ক্যামেলিয়ান ২০+২১

0
1221

#ক্যামেলিয়া
#সাদিয়া_খান(সুবাসিনী)
#পর্বঃ২০ +২১

শাশুড়ি থেকে এমন অপমান সহ্য করতে পারলো না।নিজ রুমের দরজা বন্ধ করে ফুঁপিয়ে কেঁদে চলল সে। বিবাহিত জীবনের এতগুলো বছরে তাকে কেউ কোনো দিন এতোটা অপমান করেনি। নিজ ঘরে বসে দেয়ালের দিকে তাকাতেই দেখতে পেলো টাঙানো ছবিটা।হাস্যজ্জ্বল চোখ মুখে তাকিয়ে আছে জাফরিন।তার দুই গালে চুমু দিচ্ছে নিজ দুই সন্তান।ছেলের জন্মদিনে তোলা ছবিটা।জাফরিনের মুখটা দেখে তাত ভিতরে কষ্টগুলো আর দুমড়ে মুচড়ে উঠেছে।এই মেয়েটা নিজ সন্তানের থেকে কোনো অংশে ভালো কম বাসে না সে। তবে কীভাবে মেয়েটা তার কথা মানলো না?পর মুহুর্তে মনে হলো,

“আদৌও কি মেয়েটা সুখী হতো এই সংসারে?লোকে তাকে যত কথাই বলুক না কেন সে তো জানে তার এই সংসার কতোটা সুখের।সূচনা কেন মারা গেল? না কি তাকে মরে যেতে বাধ্য করা হয়েছে? কি দোষ করেছিল মেয়েটা?মানুষ হিসেবে সবার কিছু চাহিদা রয়েছে, ভালোবেসে নিজ স্বামীর কাছাকাছি যেতে চাওয়াটা কী খুব ভুল ছিল?যে পুরুষ তার এবং স্ত্রীর মাঝের এই গোপন সময়ের কথা মাকে বলে মেয়েটাকে নিয়ে তামাশা করতে পারে, সেই পুরুষ কি পারতো তার বোনকে সুখী করতে?তাকে কি আদৌও ভালোবাসতো?”

হৃদয়ের অন্তঃসত্ত্বা বলে উঠে “না”, কখনোই না। তার কাছে ছোট্ট ফুলটা কোনো ভাবেই মানসিক শান্তি পেত না।সে যে নরপিশাচ, যে স্বীয় স্ত্রীর সম্মান নিজ ঘরের দোরগোড়ায় এনে তামাশার বস্তু বানিয়েছে।তার কাছে প্রতিটি মেয়েই সমান থাকতো।এবার তার নিজের প্রতি নিজের ঘৃণা হতে লাগলো।শাশুড়ির কথায় কত বড় ভুল আবদার করে বসেছিল সে?
ভাগ্যিস তার এই আবদার নয় ভুল আবদার কেউ মেনে নেয়নি।জাফরিন এক বুক মন খারাপ নিয়ে চলে গেছে।এখন সে আর কাঁদতে কাঁদতে তার বুকে এসে মাথা রেখে বলবে না,
বড় আপা, আব্বা কই গেল?আব্বা আমাদের এতিম করে ক্যান গেল?” মেয়েটা হয়তো এই সময় এয়ারপোর্টে দাঁড়িয়ে আছে।আগলে ধরে তাকে কাছা টানা হবে না।কে জানে ভাগ্যে আছে কি না মেয়েটার সাথে দেখা। জাফরিনের হাতের পোড়াটা নিয়েও বেশ চিন্তিত হলো সে। ইউভান বলেছিল তার সার্জারীর প্রয়োজন। কে জানে এখন কোন অবস্থায় আছে।

বাইরের থেকে আসা কান্নার শব্দে ধ্যানভঙ্গ হয় তার।কন্ঠ শুনে মনে হচ্ছে তার ছোটো মেয়েটা কাঁদছে। দ্রুত পায়ে দরজা খুলে বেরিয়ে এসে দেখলো রক্তারক্তি অবস্থা।মেয়েটার দাঁতে লেগে ঠোঁট কেটে গেছে অনেকটা।মেয়েকে কাছে টেনে নিবে এমন সময় তার হাত থেকে ছোঁ মেরে নাতনীকে নিয়ে গেলেন তার শাশুড়ি। কোলে তুলে নিতে নিতে বললেন,

“আমাকে ওয়াদা করছিলা তোমার বইনের সাথে আমার বাপের বিয়া দিবা।কিন্তু তুমি রাখো নাই।এখন তার শাস্তি তোমার পোলাইপান পাইতাছে।কেমন মা তুমি?বোনের স্বার্থ দেখতে গিয়া নিজের সন্তানের উপর মৃত্যুর অভিশাপ ডেকে আনতেছো?”

“আম্মা আপনি অতিরিক্ত কিছুই বলিয়েন না।আপনি যেমন আপনার সন্তানের কথা ভাবতেছেন আমার আম্মাও তার সন্তানের কথা ভাবছে। সে না চাইলে আমার বোন রাজি না থাকলে, আমার মুখের কথাতেই আপনার বেয়াদব ছেলের কাছে তারে বিয়ে দিবে?”

“কী বললা তুমি?”
বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন ভদ্রমহিলা। কিছুটা কাঁপানো গলায় বড় আপা উত্তর দিলেন,

“ছোটো যদি ওর বউয়ের কথা আপনার কাছে না বলতো আর আপনি যদি এতোটা বাজে ভাষায় সূচনাকে কথা না শোনাতেন, ওর মা-বাবারে ডেকে এনে অপমান না করতেন তাহলে ও আত্মহত্যা করতো না।কেমন পুরুষ আপনার ছেলে যে নিজের বৌয়ের চাহিদাই মেটাতে পারতো না, আর সেটা ডাক ঢোল পিটিয়ে বলে বেড়াতো বৌয়ের চাহিদা বেশি?”

স্ব জোরে থাপ্পর বসিয়ে দিলো পুত্র বধূর গালে।রাগে ফোঁসফোঁস করে বললেন,
“বেয়াদব, এই মুহুর্তে আমার বাসা থেকে বেরিয়ে যাবি তুই। কিসে তোর এত অহমিকা?”
“বেশ আম্মা,আজ আসুক আপনার ছেলে।আমি চলে যাবো।আমার কিছুতেই কম নেই।কিন্তু আজকের এই কাজের জন্য আপনি ভবিষ্যৎে আপনাকে কাঁদাবে।মনে রাখবেন।অন্তত সেই মরা মেয়েটার রুহের হায় লাগবে আপনার।”

(৪৭)

এনাউন্সমেন্ট শুনে উঠে দাঁড়ালো জাফরিন।উত্তেজনা না কি ভয় বুঝা গেল না তবে তার পুরো শরীর মৃদু কাঁপছে।জাফরিন ইউভানের হাত শক্ত ভাবে জড়িয়ে ধরে বলল,

“ভয় লাগছে দাদা ভাই।আমি যাবো না।মায়ের কথা মনে হচ্ছে।”

“না যেতে চাইলে বিলক্ষণ যাবি না।কিন্তু ভয় পাওয়ার কিছুই নেই।”

“আমার কান্না পাচ্ছে যে। আমি কি করবো?”

“কাঁদবি,সব কষ্টকে চাপা থাকতে দিতে হয় না।কিছু কষ্টকে চোখের পানির সাথে বইতে দিতে হয়।”

“মাকে দেখে রেখো।আর বড় আপার খোঁজ নিও।কথায় আছে ঝোঁকে বাঙালি, আপা ওরকম।তাকে আলাদা করে দিও না।আর মেঝ আপা যতই নিজেকে শক্ত মনের মানুষ বলুক না কেন,ঘরে দরজা দিয়ে নিরবে কাঁদতে জানে সে।”

“তোকে এতো কথা চিন্তা করতে হবে না।তুই আমার কথা শোন,ওখানে আমার একজন কলিগ সম্প্রতি গিয়েছেন।তোর ব্যাপার সব জানে। পৌঁছে তোর কাজ হবে সময় সুযোগ বুঝে হাতের ট্রিটমেন্ট করানো।আমি সময় হলেই তোকে দেখতে যাবোরে বোন।”

জাফরিন দুহাতে জড়িয়ে ধরে তার ভাইকে।আপন ভাই হলেও হয়তো তাকে এতোটা আদর-যত্ন করতো না যতোটা তার মামাতো ভাই তথা ইউভান করেছে। বোনের মাথায় হাত রেখে তার মাথায় চুমু দিয়ে ইউভান বলল,

“আমার যদি একটা বোন থাকতো আমি তাকেও তোর মতোন আদর করতাম।কিন্তু কি করবো বল, দেখলাম যে ছোট্ট কোনো বোন নেই তখন ফুপুকে বললাম আর ফুপু তোকে ড্রেন থেকে তুলে এনেছিল।”

“আজকে তো এসব বলো না।আমি চলে যাচ্ছি।”

“এবার সত্যি যা, ওই যে তোর জন্য অপেক্ষা করে আছে সবাই।যা দেরি করিস না।”

ইউভানের পাশে দাঁড়িয়ে এমিলি বলল,

“মিস শিকদার, এবার আমাদের যেতে হবে। এনাউন্সমেন্ট হয়েছে অনেক সময় হয়ে এলো।দেরি করা যাবে না।”

জাফরিন এগিয়ে যেতেই ইউভান পিছন ফিরলো।চোখ দুটো মুছে রোদ চশমা চোখে হাসি মুখে বিদায় দিলো বোনকে। সবটাই দূর থেকে দেখলো মাশহুদ।নিজের রাগটাকে দমন করে এগিয়ে গেল সে। এমিলি হাঁটছিল মেয়েটার পাশে পাশে। তার গায়ে এক ধরনের গন্ধ ভেসে আসছে৷ মাশহুদ মাঝেমধ্যে এই গন্ধটার কথা বলেছে ফোনে কুঞ্জকে। এই গন্ধটায় না কি মাদকতা রয়েছে।গত দুদিন পূর্বে সে এটাও এমিলিকে বলেছে যেন দেশে ফিরেই কোনো একটা কোম্পানি সাথে কোলাবোরেশান করার প্রজেক্ট হাতে নেয়, তারা নতুন একটা পারফিউম আনবে বাজারে। যেটা থাকবে প্রেয়সীকে উৎসর্গ করা যায়।ফার্স্ট ক্লাসে টিকিট বুক করা হয়েছিল তাদের জন্য।জাফরিন প্রবেশ করে দেখতে পেল সেখানে আরো কয়েকজন বাঙালি রয়েছেন বাকী সিট গুলো।পুরোপুরি ভাবে ফাঁকা পড়ে আছে। এমিলিকে জিজ্ঞেস করতেই সে জানালো তাদের বস এভাবে নিয়ে যেতে বলেছেন।জাফরিন যেন তার পছন্দসই সিটে বসে পড়ে এবং যে কোনো সমস্যা হলে তাকে জানানোর জন্য। এটা ছিল জাফরিনের প্রথম প্লেনে উঠা।সে খেয়াল করলো তার শরীর ধীরে ধীরে খারাপ হচ্ছে। ভয় আতঙ্কে মাথাটা বেশ ঝিম ধরে এলো।সে আস্তে-ধীরে গা এলিয়ে দিলো সিটটাতে।দু চোখ বন্ধ করে মনে মনে প্রার্থনা করতে লাগলো।তার ভয় কেটে গেল যখন একটা হাতের স্পর্শ পেলো নিজের হাতে।চোখ মিলিয়ে তাকিয়ে দেখলো একটা ভরসার হাত ধরে আছে তার দুটো হাত। উষ্ণ স্পর্শ, ভরসার দৃষ্টিতে তার ভয়টা উবে গেল মুহুর্তেই।

চলবে
#ক্যামেলিয়া
#সাদিয়া_খান(সুবাসিনী)
#পর্বঃ২১

(৪৮)

জাফরিনের শরীর ধীরে ধীরে কিছুটা ঠিক লাগছিল।কিছুটা পানি মুখে দিয়ে গলা ভিজিয়ে নিলো সে। দু হাতে নিজের গায়ের ওড়না ঠিক করে বলল,
“ধন্যবাদ।”
“প্রথম বার বুঝি?”
“জি, এজন্যই হয়তো কিছুটা অস্বস্তি লাগছে।”
“আমারো প্রথম বার প্লেনে উঠা। বলতে পারেন আপনার মতোই আমিও ভুক্তভোগী।কিন্তু আপনি একটু বেশিই।”

“আপনার সাথে পরিচয় হলো না।আমি জাফরিন শিকদার।”

“আমি সুচিত্রা। কিন্তু আপনি কোথায় যাবেন?”

“আমার বাবা এদের কোম্পানিতে চাকরি করতো। গত মাসে এক্সিডেন্টে ইন্তেকাল করেছেন।কোম্পানি থেকে তাই আমার আগের লেখাপড়ার দায়িত্ব নিয়েছে।তাই আজ যাচ্ছি।আপনারা?”

জাফরিনের কথায় একটু নড়ে চড়ে বসলো সুচিত্রা। গায়ের আঁচল ঠিক করে বলল,

“ওই যে ভদ্রমহিলাকে দেখছেন তিনি আমার দাদী।ভদ্রমহিলা আজ বায়ান্ন বছর পর সে তার স্বামীকে দেখতে পাবে এই আশা নিয়ে সাত সাগর পাড়ি দিচ্ছে।”

“ঠিক বুঝলাম না।”

“এক দেশেই যেহেতু যাচ্ছি দেখা তো হবেই। তখন না হয় এসব গল্প করা যাবে।”

ঠিক সেই সময় এমিলি এসে জাফরিন কে বলল,

“ম্যাম আপনি ঠিক আছেন?ডাক্তার এসেছে আপনার একটু চেকাপ করতে চাইছে।”

“আমি ঠিক আছি। ভয়ের কারণে এমনটা হয়েছিল।এছাড়া আমি ঠিক আছি।”

“তবুও একবার একটু দেখে নিতে দিন।আমাকে এই কাজের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।আশা করি বুঝবেন।”

জাফরিন কিংবা সুচিত্রা বুঝতে পারলো, যে অবধি জাফরিন চেকাপ করাবে না সে অবধি এমিলি দাঁড়িয়ে থাকবে।এই মেয়েটাকে দেখে জাফরিনের কেন যেন ভয় হয়।তার গায়ে থাকা কোর্ট দেখে মনে হয় করপোরেট জগতের বিশেষ ব্যক্তি,যে অনেক কিছুই জানে। নিশ্চয়ই তার নির্দেশনায় চলে অনেকে। অথচ জাফরিনকে সে ম্যাম বলে ডাকাটা তার সমীচীন মনে হয় না।অনুনয়ের সুরে বলা কথাটাও ফেলতে পারে না সে। তাই রাজি হয়ে যায় চেকাপের জন্য।জাফরিনকে নিয়ে একজন বিমানবালা কিছুটা দূরে বসতে বললে সে জানালার পাশে বসলো। খোলা আসমানের দিকে তাকিয়ে রইল সে।ঠিক সেই মুহুর্তে তার মনের অতীতের আসমানে ক্ষত-বিক্ষত পাখির মতোন উড়তে লাগলো তার বাবার স্মৃতি। আজ সে কাঁদতে পারবে, কেউ নেই তাকে দেখার মতোন। তার ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই যে তাকে কাঁদতে দেখলে তার বোন কিংবা মা ভেঙ্গে পড়বে।

বাবার মৃত্যুর আটাশ দিন পর জাফরিন খুব করে কাঁদলো।দুহাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো সে।আজ নিজেকে সত্যি এতিম লাগছে তার। মায়ের মুখ চাইলেও দেখতে পারবে না।দীর্ঘ সময় পর জাফরিন নিজেকে সামলে নিলো।তাকে শক্ত হতে হবে কারণ তার বাবার মৃত্যুর রহস্যটা তাকে জানতে হবে।বাবার সেই লাস্ট মেইল কেন এসেছিল?তাকে গুরুত্বপূর্ণ ফাইলটা অন্য একটা ডিভাইসে রেখে কেন দিতে বলেছিল তার বাবা?এরপর কেনোই বা ডিলিট হয়ে যায় জাফরিনের নিজস্ব সেই মেইল আইডিটা?
এতসব রহস্যের সমাধা করতেই জাফরিন এগিয়ে চলেছে এক অজানা গন্তব্যে। যেখানে তাকে দিন রাত পরিশ্রম করে শিখতে হবে বাবার সেই গুপ্ত পদ্ধতি। যে পদ্ধতিতে সে লুকিয়ে রেখেছে সকল তথ্য।

জাফরিন এটা অন্তত জানে যে তাকে পড়াতে নিয়ে আসার কথাটা নিছক বাহানা মাত্র।তারা তাকে একটা মাধ্যম হিসেবে নিয়ে যাচ্ছে সেটাও জাফরিন বুঝতে পারছে। তারা ততদিন তার মাথার উপর হাত রাখবে যতদিন তার বাবার সেই ডকুমেন্টস না পায়। মেয়েটাকে তারা হালকা ভাবে নিয়ে চরম ভুলটা করে বসলো।তারা হয়তো বুঝতেই পারেনি জাফরিনকে তারা নিয়ে যাচ্ছে না বরঙ জাফরিন নিজে যাচ্ছে তাদের সাথে।তার বাবার মৃত্যুর রহস্যটা জানবার জন্য।কারণ তাদের সাথে একই কাঁদায় মাখামাখি না হলে যে কাঁদার ভিরতে ডেবে থাকা সেই সূঁচ টা খুঁজে পাওয়া যাবে না।

দুচোখ মুছে, মুখ মুছে সামনে থাকাতেই জাফরিন দেখতে পেল ডাক্তার বসে আছে। তারা চেকাপ করে জানালের ঠিক আছে সে। চলে যাওয়ার পর কিছুটা গা এলিয়ে দিলো মেয়েটা।ক্লান্ত লাগছে তার ভীষণ। দু চোখ ভর করে নেমে এলো ঘুমের প্রজাপতি।সেই সময় জাফরিন অনুভব করতে লাগলো সেদিনের চেনা গন্ধটা। যে গন্ধটা তাকে রাত জাগতে বাধ্য করেছিল।তার মনে হতে লাগলো ধীরে ধীরে হালকা সুগন্ধিযুক্ত ফিনফিনে বাতাস ছুঁয়ে দিচ্ছে তার ঠোঁটে, চোখে, গালে কিংবা শরীরে। খুব করে চাইলো দু চোখ মেলে তাকিয়ে দেখতে কিন্তু দুটো চোখ তার সাথে প্রতারণা করে তাকে নিয়ে গেল গভীর ঘুমের উপবনে।

(৪৯)

মেয়ে চলে যাওয়ার পর বাড়ির জন্য মন কেমন করছিল জাফরিনের মায়ের।এই সময়টা তার ইদ্দত পালনের ছিল।কিন্তু নিজের অংশ মেয়েটা দেশ ছেড়ে চলে গেল বলেই বাড়ি থেকে বেরিয়েছিল সে। আজ পুনরায় বাড়িতে ফিরে এলো।আসার সময় নাতীনাতকুরদের সাথে করে নিয়ে এসেছে। বড় মেয়ের ঘরের ছেলেটা তার কাছেই থাকবে কয়েক মাস। সামনে তার মাধ্যমিক পরীক্ষা।নিজ থেকেই প্রস্তুতি নেওয়ার উদ্দেশ্যেই এখানে আসা। কারণ জেমি আজ সকালে কল।দিয়ে তার শাশুড়ির ব্যাপারে সবটা বলেছে। এটা শোনার পর সে কিছুই জবাব দিতে পারেনি।সে বলেনি ও বাড়ি থেকে বেরিয়ে আয়, তোর বাবা বাড়ি দিয়ে গেছেন, সেখানে উঠ।
সে বলেছে,
“মা, তোমার সংসার।তুমি ভুল বুঝতে পেরেছো অথচ আর কয়েকটা ঘন্টা আগে বুঝতে পারলে না।তাহলে হয়তো আমার ছোটো মেয়েটা এক বুক হতাশা নিয়ে যেত না।তুমি জানো না মা,আমার মেয়েটা তোমার পথ চেয়ে বসেছিল।”

মায়ের এমন কথা শুনে দু চোখ ভিজে এলো তার৷ জেমি কিছুই বলতে পারলো না।শুধু অনুনয়ের সুরে মাকে বলল,

“মা ছেলেটার পড়া হচ্ছে না এ বাড়িতে।তোমার কাছে রাখবে?”

“জিজ্ঞেস কর‍তে হবে না।তুমি ওকে পাঠিয়ে দাও, আমি আজ
বাড়ি ফিরবো।”

বাড়ি ফিরেই এক সমস্যার সম্মুখীন হলেন তিনি।যোহরের ওয়াক্তে জিলেপী কিনে মসজিদে মিলাদ পড়ানোর ব্যবস্থা করেছিলেন।সেই জিলেপী জাফরিনের চাচাদের হাতে দিতেই তারা কেউ হাতে নিলো তো নিলোই না উল্টো দুটো কথা শুনিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে বলল,

“জুতো মেরে গরু দান করার কোনো দরকার নেই।একবার মেয়েকে দিয়ে অপমান করাও আবার নিজে আসো?”

“আপনারা আমার বড়, আপনাদের সাথে কিসের অপমান?”

“ছোটোর নামে থানায় মামলা দেওনি?আবার আসছো পিরিত দেখাইতে?”

“আমার মেয়েকে মারার চেষ্টা করছে সে। আপনি তো বড় চাচা, আপনি একটা বার গিয়ে দেখতেন কেমন আছে আমাত মেয়েটা?”

“তোমরা আমাদের কোনো কথা শুনছো?যে তোমাদের কথা আমাদের শুনতে হবে?আমার ভাইরে চুইষা খাইছো।সব করে দিছি রক্ত ঘাম করা পরিশ্রম দিয়ে এখন বসে বসে খাইতেছো।আমাদের হক নষ্ট করে।”

“আপনাদের হক নষ্ট করিনি।আর এই কথাটা আগেও একদিন বলেছেন, সেদিন ও জবাব পেয়েছেন।আজকেও দিচ্ছি। স্বামীর ইনকাম খাওয়াটা তাকে চুষে খাওয়া বলে না।সে আমার স্বামী ছিল আমি তার দায়িত্ব ছিলাম।ভবিষ্যতে আমার সাথে কথা বলতে এলে সাবধানে বলবেন।আর এমন কোনো কথা বলবেন না যেন আপনাকে সম্মান দিতে আমার দুই বার ভাবতে হয়।”

(৫০)

দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে জাফরিন পৌঁছেছে তার গন্তব্যে। এয়ারপোর্টে দাঁড়িয়ে দম বন্ধ করা শ্বাস নিলো সে। যেন এই মাটিতে সে শ্বাস নিতে চাইছে না।এমিলি তাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। কিছু সময় পর ইউভানের সেই পরিচিত লোক এসে তাকে এই দেশের একটা ব্যাংক কার্ড এবং কিছু ক্যাশ দিয়ে গেল।জাফরিন ধন্যবাদ জানাতেই এমিলি এসে বলল,

“ম্যাম, আপনার থাকার ব্যবস্থাটা আপনার বাবার ব্যক্তিগত ফ্ল্যাটেই করা হয়েছে। ওটার মালিকানা আপনার নামেই ছিল।আমি সে অবধি আপনাকে পৌঁছে দিচ্ছি।”

জাফরিন সম্মতি জানিয়ে এগিয়ে চলল তার সাথে।ছিমছাম করে গোছানো রয়েছে ফ্ল্যাটটা।চাবি বুঝিয়ে দিয়ে এমিলি চলে যাওয়ার পর জাফরিন বসে রইল কাউচে। তার চোখের সামনে ভাসতে লাগলো কীভাবে কই বসে তার বাবা তাদের সাথে ভিডিও কলে কথা বলতো। ওই যে রান্নাঘরটা সেখানে দাঁড়িয়ে রান্না করতো।এসবের মাঝে রয়েছে তার বাবার স্পর্শ। একটা কুশন বুকে নিয়ে কাঁদতে লাগলো মেয়েটা।ঠিক সেই মুহুর্তে সে অনুভব করলো তার চোখের পানিতে কুশনের ভেজা অংশে কিছু লেখা ভেসে উঠেছে। তার বুঝতে বাকী রইল না। সে দ্রুত লবণাক্ত পানিতে দিয়ে কুশন ভেজাতেই দেখতে পেল স্পষ্ট লেখা,

“জাফরিন, মা তুমি যদি এখানে এসে থাকো তবে আমি এত দিনে মৃত।মনে রেখো তোমার আশেপাশেই রয়েছে সব কিন্তু তাদের হাতে লাগতে দিও না।কারণ পেয়ে গেলে তোমাকেও বাঁচতে দিবে না।”

চলবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here