কানামাছি,পর্ব:৭+৮

0
1531

#কানামাছি
#পার্টঃ৭
#জান্নাতুল কুহু
—”কি অদ্ভুত না?নিজের প্রাক্তন আর ভবিষ্যতে যে আসবে তার দেয়া উপহার একই হাতে পরা! জীবনটা খুব বিচিত্র”

সাঁঝ কথাটা বলে পশ্চিম আকাশে ডুবতে থাকা সূর্যের দিকে তাকালো। আকাশে লাল, গোলাপি আভা ছড়িয়ে আছে। কিছু কিছু মেঘের গায়ে গোলাপি আভা লেগে দেখতে হাওয়াই মিঠাই এর মতো লাগছে। সাঁঝে মনে হলো একটা কাঠি নিয়ে গিয়ে একটু মেঘকে কাঠির মাথায় আটকে দিব্যি হাওয়াই মিঠাই হিসেবে খাওয়া যাবে।

আর ইহান সাঁঝের দিকে তাকিয়ে আছে। হালকা বাতাসে চুল উড়ছে। একটা খয়েরী রঙের শাড়ি পরে আছে। সাঁঝকে কেমন যেন নিজের বউ বউ লাগছে! ইহান জিজ্ঞেস করলো,

—” ভালোবাসতে প্রাক্তনকে?”

—” সে বাসতো”

—” তুমি তো বাসতে না। সেটাই যথেষ্ট”

সাঁঝ একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,

—” আপনার খারাপ লাগছে না? আমি যে প্রাক্তনের কথা বলছি তার দেয়া উপহার হাতে পরে আছি সেটা নিয়ে?”

ইহান ছাদের রেলিঙে উল্টো হয়ে হেলান দিয়ে বুকে হাত গুজে বলল,

—” নাহ খারাপ লাগবে কেন? তোমার ভালোবাসার পুরোটাই তোলা আছে। সেটা হাসিল করে নেয়ার ব্যাপারটা আমার”

—” বাহ এতো confidence?”

—” কেন নয়? তোমার হাতটা দাও তো”

সাঁঝ নিজের হাতটা এগিয়ে দিলো। নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে নিজেই অবাক হয়ে গেলো। একই সাথে অনিকের দেয়া ব্রেসলেট আর আজকে ইহানের মায়ের দেয়া চুড়ি পরে আছে! সে নিজেও জানেনা কি উদ্দেশ্যে অনিকের দেয়া ব্রেসলেটটা পরেছে। যদিও সেই হার্ট শেপটা নেই। সেটা ফেলে দিয়েছে। কিন্তু
তবুও এটা অনিকের দেয়া। হয়ত ইহানকে ভড়কে দেয়ার উদ্দেশ্য এটা পরেছে। মা তাকে ঝামেলা করতে মানা করেছে কিন্তু ইহানকে পরীক্ষা করতে মানা করেনি। বিয়ের আগে বরকে একটু টেস্ট করায় যায়।

ইহান কিছুক্ষণ হাতের দিকে তাকিয়ে থেকে ব্রেসলেটটা খুলতে থাকলো। সাঁঝ কোন প্রতিরোধ করলো না। খোলা হয়ে গেলে বলল,

—” এটা না থাকায় ভালো। অতীতকে অতীতে রেখে সামনের দিকে এগিয়ে যাই?”

—” হুম”

ইহান ব্রেসলেটটা ছুড়ে পাঁচ তালার ছাদ থেকে ফেলে দিলো। সাঁঝ জিজ্ঞেস করলো,

—” ফেলে দিলেন?”

—” হুম ”

—” আমি মজা করছিলাম। ওটা প্রাক্তনের দেয়া ছিলো না। আমার কোন প্রাক্তনই ছিলো না”

—” জানি”

সাঁঝ এতোক্ষণে অবাক হলো। জিজ্ঞেস করলো,

—” কিভাবে জানেন?”

—” প্রাক্তন থাকবে তার দেয়া উপহারও হাতে পরে থাকবে কিন্তু চোখে মুখে কোন ভালোবাসার আভা দেখা যাবে না এটা তো হতে পারে না। যারা ভালোবেসে হারিয়ে ফেলে তাদের চোখে বেদনা স্পষ্ট থাকে। তোমার চোখে নেই সেটা”

—” বাহ আপনি দেখছি mind reading জানেন”

ইহান সাঁঝের চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,

—” হ্যা চোখের দিকে তাকিয়ে পিছনের অনেক কিছুই বলতে পারি আমি”

সাঁঝ চোখ সরিয়ে নিলো। চোখ সরানোর একমূহুর্ত পরে মনে হলো সে কি ভয় পেলো ইহানের কথায়? চোখ দেখে ইহান তার অতীতের অনেক কিছু জেনে যাবে এটার ভয়েই কি চোখ সরিয়ে নিলো? ঠিক করলো আবার তাকাবে। বিয়েটা করছে মায়ের কথায় বাধ্য হয়ে। এই সম্পর্ক নিয়ে খুব বেশি আশা নেই। ইহান সব জেনে যদি ছেড়েও দেয় তাতেও তার তেমন কিছু যাবে আসবে না। ইহানের প্রতি তার মায়া, মমতা,ভালোবাসা কিছুই নেই। তাই ইহানকে ছাড়তে তার কষ্ট হবে না।

সাঁঝ আবার তাকিয়ে দেখলো ইহান তার দিকে এখনো তাকিয়ে আছে। কিন্তু এই দৃষ্টিতে কিছুটা মুগ্ধতা আছে হয়তো। সেজন্য সাঁঝ লজ্জা পেয়ে চোখ সরিয়ে নিলো। নিজেই অবাক হলো সে লজ্জা পাচ্ছে? ভাবা যায়! তারপর আড়চোখে দেখলো ইহান অন্যদিকে তাকিয়েছে। সে ইহানের দিকে তাকিয়ে বলল,

—” চোখের দিকে তাকিয়ে সবাইকে খোলা বই ভাববেন না। যাকে খোলা ভাবছেন হতে পারে সেটা রহস্যে ঘেরা ধাঁধায় পরিপূর্ণ একটা বই!”

—” হুম হতে পারে। কিন্তু সব ধাঁধার সমাধান ঠিকই থাকে।”

ইহানের কথার কোন জবাব না দিয়ে সাঁঝ আকাশের দিকে ইশারা করে বলল,

—” দেখুন ঐ মেঘগুলোকে হাওয়াই-মিঠায়ের মতো লাগছে। ইচ্ছা করছে এনে খেয়ে নিই”

ইহান মেঘের দিকে তাকালো। সাঁঝের কথায় হাসি পেলো কিছুটা। সাঁঝের ভাবনার মধ্যে বাচ্চামী লুকিয়ে আছে অনেকটা। সে বলল,

—” যদি ইচ্ছা হয় তাহলে খেয়ে নেয়া উচিত। ইচ্ছাকে পুষে রাখার কোন মানে হয়না।”

—” কিভাবে?”

—” ওয়েট”

সাঁঝ ইহানের কাজ দেখতে থাকলো। ইহান ছাদে খুঁজে খুঁজে একটা কাঠি বের করলো। তারপর সেটা নিয়ে হাতটা উঁচু করে কাঠিটা ঘুরাতে থাকলো। দূরে থেকে দেখলে মনে হবে মেঘকে কাঠির চারপাশে পেচিয়ে নিচ্ছে। এরপর সাঁঝের সামনে এনে বলল নাও খাও তোমার হাওয়াই মিঠাই। সাঁঝ একটু হেসে সেই অদৃশ্য হাওয়াই মিঠাই খেতে থাকলো।
কারোর কাশির শব্দ শুনে পিছনে তাকিয়ে দেখলো ইশিতা দাঁড়িয়ে আছে। জিজ্ঞেস করলো,

—” আসবো?”

সাঁঝ কিছু বলার আগেই ইহান বললো,

—” এই যে পেত্নীর আগমন হয়েছে। এসে যখন পড়েছেন তখন আসেন”

ইশিতা তাদের কাছে এসে জিজ্ঞেস করলো,

—” খাওয়া দাওয়া হলো?”

সাঁঝ আর ইহান একে অপরের দিকে তাকালো। ইশিতা আবার জিজ্ঞেস করলো,

—” তা কি খেলেন যদি আমাকে একটু বলতেন। আমি আসলে কোন খাবার দেখতে পাচ্ছি না কিন্তু খেতে দেখছি”

ইহান বললো,

—” তোর এতো কিছু দেখতে হবে কেন? খেতে দেয় না বাসায় তোকে?”

ইশিতা একটু রেগে বলল,

—” এই তুই একদম কথা বলবি না। খুব তো আমাকে বিয়ে দিয়ে তাড়াতে চাচ্ছিলি। এখন ভাবী আসছে। দেখি তুই কেমন করে আমাকে তাড়াস। ”

ইহান বাঁকা হেসে বলল,

—” হ্যা তোর ভাবী এসেছে এবার আমরা দুজন মিলে তোর বর খুঁজবো”

ইশিতা এবার মুখ ফোলালো। সাঁঝ সেটা দেখে হেসে বলল,

—” নিচে কি আমাদের ডাকছে?”

—” হ্যা ভাবী এখন ডাকছে”

—” আচ্ছা চলো তাহলে সবাই”

সাঁঝ, ইহান আর ইশিতা সিড়িঘরের কাছে আসার পরে ইহান সাঁঝের দিকে নিজের হাত বাড়িয়ে বলল,

—” শাড়ি পরে নামতে অসুবিধা হবে না তো?”

সাঁঝ কিছুটা অবাক হলো। বাবার পরে এভাবে কতদিন পরে আবার একজন তাকে জিজ্ঞেস করলো। কিন্তু কারোর সাহায্য নেয়ার অভ্যাসটা এখন চলে গেছে। সে বলল,

—” না আমি সামলে নিতে পারবো”

ওরা তিনজন মিলে বাসায় চলে আসলো। ড্রয়িংরুমে অনেক মানুষজন বসে আছে। সাঁঝের মা, তার স্বামী, সাঁঝে সৎ ভাই-বোন, ফুফা-ফুফু, ইহানের পরিবার সবাই আছে। তারা আসতেই ইহানের মা একটা উষ্ণ হাসি দিয়ে সাঁঝের হাত ধরে টেনে একটা সোফায় নিজের পাশে বসিয়ে দিলো। আরেক পাশে ইহান বসলো। ইহানের মা একহাত দিয়ে সাঁঝকে জড়িয়ে ধরে সবার সাথে কথা বলতে থাকলো বিয়ের সব বিষয় নিয়ে।
সাঁঝ উৎসুকভাবে সব দেখছে। বাড়িতে কারোর বিয়ে হলে সবাই কি এতো খুশি হয়? দেখে মনে হচ্ছে সবাই কত খুশি! শুধু তার অনুভূতি শূন্য।
হঠাৎ সাঁঝের মনে হলো বিয়ের কনেদের বিয়ের আলোচনার সময় মাথা নিচু করে বসে লজ্জা পাওয়া উচিত। কিন্তু তার কোন লজ্জাই লাগছে না। বরং সবার কথা আর আয়োজনের ব্যবস্থা শুনে মজা লাগছে। কোন কোন কথার মাঝে বলতে ইচ্ছা হচ্ছে “এটা এভাবে না করে ওভাবে করলে ভালো হবে”। আফসোস হলো যদি ভাইয়া থাকতো তাহলে ভাইয়ার বিয়েতে নিজে সব ব্যবস্থা করতো!

সামনে চোখ যেতেই দেখলো ইশিতা আর তার সৎবোন লামিসা তার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে। সাঁঝ চোখ কুচকে ওদের দিকে তাকালো। হঠাৎ কি মনে করে একবার পাশে ইহানের দিকে তাকালো। দেখলো ইহান তার দিকে একভাবে তাকিয়ে আছে। সাঁঝ আবার লজ্জা পেয়ে চোখ সরিয়ে নিলো। ইহানকে তাকিয়ে থাকতে দেখেই ওরা দুজন হাসছিলো। সাঁঝে তার খুব অস্বস্তি লাগতে শুরু হলো। এরপর একে একে তার মা, ফুফু, ইহানের মা সবাই বিষয়টা খেয়াল করলেও ইহানের কোন হুশ নেই। সাঁঝ কটমট করে তাকালো। চাপা স্বরে জিজ্ঞেস করলো,

—” কি দেখছেন এভাবে?”

—” এই তো একই মানুষের কত রূপ!”

সাঁঝ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,

—” মানে?”

—” তোমাকে একেক সময় একেক রকম লাগে। মনে হয় ভিন্ন ভিন্ন মানুষ। ছাদে এক রকম এখানে আরেকরকম। বোঝার চেষ্টা করছি আর কত রূপ আছে”

সবাই তাদের দিকে তাকালে সাঁঝ আর কোন কিছু বললো না। ঠিক হলো আটদিন পরে বিয়ে। আর বিয়ের আগে পরের সব অনুষ্ঠানই হবে। সামনেই ইহানের কাজের ব্যস্ততা আছে অনেক তাই তাড়াতাড়ি করা হচ্ছে। সবাই যাওয়ার সময় সবার আড়ালে ইহান একটা ছোট বক্স সাঁঝের হাতে দিয়ে দিলো।
,
,
,
?
জানালার ধারে হাতে চায়ের কাপ নিয়ে সাঁঝ বসে আছে। ভেজা চুল পিঠ ছড়িয়ে দেয়া। সন্ধ্যার দিকে ইহানরা যাওয়ার পর থেকে কারেন্ট নেই। গরমে অস্থির হয়ে শাওয়ার নিয়ে এখন জানালার ধারে বসে আছে। আজকাল এই বাসায় তার কদর বেড়েছে। তার ফলস্বরূপ এই চা পেয়েছে রাতের বেলায়। ফুফু বেশ খেয়াল রাখে এখন। সে চলে গেলে তো তাদেরই ভালো। তাই খেয়াল রাখে যাতে কোন ঝামেলা করে না বসে।
অল্প কয়েকদিনের মাঝে জীবনে কত পরিবর্তন হয়ে গেছে। মাত্র আটদিন পরে তার বিয়ে। সে নিজে কখনো বিয়ের কথা ভাবতেই পারেনা কিন্তু কত তাড়াতাড়ি তার জীবনটা অন্য আরেকজনের সাথে আটকে গেলো। প্রথমে ইহান আসলো তার পরের দিনে মায়ের চাপে পড়ে হ্যা বলে দিলো। সবাই ইহানের খোঁজ নিলো ভালো করে তার পাঁচদিন পরে আজ ইহানের বাসা থেকে এসে তাকে দেখে গেছে। সাথে বিয়ের দিনও ঠিক করে গেছে! সব কত দ্রুত হয়ে গেলো। চোখের নিমিষে জীবন পুরো ঘুরে গেলো।

হালকা বাতাস আসছে এটাই যা শান্তি। নাহলে আবার ঘেমে এককার হয়ে যেতো। আকাশে তারা দেখা যাচ্ছে অনেক।।চাঁদও আছে কিন্তু সাঁঝের ঘর থেকে দেখা যাচ্ছে না। ফোনে মেসেজের শব্দ শুনে ফোনটা হাতে নিয়ে দেখলো আশিকের মেসেজ এসেছে।
সাঁঝ,
অনিকের বাবা-মা দেশে নেই। এক সপ্তাহ আগে বাইরে চলে গেছে। আমি আর কিছু জানতে পারিনি।

মেসেজটা পড়ে সাঁঝ দীর্ঘশ্বাস ফেললো। অনিক এখন একটা ধাঁধার মতো হয়ে গেছে তার কাছে। যাকে সমাধানের কোন ক্লু পাচ্ছে না। সাঁঝ ভাবলো আজই কি ছবিগুলো লিক করে দিবে? তারপর মনে হলো না। সময় আসুক তারপর।

এরপর আবার কি মনে করে নিজের ফেক একাউন্টে আবার ঢোকার চেষ্টা করতে থাকলো। সাময়িক সময়ের জন্য বন্ধ করেছিলো এখন আবার ঢুকে দেখার ইচ্ছা হচ্ছে। কিন্তু দুই বার চেষ্টা করেও একসেস করতে পারলো না। অন্ধকারে কাগজে লেখা পাসওয়ার্ড খুঁজে আর ঢুকতে ইচ্ছা হলো না। ফোনটা বিছানায় রেখে হাত সরাতে গেলে একটা কিছুর সাথে হাত লেগে গেলো। জিনিসটা হাতে নিয়ে দেখলো ইহানের দেয়া সেই বক্স। দেখতে বেশ কিউট বক্সটা।

মোবাইলের লাইট জ্বেলে বক্সটা খুললো। ভিতর থেকে একটা চাবির রিং। তার সাথে কিছু একটা ঝুলে আছে। সাঁঝ লাইটটা ভালো করে নিয়ে দেখলো একটা হার্ট শেপের কিছু। দেখার পরে তার বুকের মধ্যে ধ্বক করে উঠলো। অনিকের দেয়া ব্রেসলেটেও এমন হার্ট শেপ ছিলো। যেটা সাঁঝ ভেঙে ফেলেছিলো। একই রকম! সাঁঝ অন্ধকারের মধ্যেই হাতড়ে হাতড়ে অনিকের দেয়া সেই হার্ট শেপটা খুঁজে বের করলো। দুটা পাশাপাশি রাখলো। ভালো করে দেখার পরে বুঝলো ইহানের দেয়া রিংটা একটু বড়। আর ওর ভিতরে S.E লেখা। অনিকেরটাতে S.A লেখা। কিন্তু হঠাৎ করে দেখলে দুটাকে একই বলে ভ্রম হয়।

সাঁঝ বাইরে তাকিয়ে ভাবতে থাকলো গত কয়েকদিনে তার চারপাশের অনেক কিছুই অদ্ভুত লাগছে। এখন প্রশ্ন আসলেই অদ্ভুত না তার কাছে অদ্ভুত লাগছে?
(চলবে)

#কানামাছি
#পার্টঃ৮
#জান্নাতুল কুহু (ছদ্মনাম)
সাঁঝ অনেকক্ষন ধরে চেষ্টা করেও শাড়ির কুঁচিটা ঠিক মতো করতে পারছে না। আজকের শাড়িটা হাত থেকে বারবার পিছলে যাচ্ছে। পাঁচবারের মতো চেষ্টা করে কুঁচি করতে না পেরে শাড়িটা ফেলে দিলো। যেটুকু পরা ছিলো সেটুকু পরে বিছানায় বসে পড়লো।

দরজা খুলে কেউ এসেছে বুঝতে পেরেও পিছনে তাকালো না। নিশ্চয় তার সৎবোন লামিসা এসেছে। তার বিয়ে উপলক্ষে মা আর সৎবোন এই বাড়িতেই আছে। সে মানা করেছিলো কিন্তু মা জোর করে থেকে গেছে। কারণ একসময় এটা তার স্বামীর বাড়ি ছিলো! সাঁঝ অবাক হয় মায়ের স্বামী কেন মানা এই বাড়িতে থাকতে? কেন? তার মা যেমনই হোক এই সৎবোনটা বেশ ভালো। ক্লাস নাইনে পড়ে। তার সাথে ভালো ব্যবহার করছে। সারাদিন লাফালাফি আর বকবক করার এক অশেষ ক্ষমতা নিয়ে জন্মেছে লামিসা। সারাদিন আপু আপু করে মাথা খায়। আপু তোমাকে এভাবে সাজাবো, আপু তোমাকে এটা পরাবো, আপু তুমি এটা খাও তাহলে স্কিন ভালো হবে, আপু এটা মাখো দেখতে ভালো লাগবে, এতো এক্সাইটমেন্ট মনে হয়ে যেন লামিসা নিজেই বিয়ের কনে। ধমক দিলে মন খারাপ করে চলে যায় কিন্তু কিছুক্ষন পরে এসে আবার শুরু হয়ে যায়।
এখন আবার না জানি কি বলতে এসেছে। সাঁঝ বিরক্তি নিয়ে বলল,

—” লামিসা তুমি যদি নতুন কোন রূপচর্চার টিপস নিয়ে এসে থাকো তাহলে চলে যাও। এখন ভালো লাগছে না তোমার বকবক শুনতে।”

সাঁঝ একটু থেমে আবার বলল,

—” একটু পরেই ইহানরা চলে আসবে। আমি শাড়ির কুচি ঠিক করতে পারছি না। তুমি যদি পারো তাহলে এসে আমার কুচি ধরো”

কোন উত্তর না পাওয়ায় সাঁঝ ধমক দিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

—” এটা কি ধরনের বেয়াদবি লামিসা? কথার উত্তর দিচ্ছো না কেন?”

সাঁঝ পিছনে ঘুরে দেখলো লামিসা না নাহিদ এসেছে তার ঘরে! দেয়াল হেলান দিয়ে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সাঁঝ কিছুটা ভয় পেয়ে গেলো। গায়ে আঁচল থাকলেও কোমড়ের কাছে শাড়ি এলোমেলো হয়ে মাটিতে লুটোপুটি খাচ্ছে। সাঁঝ কোনরকমে শাড়িটা গুছিয়ে নিজের হাতে নিয়ে দাঁড়ালো। ঝাঁঝালো কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,

—” এটা কি ধরনের বেয়াদবি? না বলে আপনি আমার ঘরে কেন ঢুকেছেন? আপনার সাহস তো কম না! এতো কিছুর পরেও আবার এসেছেন?”

নাহিদ কিছু না বলে হায় তুললো। কিন্তু যাওয়ার কোন লক্ষন দেখালো না। বরং আরো আয়েশ করে দাঁড়ালো। নাহিদ ইচ্ছা করে এরকম সময়ে এসেছে। সাঁঝ শাড়ি পরে মারামারি করতে পারবে না তার সাথে। এখন নড়তেও পারবে না। সাঁঝ বলল,

—” বের হন আমার ঘর থেকে। নাহলে মেরে পঙ্গু বানিয়ে দিবো”

নাহিদ হায় তুলতে তুলতে বলল,

—” আগে ওখান থেকে হেঁটে আসো তো আমার কাছে! আমি একটু দেখি তোমাকে চোখ ভরে!”

সাঁঝের চোয়াল শক্ত হয়ে গেলো। জোরে চিৎকার দিলো,

—” লামিসা? ফুফু? একটু এখানে আসো তো”

—” আরে এতো জোরে চিল্লাচ্ছো কেন? বিয়ের কনের গলা খারাপ হলে বিষয়টা ভালো হবে না। বাড়ির সবাই ছাদে গেছে। তোমার গায়ের হলুদের অনুষ্ঠান ওখানে হবে কিনা দেখতে। এই দোতালা থেকে চিৎকার দিলে পাঁচ তালার উপরে শুনতে পাবে না”

সাঁঝ বিপাকে পড়লো। না কুচি ঠিক করতে পারছে, না শাড়িটা ছেড়ে দিতে পারছে আর না নাহিদকে গিয়ে মারতে পারছে। ফোনটাও নাহিদের পিছনে টেবিলের উপর রাখা। কিছুটা সময় পার করার জন্য সাঁঝ জিজ্ঞেস করলো,

—” কেন এসেছেন এখন এই ঘরে?”

নাহিদ দুইপা এগিয়ে দেয়ালের সাথে আবার হেলান দিয়ে বলল,

—” আমার নিজের কিছু ইচ্ছা,আকাঙ্খা আছে সেগুলো পূরণ করতে হবে আর তোমার সাথে তো পুরানো হিসাব বাদ আছে। ওগুলো মেলাতে হবে না?”

সাঁঝ বুঝতে পারলো আজ পরিস্থিতি তার প্রতিকূলে। জানালা থেকে একটু দূরেই ছিলো সাঁঝ। একটু এগিয়ে জানালার কাছে গিয়ে দেখলো ইহান নামছে গাড়ি থেকে। একমুহূর্তের জন্য ইহানকে দেখে নিজের ভিতরে একটা প্রশান্তির ঢেউ বয়ে গেলো। মনে হলো ইনাকেই তো দরকার ছিলো। সাঁঝ ডাক দিলো,

—” ইহান”

সাঁঝের রুম রাস্তা থেকে একটু সাইডে হওয়ায় ইহান প্রথমে তাকে খুঁজে না পেলেও এদিক ওদিক তাকানোর পরে জানালার ধারে সাঁঝকে দেখতে পেলো। হাত তুলে বলল,

—” আরে সাঁঝ! আমি ভিতরে আসছি”

ইহানের গলার আওয়াজ নাহিদের কান পর্যন্ত গেলো। নাহিদ কিছুটা ঘাবড়ে গিয়ে কোন কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই চলে গেলো। সাঁঝ তাড়াতাড়ি দরজা বন্ধ করে ফুফুকে ফোন দিয়ে নিচে আসতে বলল। সবাই নিচে নেমে আসলে সাঁঝ লামিসাকে ডেকে শাড়ির কুচি ঠিক করে নিলো। বসার ঘরে সবাই আছে। আজ বিয়ের শপিংয়ে যাবে তাই এতো আয়োজন। সাঁঝে কিছুটা বিরক্ত লেগেছে। এতো কেন করতে হবে? কিন্তু ইহান একমাত্র ছেলে তাই ওর পরিবারের সবার অনেক ইচ্ছা ছেলের বিয়েতে আনন্দ করবে।
আজ ইহানে মা আর বোনের সাথে বড় চাচা-চাচী আর চাচাতো ভাইও এসেছে। ইহানের বড় চাচাকে দেখে সাঁঝের মনে একটু খটকা লাগলো। কেমন যেন চেনা চেনা লাগছে বড় চাচাকে। কিন্তু মনে করতে পারলো না কোথায় দেখেছে। আবার গলা শুনে অপরিচিত গলা মনে হলো। সাঁঝ মনে করার চেষ্টা করলো কোথায় দেখেছে বা কি চেনা চেনা লাগছে।

এরপর সবাই নিচে চলে আসলো। ইহান, সাঁঝ, লামিসা আর ইশিতা একগাড়িতে। আর অন্য গাড়িতে ইহানের মা, বড় চাচা-চাচী আর চাচাতো ভাই। চাচাতো ভাইয়ের নাম রিফাত। ইহানের সাথে খুব ক্লোজ দেখেই বোঝা যায়। সবসময় দুজন ফুসুরফুসুর করতেই থাকে।
গাড়ি চালাতে চালাতে ইহান জিজ্ঞেস করলো,

—” তুমি কি আজ শুধু শপিংয়ে যাওয়ার জন্য শাড়ি পরেছো না অন্য কোন কাজ আছে?”

সাঁঝ ইহানের দিকে ঘুরে বলল,

—” না আজ ভার্সিটিতে আমাদের ডিপার্টমেন্টে একটা ছোট প্রোগ্রাম আছে। সেজন্যও পরেছি”

—” প্রোগ্রাম কখন? আমারও তো ক্লাস আছে। তাহলে শপিং শেষ করে একসাথে যেতে পারবো”

—” প্রোগ্রাম তো বিকালে কিন্তু দুপুরে গিয়ে কাজ করতে হবে”

—” আচ্ছা”

সাঁঝ জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো। একটু পরে ইহান বললো,

—” শাড়ি পরে ভার্সিটিতে যাওয়া ঠিক হবে না”

সাঁঝ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,

—” কেন?”

ইহান সাঁঝের দিকে না তাকিয়ে বলল,

—” তুমি বোধহয় জানো না তোমাকে শাড়ি পরে অনেক সুন্দর লাগে”

হঠাৎ করে সাঁঝ চমকে উঠলো। একটা ভালো লাগার পরশ যেনো তাকে ছুয়ে গেলো। গত কয়েকদিন ধরে খেয়াল করছে মাঝে মাঝে ইহানের দুই একটা কথায় এমন অনুভূতি হচ্ছে। সাঁঝ বুঝতে পারছে এটা ঠিক হচ্ছে না। নিজেই নিজেকে বলল, “সাঁঝ নিজেকে আটকাও। তোমার কিছু কাজ,কিছু উদ্দেশ্য আছে। সেগুলোর থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ কোন কিছু না। অন্য কোন জিনিসে এখন মন দিবে না।”
ইহানের দিকে তাকিয়েই নিজের ভাবনার জগতে ডুবে গিয়েছিলো সাঁঝ। হঠাৎ সামনের আয়নায় তাকিয়ে দেখলো ইশিতা আর লামিসা হাসছে। সাঁঝ খানিকটা লজ্জা পেয়ে চোখ সরিয়ে নিলো।

মার্কেটে গিয়ে সাঁঝ কোন কিছুতে তেমন মন দিতে পারলো না। ঘুরে ফিরে চোখ শুধু ইহানের চাচার উপর গিয়েই পড়ছে। সাঁঝের চিন্তা ভাবনা উনাকে ঘিরেই ঘুরছে। কেমন যেন একটা বিষন্নতা রয়েছে উনার চেহারার মধ্যে। অনেক ঘোরাঘুরি করে কিছু জিনিস কিনে আর কিছু জিনিসের অর্ডার দিয়ে সাঁঝ আর ইহান চলে আসলো। বাকি যা কেনাকাটা তা বাড়ির লোকজন করবে। ওদের দুজনকেই এখন যেতে হবে ভার্সিটিতে। দুজনে একজায়গায় বসে লাঞ্চ করে ভার্সিটিতে চলে গেলো।
,
,
,
?
ভার্সিটিতে নেমে সাঁঝ নিজের মতো ক্লাসের দিকে চললো আর ইহান অফিসরুমে। সাঁঝ ঘড়িতে দেখলো এখনো অনেক সময় আছে প্রোগ্রামের। এতো তাড়াতাড়ি গিয়ে কোন কাজ করা যাবে না। এর মধ্যে নিজের গ্রুপের সাথে আড্ডা দেয়া যাবে। দুপুরবেলা হওয়ায় মাঠে কেউ নেই। সাঁঝ ক্যান্টিনের দিকে চললো। দূর থেকে দেখতে পেলো তার গ্রুপের সবাই বসে আছে। আরো অনেক ছেলেমেয়ে আড্ডা দিচ্ছে।
সাঁঝ ক্যান্টিনের ভেতরে পা রাখতেই তার গ্রুপের সবাই ঘুরে তাকালো। এমনভাবে সবাই তাকাচ্ছে যেন কোন ভূতকে দেখছে। একটু খেয়াল করে দেখলো শুধু তার গ্রুপই না ক্যান্টিনের মোটামুটি সবাই তাকে ঘুরে দেখছে। সে কাছে আসতেই ইরা বলল,

—” সাঁঝ তুই শাড়ি পরেছিস?”

—” হ্যা কেন?”

দীপ বলল,

—”যেই সাঁঝ নবীনবরণের দিনে শাড়ি পরবে না এটা নিয়ে সব সিনিয়রদের সাথে ঝামেলা করেছে সে আজ কোন উপলক্ষ ছাড়া শাড়ি পরে ভার্সিটিতে এসেছে?”

শাওন বললো,

—” কি ব্যাপার বলতো? আজ পর্যন্ত তো তুই কখনো শাড়ি পরিসনি আজ কি মনে করে?”

সাঁঝ বিরক্ত হয়ে বলল,

—” Guys relax! সামান্য একটা শাড়িই। এমন কিছু না। আজ আমার ডিপার্টমেন্টে প্রোগ্রাম আছে তাই পরেছি”

রুনা বলল,

—” মোটেই সামান্য না। তুই এই শাড়ি পরা নিয়ে ভার্সিটিতে কম ঝামেলা করিসনি। ম্যাডামদের পর্যন্ত বলেছিস। তাই আজ অবাক লাগছে”

সাঁঝ বললো,

—” আমি নিজে যা চাই তাই করতে পছন্দ করি। বাধ্যবাধকতা আমার এতো ভালো লাগে না। আর শাড়ি নিয়ে বাধ্যবাধকতা আমার কাছে খুবই হাস্যকর লেগেছিলো। তাই সেই সময়ে বলেছিলাম যত যাই হোক আমি শাড়ি পরবো না। কিন্তু এখন ইচ্ছা হয়েছে তাই পরেছি।”

আর কেউ কিছু বললো না। সাঁঝ নিজের ব্যাগ থেকে ছয়টা কার্ড বের করলো। ওদের সামনে দিয়ে বলল,

—” নে”

সামি জিজ্ঞেস করলো,

—” কিসের কার্ড?”

—” আমার বিয়ের কার্ড।”

সবাই আবার হা করে তাকালো তার দিকে।।ইরা কোনমতে বলল,

—” সাঁঝ তুই বিয়ে করছিস? কবে?”

সাঁঝ হায় তুলয়ে তুলতে বলল,

—” সামনের শুক্রবার। ছয়দিন পরে। বর হলো তোদের ইহান স্যার। এবার তোরা স্বাভাবিক হয়ে যা। নাহলে আমি উঠে যাবো।”

ওরা কার্ডটা পড়া শুরু করলো। আর কিছুক্ষণ পরে নিজেদের প্ল্যানিংও শুরু হয়ে গেলো কে কি করবে। আর সাঁঝ শুধু বসে ওদের এই কান্ড দেখতে থাকলো। সাঁঝের চোখ হঠাৎ ইহানের উপর পড়লো। দূর থেকে দেখতে পেলো ইহান ফোনে কথা বলছে। সাঁঝ চাপাস্বরে আশিককে ডাকলো। সবাই নিজেদের মধ্যে ব্যস্ত তাই তাদের কথা কেউ শুনছে না। সাঁঝ বলল,

—” একটা কাজ করে দিতে পারবি?”

—” হুম বল”

—” ইহান সম্পর্কে খোঁজ নিতে হবে। অনিকের সাথে ইহানের কোন সম্পর্ক আছে কিনা খোঁজ নিবি তো। মানে ক্লাসমেট, বন্ধু বা দুজনের মধ্যে কোন সংযোগ আছে কিনা একটু খোঁজ নিস”

আশিক ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেস করলো,

—” ইহান স্যারের সাথে তোর বিয়ে আর তুই উনাকে সন্দেহ করছিস?”

—” আরে না না ইহান অনেক ভালো মানুষ। কিন্তু আমি জানতে চাচ্ছি ওই অমানুষটার সাথে ইনার কোন যোগাযোগ আছে কিনা? আমি চাইনা অনিকের কোন ছায়া আমাদের জীবনে পড়ুক”

—” আচ্ছা আমি চেষ্টা করবো”

—” হুম”

সাঁঝ মুখে অনিকের ছায়া না পড়ুক বললেও অনিকের ছায়া পড়লেও তার কিছু যায় আসে না। অনিক আর ইহানের কোন সম্পর্ক আছে কিনা এটা জানা দরকার। যদিও অনিকে চরিত্রের সাথে মিল আছে এমন কিছু দেখেনি ইহানের মধ্যে তাও কেন যেন এটা মনে হচ্ছে। (চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here