#ক্যামেলিয়া
#সাদিয়া_খান(সুবাসিনী)
#পর্বঃ২২+২৩
বাবার বেডরুমে প্রবেশ করে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো জাফরিন।এখন গভীর রাত, এখানে আসার পর ইউভান এবং মায়ের সাথে কথা বলেছে সে। এই মুহুর্তে সে বড্ড ক্লান্ত, তাছাড়া ক্ষুধাও পেয়েছে বেশ বড়সড় আকারে।পেটের মধ্যে ক্ষুধা যেন ঘূর্ণিপাক দিচ্ছে। কী খাবে সে?ব্যাগ খুলতেই মনে পড়লো তা মা ব্যাগে দুটো চিড়ে ভাজা মোয়া দিয়েছে।জাফরিন আনতে চায়নি কিন্তু তার মা জোড় করে দিয়েছেন।যেন ক্ষুধা রাখলে দুটো মুখে দিয়ে এক গ্লাস পানি খেয়ে নিতে পারে।সেই মুহুর্তে বিরক্ত লাগলেও এই মুহুর্তে জাফরিন বুঝতে পারছে তার মা তার এই সময়ের কথা চিন্তা করেই হয়তো দিয়েছেন।বিছানায় বসে প্রথম জাফরিনের যে কথাটা মনে হলো, তা হলো তার বাবার ঘরের জিনিসপত্র অনেকটা এদিক সেদিক করা কিন্তু বুঝার উপায় নেই।নিশ্চয়ই তার বাবার পুরো ফ্ল্যাটে তল্লাশী চালানো হয়েছে। শুধু তাই নয় জিনিসপত্র ওলট পালট করে তারা ভেবেছে জাফরিন এখানে প্রথম বার আসবে আর এই বিষয়টা প্রথম বারে কেউ বুঝবে না।এবার নড়েচড়ে বসলো সে। তার স্পষ্ট ধারণা জন্মে গেল।যদি কেউ এখানে ঢুকে তল্লাশি নিতে পারে তবে অবশ্যই গোপন কোনো ক্যামেরা কিংবা রেকর্ডার রাখাটা অবাককর বিষয় হবে না। যদি ক্যামেরা লাগানো থাকে তাহলে তো!
ভাবতেই কিছুটা অবাক হয়ে গেল সে৷তার বাবার লুকানো ম্যাসেজ কে সে রান্নাঘরে ঢুকে দেখেছিল, সেই কভারটা এখনো তার পাশেই পরে আছে৷তাকে দ্রুত এটা নষ্ট করে ফেলতে হবে, এছাড়াও বড় পয়েন্ট হচ্ছে। তাকে এই বাসাতে সব সময় এক অভিনয় করে যেতে হবে। সে একজন পিতৃহীন অসহায় মেয়ে। যার প্রতিটি পদক্ষেপ বড্ড নড়বড়ে হবে।কথায় কথায় বিপদে পড়ে যাওয়া মেয়েটার সাহায্যে বন্ধু বেশে এগিয়ে আসা ব্যক্তিগুলোই যে তার চির শত্রুপক্ষ।
নিজের পরিকল্পনাকে এক সাইডে রেখে জাফরিন প্যাকেট খুলে মোয়া বের করে। দুটো মোয়া খেয়ে পানি খায় দু গ্লাস। পেট আপাতত কিছুটা শান্ত হয়েছে বলেই হয়তো তার দু চোখে ভর করে ঘুমের প্রজাপতি।ঘুমিয়ে পড়তেই তার স্বপ্নে এসে ডাক দেয় তার বাবা।না নতুন স্বপ্ন নয়, সব তার অতীতের খন্ড খন্ড অংশ।যেখানে সে জাফরিনকে হাতে কলমে শিখিয়েছিল কেমিস্ট্রির কিছু গুপ্ত পদ্ধতি।
(৫১)
ট্রেড মিলের উপর সর্বোচ্চ গতিতে দৌড়ে চলেছে মাশহুদ। নিজেকে শান্ত করার জন্য তার দৌড়াতে হয়, ঠিক যেমন সে দৌড়েছিল তার মায়ের পিছনে কিন্তু সে পিছন ফিরে তাকায়নি।তবুও মাশহুদ দৌড়াতেই অধিক পছন্দ করে।বিজনেসের সকল ডিলের প্ল্যান সে এই ট্রেড মিলে দৌড়ানোর সময়েই ঠিক করে।দীর্ঘ সময় পর নেমে এলো সে। গলায় জমে থাকা বিন্দু বিন্দু ঘাম মুছে নিলো তোয়ালে দিয়ে।কপালের সামনে লেপ্টে আছে এক গাছি চুল। আজ তার একটা গুরুত্বপূর্ণ মিটিং রয়েছে।ফ্রেশ হয়ে নিচে নেমে এলো সে। ডায়নিং টেবিলে বসে অপেক্ষা করছেন তার দাদা-দাদী।গ্র্যানির পাশের চেয়ারে বসে স্মিত হেসে বলল,
“গ্র্যানি,আমি তোমাকে অনেক মিস করেছি এই কয়েক দিন।”
“অহ হানি,আমিও। তুমি তো বিজনেস ডিলে গিয়েছিলে। তো আমার জন্য কি নিয়ে এসেছ?”
“গ্র্যানি, আমি জানি না যা এনেছি তোমার পছন্দ হবে কী না। কিন্তু সবটাই আমাদের সবার জন্য।
তুমিই তো বলো, সব বিষয় সবার জন্য ভালো হয় না। পৃথিবীতে এমন কিছু ঘটনা ঘটে যা আমার অনুকূলে থাকে না কিন্তু যদি সেই ঘটনার কারণে কেউ বা কারোর উপকার হয় তবে অবশ্যই আমদের সে কাজ করা উচিৎ। তাই না?”
নাতনীর প্লেটে দুটো ডিম তুলে দিয়ে ভদ্রমহিলা বললেন,
“কী এনেছো?কোথায় গিয়েছিলে?”
“বাংলাদেশ।”
বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে রইলেন মাশহুদের দাদা।বাংলাদেশ শুনেই বুকের ভিতর বইতে লাগলো এক বিশাল তুফানী ঝড়। মানসপটে ভেসে উঠলো ষোড়শী এক মেয়ে, যার দুই পাশে দুটো বিনুনি,নগ্ন দুই পা। যে পায়ে সে হেঁটে আসছে এক গুচ্ছ লাল পদ্ম নিয়ে। তার মুখের হাসি, দুই চোখের খুশি। এরপর দৃশ্য বদলে গেল।সে দেখতে পেল লাল বেনারসিতে সেই পদ্মকে।গভীর রাতের সেই দুটো নরম হাত, যে আবেগে খামছে ধরেছে তার বুক। নরম অধরের স্পর্শ, উন্মুক্ত কেশে আড়াল উদাম পিঠে এসে পড়া এক ফালি রোদ।
কিন্তু! কেন সে হারিয়ে গেল? দেশেই বা কেন যুদ্ধ লাগলো?আর সেই যুদ্ধে হারিয়ে গেল তার সেই পদ্মটা। স্ত্রীর ডাকে হুশে ফিরলেন ভদ্রলোক।তার স্ত্রী তাকে প্রশ্ন করলেন,
“কী হয়েছে তোমার?ও বাংলাদেশে গিয়েছিল ডিয়ার, বাংলাদেশ। তোমার দেশে…. ”
“হুম।”
“দাদা তুমি কেন ফিরলে না ওদেশে?দেশটা তো সুন্দর।”
“কারণ মুক্তিযুদ্ধে স্ব-পরিবারে নিহত হয় যুদ্ধে।যে দেশে কেউ নেই, সে দেশে হতাশ বুকে ঘুরে ফিরতে যায়নি।আমি যেতে দেইনি।”
“কিন্তু যাওয়া উচিৎ ছিল গ্র্যানি।হতে পারতো কেউ একজন বা কেউ কেউ পুরো জীবন পার করে দিচ্ছে দাদার অপেক্ষায়?”
“না রে। কারণ তোমার যায়েদ আংকেলের বাবা নিজে নিশ্চিত করেছিল তারা কেউ বেঁচে নেই।আর সে এখানে চলে এলো তোমার দাদার কাছে।যদি আমাদের সেখানে কেউ থাকতো তবে আমরা যেতাম না?”
এত কথোপকথনের মাঝেও কিছুই বলেননি মাশহুদের দাদা।সার্ভেন্টের সহায়তায় নিজ রুমে চলে এলেন।তার প্রথম স্ত্রীর স্মৃতি চারণে।বেঁচে থাকলে সে দেখতে কেমন হতো? তাকে কী এখনো মাছের মাথাটা বেছে দিতে হতো?সে কী এখনো দুধের উপরে পড়া ঘন সর খেতে ভালোবাসতো?
(৫২)
এই কয়েক ঘন্টাতেই বেশ বিরক্ত লাগছিল জাফরিনের।ভাতের জন্য মন কেমন করছে।নিশ্চয়ই সুপার শপ গুলোতে সব পাওয়া যাবে কিন্তু এই মুহুর্তে তার কিছু খাওয়াটা অধিক প্রয়োজন।বাবার রান্নাঘরের ক্যাবিনেট খুলে দেখতে পেল কফি,দুধ রাখা আছে। একটা কফি বানিয়ে এদেশিয় ফুড সাইট ঘুরতে লাগলো সে।এমন সময় কলিংবেলটা বাজলো।কফির মগ হাতে দরজা খুললো সে। এমিলি দাঁড়িয়ে আছে।তার দু হাত ভর্তি খাবার।তাকে সাদরে আমন্ত্রণ জানালো জাফরিন।এমিলি প্রবেশ করেই তাকে বলল,
“এটা বাংলাদেশ নয় মিস শিকদার। তাই হুট করেই দরজা খুলবেন না।এই যে স্ক্রীনে দেখে নিবেন কে এসেছে। বাহিরে থাকা ক্যামেরায় আপনি এখান থেকেই দেখতে পারবেন।”
“এখানে ক্যামেরা আছে আপনি কী করে জানলেন?”
“এই হাউস বিল্ডিংটা আপনার বাবা ডিজাইন করেছিলেন তার স্পেশাল টিম নিয়ে। তাদের মধ্যে আমি একজন।আমি উপরের সেক্টরে আছি।”
“আচ্ছা।খাবারের জন্য ধন্যবাদ।”
“এটা কোম্পানির পলিসি।আপনার দায়িত্ব নেওয়া।আপনাকে তৈরি হতে হবে আমরা বের হবো।আজ আপনার এডমিশন হবে।”
“কিছু সময় প্রয়োজন, তাছাড়া ব্রেকফাস্ট করিনি।”
“আমি অনলাইন অর্ডার করছি।আপনি যেতে যেতে খেয়ে নিবেন।আমাদের দেরী করার সময় নেই।”
ইউনিভার্সিটিতে পূর্বেই পৌঁছেছে মাশহুদ।কুঞ্জের সাথে দেখা হওয়ার পর সবটা শুনে কুঞ্জ বলল,
“আজ তবে এটার খোলাসা হয়ে যাবে। শোন আমি ওকে যে কোনো সাবজেক্ট চয়েস করতে বলবো।যেহেতু ও এখানে এডমিশন নিতে চেয়েছে আর ও যথেষ্ট কোয়ালিফাইড। তাই আমার মনে হচ্ছে ও এই সাবজেক্টটাই বেছে নিবে।”
“আর যদি না নেয়?আমরা ওকে যতোটা সাধারণ ভাবে নিচ্ছি ও যদি এর থেকেও সাধারণ হয়। নরমাল একটা সাবজেক্ট কিংবা যে কোনো কিছু?আমার সব ইনভেস্ট ভেসে যাবে।”
“যতটা তুই বলেছিস, এই মেয়েটা পিছিয়ে যাওয়ার মেয়ে নয়। তাকে জানা বোঝার কিংবা দেখার শুরুই হয়নি তবে। এই মেয়ে একটা এজেন্ডা নিয়ে এসেছে।তুই তাকে নিয়ে আসিসনি, সে তোর সাথে এসেছে।এই অষ্টাদশী কন্যা প্রতিশোধের সুবর্ণ সুযোগ খুঁজবে।আর আমরা ওর প্রতিশোধের খেলাতেই ওকেই মাত দিতে হবে।”
ওদের কথার মাঝে এমিলি এসে জানালো সে নিয়ে এসেছে জাফরিনকে।কিছুটা ইতস্তত হয়ে প্রবেশ করলো মেয়েটা।কুঞ্জ হেসে তার সাথে প্রাথমিক আলাপ করে নিলো।অফিসের এক পাশে কাউচে বসে আছে মাশহুদ। কিন্তু জাফরিন একটা বারের জন্যও তার দিকে মুখ তুলে তাকায়নি।কিন্তু যখন সাবজেক্ট চয়েস করতে বলা হলো তখন জাফরিন স্পষ্ট ভাবে বলল তার ইচ্ছেটা। শিকারী নেকড়ের দুর্লভ হাসিটা ফুঁটে উঠলো তখন মাশহুদের ঠোঁটে।সে মনে মনে বলল,
“দেখা যাক, এবার কে এগিয়ে যেতে পারে?তোমার প্রতিশোধ না কি আমার তোমাকে পাওয়ার নেশা।”
চলবে
#ক্যামেলিয়া
#সাদিয়া_খান(সুবাসিনী)
#পর্ব-২৩
মাশহুদের ভীষণ ইচ্ছে করছে জাফরিনের মাথায় নিজের হাতটা রেখে তাকে আশ্বাস দিয়ে বলতে,
“ভয় নেই, তোমার কেউ নেই, কে বলে?আমি তো আছি।এই যে তোমার আশেপাশে, সবচেয়ে কাছে।তুমি যে আমার সাম্রাজ্যে এসেছো, আমার সম্রাজ্ঞী হয়ে।ফিনফিনে বাতাসকেও অনুমতি নিতে হবে তোমাকে ছুঁয়ে যাওয়ার আগে।”
কিন্তু এসব বলা হয় না। কারণ এসব মাশহুদ বলতে পারবে না।সবার সামনে নয় এমনকি দূরেও নয়। কারন এসব তার স্বভাবের সাথে যায় না।এ দেশে প্রেমিকা বদলানোটা পোশাক বদলানোর মতোন মনে হয়। বিয়ে ছাড়া থাকাটাও স্বাভাবিক অথচ জাফরিন যেমন পরিবেশ থেকে এসেছে সেখানে এই সম্পর্কটা ভীষণ পবিত্র বলে মনে হয় তার। সারা জীবন একজন অপেক্ষা করে অপর মানুষটার জন্য।তার জন্য জমিয়ে রাখে দেহের সব আবেগ। এক মাত্র অধিকার দেয় তার স্বামীকে। অথচ মাশহুদের কালচার ভিন্ন।এখানে একজন কে জড়িয়ে ধরা কিংবা লিভিং এ থাকাটা যেমন স্বাভাবিক তেমনি সিংগেল মা-বাবা সন্তানদের বড় করছে এটাও।একেক দেশের একেক নিয়ম।তবে ভালোবাসার নিয়ম সব ক্ষেত্রেই কিন্তু এক।ভালোবাসলে প্রেমদহনে জ্বলতে হয়।যেমন জ্বলছে মাশহুদ।খুব ইচ্ছে করছে তার শক্ত করে আবেগে জড়িয়ে নিতে মেয়েটাকে।কেন কাঁদছে সে?
ল্যাপটপের স্ক্রিন থেকে চোখ সরিয়ে নিলো মাশহুদ। আজ সিসি ক্যামেরা লাগানো হয়েছে পুরো এপার্টমেন্টে।অন্য কোনো উদ্দেশ্য নয়, জাফরিনের নিরাপত্তার জন্য এমন করা হয়েছে।কুঞ্জ ঠিক বলেছিল, মেয়েটা এখানে নিরাপদ নয়। এটার প্রমাণ আজ সকালেই পাওয়া গেছে।কেউ তাকে ফলো করছিল। যদিও এমিলি সাথে ছিল কিন্তু কত সময় থাকবে সে?প্ল্যান মোতাবেক জাফরিনকে তারা কোনো প্রকার সুযোগ সুবিধা দিবে না।বাকী পাঁচ জনের মতোন সেও নিজের পথ নিজে তৈরী করে এগিয়ে যাবে।প্রচন্ড বুদ্ধিমতি মেয়ে জাফরিন।একবার যদি বুঝতে পারে তাকে কেন আনা হয়েছে সে বদলে দিবে নিজের পরিকল্পনা।তাকে তার মতোন এগিয়ে যেতে দেওয়াটাই শ্রেয়।তবে নিরাপত্তার ব্যাপারে কোনো ত্রুটি রাখা যাবে না।
“স্যার আসবো?”
“জি আসুন।”
“মিস শিকদারের সম্পর্কে কিছু কথা ছিল।”
এমিলির দিকে মুখ তুলে তাকালো মাশহুদ। ভ্রু-কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,
“কী ব্যাপারে?”
“আগামীকাল থেকে সে ক্লাস শুরু করবে কিন্তু কথা হচ্ছে যে বাকি সময়টা কী করবে?”
“মানে?”
“আসলে মিস শিকদারের উপর নজর রাখা প্রয়োজন ছিল।তাই বলছিলাম!”
“স্পষ্ট ভাষায় বলুন।প্যাঁচানোত প্রয়োজন নেই।”
“অফিসে যদি তাকে কোনো জব দেওয়া যায় তবে সে সব সময় আমাদের আশেপাশে থাকবে।আর তার প্রতি নজর রাখতেও সাহায্য হবে।”
“মিস এমেলি,আমাদের কোম্পানির নাম কী?”
“রয়েল’স মুন।”
“এখানে চাকরি করতে হলে অবশ্যই নূন্যতম যোগ্যতা লাগে। এট জানেন?”
“জি স্যার।যেখানে কর্মদক্ষতা অধিক প্রয়োজনীয় সেখানে মিস শিকদার একজন স্টুডেন্ট মাত্র। সে বাকী সবার সাথে মিশতে পারবে?”
“আমি শুধু….
” বুঝতে পেরেছি।তাকে তার যোগ্যতা অনুসারে অফার করবেন।নিজ থেকে নয়, যদি সে বলে তবে। আমাদের এখানে অনেক পার্ট টাইমার আছে। তাদের মতোন করেই তাকে হ্যান্ডেল করবেন।”
“মিস জাফরিন করবেন এমন কিছু?”
“সে বুদ্ধিমতি। সে জানে এখানে একা, আহ্লাদ করার মতোন কেউ নেই তার।যদি প্রয়োজন মনে করে করবে। না হলে নিজ থেকে তাকে কিছু বলবেন না।”
এমিলি দুঃখিত বলে বেরিয়ে গেল কেবিন থেকে।সে ভেবেছিল স্বপ্নের নায়কের মতোন জাফরিন পাবে তার বস কে।কোম্পানিতে যোগ দেওয়ার পরেই তার বস তার প্রেমে হাবুডুবু খাবে।একটা প্রেজেন্টেশন এ সবাই হতাশ, জাফরিন কিছু একটা করে তাক লাগিয়ে দিবে।এরপর?
এরপর তারা দুজন বিভিন্ন সময় ডেটে যাবে, কন্ট্রোভার্সি তৈরী হবে।অফিসে সবার সামনে মাশহুদ এলান করবে জাফরিন তার বাগদত্তা।এমনটা হবে এটাই ভেবেছিল এমেলি।সে মনে করেছিল হয়তো এমনটা ভেবেই তাকে নিয়ে এসেছিল মাশহুদ।কিন্তু মাশহুদের কথায় তার ভুল ভেঙে গেল।সে আরো একবার বুঝলো এই মানুষটাকে সে চিনে না।জানে না,তাকে দূর থেকে ভালোবাসতে জানলেও তাকে বিন্দু মাত্র জানতে শিখেনি সে।
(৫৩)
ফিরে এসে জাফরিন মায়ের সাথে কথা বলছিল। তার মা গ্রামে ফিরেছে এটা শুনে কিছুটা আপত্তি করলো সে। মা কীভাবে একা থাকবে ওখানে?
“আম্মা শহরে থাকলে কি হতো?”
“মারে দম বন্ধ লাগে।”
“আর বাড়ির মানুষগুলো?তারা শান্তি দিবে?”
“তোমার আব্বার কবরটা দেখতে তো পারি।বাঁচবোই আর কয় দিন?এই কয়েক দিন তোমার আব্বার সাথেই থাকতে চাই।”
“আম্মা!”
“বলো।”
“খুব ভালোবাসেন আমার আব্বারে?”
“তারে ভালোবাসি নারে মা।জানো একবার আমার গায়ে বসন্ত উঠলো। বিয়ের বছরেই। তখন তোমরা ভাই বোন কেউ জন্ম নাওনি।সে কী অবস্থা আমার। বাড়ির সবাই তোমার আব্বারে বললো”
“তুমি কাছে যেও না বৌয়ের।তোমার বসন্ত উঠবো।”
কিন্তু কে শুনে কার কথা? সে আমার যত্ন করে গোসল করিয়ে দেয়, খাইয়ে দেয়, যে বসন্ত গলে যায় তার মধ্যে বাতাস করে।রাত চারটের সময় ভাত খাইয়ে দেয়। এসব কেউ দেখে না মা।বদ্ধ ঘরে সে আমার যত্ন করে আবার দিনে ঘরের কাজ।একদিন বলেছিলাম,
“ভালোই তো হয় আমি মরলে, আপনি নতুন স্ত্রী পাবেন।”
সে আমার মাথায় হাত রেখে কী বলছিল জানো?
“কী?”
“আমার শরীরে তোমার গন্ধ লেগে আছে।এই গন্ধটা নিয়েই আমি মরতে চাই।তুমি শুধু আমার খেয়াল রেখো, আমার সাথে থেকো।আমি তোমার পায়ে পৃথিবীর সব সুখ এনে দিবো।”
অথচ আমি তাকে একটা পুত্র সন্তান দিতে পারিনি বলে তার ভাইয়েরা তাকে আবার বিয়ে দিতে চাইলো।সে কী আমাদের ছেড়েছে?ছাড়েনি তো মা।তাই আমি তোমার আব্বাকে ভালোবাসি না।আমি তোমার আব্বার জন্যই বেঁচে আছি।”
জাফরিন ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে ফোনের অপর পাশ থেকে।বরাবর মা-বাবার ভালোবাসা, তাদের খুনসুটি দেখে আহ্লাদী হতো সে।বাবা দেশে এলে রাত-বিরেতে লুকিয়ে মায়ের জন্য ফুল আনতো কিংবা অন্য কিছু। জাফরিন দেখতো,স্মিত হাসতো তবে প্রকাশ করতো না।এত ভালোবাসার মানুষের বিচ্ছেদে বুঝি বেঁচে থাকা যায়?
মৃত্যুসম যন্ত্রণা নিয়ে কীভাবে বেঁচে আছে তার মা?
কথা শেষ করে ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ায় জাফরিন।আগামীকাল থেকে তার ক্লাস শুরু হবে।বিষয় হিসেবে সে বেছে নিয়েছে কম্পিউটার সাইন্স।তবে কোডিং টা আয়ত্তে আনা তার বেশি প্রয়োজন। কারণ একমাত্র কোডিং শেখার মাধ্যমেই সে তার বাবার সকল রহস্যের সমাধান করতে পারবে।নিজ হাতে থাকা হাত ঘড়ির দিকে তাকায় জাফরিন।এটার মাঝেই লুকিয়ে আছে তার বাবার মৃত্যু রহস্য।শুধু তাই নয় লুকিয়ে আছে আরো অনেক তথ্য। যার জন্য জীবন দিতে হয়েছে তার বাবাকে।বাবার লাশ দাফনের তিন দিনের দিন রাতে তার ফোনে একটা নোটিফিকেশন আসে। কোনো ঘড়ি এক্টিভেট হওয়ার। জাফরিন বুঝতে পারে তার বাবার জিনিসপত্রের মাঝে এমন কিছু রয়েছে। সব জিনিসপত্র ঘেটেও তেমন কিছু পায়নি সে।অবশেষে হতাশ হয়ে তার বিয়ের উপহার গুলো দেখছিল।বাবা তার জন্য ঘড়ি কিনেছিলেন।সেটার কাছে যেতেই জিপিএস অন হয়ে যায় ফোনের।টুকটাক নিজের জ্ঞান থেকে জাফরিন বুঝতে পারে এটাই কাঙ্ক্ষিত বস্তু।তাইতো সেদিন পুরো সময় নিজ ঘরে ছিল সে যখন বাকী সবাই ব্যস্ত ছিল তার বাইরে অনুষ্ঠানে। ঘড়ির মাঝে থাকা পেনড্রাইভ ঘেটেও সে খুব একটা বুঝতে পারেনি।তবে যেটা বুঝেছে সেটা হলো তার বাবা দুই মন দুই দশা করেছে তাকে এসবে জড়ানোর জন্য।একবার সে ভেবেছে মেয়েকে এসবের মাঝে জড়াবে না,কিন্তু মাশহুদ নামের ব্যক্তির জন্য তাকে এখানে আসতে বলেছে।
পেন ড্রাইভে থাকা প্রথম ফাইলটা অন করার পর জাফরিন ম্যাসেজ পায়,
“মা, ও আমার মা। তুমি যদি এটা পেয়ে থাকো তবে আমি আর নেই।আমাকে হয়তো ওরা মেরে ফেলবে।সিদ্ধান্ত তোমার হাতে, তুমি আসবে কি না।যদি তোমার বিয়েটা হয়ে যায় তবে তুমি সাবধানে থেকো।ঈশান ছেলেটা লোভ বেশি, তুমি সামলে চলো।বাকীটা তোমার সুখেই সুখী আমি।আর যদি বিয়েটা না করো তবে মাশহুদের জন্য হলেও এখানে একটা বার এসো।মনে রেখো মা,
” পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় এবং শক্তিশালী অস্ত্র হচ্ছে ভালোবাসা।”
এরপর জাফরিন আর কিছুই বুঝেনি।তবে সে জানে না মাশহুদ কে?কী তার পরিচয় কিন্তু তাকে খুঁজতেই এসেছে সে নিজেকে হারিয়ে।
চলবে