#ক্যামেলিয়া
#সাদিয়া_খান(সুবাসিনী)
#পর্বঃ১৮ +১৯
(৪৩)
জাফরিন চলে যাওয়ার আগের দিন সকালে চূড়ান্ত ঝামেলাটা হলো। সূচনার খুনের ব্যাপারে পুলিশ এসে চার্জ করলো জাফরিনকে। থানায় করা মামলায় প্রধান আসামী হিসেবে দায়ী করা হয়েছে তাকে। অফিসার এসে জাফরিন কে জিজ্ঞেস করলেন,
“আপনি সূচনাকে চিনেন?”
“জি।”
“কত বছর যাবত তার স্বামীর সাথে আপনার সম্পর্ক?”
“ঠিক কেমন সম্পর্কের কথা বলছেন?আমি কি একটু জানতে পারি?”
“যেমন সম্পর্ক থাকলে একজন মেয়ে অন্য মেয়েকে আত্মহত্যা করতে মোটিভেট করতে পারে।”
“আত্মহত্যা নিশ্চয়ই কোনো সুখকর কাজ নয় যে করতে মোটিভেট করলাম।আর সে করে ফেলল।আর তাছাড়া আপনার কাছে কোনো ওয়ারেন্ট আছে আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করার?”
“এমনি এমনি তো আপনার সাথে তামাশা করতে আসিনি ম্যাডাম।আপনি প্রশ্ন না ঘুরিয়ে সরাসরি জবাব দিন।”
“আপনিও না ঘুরিয়ে সরাসরি প্রশ্ন করুন।”
“আপনার সাথে ভিক্টিমের স্বামীর কেমন সম্পর্ক? ”
“সে আমার বড় দুলাভাই আসলাম সাহেবের ছোটো ভাই।তার সাথে আমার আর পাঁচ টা মানুষের মতন সম্পর্ক।”
” আপনার বিরুদ্ধে অভিযোগ এসেছে আপনি এবং তার স্বামী, দুজনে মিলে বাধ্য করেছেন ভিক্টিমকে আত্মহত্যা করতে। কারণ আপনাদের প্রেমের সম্পর্ক চলছে চার বছর যাবত।”
এবার জাফরিন না হেসে পারলো না।ফিক করে হেসে বলল,
” একটু খোঁজ নিয়ে দেখলে জানতে পারবেন সম্প্রতি আমার বিয়ে ভেঙেছে এবং সেটাও আমার প্রেমের বিয়েই ছিল।এরপর গুঞ্জন উঠেছে আমার চাচাতো ভাইয়ের সাথেও আমার প্রেমের সম্পর্ক।আচ্ছা বাদ দিন এটাও, সব থেকে বড় কথা, ওই যে দেয়ালে যার ছবি দেখছেন আমার সাথে,সে আমার মামাতো ভাই। তার সাথেও আমার প্রেমের গুঞ্জন রয়েছে। আজ আবার এটা, আসলে আমি কনফিউজড। আমার প্রেমটা হয়েছিল কার সাথে?”
“আপনি আমার সাথে মশকরা করছেন?”
“জি না।আমি এটা বুঝাতে চাচ্ছি যে শোনা কথায় সব হয় না।আমার বিরুদ্ধে প্রমাণ তো লাগবে।”
” ভিক্টিমের মা আপনার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন। কারণ দুর্ঘটনার পর পরেই আপনাদের বিয়ের কথা চলছে।”
“এক পাক্ষিক কিছুই হয়নি। আর তাছাড়া আমার এই বিষয় নিয়ে কিছুই বলার নেই।যদি করতেই হয় তবে সূচনার স্বামী এবং শাশুড়িকে জিজ্ঞেস করুন।”
ঠিক সেই মুহুর্তে জাফরিনের বড় মামা চলে আসেন। তিনি অফিসারের সাথে কথা বললেন।পরিচয় দেওয়ার পূর্বেই তাকে চিনতে পারেন।তিনি নিশ্চিয়তা দেন এসবের সঠিক ভাবে তদন্ত করার। কিন্তু জাফরিন এই মুহুর্তে দেশ ছেড়ে যেতে পারবে না বলেও জানান।আগামী সপ্তাহে কেস কোর্টে উঠবে এরপর দেখা যাবে কী হয়।
পুলিশ চলে যাওয়ার পর চিন্তার ভাঁজ পড়লো সবার কপালে।বিশেষ করে জাফরিনের মায়ের। আসলাম সাহেব সবটা জানতে পেরে দ্রুত ছুটে আসলেন তাদের কাছে।মামা সাহেব উপরস্থ কর্মকর্তা তার বন্ধুকে কল দিলে তিনি বললেন,
যদি ভিক্টিমের পরিবার থেকে কেউ একজন তাকে নির্দোষ বলে লিখিত দেয় তবে বাকীটা উনি দেখবেন। না হলে আগামী সপ্তাহ অবধি অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই।
এবার আসলাম সাহেব সরাসরি কথা বললেন সূচনার পরিবারের সাথে।
“জাফরিনের কোনো দোষ নেই এতে তালোই সাহেব।আমি গ্যারান্টি দিচ্ছি এটা।”
“আপনি সেদিন কোথায় ছিলেন যেদিন আমার মেয়ে মারা গেল?সেদিন তো আপনার শালী সেখানে ছিল।”
“কারণ নিশ্চয়ই আপনি জানেন।আমার শশুর ইন্তেকাল করেছেন আর মেয়েটার জীবনে অনেক সমস্যা লেগেই আছে। এই তো সে আগামীকাল স্পেনের উদ্দেশ্যে যাত্রা করবে কিন্তু পুলিশ বিধিনিষেধ দিয়ে গেল।এভাবে মেয়েটার ভবিষ্যৎ নষ্ট করবেন না।”
“আর আমার মেয়েটা যে মরে গেল?”
জাফরিনের মেঝ আপা এই কথাতে ভীষণ রেগে গেলেন।সে কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু মামা নিষেধ করলেন।এই মুহুর্তে তাদের মাথা ঠান্ডা রাখতেই হবে।প্রয়োজন পড়লে নিচু হয়ে কথা বলতে হবে। তাদের নিজেদের ভালোর জন্য।
“আপনারা যা ভাবছেন এমন নয়।জাফরিনের সাথে আমার কুলাঙ্গার ভাইয়ের কোনো সম্পর্ক নেই। আপনারা যা শুনেছেন সবটা ভুল।হ্যাঁ, আমার মা বলেছিল বিয়ের কথা কিন্তু জাফরিন রাজি হয়নি।তাই তো সে চলে যাচ্ছে দেশ থেকে।”
অপর পাশে থেকে কেউ একজন বলল,
“হ্যাঁ, ওই মেয়েটা তখনি রাগারাগি করে বাড়ি থেকে চলে যায়।ওর দোষ নাই।অযথা ওর যাওয়াটা আটকালে এতিম মেয়েটার সাথে খারাপ হবে।ওর সাহায্য করলে হয়তো সৃষ্টিকর্তা আমাদের মেয়ের প্রতি রহম করবে৷”
“আচ্ছা বেশ, আমাদের কী করতে হবে?”
“বেশি কিছু নয়, আপনাদের লিখিত দিলেই হবে যে জাফরিনের প্রতি কোনো অভিযোগ নেই।বাকীটা হয়ে যাবে।”
(৪৪)
মাশহুদ যখন এই বিষয় সম্পর্কে জানতে পারলো তখন মনে মনে বলল,
“এই মেয়ে কী চলন্ত সমস্যার মেট্রোরেল? এত সমস্যা কেন তাকে ঘিরেই?”
মাত্র কয়েক ঘন্টা বাকী আছে, এরপর তাদের বেরুতে হবে। আর এখন কী না এই মেয়ে কেসে ফেসেছে৷ রাগে তার কপালের দুটো শিরা ফুলে উঠেছে। ভুল হয়েছে একটাই।সেদিন রাতেই তাকে এখানে নিয়ে আসা উচিৎ ছিল।তার কাজ শেষ হলে ছেড়ে দিতো অথচ তার প্রতি অমোঘ মায়ার শেষ হবে কী করে?
এমিলিকে সে বলল বিষয়টা মিটিয়ে নিতে প্রয়োজন হলে টাকা দিয়েও মিটিয়ে নিতে।
তখন এমিলি জানালো তার পরিবার থেকেই সব মিটিয়ে নিয়েছে।
“যাক তবে, মেয়েটার পরিবার এতোটাও তবে ফেলনা নয়। সাপোর্ট করার ক্ষমতা তাদের আছে তবে।বিপদ মোকাবিলা করতে জানে ঠান্ডা মাথায়।”
“কিন্তু স্যার, আমার মনে হয় মিস. জাফরিন নিজেই সমস্যা গুলো ক্রিয়েট করে।”
“মিস এমিলি,আপনি কী নিজের সমস্যা ক্রিয়েট করে আপনার নিজের শরীরের অংশ পুড়িয়ে ফেলবেন?না কী এমন একটা মার্ডার কেসে জড়াবেন?”
“দুঃখিত স্যার।আমি পরবর্তী সময়ে আমার শব্দ চয়নে কেয়ারফুল হবো।”
মাশহুদ কিছু না বলে উঠে দাঁড়ালো। এমিলি তার পিছনে দাঁড়িয়ে ভাবতে লাগলো,
“জাফরিন নামের মেয়েটার পিছনে ছায়ার মতোন লেগে থাকা এই মাশহুদ যে তাকে আগলে রাখছে। যে তার জীবনে জমিয়ে রাখা সব স্নেহ,ভালোবাসা,ইচ্ছে কিংবা অভিমান ঢেলে দিবে
মেয়েটার মাঝে। সে কী মেনে নিতে পারবে?
কারণ প্রেমিক পুরুষ হিসেবে মাশহুদ যে বড্ড অভিমানী প্রজাতির প্রেমিক। জাফরিন বুঝবে তো তাকে?”
চাপা গুঞ্জনে চারপাশে মানুষ কথা বলছে। এই মাষ্টার বাড়িতে কয়েক দিন যাবত কারা যেন থাকছে। তাও আবার বিদেশি,আসার পর মাষ্টারের সব ঋণ শোধ করেছে, নিত্যদিন বাজার থেকে ব্যাগ ভরে বাজার নিয়ে আসে। বাড়ির বাইরে দাঁড়ানো থাকে সারি করে দামী গাড়ি। সব বিদেশি লোকজনের মতোন লাগে। আবার সেদিন বারান্দায় মাষ্টারের বড় মেয়ের সাথে এক ছেলেকে দেখছে পাশের বাড়ির লোক।পুরো যেন সিনেমার নায়ক- নায়িকা। এমন ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে ছিল তারা। মাষ্টার কী বড় মেয়ের জন্য বিদেশি পাত্র ঠিক করেছে?
মাষ্টার এই সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন।তিনি চায়ের দোকানে বসে ছিলেন অনেকের সাথে। দীর্ঘ কয়েক বছর পর এখানে বসা। তার জন্ম হয়েছে যুদ্ধের বছর। এই এলাকার সবার কাছে সে মাষ্টার নামেই বেশি পরিচিত। অন্যের সন্তান মানুষ করলেও করতে পারেনি নিজের সন্তান। কারণ ছেলেটা অল্প বয়সে জুয়াড়িদের খাতায় নাম লেখায়।বার বার জেলে যেতো আর তাকে ছাড়াতে মাষ্টার ধার-দেনা কিংবা সুদে টাকা নিতো।এভাবেই যখন ঋণের বোঝা বাড়লো তখন আর বসা হতো না চায়ের দোকানে। পাঁচটা টাকাও যে অনেক ছিল তখন। কিন্তু এখন ঋণ নেই। তাই বসেছে এখানে।সবাই যখন জিজ্ঞেস করলো তখন সে বলল
“ছেলেটা না কী তার ভাতিজা লাগে। তার বাবা বিদেশে বিয়ে করেছে সেই ঘরের।দেশে এসেছে তাদের নিতে। কিন্তু সে বিশ্বাস পাচ্ছে না।অপর দিকে সে তার ঋণ শোধ করেছে তাও বিশ্বাস পায় না।ঘরে জোয়ান -যুবতী মেয়ে নিয়ে থাকে। তাই তারা যদি সাহায্য করে ওই ছেলের সাথে বিয়ে দিতে তাহলে বেশ উপকার হইতো তার।”
“তোমাদের তো নিয়ে যেতে চায়, আর জোড় করলেই কী রাজি হবে?”
“তোমরা ভাইয়েরা আমারে এইটুক সাহায্য করবা না? এই ছেলে যাওয়ার পর কেউ আমার মেয়েরে বিয়ে করবে?কোনো সম্বন্ধ আসবে?এমনিতেই আমার পোড়া কপাল।আর তাছাড়া এক বার ভাবো, বিদেশে এত ধনী লোক,শুনলাম কোম্পানি আছে, আমার মেয়ে যদি এর বৌ হয় তাহলে গ্রামবাসীর জন্য কিছু করবো না?অবশ্যই করবে।আমি বলতেছি করবে।”
“তাহলে এখন কী করা যায়?”
“এই ছেলে বাংলা এত বুঝে না।আর আজ রাতেই তোমরা সবাই আমার বাড়ি আসো। জোড় করে ধরো তারে, বিয়ে না করতে চাইলে জোড় করবা।সব তোমাদের হাতে। কিন্তু আমি কিছুই জানি না।মনে থাকবে?”
“আচ্ছা, তবে রাতে আমরা আসতেছি।তুমি পারলে মিষ্টির ব্যবস্থা করিয়ো।বিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব আমাদের।”
চলবে
#ক্যামেলিয়া
#সাদিয়া_খান(সুবাসিনী)
#পর্বঃ১৯
সূচনার বাবা-মা জাফরিনের বিরুদ্ধে দেওয়া স্টেটমেন্ট তুলে নিয়েছে এটা শুনে একদফা বিরক্ত হলেন বড় আপার শাশুড়ি। তিনি ইচ্ছে করে সেদিন বার বার ছোটো ছেলের সাথে জাফরিনের নামটা নিয়েছেন। যেন হুট করে কোনো ব্যক্তি শুনে এটাই ধারণা করতে বাধ্য হয় যে জাফরিনের সাথে সূচনার স্বামীর অনৈতিক সম্পর্ক ছিল।যেটা সহ্য না করতে পেরে মেয়েটা আত্মহত্যা করেছে।যেহেতু জাফরিনের আগেও বিয়ে ভেঙেছে তাই মানুষকে এটা বিশ্বাস করানো সব থেকে বেশি সহজ ছিল।এমনটা হয়েও ছিল কিন্তু নিজ বড় ছেলের কারণে আজ ছোটো ভাইয়ের ভবিষ্যৎটা নষ্ট হয়ে গেল।সে তো নিজেরটা ভালোই বুঝে নিয়েছে। লাখ লাখ টাকার সম্পত্তি পেয়েছে শ্বশুর বাড়ি থেকে।কিন্তু যেই ছোটো ভাইটা একটু সুখের মুখ দেখবে তখন বড় ভাই নিজের আপন ভাইয়ের শত্রু হয়ে গেল। ছোটো ভাই যদি টাকা পয়সার সঠিক ব্যবহার করে তার থেকে বেশি টাকার মালিক হয়, এই কারণেই সে নিজের শালিকে তার ভাইয়ের সাথে বিয়ে দিলো না বলে তীব্র ধারণা নিয়ে বসে আছেন বড় আপার একমাত্র শাশুড়ি। জাফরিনের অভিযোগ তুলে নেওয়া হয়েছে সেটা তিনি জানতে পারেন বেলা দশটার দিকে।কিন্তু তার মাথায় বাঁজ পড়লো সেই সময় যখন তিনি জানতে পারলেন,
যদি তারা লিখিত না দিতো তাহলে জাফরিন বিদেশ যেতে পারতো না,যতদিন না কেস চলতো।এমনটা শুনে তার জ্ঞান যায় যায় অবস্থা হয়ে গেল।এতক্ষণে তো সবাই বেরিয়েও গেছে এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে। ছোটো ছেলেটার মুখের দিকে তাকিয়ে কান্না আটকে রাখতে পারলো না সে। আঁচলে মুখ ডেকে ফুপিয়ে কাঁদতে লাগলো তার জনম দুঃখী ছেলের জন্য।বড় আপা তার জন্য সকালের নাস্তা নিয়ে যেতেই সেগুলো নিয়ে যেতে বলল।তাকে আরো কড়া ভাবে হুমকি দিয়ে বলল,
“আমার সংসারের তুমি এতবড় ক্ষতি করবা জানলে কোনো দিন তোমারে এই সংসারে আমি আনতাম না।তুমি আমার ঘরের ধারে কাছে আসবে না।যদি আসো তাহলে আমি গলায় দড়ি দিমু।”
(৪৫)
গ্রামবাসী প্রস্তুতি নিয়েই এসেছে আজ মাশহুদের সাথে মাষ্টারের মেয়ের বিয়ের জন্য।কেউ কেউ ঝামেলায় জড়াতে চায় নি,কারণ তারা দেখেছে ওই বাড়ির সামনে যে কয়জন কালো পোশাকধারী লোক দাঁড়িয়ে আছে, তাদের মধ্যে কয়েকজনের সাথে নিয়মিত পুলিশ যোগাযোগ রাখছে।তাছাড়া ছেলেটাকে দেখেও মনে হয় না যে সে এত সহজে সবার কথা মেনে নিয়ে বিয়ে করবে।এই মাষ্টারের উপকার করতে গিয়ে শেষ মেষ বিপদে পড়বে না কি?এর চেয়ে ভালো দূর থেকে তামাশা দেখবে, আর যদি সত্যি লাভবান হওয়া যায় তবে শেষ সময়ে গিয়ে দাঁড়াবে তাদের কাছে।দলের নেতা বার বার সবাইকে বুঝিয়ে সে বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছে। কাকে কী বলতে হবে,কে কী করবে।তারা সবাই যখন বাড়িতে প্রবেশ করল তখন পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী মাষ্টার এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলেন,
“আরে আপনারা সবাই?কোনো প্রয়োজনে?”
“প্রয়োজন তো অনেক মাষ্টার। কিন্তু কথা হইলো তোমার বাড়িতে এক যুবক পোলা দেখি,সে কে?”
দীর্ঘ শ্বাস ফেলার ভঙ্গিতে মাষ্টার বললেন,
“সে তো পরিচয় দিতেছে আমার বাবার নাতী হিসেবে।মানে আমার বাপে না কী বিদেশে আরেকটা বিয়ে করেছে, সেখানের ঘরে যে ছেলে হইছে তার ছেলে।”
“কোন বিদেশি মানুষ কি কইলো আর বিশ্বাস করে নিছো?মাষ্টার তোমারে বুদ্ধিমান জানতাম।তুমি এতবড় একটা ভুল কেমনে করলা?আর এই ছেলেরে তুমি বাড়িতে থাকতে দিছো যখন ঘরে তোমার যুবতি মেয়ে আছে। না এটা মেনে নেওয়া যায় না।”
“ভাই আপনাগো পায়ে ধরি,আমার মেয়েরে এমন অপবাদ দিয়েন না।ওর বিয়ে শাদী হবে না।আর আমরা তো ওই ছেলের সাথে বিদেশ যাইতেছি।”
“বিদেশ যাইতেছো যাও। আমাগোর কোনো আপত্তি নাই।কিন্তু এই ভাবে অবিবাহিত মেয়েকে সাথে নিয়ে ওই ছেলের সাথে যাবা, এটা তে আমাগোর আপত্তি আছে।কী বলো সবাই?”
ভিতর বাড়ি থেকে সবাই বেরিয়ে এসেছে।এমন কথা শুনে চিন্তার ভাঁজ পড়ল বাড়ির গিন্নির কপালে।মাথায় আঁচল তুলে দিয়ে সে জিজ্ঞেস করল,
“আপনারা কী বলতে চাইতেছেন?”
“ভাবী সাব আমরা চাইতেছি ওই পোলায় যেহেতু আপনাদের নিয়ে বিদেশ যাইতেই চাইছে তাহলে ক্যান আপনার মেয়ে সুচিত্রা কে বিয়ে করেই নিয়ে যাক।আমরা গ্রামবাসীরাও একটু শান্তি পাব আর পাঁচ গ্রামের মানুষ কিছু বলার আগে ভেবে-চিন্তে বলবে।আরে কে আছিস যা ওই ছেলেরে ডাক দিয়ে নিয়ে আয়।”
কথপোকথন সবটাই বেশ ভালো ভাবেই বুঝতে পারলো এমিলি।নিজের গায়ে শাল জড়িয়ে সে বেরিয়ে এলো মাশহুদের জন্য বরাদ্দকৃত ঘর থেকে।এ সময়টুক সে ছিল মাশহুদের স্পর্শের সাথে।যে মেয়েটা তার সাথে ছায়ার মতোন থাকে কিন্তু তাকে স্পর্শ অবধি করতে পারে না সেই মেয়ের মনের ভিতরের অস্থিরতা অন্য কোনো মানুষ আন্দাজ করতে পারে না।গতকাল রাতেই মাশহুদ বেরিয়ে গেছে এই বাড়ি থেকে।তার উপর দায়িত্ব দিয়ে গেছেন পুরো পরিবার নিয়ে যথাযথ সময়ে এয়ারপোর্টে প্রবেশ করার।মাশহুদের মনে হচ্ছিলো জাফরিন নামক মেয়েটা আবারো কোনো বিপদে পড়বে। এ সময়টা তার কাছেই থাকাটা শ্রেয়।যে অবধি তাকে নিয়ে স্পেনের মাটিতে না নামছে সে অবধি দ্বিতীয় কোনো ঝুঁকি নিতে চায় না।এমিলি এসে দাঁড়াতেই একদল ফিনফিনে বাতাস এসে লাগল তার গায়ে।মন খারাপ তীব্র হলো।সামনে দাঁড়িয়ে থাকা প্রতিটি মানুষ চক্রান্ত করে বসেছে মাশহুদের বিপক্ষে?জোড়ে শ্বাস টেনে নিয়ে সামনে এগিয়ে যায় এমিলি।
এরপর আধো ভাঙ্গা বাংলা ভাষায় বলল,
“দুঃখিত, আপনারা স্যারকে পাবেন না।ইতিমধ্যে স্যার বেরিয়ে গেছেন এবং আমাকে বলে গেছেন আমিও যেন খুব দ্রুত আপনাদের নিয়ে রওনা হই।তাই আপনাদের অনুরোধ করবো ঘন্টা খানেক সময়ের মধ্যে তৈরী হয়ে আমাকে জানাতে।”
গ্রামবাসী অবাক চোখে তাকিয়ে রইল মাষ্টারের মুখের দিকে।তারা হতাশ হয়ে ফিরে গেলেন নিজ গন্তব্যে।
(৪৬)
মায়ের বুক থেকে জাফরিন নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে কাঁদতে লাগলো ফুঁপিয়ে। মেয়েটা আজ মায়ের থেকেও আলাদা হয়ে যাচ্ছে।ভেবেছিল যত রাগ থাকুক না কেন আজ বড় আপা আসবেন, তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলবে,
“যাই হয়েছে থাক, মন খারাপ করিস না৷ আমি তোর ভালো চাই। কিন্তু আমাদের মধ্যে কোনো ভুল বুঝাবুঝি থাকুক এটাও আমি চাই না।ভালো ভাবে থাকিস বোন।”
কিন্তু এমন কোনো কিছুই হলো না, আপা এলেন না তার সাথে দেখা করতে। দুলাভাই এসে জানালেন যে তার আপা আসার সময় তার জন্য আচার পাঠিয়েছেন।কিন্তু জাফরিন জানে আপা এটা পাঠায়নি, দুলাভাই নিজ থেকেই নিয়ে এসেছেন। এটা নিয়েও তাদের দুজনের মাঝে তর্ক হয়েছে।মেঝ আপা তাকে নতুন একজোড়া দুল দিয়ে বললেন,
“শোনো বোন,পরদেশ তো আমরা জানি না মানুষ কেমন কী হবে। তুমি সাবধানে থাকবে।অন্য দেশের কালচারের সাথে আমাদের কালচার মিলবে না।আর সব থেকে বড় কথা নিজের সম্মান নিজেকে বজায় রাখতে হবে।”
একে একে সবার থেকে বিদায় নেওয়ার পর জাফরিন এগিয়ে গেল ইউভানের দিকে।ইউভান দুহাতে তাকে আগলে নিলো।বুকটা আজ তার ভীষণ খালি হয়ে যাবে।তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,
“সুযোগ পেলেই আমি যাবো তোর সাথে দেখা করতে। ওখানে আমার এক বন্ধু আছে।আমি তাকে জানিয়েছি, যে কোনো বিপদে তুই তার সাথে যোগাযোগ করতে পারবি।আর হ্যাঁ ওখানে পৌঁছাতেই তুই প্রয়োজনীয় সকল জিনিসপত্র পেয়ে যাবি।সাবধানে থাকবি।”
সবার থেকে বিদায় নিয়ে ভিতরে প্রবেশ করলো জাফরিন।স্পেশাল পারমিশনে ফ্লাইট ফ্লাই করার আগ অবধি তার সাথে থাকবে ইউভান।ওয়েটিং সিটে বসে জাফরিনের দিকে কফি এগিয়ে দিয়ে সে বলল,
“ভয় পাসনে।আমি জানি তুই কীসের জন্য যাচ্ছিস।তোর ইচ্ছে এবং কাজ সফল ভাবে হোক এটাই কাম্য।”
“বাবার মৃত্যু স্বাভাবিক ছিল না।আমার তার ময়নাতদন্তের রিপোর্ট চাই।তুমি কি ব্যবস্থা করে দিতে পারবে?”
“এটা নির্ভর করবে কোম্পানির লোকের উপর। যদি তারা ডাক্তারকেই সরিয়ে দেয় বা ডাক্তার নিজেই তাদের মদদ দেয় তাহলে সম্ভব নয়।”
“আমি সবটা জেনেই ফিরবো।আর না ফিরলে তুমি তো জানোই তোমাকে কী করতে হবে।”
“হাতের যত্ন নিস। এখানে ইনফেকশন হতে দিস না কিন্তু।”
কথাগুলো শেষ করেই শক্ত হাতে জড়িয়ে নিলো তার বোনের হাত। দূর থেকে বসে সবটা দেখে ক্রোধের দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল মাশহুদ।প্রিয় বস্তটার আশেপাশে কাউকে সহ্য না করার এক অসহনীয় অনুভূতি হচ্ছে তার। সে কি সত্যি এই মেয়েটার প্রেমে পড়েছে?
চলবে
(এডিট ছাড়া।যারা গল্প পড়েন তাদের রেসপন্স করার অনুরোধ রইল)