কানামাছি,পর্ব:৯+১০

0
1958

#কানামাছি
#পার্টঃ৯
#জান্নাতুল কুহু (ছদ্মনাম)
হাত-পা ভর্তি মেহেদী দিয়ে সাঁঝ স্ট্যাচু হয়ে বসে আছে। নড়তে পারছে না। এদিকে মশা এসে মনে হচ্ছে এখনই তুলে নিয়ে যাবে। বিরক্তির চরম সীমাতে পৌঁছে গেছে সাঁঝ। গত দুই ঘন্টা ধরে এক ভাবে বসে আছে। নিজের মনে মনেই বলল, ” কে বলে মানুষকে বিয়ে করতে? কে? বিয়ে করবে তার আবার এতো অনুষ্ঠান কেন? মানুষ বিয়েতে মেহেদী কেন পরে? আজব তোহ! এই মূর্তির মতো বসে থেকে মেহেদী পরার কোন মানে হয়?”

সাঁঝ রাগে গজগজ করতে করতে সামনের দিকে তাকালো। অনুষ্ঠান তাকে ঘিরে কিন্তু তার দিকে কারোর নজরই নেই! সবাই নিজেদের মধ্যে ব্যস্ত। সামনে ইহানকে হেসে কথা বলতে দেখে বলল নিজের মনে বলল, “এই ভাই সাহেব কে দেখুন! এখানে আমি এভাবে মেহেদী লাগিয়ে স্ট্যাচু হয়ে বসে আছি উনি কি সুন্দর আমার বাড়ির লোকের সাথে কুশল বিনিময় করছে!”

সাঁঝ নিজের হাত পায়ের দিকে তাকালো। বাম হাতে মেহেদী পরার পরে নড়ার কারণে মেহেদী নষ্ট হয়ে যায়। সেখানে পরিষ্কার করে আবার মেহেদী দিয়েছে। দুই হাত টানটান করে ধরে আছে। এবার অত্যাচার চলছে দুই পায়ের উপর। একবার ইচ্ছা হলো মেহেদী পরানোর মেয়েটাকে বলবে যে আপনি চলে যান। লামিসা, ইশিতা আর ইহানের চাচাতো ভাই রিফাত হলো এই মেহেদী অনুষ্ঠানের নাটের গুরু। কি উনাদের শখ জাগলো গায়ে হলুদের আগের রাতে মেহেদীর অনুষ্ঠান হবে। আর সাথে সাথে সব ব্যবস্থা হয়েও গেলো! এখন নিজেরা কি হাসি খুশি মাঝখান থেকে সে ফেসে গেলো।

সাঁঝ চোখ বন্ধ করে পিছনের দিকে ঝুকলো। পিঠে ব্যথা হচ্ছে। চোখ বন্ধ করে অনুভব করতে পারলো কিছু একটা আছে হেলান দেয়ার জন্য। কিন্তু পিছনের দেয়াল তো বেশ দূরে। সাঁঝ চোখ খুললো। দেখলো ইহান নিজের একটা বালিশ সাঁঝের পিঠের নিচে দিয়ে বালিশটা ধরে আছে। সে চোখ খুললে বলল,

—” ব্যথা হচ্ছে না পিঠে?”

—” শুধু পিঠে না হাতে, পায়ে, মাথায় সব জায়গায় ব্যথা হচ্ছে”

ইহান একটু অনুতপ্ত হয়ে বলল,

—” আসলে আজকে এখানে এসে কোন অনুষ্ঠান করার প্ল্যান আমাদের ছিলো না। কিন্তু ইশিতা, রিফাত, আর অন্য কাজিনরা এতো করে জেদ ধরলো আর তোমার বাসা থেকে মেনে নিলো তাই”

—” আচ্ছা”

সাঁঝ হেলান দিয়ে সুবিধা করতে না পেরে মনের অজান্তেই আলতোভাবে ইহানের কাঁধে মাথা রেখে দিলো। সাথে সাথে ঘুমে চোখ বুজে আসলো।

আজ দুপুর অব্দি সে জানতো না সন্ধ্যায় এই অনুষ্ঠান আছে। দুপুরে ঘুমিয়েছিলো। মা আর ফুফু কয়েকবার ডেকে গিয়েছিলো কিন্তু কোন গুরুত্ব দেয়নি। পরে অনেকের গলা শুনে উঠে ড্রইংরুমে গিয়ে দেখে ইহান দাঁড়িয়ে আছে। আর বাকিরা বসে। তখন ইহান তাকে দেখে হেসে বলেছিলো,

—” ঘুম ঘুম চোখে তোমাকে একদম বাচ্চাদের মতো লাগছে। ইচ্ছা হচ্ছে গাল গুলো টেনে দিই”

সাঁঝ কিছু না বলে ভিতরে চলে গিয়েছিলো।
তন্দ্রার মধ্যে সাঁঝ একটা মিষ্টি মিষ্টি সুবাস পেলো। সুবাসটা ক্রমেই কড়া হয়ে নাকে লাগতে শুরু হলো। সাঁঝ বিরক্ত হয়ে চোখ খুলে দেখলো সে ইহানের কাঁধে মাথা রেখেছে। ঝট করে সরে গিয়ে সামনে তাকালো কেউ দেখেছে কিনা। কেউ দেখেনি। নিজের মেহেদীর দিকে তাকালো। নষ্ট হয়নি। নাহলে আবার দেয়া লাগতো। ইহান বলল,

—” তোমার ঘুম আসছে? অনেক ধকল যাচ্ছে তো। আগে থেকে বলা উচিত ছিলো আমাদের। আসলে আমার ভাইবোনগুলো এমন জেদ ধরলো যে”

ইহানের কথার মাঝেই সাঁঝ বলল,

—” ব্যাপার না। এসব বাচ্চাদের আমি দেখে নিবো। সব গুলোকে ড্রেনের সামনে এক লাইনে দাঁড় করিয়ে ধাক্কা দিবো। তাহলে এদের শিক্ষা হবে ?”

ইহান কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে হাসা শুরু করলো। সাঁঝের চোখ ইহানের হাতের মেহেদীর দিকে গেলো। ইহানও মেহেদী পরেছে। কিন্তু শুধু বাম হাতে। তার আর ইহানের হাত মিলে একটা পূর্ণ হার্ট শেপ আঁকা হয়েছে। তার ডান হাতের অর্ধেক হার্টের মধ্যে ইহান লেখা। আর ইহানের হাতের অর্ধেকের মধ্যে লেখা সাঁঝ। দুজনের হাত পাশাপাশি আনলে একটা পূর্ণ হার্ট সহ “সাঁঝইহান = সাঁঝিহান” হয়। ইহানের হাতে কেবল এটুকুই আছে। ইহান হাসি থামিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

—” কিছু খাবে? আনবো?”

সাঁঝ একটু ভেবে বলল,

—” কোল্ড ড্রিংকস”

—” আচ্ছা আমি আনছি”

ইহান চলে গেলে সাঁঝ গলা নামিয়ে মেহেদী যে মেয়েটা পরাচ্ছে তাকে জিজ্ঞেস করলো,

—” আপনি কি নাস্তা করেছেন?”

মেয়েটা উত্তর দিলো,

—” হ্যা আপু নাস্তা করেছি”

—” আপনার পেমেন্ট করা হয়েছে?”

—” হ্যা”

—” আচ্ছা বাকি যে দুইজন এসেছিলো মেহেদী দিতে উনাদের তো দেখছি না। উনারা কোথায়?”

—” উনারা তো আমার সাথে আসেননি। আমি স্পেশালি শুধু ব্রাইডাল মেহেদী দিই। উনারা চলে গেছেন”

—” আচ্ছা। এবার আপনিও চলে যান”

মেয়েটা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,

—” মানে? আপনার মেহেদী দেয়া এখনো শেষ হয়নি। এক পায়ে তো পুরোই বাদ আছে”

সাঁঝ হেসে বলল,

—” নাহ আর দরকার নেই। যা দিয়েছেন সেটাই অনেক। আপনার পেমেন্ট হয়ে গেছে। এবার তো আর কোন সমস্যা নেই”

—” কিন্তু আপু….”

—” আর কোন কিন্তু না আপু। আপনি এখান থেকে ওই যে দরজা ওখান দিয়ে চলে যাবেন। খেয়াল রাখবেন কেউ যেন না দেখে”

সাঁঝের জোরাজুরিতে মেয়েটা চলে গেলো। বেশ কিছুক্ষণ পরে ইহান এসে জিজ্ঞেস করলো,

—” মেয়েটা কোথায়? মেহেদী দেয়া শেষ? ”

সাঁঝ বিজয়ীর ভঙ্গিতে হেসে বলল,

—” চলে গেছে। উনার কাজ শেষ”

ইহান নিচু হয়ে সাঁঝের পায়ের দিকে তাকিয়ে হেসে দিলো। হাসতে হাসতে বলল,

—” শেষ না বলো তুমি তাড়িয়ে দিয়েছো। এক পায়ে মেহেদী আছে অন্য পায়ে নেই। Weird!”

ইহান হাসতে থাকলো। সাঁঝ সরু চোখে তাকিয়ে বলল,

—” এক পায়ে পায়েল পরা যদি স্টাইল হয় তাহলে এটা কেন স্টাইল হবে না?”

—” সেটাই। এটা নিউ স্টাইল”

ইহান সাঁঝের সামনে গ্লাস ধরলো। সাঁঝের একটু অস্বস্তি হলো। তারপর একবারে পুরোটুকু খেয়ে নিলো। এরপর ইহান গ্লাস নিয়ে চলে গেলো। আর আসলো না। সাঁঝ সামনের দিকে তাকালো। বেশ মানুষ আছে। তার নিজের অনেক লতানো প্যাচানো ভাইবোন এসেছে যাদের কোনদিন দেখেছে কিনা সন্দেহ। তার এই ভাইবোন আর ইহানের কাজিনরা মিলে একজায়গায় আড্ডা দিচ্ছে। আন্টিরা একজায়গায় বসে গল্প করছে। আর আঙ্কেলরা আরেক জায়গায়। ইহানকে কোথাও দেখতে পেলো না।

সাঁঝ উঠে পড়লো। একা একা বসে থাকার কোন মানে হয়না। সবার সাথে হাই হ্যালো বলে ছাদে হাঁটতে লাগলো। তাদের ছাদটা বেশ বড়। একটু দূরে ফাকা জায়গায় ইহান আর বড় চাচা একজায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। সাঁঝ হাঁটতে হাঁটতে ওদিকে গেলো। পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় শুনলো ইহান বলছে,

—” চাচু তুমি চিন্তা করো না। আমি আছি তো। আমার উপর বিশ্বাস নেই?”

বড় চাচা মিনমিন করে বলল,

—” আমার কি যাওয়া উচিত ছিলো? সব ম্যানেজ করতে পারবে তো ওরা?”

ইহান চাচার কাঁধে হাত দিয়ে বলল,

—” বিশ্বাস রাখো আমার উপর। সব ঠিক হবে। আমি ব্যবস্থা করছি। এখন ওসব চিন্তা বাদ দিয়ে আমার বিয়ে এঞ্জয় করো”

সাঁঝ চলে আসলো। তার মনে প্রশ্ন জাগলো কি হয়েছে? ইহান কিসের কথা বলছে? বড় চাচাই বা এভাবে কি বলছিলো? অন্য সবাইকে তো ঠিকঠাক লাগছে। শুধু বড় চাচাকেই বিষন্ন লাগছে। সাঁঝ আন্টিদের গ্রুপের দিকে গেলো। ওখানে ইহানের মা, চাচী, বাড়ির ভাড়াটিয়া আন্টিসহ অনেকে আছে।
সাঁঝ যেতেই ইহানের মা বলল,

—” দেখি মেহেদী”

সাঁঝ হাত সামনে নিয়ে দেখালো। ইহানের মা বলল,

—” এখনো শুকায়নি তো। তবুও সুন্দর লাগছে”

ইহানের চাচীও তাল মেলালো। বলল,

— ” আসলেই অনেক সুন্দর লাগছে”

সাঁঝ চাচীকে জিজ্ঞেস করলো,

—” চাচী অনিক কোথায়?”

চাচী জিজ্ঞেস করলো,

—” অনিক কে মা?”

সাঁঝ আমতাআমতা করে বলল,

—” ইহানের চাচাতো ভাই মানে.. আপনার ছেলে”

চাচী হেসে বলল,

—” ওর নাম তো অনিক না। ওর নাম রিফাত। ওই যে ওখানে কথা বলছে”

সাঁঝ একটু হেসে বলল,

—” আসলে নাম ভুলে গিয়েছিলাম। আমি খেয়াল করিনি ওখানে আছে”

—” ব্যাপার না মা”

সাঁঝ আবার জিজ্ঞেস করলো,

—” চাচী আপনার আর ছেলে মেয়ে নেই?”

চাচী একটু আফসোস করে বলল,

—” না একটাই ছেলে আমার”

—” ও আচ্ছা”

সাঁঝ চলে আসলো ওখান থেকে। ইহানের বলা কথাগুলো মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। এদিকে মৃদু সুরের একটা গান বাজছে। সাথে মানুষের কথার শব্দ তো আছে। সাঁঝের মাথার ভিতর দপদপ করতে শুরু হলো। তাই হেঁটে হেঁটে ছাদের অন্য পাশে চলে আসলো। এদিকে শব্দ আসছে না। বাতাসও আছে। সাঁঝ ইহানের বলা কথাগুলো মনে মনে আওড়াতে থাকলো। পিছন থেকে কেউ বলল,

—” আরে সাঁঝ যে!”

সাঁঝ পিছন ঘুরে দেখলো নাহিদ দাঁড়িয়ে আছে রাস্তা ব্লক করে। সাঁঝ বলতে গেলে দেয়ালেফ সাথে আটকে আছে। সাঁঝ বলল,

—” আপনার সাহস দেখছি দিন দিন বেড়েই চলেছে।”

—” তোমার সাথে হিসাব ক্লিয়ার না করে তো যেতে দিতে পারিনা”

—” সেদিন রাতে কি বলেছিলাম ভুলে গেছিস? এটা আমার…”

সাঁঝকে কথা শেষ করতে না দিয়েই নাহিদ বলল,

—” জানি জানি এটা তোমার এলাকা। কিন্তু আর কতদিন? দুদিন পরই তো চলে যাবা অন্য বাড়িতে। তখন এতো তেজ থাকবে না তোমার। মাথা নিচু করে চলতে হবে। এখন এমন বাঘের মতো গর্জন করছো তখন ভেজা বিড়াল হয়ে থাকতে হবে”

সাঁঝ কঠিন স্বরে বলল,

—” বাঘিনী যে জঙ্গলেই যাক সে বাঘিনীই থাকে। আর সময় আসলে গর্জনও করে। আর বিড়াল জঙ্গলে গেলেও বাঘ হয় না। বিড়ালই থেকে যায়। অবশ্য ইদুরকে বিড়ালের কথা বলাও ভুল। বুঝবে না”

নাহিদ সাঁঝের দিকে এগিয়ে এসে হেসে বলল,

—” এতো যে কথা বলছো তুমি নিজেই এখন মেহেদী পরে বউ সেজে দাঁড়িয়ে আছো। কি করবে তুমি আমার?”

—” এতো এগিয়ে আসছেন কেন পেছান। আমার রাস্তা ছাড়ুন”

নাহিদ পেছানোর বদলে আরো একপা এগিয়ে আসলো। সাঁঝ দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

—” আমি নিজের মেহেদী নষ্ট করতে চাচ্ছিলাম না। কিন্তু অমানুষদের শিক্ষা দেয়ার জন্য এটা করতেই হবে”

সাঁঝ নাহিদকে মারার জন্য হাত তুললো। লাস্ট মোমেন্টে সাঁঝের হাত ধরে ফেললো। দেখলো ইহান দাঁড়িয়ে আছে। ইহান বলল,

—” ইদুর মেরে নিজের হাতের মেহেদী কেন নষ্ট করবা?”

এরপর ইহান নাহিদের কাঁধে হাত দিয়ে বলল,

—” আপনার নাম তো নাহিদ না? Lets talk man to man”

ইহান নাহিদকে একপ্রকার ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে গেলো। আর সাঁঝ রাগে ফুসতে থাকলো। একটা শিক্ষা নাহিদকে দেয়াই লাগবে।
,
,
,
?
সাঁঝ রাতে ফোন হাতে নিয়ে দেখলো আশিকের ভয়েস মেসেজ এসেছে। সেটা অন করে শুনলো আশিক বলছে,

” সাঁঝ আমি অনিক আর ইহান স্যারের মধ্যে কোন যোগসূত্র খুঁজে পাইনি। দুজনের স্কুল কলেজ আলাদা ছিলো। আর তুই এগুলো নিয়ে ভাবা বন্ধ কর। পরশু তোর বিয়ে সেটাতে মনোযোগ দে”

সাঁঝ এটা শোনার পরে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। এরপর সাকিবকে ফোন দিলো। ওপাশ থেকে ধরে বলল,

—” হ্যা সাঁঝ আপু বলো”

—” ব্যস্ত আছিস?”

—” ব্যস্ত মানে তোমার বিয়ের কাজেই ব্যস্ত”

—” আচ্ছা একটা কাজ করতে হবে”

—” কি কাজ?”

—” ওই নাহিদ আছে না? আমাদের বাসায় থাকে? ওকে শিক্ষা দিতে হবে”

—” নাহিদ মানে রোমেসা আন্টির দেবর তো? কি শিক্ষা?

—” হ্যা ওই নাহিদ। ওর হাত আর পা ভাঙতে হবে। আজ রাতেই। পিছন দিকে যে পুরানা মাঠ আছে ওখানে মারবি।ওকে কিভাবে ওখানে ডাকবি আর কি পরিচয় মানে ডাকাত না ছিনতাইকারী কি সেজে মারবি সেটা তোদের ব্যাপার। আমি জানি তোরা এসব কাজ করিস না কিন্তু এই অমানুষটাকে শিক্ষা দেয়া লাগবে। আর কাজ শেষে আমাকে ফোন দিস”

—” আচ্ছা আপু আমি দেখছি কি করা যায়। এমনিই লোকটার নজর খারাপ। আমি কাজ শেষে ফোন দিবোনে।”

সাঁঝ ফোন রেখে ইহানের কথাগুলো ভাবতে থাকলো। একসময় ঘুমিয়ে পড়লো। ফোনের শব্দে ঘুম ভেঙে দেখে ১ টা বাজে। সাকিব ফোন করেছে। সাঁঝ ফোন তুলে বলল,

—” হ্যা বল কাজ শেষ? ”

—” কাজ শেষ কিন্তু আমরা করিনি।”

—” মানে কে করেছে?”

—”আমি নাহিদকে বললাম যে কাজ আছে আসতে হবে। নাহিদ নিজেই বলল উনি ওই মাঠের দিকে থাকবে। তারপর আমার ছেলেদের নিয়ে গিয়ে দেখলাম তিনজন আগে থেকেই মারছে। আমরা দূর থেকে দেখলাম। তারপর চলে গেলাম। পরে আবার গিয়ে হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে এসেছি। নাহলে আমাদের উপর সন্দেহ করতো। তোমার বাড়িতেও খবর গেছে”

—” আচ্ছা ভালো করেছিস। কিন্তু কারা মেরেছে?”

—” জানিনা আপু। দূর থেকে দেখতে পাইনি। মুখ ঢাকা ছিলো”

—” যেই মারুক ভালো কাজ করেছে। তোরা বিয়ের দিন এসে ভালো করে খাবি কিন্তু”

—” আচ্ছা আপু কবজি ডুবিয়ে খেয়ে আসবো”

সাঁঝ ফোন কেটে দিলো। যেই মারুক নাহিদকে ভালো কাজ করেছে। একটা শান্তির ঘুম দিতে পারবে সে। (চলবে)

#কানামাছি
#পার্টঃ১০
#জান্নাতুল কুহু (ছদ্মনাম)
—” নিজের নোংরা নজর ঠিক কর। মেয়েদের পা থেকে মাথা পর্যন্ত স্ক্যান করার আগে একবার নিজের এই ভাঙা হাতের দিকে তাকাবি। এবারের মতো ছেড়ে দিয়েছি এরপর আর প্রাণে বাঁচবি না। মাটির দিকে তাকিয়ে চলবি। খুব সাহস না তোর? সাঁঝের পিছনে লাগবি? ওর ক্ষতি করবি? এতোদিন তো ও তোকে শিক্ষা দিয়েই এসেছে। এবার থেকে আমিও আছি ওর সাথে। কিছু বলার আগে ভেবে নিবি এর পরের বার কি হবে!”

সাঁঝ ইহানের গলায় কথাগুলো শুনে থমকে দাঁড়ালো। হাসপাতালে দেখতে এসেছে সবাই নাহিদকে। ইহানও এসেছিলো দেখতে। ইহান ভিতরে নাহিদের সাথে কথা বলার নাম করে ঢুকেছিলো। সাঁঝ ইহানের জন্য অপেক্ষা করছিলো। তার মানে গত রাতে ইহান নাহিদকে মেরেছে। সাঁঝের কানে একটা কথা বাজতে লাগলো, “সাঁঝের সাথে আমি আছি।”

কেউ আছে তার সাথে। যে তার সাথে তাল মিলাচ্ছে। হঠাৎই সাঁঝের নিজের মায়ের প্রতি কিছুটা কৃতজ্ঞতা জন্মালো। মা জোর না করলে সে হয়তো ইহানের সাথে বিয়ে করার কথাটা ভাবতে পারতো না। সাঁঝ হাঁটতে হাঁটতে অন্য দিকে চলে আসলো। এদিকে মানুষ কম। হয়তো সিরিয়াস পেশেন্টরা থাকে। অনেক বড় একটা করিডর। করিডরে যত সামনের দিকে যাচ্ছে কোলাহল, মানুষ তত কমে যাচ্ছে। সাঁঝের একসময় মনে হলো একটা ভৌতিক হাসপাতালে চলে এসেছে। করিডরের শেষ প্রান্তে কোন মানুষ নেই। এমনকি ডাক্তার নার্সও নেই। দুইপাশে কিছু রুম আছে। আর সামনে একটা বড়া জানালা আছে। রাস্তার রোডল্যাম্পের আলো আসছে ওখান থেকে। নিজের গায়ে থাকা কাচা ফুলের গন্ধ বারবার নাকে এসে লাগছে। সাঁঝ গয়নাগুলোর কিছু কিছু খুলে পাশের ডাস্টবিনে ফেলে দিলো। গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানের হলুদ শাড়ি এখনো পরনে আছে।

নাহিদের মার খাওয়ার ঘটনা কাল রাতে ঘটলে তাকে আজ সকাল থেকে কেউ কিছুই বলেনি। সবাই তার গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে ব্যস্ত ছিলো। এমনকি ফুফুর মধ্যে কোন হেলদোল দেখতে না পেয়ে সাঁঝ বেশ অবাক হয়েছিলো। তারপর বিকালে সব অনুষ্ঠান শেষে সবাই জানালো নাহিদ হাসপাতালে ভর্তি। ইহানদের বাসাতে বলা হয়েছে নাহিদ এক্সিডেন্ট করেছে। তাই ইহান নাহিদকে দেখতে এসেছিল। কিন্তু ইহানের আসল উদ্দেশ্য তো নাহিদকে ভয় দেখানো ছিলো।
সাঁঝ আনমনে হেসে উঠলো। ইহান তার জন্য ভাবে!

পিছন দিকে তাকিয়ে তার গা ছমছম করে উঠলো। কেউ নেই সে একা একা দাঁড়িয়ে আছে এই রাতের বেলায়। সে পিছন দিকে আসার সময় দুই পাশে থাকা হাতে গোনা কয়েকটা রুমের প্রতি তার তীব্র আকর্ষণ হলো। সাঁঝ সবগুলোতে উঁকি মেরে মেরে দেখতে থাকলো। সবগুলোই ফাকা। শেষের আগেরটাতে একজন শুয়ে আছে। হাতে পায়ে মাথায় নানা ধরনের যন্ত্র লাগানো। সাঁঝ চোখ সরিয়ে নিলো। দ্বিতীয়বার তাকানোর পরে সাঁঝ চমকে উঠলো। অনিক! সাঁঝের আবছা মনে হলো অনিক শুয়ে আছে। মুখ প্রায় দেখতে পাচ্ছেনা। আরো ভালো করে দেখার জন্য রুমটার কাঁচের জানালা ঘষামাজা শুরু করলো। কিন্তু তাও দেখতে পেলো না ঠিক মতো। হঠাৎ বাজখাঁই গলায় শুনতে পেলো,

—” এখানে কি চায়?”

সাঁঝ চমকে উঠলো। একটু স্থির হয়ে পিছনে তাকিয়ে দেখলো একজন নার্স তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সাঁঝ বলল,

—” কিছু না এমনি হাঁটতে হাঁটতে এসেছি”

—” এটা হাসপাতাল। সব জায়গায় এমনি হাঁটা যায় না। আর হাঁটতে আসলে কি উঁকি মারতে হয়?”

—” না আসলে এমনি।”

সাঁঝ একটু চুপ থেকে আবার জিজ্ঞেস করলো,

—” এই তিনটা রুম কিসের জন্য?”

মহিলাটি থমথমে গলায় বলল,

—” এগুলো আইসিইউ”

সাঁঝ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,

—” আইসিইউ তো ওইদিকে আছে। তাহলে এগুলো কি?”

—” এগুলো স্পেশাল।”

—” আইসিইউ আবার স্পেশাল হয়?”

মহিলাটা বিরক্ত হয়ে বলল,

—” আপনি ডাক্তারও না নার্সও না। এতো প্রশ্ন কেন আপনার? আর এখানে যে উকি মারছেন আপনার কাছে পারমিশন আছে?”

—” না”

—” পারমিশন না থাকলে এখানে আসতে পারবেন না। এখন যান”

সাঁঝ আর কিছু বলতে পারলো না। চলে আসলো। সে লোকটাকে ঠিকমতো দেখতে না পেলেও মোটামুটি শিউর ওটা অনিক। অনিক আইসিইউ তে আছে? কিন্তু মনের মধ্যে আবার খচখচ শুরু হলো অনিক তো? কিভাবে জানবে? আশিককে বললে হয়তো বিরক্ত হবে। সে নিজেও তো কিছু করতে পারবে না। সাঁঝের ভিতরে তোলপাড় শুরু হয়ে গেলো। তার কাছে অনিকের ছবি এখনো আছে। আবার জানার ইচ্ছা হচ্ছে অনিকের আসলে কি হয়েছিলো? ও কি ইচ্ছা করে গুলির সামনে দাঁড়িয়েছিলো কিনা জানতে হবে।

আনমনে হাঁটতে হাঁটতে মূল হাসপাতালে এসে গেলো। মা, ফুফু ফুফাকে দেখতে পাচ্ছে। ইহানও আশেপাশে আছে কোথাও। একটু পরে ইহানও কোথা থেকে এসে গেলো। তাকে দেখে বলল,

—” তোমার চোখ মুখ শুকিয়ে গেছে। অনেক ক্লান্ত মনে হয়”

—” হ্যা অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার পরে রেস্ট নেয়ার সময় পাইনি।”

—” এখন চলো। নাহিদের বাসা থেকে লোক আসছে। কাল তো বিয়ে সেজন্য তোমার ফুফা,ফুফু থাকতে পারবে না।”

—” আচ্ছা।”

নাহিদের কথা মনে হতে সাঁঝের মুখে হাসি ফুটে উঠলো। ইহানের দিকে তাকিয়ে হেসে দিলো। ইহান জিজ্ঞেস করলো,

—” কি?”

—” কিছু না। আপনি অনেক ভালো”

ইহান তব্দা মেরে দাঁড়িয়ে থাকলো। সাঁঝ এতো মিষ্টি স্বরে কখনো কথা বলে না। এরপর ইহান নিজের বাসায় আর সাঁঝ নিজের বাসায় চলে আসলো। রাতে ঘুমাতে যাওয়ার সময় সেই মানুষটার কথা মনে হচ্ছিলো যাকে দেখে অনিক মনে হয়েছে। খুব অদ্ভুত লাগছিলো দেখতে। একবার মনে হয়েছে অন্য কেউ। আরেকবার মনে হয়েছে ওটা অনিক। সাঁঝ নিজের মাথা চেপে ধরেছে। এই গোলকধাঁধা থেকে বের হতে পারছে না সে!
,
,
,
?
গোলাপ দিয়ে সাজানো খাটে বসে আছে সাঁঝ। রুমটা বেশ সুন্দর করে ফুল, মোমবাতি দিয়ে সাজানো। কিন্তু সাঁঝের মেজাজ খিটখিটে হয়ে আছে। মনে হচ্ছে পাগল হয়ে যাবে। একে সারাদিনের শারিরীক ধকল তার উপর মানসিক ধকল!
সকাল থেকে শুধু ধকল যাচ্ছে। এখন রাত বারোটা তাও একটু রেস্ট নিতে পারেনি।
সকালে ইহান আর ওর পরিবারের অল্প কয়েকজন কাজী নিয়ে এসে বিয়ে পড়িয়ে গিয়েছে। তারপর বিকাল থেকে রাত পর্যন্ত একটা কমিউনিটি সেন্টারে বিয়ের অনুষ্ঠান হয়েছে। সেখানে ইহান আর তার সব আত্মীয়দের সাথে শুধু কুশল বিনিময় করতে গিয়েই সে হাপিয়ে গেছে। এরপর এই বাসায় চলে আসলো। কিছুক্ষণ সবার সাথে বসে কথা বলে খেয়েদেয়ে এখন বসে আছে ইহানের জন্য।
বিয়ের কবুল বলার মুহুর্তের কথা মনে হতেই সাঁঝ অন্যমনস্ক হয়ে গেলো। তখন মনে হয়েছিলো বাবা আর ভাইয়া থাকলে কত ভালো হতো। একটা শব্দ কবুল তারপর থেকে অন্য একজন মানুষের সাথে জীবনটা একদম জুড়ে যাবে। যদিও ইহানের জন্য কোন অনুভূতি নেই সাঁঝের মনে তাও ইহানের সাথেই সে জুড়ে গিয়েছে।

সাঁঝ রুমটার দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিলো। সবই প্রায় সাদা। ইহানের পছন্দের রঙ সাদা। সাথে বাথরুম আর ট্রান্সপারেন্ট গ্লাস দেয়া বারান্দা আছে। বারান্দার সামনে অবশ্য পর্দা টাঙানো সাদা রঙের। চোখ বুলাতে গিয়ে সাঁঝের চোখ সামনের মিনি সোফাতে গেলো। সেখানে ইহানের বিয়ের শেরওয়ানি আছে। মানে ইহান চেঞ্জ করেছে। সাঁঝ মনে মনে বলল,

—” উনি চেঞ্জ করে ফুরফুরানো মেজাজে ঘুরছেন। আর আমি এতোসব ভারী জামা কাপড় পরে থাকবো? মোটেও না”

সাঁঝ নিজের লাগেজ খুলে কাপড় বের করতে গেলেই ডায়েরিটা চোখে পড়লো। তার কানামাছি ডায়েরি। এটা সাথেই নিয়ে এসেছে। ওখানে রেখে আসার সাহস হয়নি। কারোর সাথে পড়তে দেয়া যাবে না। সাথে দুটো মেমরি কার্ড আর নিজের পুরাতন সিমটাও এনেছে। এগুলো লাগেজের নিচের দিকে রেখে কাপড় নিয়ে বাথরুমে চলে গেলো। ফ্রেশ হয়ে রুমের ভিতরে পায়চারী করতে থাকলো। ইহানের শেরওয়ানীর পকেটে একটা কাগজ দেখতে পেয়ে সেটা বের করে নিলো। পারমিশন ছাড়া খুলে দেখবে কিনা সেটা নিয়ে দ্বিধায় পড়ে গেলো সাঁঝ। আবার মনে হলো ইহানের স্ত্রী সে। দেখতেই পারে। কোন সমস্যা নেই।

কাগজটা খুলে দেখলো হসপিটালের বিল। প্রায় পঞ্চাশ হাজার টাকার কাছাকাছি বিল। টাকার পরিমাণ দেখে সাঁঝের চোখ কপালে উঠে গেলো। রিলিজ করার কোন কথা লেখা নেই। তারমানে রোগী এখনো ভর্তি অথচ এতো বিল! কিন্তু এতোক্ষণ পরে হাসপাতালের নাম দেখে সাঁঝের খটকা লাগলো। নাহিদ যে হাসপাতালে ভর্তি আছে এটা সেই হাসপাতালের বিল। ইহান ওই হাসপাতালে কার বিল দিলো?

সাঁঝ কাগজটা আবার নিজের জায়গায় রেখে একটা সিগারেট বের করে জ্বালিয়ে বারান্দায় চলে গেলো। নিজের ভিতরে আর রাগ, বিরক্তি এসে ভর করছে। আগুন দেখলে শান্তি লাগবে তাই ধরালো। আকাশের দিকে তাকিয়ে সাঁঝের মনে হলো ইহান তার জীবনে এসেছে তাকে পাগল বানিয়ে দেয়ার জন্য!
সিগারেটটা একটু একটু করে পুড়ছে আর সাঁঝ একদৃষ্টিতে দেখছে।
একটু পরে ইহান এসে বলল,

—” কি মিসেস কি চলছে?”

সাঁঝ না ঘুরেই বলল,

—” কিছু না”

ইহান সিগারেট নিজের হাতে তুলে নিয়ে বলল,

—” বাহ এটাও আছে দেখছি”

সাঁঝ এবার পিছনে ঘুরলো। ইহান ফ্রেশ হয়ে চেঞ্জ করে এসেছে। তার মানে অনেকক্ষণ আগে রুমে এসেছে। বারান্দায় থাকার কারণে খেয়াল করেনি। সাঁঝ ইহানের চোখের দিকে তাকালো। খুশির ঝিলিক দেখা যাচ্ছে চোখে।
ইহান জিজ্ঞেস করলো,

—” মন খারাপ নাকি?”

—” না ক্লান্ত লাগছে”

সাঁঝের হাতে হঠাৎ জ্বলতে শুরু করলে সাঁঝ আহ করে নিচে তাকিয়ে দেখলো ইহান তার হাতে সিগারেটটা ধরে আছে। ইহান সাঁঝের দৃষ্টি অনুসরণ করে তাকিয়ে তাড়াতাড়ি হাত সরিয়ে নিয়ে বলল,

—” সরি সরি সরি। আমি আসলে বুঝতে পারিনি। আমি ইচ্ছা করে করিনি। পুড়ে গেছে। ইশ খুব ব্যথা হচ্ছে?”

ইহান সিগারেট ফেলে দিয়ে সাঁঝের হাত নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেলো। কিন্তু ফেলে দেয়ার পরে সেটা সাঁঝের পায়ের উপর পড়লো। পায়ের অনেকখানি পুড়ে গেলো। ইহান নিচু হয়ে বসে সাঁঝের পায়ের উপর থেকে সরিয়ে নিলো।
কেউ তার জন্য এতো ভাবছে এতো ব্যাকুল হচ্ছে দেখে সাঁঝের ভালো লাগলো।
কিন্তু সাঁঝ যদি নিচে তাকিয়ে ইহানকে ভালো ভাবে দেখতো তাহলে ইহানের মুখে একটা হাসির ঝিলিক দেখতে পেতো। (চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here