইরে ডেলিভারি বয় দাঁড়ানো।সে ভেবেছিল হয়তো জাফরিন কিছু আনিয়েছে। তাই ওকে করতেই দরজা খুলে গেল।কিন্তু স্ক্রিনে থেকে চোখ সরানোর পূর্বেই সে বুঝে গেল তার জীবনের সব থেকে বড় ভুলটা সে করে ফেলেছে।যে ভয় পাচ্ছিলো সেটাই হলো।তার চোখের সামনেই কেউ একজন সজোরে আঘাত করে বসলো জাফরিনের মাথায়।চুইয়ে চুইয়ে রক্ত ঝরছে,তিনজন লোক টেনে ভিতরে নিয়ে যাচ্ছে তাকে।শক্ত করে বেঁধে ফেলে তার চুলের মুঠি ধরে বলছে,
“পেনড্রাইভ কোথায়?তোর বাবা শেষ বার তোকে যে মেইল করেছিল তাতে কী ছিল?”
ক্লান্ত জাফরিনের দুচোখে নেমে এলো রাজ্যের অস্থিরতা। সে ধীরে ধীরে তলিয়ে গেল ব্যথাহীন, যন্ত্রণাহীন কোনো এক রাজ্যে।”
চলবে