কুড়িয়ে পাওয়া ধন পর্ব ৬

0
594

#কুড়িয়ে_পাওয়া_ধন
#পার্ট_৬
জাওয়াদ জামী

” তোমাকে এই প্রথম এবং শেষবারের মত বলে দিচ্ছি, কারও হুকুমে তুমি রান্নাঘরে ঢুকবেনা। যদি নিজের কিছু খেতে ইচ্ছে করে, তবেই রান্নাঘরে যাবে। কারন এ বাড়িতে তোমাকে কেউ কিছু তৈরি করে খাওয়াবেনা। যেটা খেতে ইচ্ছে করবে, আমাকে বলবে সব উপকরণ এনে দিব। মনে রেখ, তুমি এই বাড়ির কাজের মানুষ নও। তুমি আমার বউ। মাথা উঁচু করে এ বাড়িতে চলবে। আর তোমার স্বামী অযোগ্য কেউই নয়, যে তুমি মাথা নিচু করে থাকবে। মনে থাকবে আমার কথাগুলো? ”
আরমানের প্রশ্নের জবাবে কান্তা শুধু মাথা নাড়ায়।

বেশ কিছুক্ষণ পর শ্রীজা আসে, আরমানের রুমে। ওর হাতে একটা ট্রে। ট্রেতে করে কিছু খাবার এনেছে ও।
রুমে ঢুকেই আরমানকে টেনে বিছানায় বসায় শ্রীজা। বারান্দা থেকে নিয়ে আসে টি টেবিল।
ট্রে টি টেবিলে রেখে একে একে প্লেট টেবিলে সাজিয়ে রাখে। এরপর প্লেটে পরোটা তুলে দেয়। কান্তা অবাক হয়ে শ্রীজার কান্ড দেখছে। মেয়েটা বড্ড ভালো।
একসাথে তিনজন মিলে খেয়ে নেয়। যদিও আরমানের খাওয়ার ইচ্ছা ছিলনা, কিন্তু শ্রীজার জেদের কাছে হার মানতে হয় ওকে।
কান্তা মনে মনে ভাবছে, এতদিনে বুঝি ওর একটা বোনের অভাববোধ দূর হল।

সকালে খাওয়ার পর আরমান সেই যে বের হয়েছে, বিকেল হয়েছে তবুও ওর আসার কথা নেই। এ নিয়ে কান্তা একটু চিন্তিত। শ্রীজাকে যে আরমানের কথা জিজ্ঞেস করবে, কিন্তু লজ্জায় বলতে পারছেনা।
সেই সকালের পর থেকে এখন অব্দি ওর শ্বাশুড়ি কিংবা দাদি শ্বাশুড়ি কেউই একটাবারের জন্যও কান্তার খোঁজ করেনি। এটা কান্তাকে বেশ অবাক করে। তবে শ্রীজা সারাক্ষণ কান্তার সাথে ছিল। দুপুরে দুজনের জন্য খাবার রুমে নিয়ে এসেছে। কান্তা খেতে না চাইলেও জোড় করে খাইয়েছে। এই অল্প সময়ের মধ্যে কান্তা শ্রীজাকে ভালোবেসে ফেলেছে। মেয়েটা সত্যিই আন্তরিক।

আরমানের বাসায় ফিরতে রাত হয়ে যায়। সে রুমে এসে দেখল কান্তা সেখানে নেই। কান্তাকে রুমে না দেখে আরমান বেশ অবাক হয়। হঠাৎই ওর নজর যায় বারান্দায়। সেখানে আলো জ্বলছে। আরমান স্মিথ হেসে সেদিকে পা বাড়ায়।

বারান্দায় উঁকি দিতেই আরমানের চোখ যায়, চেয়ারে বসা এক মানবীর দিকে। ফুলের টবের মাঝখানে চেয়ার পেতে বসেছে সেই মানবী। যার দুচোখ, মন, মস্তিষ্ক সবকিছুই বইয়ের মাঝে নিবদ্ধ। আশেপাশে কি ঘটছে সেদিকে তার কোন নজরই নেই। এমনকি চাঁদের আলোও যে তার সাথে আলিঙ্গনে মত্ত সেটিও আমলে নেই তার।
আরমান ভালোভাবে উঁকিঝুঁকি মে’রে দেখল তার রমনীর হাতে ‘ দ্য ভিঞ্চি কোড ‘ বইটি শোভা পাচ্ছে।
মনে মনে বেশ উল্লসিত হয় আরমান। তার একান্ত আপন রমনীটিও তাহলে বই প্রেমী!
বেশ কিছুক্ষণ উঁকিঝুঁকি মে’রে আরমান রুমে যেয়ে ধুপধাপ শব্দ করে কান্তার মনযোগ আকর্ষনের চেষ্টা করছে। কান্তা বারান্দা থেকে শব্দ শুনতে পেয়ে বই চেয়ারে রেখেই রুমে আসে।
আরমান শব্দ করে একবার ফোন রাখছে, তো আরেকবার ড্রেসিংটেবিল থেকে পারফিউম নিয়ে পুনরায় শব্দ করে ড্রেসিংটেবিলেই রাখছে।

” আপনি এসেছেন। এত দেরি করলেন যে? কত রাত হয়েছে দেখেছেন! ” কান্তা উদগ্রীব হয়ে জানতে চায়।

কান্তার প্রশ্ন শুনে আরমান দু কদম সামনে এগিয়ে আসে। কান্তার মুখোমুখি এসে দাঁড়ায়।

” কেন! খুব চিন্তা হচ্ছিল বুঝি! আর এমনিতেও খুব বেশি রাত হয়নি। কিন্তু আমি যদি জানতাম তুমি এতটুকুতেই চিন্তায় অস্থির হয়ে যাবে, তাহলে সারাদিন রুমেই বসে থাকতাম। কিন্তু তুমি এতটুকুন মেয়ে এই বয়সেই এমন স্বামী পাগল হয়েছ! বিষয়টা কিন্তু খুবই লজ্জার, কি বল? ”

আরমানের কথা শুনে কান্তা লজ্জায় মাটিতে মিশে যাচ্ছে। এই ঠোঁ’ট’কা’টা লোক বলে কি!
কান্তা কথা বলার ভাষা হারিয়েছে।
নিজের স্বামীর জন্য চিন্তা করলে যদি, স্বামী পাগল হয় , তবে তাই হোক।

আরমান বুঝতে পারছে কান্তা লজ্জা পেয়েছে। তাই কান্তার লজ্জা দূর করতে নিজ থেকেই কথা বলে।

” এখানে তোমার সব বই, খাতা, নোটস সব আছে । সেই সাথে প্রয়োজনিয় সকল সাজেশন আছে। কাল থেকে পুরোদমে পড়াশোনা শুরু করবে৷ কোন ফাঁ’কি’বা’জি আমি মেনে নিবনা। আর আগামী মাস থেকে তুমি কোচিংএ যেয়ে ক্লাস করবে। আমি সব ঠিক করেছি। ”

বিছানার উপরে থাকা বইগুলো দেখে কান্তার চোখ বেয়ে পানি ঝরতে থাকে। মানুষটা সত্যিই চায় ও লেখাপড়া করুক! একে একে সব বই দেখতে থাকে কান্তা।

” আমার তো সব বই ছিলই। আপনি শুধু শুধু কিনে আনলেন। কতগুলো টাকা নষ্ট হল এতে! আমি গ্রামে গিয়ে সব বই নিয়ে আসতাম। ”

” তোমার গ্রামে যাওয়া চলবেনা। কালকের আগ পর্যন্ত তুমি তোমার ভাইদের দ্বায়িত্ব ছিলে। কিন্তু কাল থেকে তোমার সব দ্বায়িত্ব আমার। তোমার ভালোমন্দ দেখাশোনার দ্বায়িত্ব আমার। সে হিসেবে তুমি তোমার বাবার বাড়িতে যাবে কিনা, কিংবা আমি যেতে দেব কিনা, সেই সিদ্ধান্তও আমিই নিব। আর আমার সিদ্ধান্ত হল, আমি চাইনা তুমি তোমার বাবার বাড়িতে যাও। না, একেবারে যাওয়া বন্ধ করে দেবনা। তুমি বছরে একবার সেখানে যাবে। গ্রামে পৌঁছানোর পর দুই-তিন ঘন্টা থেকে সবার সাথে দেখা করে আবার সেইদিনই ফিরে আসবে। ”

আরমানের কথা শুনে কান্তা হাঁফ ছাড়ে। ওর ও গ্রামে যাওয়ার খুব একটা ইচ্ছা নেই। সেখানে কার কাছে যাবে ও। ভাইদের কাছে অবহেলার পাত্রী, ভাবিদের কাছেও ও উচ্ছিষ্ট হিসেবে পরিগনিত হয়। তাই সেখানে না যাওয়াই ভালো। কিন্তু এ বাড়িতে কি বলবে এ নিয়ে খুব চিন্তায় ছিল কান্তা। কিন্তু আরমান নিজেই এই সমস্যা থেকে ওকে উদ্ধার করল। কি বলে যে মানুষটাকে ধন্যবাদ দিবে তা ভেবে পায়না কান্তা।

” এই যে চিন্তাবতী, কোথায় হারালে? ” আরমানের ডাকে সম্বিৎ ফিরে পায় কান্তা।

” আপনি তো সারাদিন বাইরেই ছিলেন। দুপুরে খেয়েছিলেন কিছু? ” সাহস করে বলে কান্তা৷

আরমান মুচকি হেসে জবাব দেয়,

” প্রশ্নটা করা উচিত ছিল আমার। কিন্তু উল্টো, প্রশ্নটা তুমি করলে! আমার এখনও খাওয়া হয়নি। তুমি কিছু খেয়েছিলে? আমি শ্রীজাকে বলে গিয়েছিলাম তোমাকে খাওয়ানোর কথা। সে কি খাবার নিয়ে এখানে এসেছিল? নাকি তোমাকে নিচে যেতে হয়েছিল? ”

আরমানের খাওয়া হয়নি শুনে কান্তার ভিষণ কান্না পায়। সারাদিন মানুষটা কিছুই খায়নি! কিন্তু ও এখন খাবার কোথায় পাবে? রান্নাঘরে যেয়ে কি নিয়ে আসবে? কিন্তু ইনি তো নিষেধ করেছেন রান্নাঘরে যেতে।

” শ্রীজাপু, এখানে খাবার নিয়ে এসেছিল। আমরা দুজন একসাথে খেয়েছি। রাতের খাবার এখনও খাওয়া হয়নি। শ্রীজাপু আমাকে খাওয়ার কথা বলেছিল, কিন্তু আমার ক্ষুধা না থাকায় খাইনি। আপনি সেই কখন থেকে না খাওয়া। আমি আপনার জন্য কিছু বানিয়ে নিয়ে আসি? ” প্রশ্নটা করেই মাথা নিচু করে কান্তা।

” কি কি রান্না করতে জানো? আমি কি খেতে পছন্দ করি, তা কি তুমি জানো? ” প্রশ্নবোধক চোখে চেয়ে আছে আরমান৷

” চলার মত খাবার রান্না করতে জানি। কিন্তু আপনি কি পছন্দ করেন তা এখনও জানিনা। ”

” সবাই বোধহয় খেয়ে নিয়েছে। আমাদের খাবার জন্য কিছু রাখবেনা এটা ভালো করেই জানি৷ আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি। তুমি আমার সাথে রান্নাঘরে যেয়ে কিছু একটা বানিয়ে নিও। যেটা খেলে রাতে আর ক্ষুধা লাগবেনা। ”

আরমান ওয়াশরুমে গেলে কান্তা বইগুলো নিয়ে বারান্দায় যায়। একে একে সব গুছিয়ে রাখে টেবিলে।

আরমান ওয়াশরুম থেকে বের হলে, দুজন মিলে রান্নাঘরে আসে। আরমান রান্নাঘরেই একটা মোড়ায় বসে ফোন টিপছে। কান্তা বেশ কিছুক্ষণ এদিকওদিক তাকায়। ও সত্যিই দেখল ওদের জন্য একটুও খাবার রাখেনি! একটু পর একটা প্লাস্টিকের জার থেকে ময়দা নিয়ে মাখতে থাকে। এরপর কয়েকটা রুটি বানায়। ফ্রিজ থেকে দুইটা ডিম নিয়ে ভেজে নেয়। এরপর রান্নাঘরের কোনায় থাকা ঝুড়ি থেকে কয়েকটা আলু নিয়ে কুঁচি কুঁচি করে কে’টে, ধুয়ে ভাজি করে। অতি দক্ষতার সাথে কাজগুলো করে আরমানকে ডাইনিং টেবিলে যেতে বলে। আরমান ফোন দেখার পাশাপাশি আড়চোখে কান্তার কাজ করা দেখছিল। রান্না করার সময় মেয়েটাকে পাক্কা গিন্নীরমত লাগছিল।

দু’জন একসাথে বসে খেয়ে নেয়। যদিও কান্তা খেতে চাইছিলনা, কিন্তু আরমানের ধ’ম’ক খেয়ে আর না করার সাহস পায়না। চুপচাপ দুইটা রুটি খেয়ে নেয়।
আরমানও বেশ তৃপ্তির সাথে চারটা রুটি খায়।

” তোমাকে রাত-বিরেতে মাঝেমধ্যেই এমন করে রান্না করতে হবে, বুঝলে। যেদিন আমার আসতে দেরি হবে, আর কোনও খাবার আমার জন্য থাকবেনা, সেদিন তোমাকে আজকের মত রান্না করতে হবে। কাজটা বেশ কঠিন, তাইনা? ”

” কঠিন কিছুই নয়। আমি করে দিতে পারব। কিন্তু আপনার আসতে দেরি হবে কেন? এত রাত পর্যন্ত বাইরে কি করেন আপনি! ”

” বাব্বাহ্, দুইদিনেই বউয়ের ফর্মে চলে এসেছ দেখছি! বিষয়টা খুবই ভালো। মাঝেমধ্যে এরকম খোঁজ খবর রাখবে, বুঝলে? তাছাড়া জামাই হাতছাড়া হবার ভয় আছে। ”

” আমার প্রশ্নের উত্তর এটা! ” আরমানের খাপছাড়া কথা শুনে কান্তার মুখ ফসকে বেরিয়ে যায়।

” ভার্সিটি শেষে কোচিং-এ যেতে হয়। সেখানে রাত আটটা পর্যন্ত ক্লাস নিয়ে তবেই বাসায় আসি। যেদিন কোচিং-এ পরীক্ষা থাকে সেদিন আসতে রাত হয়। ” ক্ষণকাল কান্তার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে জবাব দেয় আরমান।

এরপর দুজনের আর কোন কথা হয়না। চুপচাপ খাওয়া শেষ করে উঠে পরে। আরমান ড্রয়িংরুমে যেয়ে বসে। আর কান্তা এঁটো থালাগুলো ধুয়েমুছে রেখে আসে।
কান্তা রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে আসলে আরমানও উঠে নিজের রুমে যায়।

সারাদিন কান্তার শুয়ে-বসে কেটেছে, তাই ওর চোখে ঘুম আসছেনা। কিছুক্ষণ বিছানায় এপাশ-ওপাশ করে উঠে বারান্দায় যায়। টেবিল থেকে বই নিয়ে পড়তে বসে।
আরমান সারাদিনের পরিশ্রমে ক্লান্ত থাকায় বিছানায় শোয়া মাত্রই ঘুমিয়ে যায়।

রাত একটায় ঘুম ভাঙ্গলে আরমান বিছানা ফাঁকা দেখল। পাশে কান্তাকে না দেখে এক ঝটকায় উঠে বসে। প্রথমেই চোখ যায় ওয়াশরুমের দরজায়। কিন্তু দরজা বাহির থেকে বন্ধ আছে। এরপর তাকায় রুমের দরজার দিকে। এটাও ভেতর থেকে বন্ধ। এবার আরমান বিছানা থেকে নামে। দ্রুত পায়ে বারান্দার দিকে যায়। বারান্দার দরজা বন্ধ আছে। আরমান নব ঘোরাতেই খুলে যায় দরজা। আলোকিত বারান্দার মেঝেতে বসে পড়ছে কান্তা।
দরজা খোলার আওয়াজ পেতেই কান্তা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়।

” অনেক রাত হয়েছে। এখন ঘুমিয়ে পর। কাল থেকে আমি বাসায় আসার পর, আমার কাছে দুইঘন্টা পড়বে। আর দিনে অবসর সময়ে পড়বে। এখন চল। রাত জাগলে সকালে উঠতে দেরি হয়ে যাবে। তখন বয়স্ক ভদ্রমহিলার কথার ঠ্যালায় থাকতে পারবেনা। আমিও বাসায় থাকবনা, আর তোমাকে ইচ্ছেমত কথা শোনাবে। ” আরমান আর দাঁড়ায়না। রুমে এসে শুয়ে পরে।
কান্তাও ওর পিছুপিছু এসে বিছানায় শরীর এলিয়ে দেয়।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here